উদ্ভট ঊটের সওয়ারী

দেশের দুর্গতিতে প্রবাসী-প্রাণ কাঁদে, ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার করেই কাঁদে। ফেলে আসেনি, সঙ্গে করে প্রাণভোমরার মতন বয়ে এনেছে জেনেও কাঁদে। ঝড়-বন্যা-ক্ষরা-দুর্ভিক্ষ-ভোট-ভোটদুর্নীতি সব খবরেই বিচলিত হয়। মাঝে মাঝে যখন পার্কের বিজনে সাইপ্রাসের ডালপালায় বাতাসের ঝরঝর-থরথর-কাঁপে পাতাপত্তর শুনতে পাই, আমার মনে পড়ে আমাদের বাড়ির নিমগাছে সকালের বাতাসের কথা। [...]

সত্তুরের দশকে অনেক উঠতিযুবক আর পড়তিযুবকের কাফেলার সাথে আমাদের মামা-চাচারাও পাড়ি দিয়েছিলেন বিদেশে, জীবনবদলের হাতছানি/নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে। আশির দশকের মাঝামাঝি যখন তাঁরা ছুটিতে বাড়ি ফিরতে লাগলেন, আমরা স্কুলফেরতা এসে তাঁদের আশ্চর্য সাবান আর ট্যাল্কগন্ধী লাগেজের ডালা খোলা দেখতে লাগলাম, তখন থেকে আমরা/আমি একটি অদ্ভূত বিষয়ের সাথে পরিচিত। সেটা হচ্ছে, এইসব আর কোনোদিন দেশে ফিরতে না চাওয়া কৃতসংকল্প মানুষের বিরাগ, দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি। আমরা তখন স্কুলে পড়ি, আমাদের তখন প্রতি বিকেলেই বিটিভির সঙ্গে সঙ্গে ‘দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন’, শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া সত্যি আর কিছু প্রয়োজন নেই। আমরা তখন দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আমরা হাতে খেতে বড় ডরাই/আমরা স্ত্রীকে ছুরিকাঁটা ধরাই/আমরা মেয়েদের জুতোমোজা আর দিদিমাকে জ্যাকেট-কামিজ পরাই’ ইত্যাদি বলে বলে ‘বিপদেতে দেই বাঙালিরই মতো চম্পট পরিপাটি’তে এসে পাঁই-পাঁই দৌড় লাগাই। ‘নিবেদন’ নামের একটি অনুষ্ঠান হয় ছুটির দিনে দুপুরবেলা, তাতে দীনবন্ধু মিত্রের নাটক দেখে আমাদের নাতিশীতোষ্ণ রক্ত উষ্ণ হয়ে ওঠে। দেশের বিপক্ষে, দেশের মানুষের বিপক্ষে আমরা তখন কিছুমাত্র শুনবার জন্যে রাজি নই। অতএব এইসব মানুষের আহাজারি শুনে আমরা বাঁকা হাসতাম, সোশ্যাল সিকিউরিটি সে আবার কি? সেটা তো আম্মা, বাসায় ফিরে আম্মা আর আম্মার হাতের রান্না ভরা খাবার টেবিল দেখতে পাওয়া। মনে মনে আমরা ভেবে ফেলেছিলাম, এইরকম করে কখনও দেশকে দুষবো না।

বলার অপেক্ষা রাখে না, স্কুলের গন্ডী ছাড়াবার আগেই দেশের প্রতি আমার এই একগামিতার অবসান ঘটে, আমি বিপন্ন বিস্ময়ে আবিষ্কার করি, ব্যক্তির বিকাশ-প্রয়াস এবং সিদ্ধিসাধনের পথে সর্বোচ্চ বিরোধিতা করে আমারই রাষ্ট্র। আমরা পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়েই যন্ত্রণা দিতে, নিতে এবং বজায় রাখতে ভালবাসি, যন্ত্রণাই আমাদের মোক্ষ, আনন্দ আমরা নিতেই পারি না, শারীরিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মানসিক যেকোনো আনন্দ, আমাদের আনন্দের চরম প্রকাশ অন্যের গায়ে রঙ ছুঁড়ে দেয়া।‘আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে’, আশ্চর্য, আমার রঙ আলাদা হলেও তাই করতে হবে? ব্যক্তির বিকাশের পুর্বশর্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা, তার রূপের সাথে আমরা পরিচিত নই। আমরা যেকোনো স্থানে খ্যাক-থু করে থুথু ফেলতে পারি, শারীরিক পয়োনিষ্কাশনার্থে বসে পড়তে পারি যেকোনো নালায়, কিন্তু আমরা সীমানা বুঝিনা, অন্যের সম্পত্তিকে শত্রুসম্পত্তি বানিয়ে গ্রাস করি, রাষ্ট্রের যেকোনো ভূখন্ড আমার খাসজমি, রাষ্ট্রের নাগরিকের ব্যক্তিগত সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার বলবার আছে, শোনাবারও আছে, শিল্পীর শিল্প নিয়ে বলবার ক্ষ্যামতা না থাকলে কি হয় শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন এবং তার স্খলন-পতন-ত্রুটি নিয়ে বলবার মুরোদ ষোল আনা আছে। (‘হোসেন মিয়া’কে হোসেন মিয়া, ‘কুবের মাঝি’কে কুবের মাঝি বলেই মনে হয়, কিন্তু ‘মিসির আলি’কে হূমায়ুন আহমেদ মনে হয়, ‘হিমু’কে তো বটেই, ‘মতিনউদ্দিন সাহেব’কেও তাই মনে হয় কেন, এইসব নিয়ে আলাপ নাই, আলাপ আছে হূমায়ুন আহমেদ মেয়ের বন্ধুকে কেমন করে বিয়ে করলেন? যদিও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, মেয়ের বন্ধু কি মেয়ে? স্ত্রীর বন্ধু কি স্ত্রী?)

দেশ ছাড়বার পর মনে হলো- ‘আমাদের পতাকার রঙের জন্যে এই প্রুশিয়ান গ্রীন এর মতন একটা অসহ্য বাজে রঙ বেছে নেয়ার কোনো মানে ছিল না’ এইরকম বাক্য আমি ভাবতে পারি, আগেও পারতাম, এখন লিখতেও পারি। কারণ এই বাক্য সত্য। অন্যলোকে বলবে- আমি দেশত্যাগী (প্রবাসের আরেক অর্থ কি না ট্রিজন), তাই এখন আমার পতাকার রঙও রোচে না…এই ভয়কে কাঁচকলা দেখিয়েই আমি লিখতে পারি প্রুশিয়ান গ্রীন একটি অত্যন্ত বাজে রঙ, বাজে কারণ এর চেয়ে অনেক সুন্দর সবুজ আমার দেশের ভূপ্রকৃতিতে আছে। মোটের ওপর যা কিছু আমার হাতে ধরে দেয়া হয়েছে, দেশের নামে, রাষ্ট্রের নামে, দেশপ্রেমের নামে, তার অপেরণকে ডিঙিয়ে আমি আমার মনোভাব প্রকাশ করতে পারছি। তার একটা বিশাল কারণ আমার ঘাড়ে-পিঠে-আমার চিন্তায় মাছির পুঞ্জাক্ষি নিয়ে সমাজ বসে নেই, তার আরো কাজ আছে। জনকল্যাণমূলক জনগুরুত্বপূর্ন কাজ। ব্যক্তির বিকাশের একটি শর্ত ভাবপ্রকাশ, ভাবনার প্রকাশ, সেটা ভাবমূর্তির চেয়ে জরুরি।

দেশের দুর্গতিতে প্রবাসী-প্রাণ কাঁদে, ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার করেই কাঁদে। ফেলে আসেনি, সঙ্গে করে প্রাণভোমরার মতন বয়ে এনেছে জেনেও কাঁদে। ঝড়-বন্যা-ক্ষরা-দুর্ভিক্ষ-ভোট-ভোটদুর্নীতি সব খবরেই বিচলিত হয়। মাঝে মাঝে যখন পার্কের বিজনে সাইপ্রাসের ডালপালায় বাতাসের ঝরঝর-থরথর-কাঁপে পাতাপত্তর শুনতে পাই, আমার মনে পড়ে আমাদের বাড়ির নিমগাছে সকালের বাতাসের কথা। বুয়ার সাথে আম্মার চিৎকার-কাকের কাকা-ঝনঝন করে পড়ে যাওয়া বাসন-ফেরিওয়ালার ডাক-রিকশার বেল মিলে ভরপুর হয়ে থাকা একটা অ্যাটমসফিয়ারের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বাসে-ট্রেনে অচেনা মানুষের সহানুভূতিমাখা আদরের স্মৃতি (হাঁটিকুমড়ুলের সেই মেয়েটা, বাস থামলে দুঃসাধ্য অপব্যয় করে আপেল কিনে এনেছিল যে- ভাগ করে খাবে বলে), তখন ভিতরে যা আন্দোলিত হয়, তার একমাত্র তুলনা অনাগত সন্তানের নড়াচড়া। মনে হয়- আহারে আমার দেশ। সুজলা সুফলা দেশ না, সোনার দেশ না, শুধু মনে হয় আমার দেশ। ব্যাজস্তূতিহীন।
জন্মান্ধ একরকম তাড়নায় টিকেট কিনে বসি। উড়োজাহাজের গুমোট গন্ধ সইতে পারি না জেনেও চড়ে বসি। অর্থকষ্টে পড়বো জেনেও পাড়ি জমাই।

এবং ‘কিসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল যেই/ দেখি কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই…’

নাহ, আমার শহর আর আমার নেই। তার পথঘাট, তার পায়ে চলবার ওভারব্রীজ, তার প্লাজা নামধারী বিপনীবিতান, তার পোস্টারে আচ্ছন্ন দেয়াল (৩০০ রকম হাতের লেখা শিখানো জারীফ স্যার) আর সড়কবিভাজিকা (এমনকি খুনিদের পোস্টারে লেখা- ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’, কি আশ্চর্য, জানলাম এ তোমার আমার পাপ!), তার বুজিয়ে ফেলা সবক’টি জলাভূমি, তার ফ্লাই ওভার (চলিয়াছে চলার খেয়ালে…), তার শ্যামলিমাহীন নগরায়ন এর কিছুই আর আমার বলে মনে হয় না। আন্তনগর মহাসড়কে কিছুদূর পরপর অমুক মাদ্রাসা তমুক মাদ্রাসা আছে, প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে চা-খানার পাশে নিরন্তর খামিপেষণরত মানুষের হাতে তৈয়ার সিঙ্গারা-পুরি-খোলাজালি-মালপোভোগ, দোকানগুলিতে ঝুলছে শুধু প্যাকেট করা রিং চিপস আর কালচে কলা (আমার কষ্ট লাগে, স্ট্রিটফুডের জয়জয়কারের কালে এসে আমাদের স্ট্রিটফুড হারিয়ে গেল!)। কি অসম্ভব অসঙ্গতি দ্রব্যমূল্যের সাথে বেতনের, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলে কোনোকিছু মধ্যবিত্ত নারীপুরুষের জন্যে অবশিষ্ট নেই, চলমান মানুষকে প্রকৃতি বেদম বেগে ডাকলেও ডাক উপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, নিজের বাড়ি-নিমগাছ-সামনে ঢেঁড়স আর গোলাপফুল একসাথে-সিঁড়িবারান্দায় খালার বিয়ের পুরাতন আলপনা এইরকম কিছু আর নেই, সব বাড়ি ডেভলপারের বাগদত্ত অথবা রক্ষিত, আপনমনা দেয়াল নয়, কয়েদখানার মতন প্রাচীর-প্রাচীররক্ষক, দেয়াল আর বাড়ির মাঝখানের জায়গাটুকুও লোহার জালে ঢাকা।

একসময় এই শহরের কোনো কোনো রাস্তায় রিকশায় চড়লে মনে হতো এই যাত্রার নামই ভাটিয়ালি, সে রাস্তা নাই, সেই রিকশাও নাই। পশ্চিমাদের চেয়েও উর্ধ্বশ্বাসে চলেছে আমার দেশের মানুষ, আমার শহরের ছেলেমেয়েরা, ভয়ের কথা মোক্ষ কেবলি অর্থ। এই শহর যেমন করে জেনেছে সব জিনিসের দ্রব্যমূল্য আর যেমন করে ভুলেছে সব জিনিসের তূল্যমূল্য আর মান, তেমনটি দেখলে অস্কার ওয়াইল্ড অবাক হতেন। তাঁর চোখের সামনে সব নাইটিঙ্গেল নীরক্ত হয়ে মরে থাকতো, তাঁর সব রক্তগোলাপ থেঁতলে যেত, তাঁর সবক’টি গোলাপের বদলে চুনির হার দেয়া প্রেমিক জয়ী হতো। এই শহরে ছেলেমেয়েরা প্রেম করে কোথায়? প্রান্তর কই? নির্জনতা কই? জলাভূমি আর শরবন কই? পাখির স্বগতোক্তি কই? এই শহরে মানুষ প্রিয়জনকে স্পর্শ করে না? কোথায়? হয় কোনো জায়গায় খেতে যায় নয় রাত জেগে ফোনালাপ করে নয় লিটনের ফ্ল্যাটে যায়? মানুষ মানুষকে ভালবাসবে, ভরসা দিতে হাত ধরবে, খুশিতে জড়িয়ে ধরবে, রেগে অস্থির হবে, কথা কাটাকাটি করবে, স্বস্তির হাত রাখবে পিঠে, পাশাপাশি বসে স্মৃতিচারণ করবে-অভিমান করবে- অভিমান ভাঙবে-খুনসুঁটি করবে, সেইসবক’টি মুদ্রার জন্যে আমরা কেবলি চারদেয়াল বরাদ্দ রেখেছি? জেলখানার মতনই আমাদেরও মাথাপিছু তিনটি দেয়াল একটি দরজা? (খেমটা নাচ আমাদের আপামর জনতার প্রিয়, কিন্তু সেজন্যে পামরের অব্দি একটি করে ঘোমটা চাই।)

আমরা ভাবতে ভালবাসি আমরা পশ্চিমাদের চেয়ে অনুভূতিপ্রবণ, আমরা চিন্তায় পশ্চাৎপদ হলেও চেতনায় অগ্রসর, আমরা মানুষের সূক্ষ্ণ অনুভবগুলির মূল্য দেই বেশি। একেবারে ভুল কথা। আমাদের বিয়ে-আকিকা-জন্মদিন-কুলখানি ইত্যাদি সামাজিক সম্মেলনগুলিকে বিচার করলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমরা সেই সম্মেলনগুলিকে কেন্দ্র করে আমাদের কদর্যতাকে উন্মুক্ত করি, কারণ আমরা জানি সামাজিক সম্পর্কের খাতিরে এই কদর্যতা আমারই প্রিয়জনের ভুক্তিবিশেষ হবে। প্রাণের টানে প্রিয়জনের শুভমুহূর্তকে সবিশেষ করবার কোনো মহতী উদ্দেশ্য পাঠ্য-আকারে ছাড়া আমি কোত্থাও দেখিনি, সেই ছোট্টবেলা থেকে। আমরা মানুষের বিচার করি অর্থমূল্যে, কে কাকে কত দিল, কিভাবে দিল, কবে দিল। আমরা প্রয়াস এবং আন্তরিকতার বিচার করি অধুনা বিস্মৃত চলিত-নিয়মে, ইমেইলে দাওয়াত না, পদব্রজে এসে দাওয়াত দিতে হবে, এসে দাওয়াত দিলে কোন কোন নিমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়েছে সেটা বিবেচ্য, দাওয়াত দেয়ার পরে ফোন করে পুনরায় সম্মতি আদায় করতে হবে, সম্মত মানুষগুলিও যেকোনো সময় যেকোনো ওজরে গরহাজির হবে (এই ওজরগুলি আসতে থাকবে ঠিক অনুষ্ঠানের আগের রাতে), তার কারণ হবে নিম্নোল্লিখিত-
১. শরীর খারাপ, মাথাব্যথা, জ্বর
২. বেশিক্ষণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্থানে থাকার উপসর্গ- শরীর খারাপ, মাথাব্যথা, জ্বর, গলাব্যথা
৩. কাজের লোক দেশে গেছে, পালিয়ে গেছে, চলে গেছে, নাই, কাজের লোকের মা আজ টাকা নিতে আসবে
৪. অন্য কাজ আছে
৫. আনন্দানুষ্ঠানে আমার মতন বেমানান মানুষ কেন
৬. উনি আসলে আমি আসবো না
৭. ড্রাইভার নাই
৮. এত দূরের পাল্লা, সি-এন-জি যেতে চায় না, রাতে ফিরবার গাড়ি পাব না
৯. আমার শরীর (হঠাৎ শুকিয়ে গেছি/হঠাৎ মোটা হয়ে গেছি, তাই সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে লজ্জা পাই)
১০. কোনো কারণ নাই/ বলবো না/ আমাকে বলতে বাধ্য কোর না
আর আপনি যদি হতভাগ্য হন, আপনাকে কোনো ওজরই দেয়া হবে না, শুধুই অনুপস্থিত থাকা হবে। (আমি এই তালিকা তৈরি করেছি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, আমি দেশে ফিরেছি, বহুবছর বাদে, ফিরে গেলে আবার বহুবছর বাদে আসব, একটি আনন্দানুষ্ঠানকে উপলক্ষ্য করে আমি আমার প্রিয়জনদের মুখ দেখতে চাই এইসব ফালতু সেন্টিমেন্টের জন্যে কারো সময় নেই, আমার ছাড়া।)

আরেকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নজির দিই। জাতীয় জাদুঘরে গিয়েছিলাম, ‘শতকিয়া’ লিখবার জন্যে কিছু পড়াশোনা করবো বলে আর পূবদিকের অসহ্য প্রাণশক্তিতে কাঁপা অশত্থগাছ (বুদ্ধদেব বসু) দেখব বলে। ইনফর্মেশন ডেস্কের বোরকা পরা মহিলা আঙুল উঁচিয়ে আরেকদিকে দেখিয়ে দিলেন, আরেকজন ইনফর্মেশন জানে বলে। সেখানে যাই। সেখানেও ‘ইনফর্মেশন’ লাঞ্চে আছেন। আমাকে নিরুপায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন সদয় হন, তিনি নিয়ে যান ভিতরে, ভিতরে সরকারি অফিস চলছে, সেই একই ঘষা কাঁচের গেলাস, অসময়ের একদল অতিথি, অতিথির সময়ানূগ আপ্যায়ণ- চা-কলা-রুটি-.বিস্কুট-আমলকি-ঝাললবণ ইত্যাদি, মাথার উপর ঘটঘটিয়ে চলছে বৈদ্যুতিক পাখা, ভুক্তাবশেষ ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে জানালা দিয়ে। দরখাস্ত ছাড়া আজও কিছু হতে পারে না, মৌখিক বলে রাষ্ট্রের কিছু নাই, মহাপরিচালক সমীপে দরখাস্ত করলাম, কে কাকে ডিঙিয়ে ফাইল দিয়ে এসেছে সেই তর্ক চলছে তাই কান ভরে শুনলাম, নীরু আপার সৌজন্যে আমলকি আর চা খেলাম। সন্তর্পণে দেখলাম দাপ্তরিক কাজের সকল মহিলার পরনে বোরকা, বোরকার আড়ালে শালওয়ার-কামিজ। সামনে ঈদের ছুটি, তাই কবে দরখাস্ত মঞ্জুর হবে তা বলা গেল না। বের হয়ে আবার ‘ইনফর্মেশন’কে দেখলাম বিপুল বেগে কিসব লিখে চলেছেন নীলকাগজের খাতায়। আমি ক্যাটালগ এবং কিছু বই কিনবার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম, তিনি অপ্রস্তুত হেসে বললেন- তাঁর এখন বিক্রিবাটা করবার সময় নেই, অনেকগুলি কাগজে সই করাবার জন্যে তাঁকে দৌড়াতে হচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে যাই, আমার মনে পড়ে বিলেতের ছোটখাটো মিউজিয়াম বা ন্যাশনাল ট্রাস্টের বাগানবাড়িগুলিতেও এইরকম শপগুলিতে অভ্যাগতদের কিছু কেনানোর জন্যে কর্মচারীদের বেদম প্রচেষ্টার কথা, সানুনয় অনুরোধ-উপরোধের কথা, আর আমি এসেছি আমাদের জাতীয় জাদুঘরে। কোন দুর্মুখ বলে- আমাদের একমাত্র মোক্ষ অর্থ? রাষ্ট্রের পকেটে পয়সা পুরবার সময় আমাদের নিরাসক্তি দেখলে ঋষিরাও লজ্জা পেতেন।

অবশেষে জেনেছি, আমাদের সামাজিক বন্ধন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় আনুগত্য পর্যন্ত সবই আধাখেঁচড়া। আমরা ভাবতে ভালবাসি আমরা নীতিবান, কিন্তু নীতিহীনতার সুযোগ নিতে চাই, শিক্ষাবোর্ড থেকে মন্ত্রীপাড়া সর্বত্র ধর্না দেবার সময় আমরা ভুলে যেতে ভালবাসি আমরা নীতিহীনতার চর্চ্চার অংশ হচ্ছি। আমরা ভাবতে ভালবাসি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমাদের শ্রদ্ধার নমুনা হচ্ছে আমাদের কপটাচরণ, বাপের সামনে সিগারেট না খাওয়া/ দাঁত মেজে নয় পেয়ারাপাতা চিবিয়ে বাড়ি ফেরা (এদিকে বাপও জানে, ছেলেও জানে যে ছেলে সিগারেট খায়, মা প্রতিদিন খাটের তলা থেকে অ্যাশট্রে সাফ করে।), পরিবারের সামনে প্রেম না করা (ঠারেঠোরে প্রতিবেশী জানাবে তোমার ছেলে প্রেম করে, কিন্তু মাতাপিতার তা অস্বীকার করবার সকল সুযোগ বর্তমান থাকতে হবে।), দুঃসহ ঠেকলেও পরিবারে বৃদ্ধদের পালন-পোষণ (সমাদরে নয়, পাড়া-প্রতিবেশীর ভয়ে।)। আমরা ভাবতে ভালবাসি আমরা মানুষকে ভালবাসি, আমরা আসলে মানুষকে ভালবাসি এই আইডিয়াটাকে ভালবাসি, ভালবাসার মুদ্রাবলী গর্হিত, ভালবাসার জন্যে ত্যাগস্বীকার হেরে যাওয়ার আরেক নাম, ভালবাসার পরাজয়ে(!) আমাদের চেয়ে চরিতার্থ-প্রতিহিংসা আর কেউ বোধ করে কি না আমি জানি না।

প্রথমবার যখন দেশ ছাড়ি, সেটা ছিল বৃষ্টির রাত। প্লেন টেক অফ করবার সময় আমার মনোভাব ছিল একেবারে রবিঠাকুরের হেমশশীর মতন, “ওগো পায়ে পড়ি, আমাকে আমার বাড়ি রেখে এসো… এখনো রাত আছে, আমার মা, আমার দুটি ভাই, এখনো জাগে নাই, এখনো আমাকে ফিরাইয়া রাখিয়া আইস”, আমার মশারির চালে ঘুমানো বিড়াল ‘পিংপং’, আমার মায়ের বর্ষার দিনে ঘর আন্ধার করে শুকাতে দেয়া শাড়ি, আমার বাপের প্রথম শীতের ফুলকপি কিনবার পরিতোষ, এইসব আমার হাত টেনে ধরেছিল, একেবারে জলমগ্ন মানুষের মতন টানে। এবার দেশ ছাড়তে গিয়ে প্লেন টেক-অফের সময় আমার ভিতর একটা অসম্ভব হাহাকার তৈরি হয়, রানওয়েতে ব্রাত্য রাইসুর চেনানো বিনয় মজুমদারের কচুবনান্তের জন্যে, আকাশে উঠবামাত্র প্লেনের কাঁচের জানালায় ক্রম-অপসৃয়মান জলের রেখার জন্যে, (আমার হঠাৎ করেই এক পাকিস্তানি একনায়কের কথা মনে হয়, যে মর্কট দেশের মানুষ না হলেও চলবে-দেশটুকু থাকলেই হবে এইরকম মনোভাব প্রকাশ করে ফেলেছিল), হাহাকারে শব্দ বসাতে পারলে হতো- আহা আমার বাংলাদেশ!’ কিন্তু এই মুহূর্তে আমি সশব্দ হতে চাই না, ‘রেখো মা দাসেরে মনে…’ করতে চাই না, হাহাকার করতে চাই। লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায়- মনে না রাখলেও এই দাসত্ব ঘুচবে না।

৩১ অক্টোবর, ২০১২
লন্ডন ইস্ট, প্লাস্টো

সাগুফতা শারমীন তানিয়া

বিপন্ন বিস্ময়ের অন্তর্গত খেলায় ক্লান্ত।

১ comment

  1. অভিযাত্রিক - ৫ নভেম্বর ২০১২ (১২:২১ পূর্বাহ্ণ)

    “আমরা ভাবতে ভালবাসি আমরা শ্রদ্ধাশীল।
    আমাদের শ্রদ্ধার নমুনা হচ্ছে আমাদের
    কপটাচরণ, বাপের সামনে সিগারেট
    না খাওয়া/ দাঁত মেজে নয়
    পেয়ারাপাতা চিবিয়ে বাড়ি ফেরা (এদিকে
    বাপও জানে, ছেলেও
    জানে যে ছেলে সিগারেট খায়, মা প্রতিদিন
    খাটের তলা থেকে অ্যাশট্রে সাফ করে।)”

    অসাধারণ বলেছেন।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.