এস.এস.সি.তে আমাদের ভূগোল বইটা আমার খুব প্রিয় ছিল। কী সব নাম —
সাতপুরা পাহাড়। আরাবল্লী পর্বতমালা।
প্রেইরি। সাভানাহ্ তৃণভূমি। স্তেপ্স্। তৈগা বনভূমি।
অয়নবায়ু আর প্রত্যয়ন বায়ু। গর্জনশীল চল্লিশা।
ওব-ইনিসি-লেনা-আমুর। দজলা-ফোরাত। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস। শিরদরিয়া-আমুদরিয়া। বিপাশা-বিতস্তা-ইরাবতী-শতদ্রু-চন্দ্রভাগা। আহা!
ইংল্যান্ডের খনি এলাকার নাম। উত্তর আমেরিকার খনিজদের নাম। মাদাগাস্কারের পশুদের নাম। এখন যখন ফিরে দেখি, মনে হয় কী চমৎকার পাঠ্যবই, আর কী প্রাণ ঢেলেই না সেই বই পড়াতেন মিসেস রোকেয়া (হলিক্রস স্কুল, দশম শ্রেণী, ১৯৯২)। যারা স্কুলজীবনে কখনো বিদেশে যায়নি, যারা কোমরে ভাঁজ করে রুমাল গুঁজে রাখা শিখেছিল পরিচ্ছন্নতার জন্যে আর যারা পানির বোতল দেবার সময় আলতো করে বলতো — ‘মুখ না লাগিয়ে খাও’, সেইসব মেয়েদের রোমান্টিক জগতে একটা নিঃশব্দ বিপ্লব এনে দিয়েছিল সেই ভূগোলবইটা। যেন আস্তে করে বলেছিল — ‘এখানেই সবকিছু শেষ নয়। আরো কত আছে!’
এর আগে যে-পাঠ্যবইটি আমার মন জয় করেছিল সেটি সমাজবিজ্ঞান বই, ক্লাস ফাইভের (১৯৮৭), রাজা বিম্বিসারের (নাকি বিন্দুসার) নাম শোনামাত্র আমার কেন ভাল লেগেছিল মনে নেই। চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক হওয়া, বখতিয়ার খলজির হাতে গোনা কয়টি ঘোড়সওয়ার নিয়ে বঙ্গবিজয় আর সেসময় লক্ষ্মণ সেন নাকি দুপুরের ভাত খাচ্ছিলেন (আচ্ছা, লক্ষণ সেন ভাতের পাতে আর কী কী খেতেন?), বারভুঁইয়ার গল্প, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুরো ইতিহাস, ভাইসরয়দের পরম্পরা এইসব মিসেস চন্দ্রাবতী ঘোষ খুব যত্ন করে পড়াতেন। আর তার সম্পূরক খাদ্য হিসেবে মিসেস রোজ ডায়াস পড়ে শোনাতেন একটা বই আলো দিয়ে গেল যারা। পুরুরাজের সাহস, বৃক্ষপ্রিয় বাবর, জ্ঞানান্বেষী হুমায়ুন, কোহ-ঈ-নুর দরিয়া-ঈ-নুর দুই রত্ন।
আর একটা পাঠ্যবইয়ের উল্লেখ না করলেই নয়, সেটা কলেজে থাকতে হাতে পেয়েছিলাম, আমাদের ইংরেজি বই (এইচ.এস.সি.তে পঠিতব্য বই, ১৯৯৪-৯৫), আমরা তো নেহাত বাংলামিডিয়ামের ছাত্রী, বিয়েট্রিক্স পটারের জেমাইমা পাডল ডাককে চিনি না, পি জি উডহাউজ পড়িনি, কেউ কেউ চার্লস ডিকেন্সের দ্য ওল্ড কিউরিওসিটি শপ সিনেমাটা দেখেছি, হেমিংওয়েকে চিনি কেবল মুভি অভ দ্য উইকের একনিষ্ঠ দর্শক ছিলাম বলে। আমাদের পাতে এসে পড়লো সমারসেট মম, ও হেনরী, রবার্ট ফ্রস্ট। আর আমাদের ইংরেজি শিক্ষিকা মিসেস সেলিনা শেখালেন নতুন শব্দ — অ্যাজাইল/নিম্বল। ক্রাইটেরিয়ন। নাইভ। আর আমরা (অ্যাজাইল এবং নাইভ) মেয়েরা আমাদের পুরনো লাইব্রেরিতে (অসাধারণ লাইব্রেরি ছিল হলিক্রস কলেজে, কেউ যেত না সচরাচর, যে যেত, তার গোত্রান্তর ঘটে যেত) খুঁজে পেলাম প্যালগ্রেভস গোল্ডেন ট্রেজারি। আহা, সে যে সত্যিই কাঞ্চন-সিন্দুক। ভিতরে মোহর আর মোহর। যেন জগৎসংসারের একটি গুপ্তধনের রন্ধ্রপথ খুলে গেল অকাতরে।
পাঠ্যবইয়ের বাকি ইতিহাস বড় করুণ। ছোটবেলায় রেডিয়েন্ট ওয়ে, ব্রাইটার গ্রামার বা ফান্ডামেন্টাল ইংলিশ (পাণ্ডুর মলাটের ছোট্ট বইটা) এইসব পড়া হয়েছে শিক্ষকদের শুভবুদ্ধিতে। ইংরেজি বইয়ের অবস্থা ছিল ভয়াবহ, ‘সামিরা ইজ মেকিং পিথা অন আ চুলা’ টাইপ ইংরেজি দেখে হাসবো না কাঁদবো বুঝে পেতাম না, তারেক নামের একটা ছেলের পেনফ্রেন্ডশিপ আর গ্রীক দোলমা খাওয়ার অসহ্য গল্প দিয়ে ভরা ছিল আমাদের ইংরেজি বই। সাহিত্য না পড়লে ভাষা আপন হয় না। সাহিত্যের নামগন্ধ ছিল না ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে। রেপিড রিডিং-এর জন্যে শুধু — দ্য কোরাল আইল্যান্ড বা ট্রেজার আইল্যান্ড পড়া হয়েছিল। বাংলা পাঠ্যবইয়ে ফি বছর পড়তে হতো — ম্লান জুলমতে ঘুরে ফেরা তাজীতে চড়া ফররুখ আহমেদ। আনন্দ পেয়েছিলাম দশম শ্রেণীতে পাঠ্য মুনীর চৌধুরী আর মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ব্যাকরণবইটা পড়ে। আমাদের পাঠ্যবইয়ে জীবনানন্দ কেন যেন নিষিদ্ধ, অনেক সময় বইয়ে থাকতেন কিন্তু সিলেবাসে থাকতেন না। বুদ্ধদেব বসুর ‘পুরানা পল্টন’ ছাড়া বারো বছরের পাঠ্যপুস্তকে তাঁর আর দেখা মেলেনি — সেটিও সিলেবাসে ছিল না, অথচ কী অপূর্ব মেদুর সেই স্মৃতিচারণ, ‘নরম নীল মেঘের স্তর’ শুনলেই তো মনে হয় শ্রাবণমাসের আধাশহর সেই পুরানা পল্টন যেন দেখতে পাচ্ছি। ‘বুটিদার জরিপাড় শ্যামশাড়ি অঙ্গে/ এলোকেশে এলো হেসে শরৎ এ বঙ্গে’ কিংবা ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/ আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা’ কিংবা ‘কদম কেশরে ছেয়েছে আজ বনপথের ধুলি/ মৌমাছিরা কেয়া বনের পথ গিয়েছে ভুলি’ এইসব যতদূর মনে পড়ে রচনাবইয়ের কৃপায় শেখা, প্রণমহি হরলাল রায়। তারাশঙ্কর কিংবা মানিক (পদ্মানদীর মাঝি খণ্ডাকারে ছিল শুধু) বড় অবহেলিত, অবনীন্দ্রনাথ (চয়নিকায় একঝলক পড়েছিলাম শুধু, একটা শব্দ শিখেছিলাম, ‘বিদ্যুল্লতা’!) ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং তদীয় পুত্র অনুপস্থিত। অন্নদাশঙ্করের ‘পারী’ নামক ভ্রমণকাহিনী পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছিল, কিন্তু সিলেবাসে স্থান পায়নি। ‘অন্ধ-বধূ’র মতন মর্মস্পর্শী কবিতা আমাদের বইয়ে ছিল, ‘পায়ের তলায় নরম ঠেকলো কী/ আস্তে একটু চল্ না ঠাকুরঝি’, অথচ পাঠ্য ছিল না। জসীমউদ্দীনের ‘আসমানি’ (সঙ্গে হাশেম খানের অসহনীয় একঘেয়ে ইলাস্ট্রেশন) ছাড়া আমরা কিছু খুঁজে পেলাম না, আশ্চর্য। (অবশ্য ‘রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও’ ছিল, ছিল ‘সর্ষেবালা নুইয়ে গলা হলদে হাওয়ার সুখে/ মটরবোনের ঘোমটা খুলে চুম দিয়ে যায় মুখে’ আর ছিল ‘এই গাঁয়ের এক কালো ছেলে লম্বা মাথার চুল’ রুপাইয়ের বর্ণনা, সেটার মেটাফরগুলি শিক্ষকরা বোঝাতে পারতেন না।) সিলেবাস ইসমাইল হোসেন সিরাজী, বেনজীর আহমেদ, ফররুখ আহমেদ, লুৎফর রহমান এবং নজরুলের স্নেহধন্যা মুসলিম কন্যাদের অপ্রতিভ লেখায় ঠাসা। আলবুর্জের চূড়ার নীচে বা আল হামরার প্রাসাদগুলিতে আমাদের জন্যে কী আছে যা বছরের পর বছর আমরা বাধ্যতামূলক ভাবে খুঁজেছি? রেপিড রিডিং হিসেবে ‘জোহরা’/ আনোয়ারা ইত্যাদি বাঙালি মুসলিমের সন্ধ্যাভাষার সাহিত্য। হয়তো পাঠ্যবইয়ের সূচিপত্র থেকেই আমাদের বাঙালি মুসলমান বানাবার চেষ্টার শুরু। হয়তো জাত হিসেবে আমাদের স্বপ্ন দেখবার, কল্পনা করবার, বড় কিছু ভাববার, অন্যকিছু বলবার, ননসেন্সের মজা খুঁজবার সকল সম্ভাবনার সমাধিসৌধ রচনার এই থেকে শুরু, এইসব পাঠ্যপুস্তিকা থেকে। যে জাত তার রত্নাবলীর ইতিহাস জানে না, রসাস্বাদন দূরে থাক, নামে মাত্র চেনে না, সে জাত কেন অন্যজাতের পতাকা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে নাচানাচি করবে না?
এইবার আসি বাংলা মিডিয়ামের শিক্ষকশিক্ষিকা প্রসঙ্গে। আমার আব্বা বলতেন — ‘অন্ধকার পাড়াগাঁয়ে টিমটিম করে আলো জ্বলে কোনো কোনো বাড়িতে, বুঝবা ঐখানে ছাত্র পড়তাছে। ভুতুম পাখি ডাকে পাখনা নাইড়া, আর কেউ জাইগা নাই, বুঝবা নির্ভুল গণিত শিখতেছে ছাত্ররা — ইংরেজি প্রিপোজিশান মুখস্ত করতাছে। গ্রামের স্কুলের সেইসব কী শিক্ষক, আর কী ছাত্র’… এখানে আগে নান্দীপাঠ হিসেবে আমাদের অসামান্য স্বপ্নচাষী শিক্ষকদের দূরে রাখি। যাঁরা সকল প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে বীজতলায় প্রতিদিন যেতেন, চারাগাছ পরিচর্যা করতেন, স্নেহ আর শাসন যাঁদের ছিল প্রশ্নাতীত। আর যাঁরা প্রশ্ন করলে ডাস্টার ছুঁড়ে মারতেন, যাঁরা ভুল ধরিয়ে দিলে বেয়াদব হিসেবে একঘণ্টা ইট হাতে দাঁড় করিয়ে রাখতেন বা মুরগী বানিয়ে রাখতেন (হাঁটুর তলা দিয়ে হাত নিয়ে পা মুড়ে বসে কান ধরার পদ্ধতি), যাঁরা পিটি ক্লাসে অমনোযোগীদের কাকের বাসাভর্তি বকুলগাছতলায় দাঁড় করিয়ে দিতেন যাতে ঝপাঝপ পাখির মলে চুনকাম হয়ে যায় ছাত্রছাত্রীরা, যাঁরা গৃহপালিত ছাত্রছাত্রীদের খাতায় বেশি নম্বর দিতে দ্বিধা করতেন না, সেইসব পরম প্রতাপশালী নাদির শাহ্দের প্রসঙ্গে আসি। একরকমের কার্যকারণহীন ভয়ে যাঁদের অভিভাবকসুলভ পদাধিকারকে মেনে কিছু বলতে পারিনি, তাঁদের কথা বলি। আজ এতকাল পরে।
একসময় এঁদের মাথায় রেখে লিখেছিলাম —
ছেলেমেয়েরা তার ক্লাসে হাসতো না, ঠিকঠাক মতো বই আনতো, পড়া করে আসতো। সে মারতো না কাউকে। তার অস্ত্র ছিল কনকনে চাউনি আর বিষম উদাসীনতা। বই না আনলে বলতো — ‘দাঁড়িয়ে থাকো।’ পড়া না পারলে বলতো — ‘বেরিয়ে যাও’… সেই জের সারা ক্লাস চলতো, ফিরেও তাকাতো না সে। বাচ্চাগুলি কষ্ট পেতো। বাড়ি ফিরে খারাপ লাগতো তারও। কিন্তু ক্লাসে খুব আত্মপ্রসাদ বোধ করতো সে। মনে হতো এ জীবনে যা সে হতে চেয়েছে, অবলীলাক্রমে নিষ্ঠুর আর কঠিন ক্ষমতাবান, তাই হয়েছে। অন্ততঃ একটি জায়গায় এসে। বাড়িতে সে ছিল ভিজে ন্যাতার মতো গুরুত্বহীন।
আর লিখেছিলাম —
ক্লাস ধরবার জন্যে শাড়ি পরতো সে। বৃষ্টিবাদল হলে কালো ডোরার উপর লাল-নীল নিঁখুত বড় বড় গোলাপ বা নাশপাতি আঁকা রুচিহীন নাইলন বা জর্জেট।
তারপর ক্লাসে এসে একটা না একটাকে শাস্তি দিতই।
আচ্ছা, সে চলে যাবার সময় তার ছাত্রছাত্রীরা কার পিঠ দ্যাখে? দুঃসহ মেজাজ-রগভাসা হাত-বিবর্ণ নাকফুল আর চিটচিটে চুল যারা ক্ষিপ্র পায়ে বেরিয়ে যেত স্কুলছুটির সময়, ডিগডিগে বিনুনি পিঠে গেরো দিয়ে ফেলে অবিরাম ধোঁয়ায় কাশতে কাশতে রাতের খাবার রাঁধতো — ঝর্নাকলমের সুলেখা-কালি অবিরাম চুলে মুছতে মুছতে যারা পরীক্ষার খাতা দেখতো — যাদের মত চিমসে-স্তনী আর খটখটে শরীর দেখলেই পাত্রপক্ষ জোকার দিয়ে উঠতো — ‘এহ্ মাস্টারনীর মতো!’
তার শৈশবে এরা ছিল, এইসব ভুল সরল-অঙ্করা। তার সহকর্মীদের মধ্যে তারা আছে। কী আশ্চর্য, তার পাশে তাহলে বসে আছে ভুল সরলাঙ্ক। তার সুমুখ দিয়ে হেঁটে গিয়ে উবু হয়ে বাসস্টপে চিনিচাঁপা কলা কিনছে ভুল সরলাঙ্ক। যোগেশবাবু এমনটি দেখতে পেলে কী করতেন?
আমাদের স্কুলশিক্ষকরা তো আমাদের থেকে আলাদা নন, দেশব্যাপী সাধারণমানুষের যা আক্ষেপ, যা হতাশা, যা নিত্য অভিযোগ সেসবে ভাসমান ছিলেন তাঁরাও। স্কুলে পড়াতেন আসতেন কারা, এটা একটা বড় প্রশ্ন। সচ্ছল মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা আসতেন, যাঁরা অর্থ-উপার্জন না করলেও ঠিক চলে যাবে তাঁদের। আর বাকিরা যাঁরা আসতেন তাঁরা হতাশ মানুষ, তাঁদের ছায়া সবসময় এলানো, সব দিক থেকে প্রতিফলিত হয়ে তাড়িত হয়ে তাঁরা ফিরে গেছেন একটিমাত্র পেশার কাছে, তাঁদের হতাশা-ক্ষোভ-জীবনযন্ত্রণা একটি পথ ধরেই মুক্তি পেত, ছাত্রদের প্রতি ক্রোধ। স্কুলশিক্ষকদের ভিতরে আপনি সবগুলি লক্ষণ পাবেন, ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য, আর আরেকটু নিরিখ করে দেখলে হয়তো প্রথমটিও। কাম কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের একচ্ছত্র অধিকার তো নয়।
ভাল ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে পড়াতে আসতেন না। তাঁদের গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোজা চলে যেত যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে যাঁরা জ্ঞানী-যাঁরা গুণী-যাঁরা রাজা তাঁরা তাঁদেরকে ‘হীরেবসানো সোনার ফুল’ হিসেবে আবিষ্কার করবেন, রবীন্দ্রনাথ সে-আশ্বাস দিয়ে গেছেন না!
একসময় এলো, জ্ঞানী-গুণী-রাজারা আর এইসব হীরেবসানো ফুল তেমন করে চাইলেন না, তাঁরা এখন ঘর হতে শুধু দুইপা ফেলিয়া ঘাসফুল পেতে চান, নিজভূমের, চেনাজাতের। হীরের ফুলরা নিজেদের ঘাসফুল বানাতে চেষ্টা করতে লাগলেন, বিদেশের মাটিতে। সময় লাগবে, কিন্তু সাধন হবে। এই সময়টুকু আর অনেককিছুর মতনই ঢোকা যায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। কিছু টাকা আসবে তো!
অতএব, বাংলামিডিয়ামের কথা কেউ আর মনে রাখে না। বাংলামিডিয়াম স্কুলগুলি মায়ের শাড়ি কেটে মিডি-ড্রেস বানাবার মতন করে ইংলিশ মিডিয়াম ডে-শিফট খুলতে থাকে। যেন ভাষা বা ভাষ্যি বদলালেই সব বদলে যাবে। এখন বাংলামিডিয়ামের পাঠ্য কী? এখন কারা সেই পাঠ্য পড়ায়? কাদের পড়ায়? তারা আর কী পড়ে? কিছু কি পড়ে? তাহলে রাজা বিম্বিসারের-যতীন্দ্রমোহন বাগচীর-বন্দে আলী মিয়ার গ্রামের আর কে রইলো আপন?
আমরা দুই ভাইবোন অত্যন্ত আনন্দ নিয়ে সাহিত্যপাঠ করতাম, আমাদের কার্নিশে একটা অলস দার্শনিক বিড়াল ঘুমাতো, আমরা তার নাম দিয়েছিলাম ‘কনফুসিয়াস’, আমার ভাই আমাকে ডাকতো ‘চিল্লানোসোরাস’ কিংবা ‘বাবা-ইয়াগা’, আমি ওকে ডাকতাম ‘ভুষুন্ডির মাঠের কাঁড়িয়া পীরেত’, আমরা যেসময় যে-গল্প পড়তাম সে-গল্পকারের ধরণে কথা বলতাম — মানিক পড়লে মানিক, হুমায়ূন আহমেদ পড়লে হুমায়ূন আহমেদ, আশাপূর্ণা দেবী/ লীলা মজুমদার/ গজেন্দ্র মিত্র পড়লে আশাপূর্ণা/ লীলা/ গজেন্দ্র (বারবিকিউ সস কিনে এনে শখের মুরগী রেঁধেছি একদিন, আমার ভাই বলল — ‘তামাকু দিয়া রামপাখি রান্ধিয়াছিস রে দুর্মতি!’ আমি ওকে ‘ভাতারখাকি’ গালি দিয়ে আম্মার চড় খেয়েছি দিব্যি — বুঝেছি ভাতার ওর খাদ্য নয়।)। গালিনা দেমিকিনার বনের গান আর রুশদেশের উপকথা-র ‘হলদে বাজ ফিনিস্ত’ আর মালাকাইটের ঝাঁপি-র স্তেপান আর বেলিয়ায়েভের হাঙরের ফুসফুস লাগানো উভচর মানুষ। স্কুল থেকে ফিরে বাসি খাদিমের জুতোমোজা ছেড়ে, দুপুরের ভাত খেতে গিয়ে শেষপাতের ডাল নিয়ে বসে আমাদের এইসব হাবিজাবি ফুরাতে চাইতো না। আমরা সত্যবদ্ধ ছিলাম যে, ছেলেমেয়েকে ইংলিশ স্কুলে দেব না। কক্ষনো না। তারা আমাদের মতন (যৎসামান্য হলেও) বাংলার মজা নেবে। স্বপ্ন এবং স্মৃতি মাতৃভাষায় রচিত হয় — এই নিয়ে কত তর্কই না করেছি। গতকাল আমি জেনেছি আমার তুলতুলে ভাইপো স্কলাস্টিকায় যাবে, নয় আগাখানে যাবে, নয় সানবীমস-এ যাবে (সেই থেকে আমার যা হয়েছে, তার নাম শয্যাকণ্টকী), তার সূর্যের আলোকরশ্মি সানবীমস হবে, সে হয়তো জানবেই না — ‘রশ্মি’ বলে একটা অদ্ভুত শব্দ আছে। জানবে না তার বাবার নাম আসলে ‘মামদোভূত’ বা ‘ব্রহ্মদত্যি’। হ্যাঁ, তাকে কোনো শিক্ষিকা পাখির মলে চুনকাম হবার জন্যে বকুলতলায় দাঁড় করিয়ে রাখবার সাহস করবে না, শুনতে পাই অনেক ইংলিশমিডিয়াম স্কুলে প্রিন্সিপাল বরং শিক্ষকশিক্ষিকাকে চপেটাঘাত করেন, ছাত্রছাত্রীদের নয় (প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শোনা, যাঁদের স্কুলটির নাম জানবার ইচ্ছা, অন্যকোথাও জানাবো)। পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনের দোষে কি শিক্ষকের দোষে কি ইংলিশ শুনলে আমাদের স্বয়ংক্রিয় শ্রদ্ধাবোধ উপচানোর দোষে এভাবে বাংলামিডিয়াম স্কুলগুলির দীপ নিভে যাচ্ছে, তা বিতর্কের বিষয় হলে খুশি হবো। জানবো কেউ তো এই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। কেউ তো অন্ততঃ জানে, প্রথমে ভাষা যায়, তারপর সব যায়। দেউলিয়াপনার শুরু ভাষা যে-পথ দিয়ে গেছে সেই পথে।
৩১ মার্চ ২০১১
লন্ডন ইস্ট, ইউ কে
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৭ comments
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১ এপ্রিল ২০১১ (৯:২২ পূর্বাহ্ণ)
ভালো লাগল স্মৃতিকথন!
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ১ এপ্রিল ২০১১ (৭:৫২ অপরাহ্ণ)
জাহাঙ্গীরভাই, আপনি আমার প্রতিটা লেখা পড়েছেন এবং কমেন্ট করেছেন, এই ধৈর্য এবং মর্যাদার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ - ২ এপ্রিল ২০১১ (২:১৪ পূর্বাহ্ণ)
তানিয়ার লেখা, তাঁরই লেখা… অমন আর হয় না… যা-ই লেখে, গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী, প্রবন্ধ — সব শেষপর্যন্ত তানিয়ারই লেখা হ’য়ে দাঁড়ায়… আর, কী লেখা! জয় হোক..
সৈকত আচার্য - ৩ এপ্রিল ২০১১ (৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
এস এস সি তে ভূগোল পড়েছিলাম, মোটামোটি সবাই। এই লিখা পড়ে হঠাৎ নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আমি ভূগোল পড়ে কি শিখেছি? কিছুই মনে করতে পারলাম না। আবার ও ভাবলাম। পরক্ষনেই দেখি মনে পড়লো, আরে না, আমি তো বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা শিখেছিলাম এই ভূগোল পড়েই। মনে পড়লো শিক্ষকরা উৎসাহ দিতেন মানচিত্র আঁকার জন্য, এবং বলতেন, কোথায় কি খনিজ সম্পদ আছে তা যদি তোমরা এই মানচিত্র এঁকে তাতে নির্দেশ করে দিতে পারো তাতে তোমাদের মার্কস উঠবে অনেক বেশী। এই করতে গিয়ে কেবল আমাদের দেশের মানচিত্রটাই খানিকটা আঁকা শিখলাম। এই মন্তব্যটা দিতে যাওয়ার আগে মানচিত্রটা আবার আঁকলাম। অ-নে-ক-দি-ন পর। দেখলাম, না আমার ভূগোল পড়া একেবারে বৃথা যায় নি!! এখনও প্রায় আগের মতোই অনেকটা কাছাকাছি রকমের করে, আমার দেশের মানচিত্রটা তো আমি আঁকতে পারছি!!
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ - ৪ এপ্রিল ২০১১ (২:২৩ পূর্বাহ্ণ)
“হয়তো পাঠ্যবইয়ের সূচিপত্র থেকেই আমাদের বাঙালি মুসলমান বানাবার চেষ্টার শুরু। হয়তো জাত হিসেবে আমাদের স্বপ্ন দেখবার, কল্পনা করবার, বড় কিছু ভাববার, অন্যকিছু বলবার, ননসেন্সের মজা খুঁজবার সকল সম্ভাবনার সমাধিসৌধ রচনার এই থেকে শুরু, এইসব পাঠ্যপুস্তিকা থেকে। যে জাত তার রত্নাবলীর ইতিহাস জানে না, রসাস্বাদন দূরে থাক, নামে মাত্র চেনে না, সে জাত কেন অন্যজাতের পতাকা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে নাচানাচি করবে না?”
নুর নবী দুলাল - ৭ এপ্রিল ২০১১ (৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ)
এত সাবলীল ও সুন্দর উপস্থাপনা আপনার। সত্যিই পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাই। শুভ কামনা।
5th in the alfabet - ১৭ এপ্রিল ২০১১ (৯:০২ পূর্বাহ্ণ)
বই গুলো আর আনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন !