এদেশে পশ্চিমারা আমাদেরকে প্রথম পরিচয়ে সচরাচর দুই-তিনটা প্রশ্ন করে। যেমন -- তোমার ভাইবোনরা কি বাবা-মায়ের সাথে থাকে? যেমন -- তুমি কি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ করেছো? [...]

এদেশে পশ্চিমারা আমাদেরকে প্রথম পরিচয়ে সচরাচর দুই-তিনটা প্রশ্ন করে। যেমন — তোমার ভাইবোনরা কি বাবা-মায়ের সাথে থাকে? যেমন — তুমি কি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ করেছো? আর জিজ্ঞেস করে — তোমার দেশে কি স্টারবাক্‌স্‌ আছে?

বলাই বাহুল্য সেইসব প্রশ্নোত্তর যাই হোক না কেন, তাতে উত্তরদাতার প্রতি বা তার দেশের প্রতি প্রশ্নকর্তার মনোভাব তেমন বদলায় না। সে তখনও আমার মাথায় মাহুতের পাগড়ি দেখতে থাকে, আমার চুপড়ি থেকে সাপের ফোঁসফোঁস শুনতে থাকে, আমাকে হয়তো তার চোখে সবচেয়ে মানানসই হয় রাস্তার মোড়ে দড়ির ম্যাজিক দেখানো সিড়িঙ্গে লোকটা হিসেবে… কিংবা বড়জোর আমার হাতে হয়তো আজকাল মানায় ম্যাকের সদ্যবানানো বার্গার — মুখে অধমর্ণের হাসি দিয়ে বার্গার বেচছি।

নাজী প্রপাগান্ডা বলতো — ইহুদীদের গায়ে একরকম অস্বস্তিকর তেতো মিষ্টি গন্ধ। সব প্রপাগান্ডার শুরুই কি গায়ের গন্ধ দিয়ে? বৃটিশরা যেমন আমাদের গায়ে কেবলি পেঁয়াজ কষানো কারির গন্ধ পায়, কোরিয়ানদের গায়ে রসুনের গন্ধ পায়, আফ্রিকানদের গায়ে পোড়াকাঠ আর ভাতের মাড়ের গন্ধ পায়।

এইসব সংরক্ত অভিমান গোটা লন্ডন শহরটাকেই আমার চোখে দারুণ ধূসর করে দিয়েছিল। বেন্ডি বাস বলে এশহরে একরকম বাস আছে, তার কটিদেশ স্থিতিস্থাপক, ফলে সেন্ট্রাল লন্ডনের সরু পথঘাট দিয়ে এই আঠের মিটারের দীর্ঘ বাসটা দিব্যি চলতে পারে। টিকিট বা ট্রাভেলকার্ড ড্রাইভারকে দেখাতে হয় না বলে এই বাসে ভবঘুরে-মাতাল-গৃহহীনদের এক অপূর্ব সমাবেশ তৈয়ার হয়। কত জাতের লোক যে এশহরে করে-কেটে খায়, সেটা এ বাসে চড়লে চমৎকার বোঝা যায়। তবে বাসটায় মুখ বুঁজে থাকা চাই। নয়তো গথদের ভয়ালদর্শন কুকুর দেবে গায়ে ঝাঁপ, নয়তো অবিরাম বাইবেল আউড়ে যাওয়া বেহদ্দমাতাল কালো লোকটা দেবে থুতু। কিংবা পোকায় কাটা চেহারার কোনো শ্বেতাঙ্গ ভবঘুরে তোমাকে ডাক দেবে — “হেই, চিকেন টিক্কা মসালা” (কী মুশকিল, আমি কি তোমাকে খাবারের নামে ডাকি? ডাকি টোড ইন দ্য হোল? বা স্পটেড ডিক?)। সেই সঙ্গে চোখকানও খোলা রাখা চাই, নইলে কাজল টানা ক্রসড্রেসার লোকটা তোমার পিঠের ব্যাগের চেইন খুলে দেখবে কি আছে, নইলে নিপাট চেহারার এশিয়ান বেরাদর তোমার পকেট সাফ করে দেবে ভিড়ের ভেতর।

কলসেন্টারে পার্টটাইম কাজ শেষ করে গ্রেট পোর্টল্যান্ড স্ট্রীট বেয়ে এসে আমি এইরকম বেন্ডি বাসে চড়তাম দেড় ঘণ্টার জন্যে, উপায় ছিল না, ঐ বাসটাই কি না যেত আমার বাড়ির কাছে। দেড় ঘণ্টার জন্যে আমার মাথা-বুদ্ধি-হৃদয়-বিশ্বাস-জাত্যাভিমান সব চলে যেত হিমাগারে।

জানালার কাঁচে বুঁদ হয়ে, উদ্গত অশ্রু চকচকে চোখ আড়াল করে — একসময় আয়ুর মতো দীর্ঘ বাসযাত্রা শেষ হবে, নিজের স্টপে নামব আমি। তারপরও নিষ্কৃতি নেই। উড়ালপায়ে পার হতে হবে জনশূন্য স্ট্রীট, তার একপাশে রেলওয়ের পতিত জমি, অন্ধকার। বাসস্টপে বেশিক্ষণ দাঁড়াবার ভুল কদাচ করতে নেই। সিলেটি বাঙালিরা বেশ সই করে কাঁচাডিম মারবে তাহলে। কিংবা চলন্ত গাড়ির কাঁচ খুলে ছুঁড়ে দেবে আলুভাজা-ভিনেগার-মেয়নিজ-ফিশ এন্ড চিপস এর উদ্বৃত্ত। চাঁদমারিতে ওস্তাদ তারা।

এইভাবেই দিন যাচ্ছিল। একদিন কাজের শেষে বেন্ডি বাসে বাড়ি ফিরছি। আমার পাশে এক থুত্থুরে মহিলা বসা, অতিরিক্ত জলশোষণ করবার পরে ব্লটিং পেপারের যেমন হয় — তেমনি হয়ে এসেছে তাঁর চামড়া। হাতে একথোকা গোলাপ। নানান রঙের টি-রোজ। কী যে গরবিনী গোলাপগুলি। আমি একটু একটু করে কথা বলি। তিনি চলেছেন তাঁর নাতনিকে দেখতে। আমি উসখুস করে বলি — “ফুলগুলি যা সুন্দর”, ভাঙা গলায় নিচুস্বরে তিনি বলেন — “তুমি একটা নাও। তোমার জ্যাকেটের রঙের সাথে রঙ মিলিয়ে এই পোড়া-কমলা ফুলটা নাও।” কাঁপাহাতে তুলে দেন ফুল। টুকটাক কথা বলি আরো, আমরা ফোননাম্বার বিনিময় করি, তিনি বলেন — শোনো আমি তোমাকে ফোন করে বলবো — রোজ আছে? আর নিজের নামও বলবো রোজ”, অভিনব প্রস্তাব। নিজের স্টপে নামবার আগে আমি ওঁকে বলি — “তোমায় একটু আদর জানাই?” মহিলা মাথা নুইয়ে বলেন — “যদি তোমার মন চায়”, আমি ওঁকে চুমু খেয়ে নেমে যাই।

রোজ আমাকে কখনো ফোন করেননি। বেঁচে আছেন কি না জানি না। কিন্তু সে-রাতটা ছিল অপার্থিব। প্রকাণ্ড ধূসর শহর তার ফুটফুটে মুখটা সে-রাতে প্রথম বের করেছিল আমাকে দেখতে দেবার জন্যে। বাড়ি ফিরে আমি লিখেছিলাম — “প্রত্যেক দেশের বুকের ভেতর থাকে তার শীতকালীন রূপকথা — দাদিমার মেঠাই। সহজে সে তার হৃদয় খুলে দেয় না।” আমার ভেতরে চাবি ঘুরিয়ে একটা গোলাপফুল একটা শহরের জন্যে জায়গা করে ফেলেছিল। বেন্ডিবাসের জানালায় লন্ডন শহর আর পাশাবতী বোনদের মতো ছড়া কাটছিল না — “যে জিনে সে মালা পায়/ হারিলে মোদের পেটে যায়”! আমার ভাল লাগতে শুরু করেছিল — টিউডর আমলের শাদা-কালো ডুরে বাড়িগুলি। আমার ভাল লাগছিল মার্ডার মিস্ট্রি আর কুয়াশাময় অলিগলি। বন্ধকী দোকান। শুঁড়িখানার গার্নেট রঙা আলোয় অলস বসে থাকা বেড়াল। ঝর্নাকলম সারাই কারখানার মুছে যাওয়া বিজ্ঞাপন। হীচকক-ওলস্টোনক্রাফট-ডেফো-ডয়েলের ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা চিহ্নগুলি।

৮ জানুয়ারি, ২০১১

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

10 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
10
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.