তোমার জন্ম কি তোমার মনে আছে? জন্মস্থানে কি তুমি কখনো সূর্যের আলো দেখেছিলে? নাকি অন্ধকার জলের ভিতরে — প্রবহমান রক্তের ভিতরে তোমার মা ফিসফিস করে তোমাকে জানিয়েছিল — তুই হচ্ছিস জলেশ্বর। মহাসাগরে হেন প্রাণী নেই যার সাধ্য তোকে খায়!
তোমাদের ছবি আমি প্রথম দেখি ছোট্টবেলায় একটা বইয়ে- বইয়ের নাম ‘দ্য সী’। শেষের দিকের এক পাতায় একখানা খুনে-তিমির ছবি আছে — যে ফটোগ্রাফার সে ছবি তুলেছিলেন তাঁকে জলের তলে নিয়ে যাবার জন্যে সে হিমশীর্ষ ভেদ করে ভুস করে ভেসে উঠেছে। আমার মনে হয়েছিল এইরকম সুন্দর কালো আর শাদা — এইরকম হাসকুটে বুদ্ধিমান চেহারা আমি আর দেখিনি।
ছয়-টনের বিশাল শরীর বিশালতর সমুদ্রে আছড়ে বেড়াতে তুমি, জলমণ্ডলের বিপুল বালক, তেলতেলে সীলমাছ শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লেজের বাড়ি দিয়ে মেরে খেতে, কেমন করে শেষ অব্দি অর্লান্ডোর অ্যাকুইরিয়ামে আটকে গেলে? কেমন করে তোমার দিন কাটে — ‘খেলা দেখে যান বাবু’…করে করে। লোকে একটু আগেও তোমাকে দেখেছে খেলা দেখাতে, ট্রেইনারের হাত থেকে হাসিহাসি মুখে মাছ খেতে। ট্রেইনারকে জলের তলায় টেনে নিয়ে আছড়ে আছড়ে মেরে তুমি কী বোঝাতে চেয়েছিলে — বোঝাতে চেয়েছিলে এইরকম লাগে স্বাধীনতাহীনতায়? এইরকম গুমরে গুমরে মরছো তুমি ওদের খেলায়।তুমি এইরকম আছো।
মানুষ তোমার জ্বালা বোঝে কি? মানুষ তোমাকে আদুরে দেখতে চায় কি? মানুষ কি জানে না তুমি খুনে-তিমি? প্রবৃত্তির কারাগারে বন্দী, মানুষের মতই? তোমার তো মানুষকে চাই না, তার মাংস চাই না, তার হাততালিও না, মানুষের কেন তোমায় চাই?
একদিন তুমি ডোডো পাখি আর প্যাসেঞ্জার পিজিয়ন-এর সঙ্গী হবে, একদিন তুমি আইরিশ এল্ক আর গ্রে-হোয়েল-এর পাশে দাঁড়াবে। কঙ্কাল হয়ে। মিউজিয়ামে নিজের হাড়ের করতাল বাজিয়ে — ‘খেলা দেখে যান বাবু’…করে করে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১০ comments
মোহাম্মদ মুনিম - ২ মার্চ ২০১০ (১:০৫ পূর্বাহ্ণ)
টিলিকুম বিষয়ে সংবাদের লিঙ্ক এখানে
নীড় সন্ধানী - ৪ মার্চ ২০১০ (৫:১৭ অপরাহ্ণ)
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, সেই দাবীটা জোরদার করার জন্য। হয়তো।
মন খারাপ হয়ে গেল পড়ে। টিলিকুমের জন্য নাকি তার ট্রেনারের জন্য বুঝতে পারছি না।
রায়হান রশিদ - ৯ মার্চ ২০১০ (৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ)
একই অনুভূতি।
এক টিলিকুম একজন মানুষের প্রাণ সংহার করলে বিশ্ববিবেক হোঁচট খায়, আর অন্তরালে হাজার টিলিকুম তিমি শিকারীদের হারপুনে মহাসাগরের জল রক্তাক্ত করলেও সেটা নিয়ে বড় জোর হাতে গোণা গুটিকয় সমুদ্রবিদ আর পরিবেশবাদী ছাড়া কথা বলার মানুষ থাকে না। টিলিকুমদের তো ‘খেলা’ দেখানোর জন্য এ্যাকুইরিয়ামেই থাকার কথা ছিল না। পিয়েরে বোল এর ‘প্ল্যানেট অব দি এপস’ স্যাটায়ার সিরিজটির কথা মনে পড়ছে কেবল।
ধন্যবাদ তানিয়া।
aruddho sokal - ৪ মার্চ ২০১০ (৭:৫৬ অপরাহ্ণ)
সুন্দর !!!
শুভ কামণা
বিনয়ভূষণ ধর - ৮ মার্চ ২০১০ (৭:২৯ অপরাহ্ণ)
@সাগুফতা শারমীন তানিয়া!
সত্যি কথা বলতে কি লেখাটা পড়ে আমার এতো ভালো লেগেছে যে তাই লেখাটা আমি অনেকবার পড়লাম এবং মনোযোগ সহকারে পড়লাম। যার কারণে ভালো লাগার অনুভূতিটা আপনাকে জানাতে একটু দেরী হয়ে গেলো। কি বলবো আপনাকে! লেখাটা পড়ে বারবার মনটা কেমন জানি অজানা একটা কষ্টে ভরে যায়। বলতে আমার দ্বিধা নেই যে অনেকদিন পর একটা ভালো লেখা পড়লাম। সামনে এরকম সুন্দর ও অসাধারন লেখা আমরা সামনে পাবো আশা রাখছি। পরিশেষে আমার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি রইল বসন্তের শুভেচ্ছা!
@মোহাম্মদ মুনিম!
টিলিকুম বিষয়ে সংবাদের লিঙ্ক’টির জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি!
মুয়িন পার্ভেজ - ৯ মার্চ ২০১০ (১:১১ অপরাহ্ণ)
খুবই ভালো লাগল এই লেখা; একে কবিতা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। বাংলায় ‘elegy’ বা শোকগাথা রচিত হয়েছে প্রচুর — এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে মাইকেলের মেঘনাদবধকাব্য-এর ‘রাবণের বিলাপ’। যে-আঁধার আলোর অধিক কাব্যের অন্তর্ভুক্ত বুদ্ধদেব বসুর একটি কবিতার সঙ্গে সাগুফতা শারমীন তানিয়ার এ-লেখার প্রতিবেশসামীপ্য আছে যেন কোথাও। না কি ‘প্রবৃত্তির কারাগারে বন্দী’ কথাটির জন্যই বুদ্ধদেবের কবিতা মনে এল আমার!
(কবিতাসংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, আগস্ট ১৯৯৩, পৃ. ৬৯)
রেজাউল করিম সুমন - ১৪ মার্চ ২০১০ (৫:২৩ অপরাহ্ণ)
জফির সেতু-র একটি সাম্প্রতিক কবিতা — ‘তিমি’ :
(শালুক-এর দশ বছর পূর্তি সংখ্যায় [ফেব্রুয়ারি ২০১০] প্রকাশিত)
kamrul al mamun - ৯ মার্চ ২০১০ (১১:২৬ অপরাহ্ণ)
হুমমম….
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ১১ মার্চ ২০১০ (৩:৩৬ অপরাহ্ণ)
মনোযোগের জন্যে অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনার জন্যেও। মোহাম্মদ মুনিমকে অনেক ধন্যবাদ লিঙ্কটা দিয়ে দেবার শুভবুদ্ধির জন্য। রায়হানভাই, একটি মৃত মানুষ বনাম কয়টা মৃত হোয়াইট শার্ক কিংবা তিমি, এইসব পরিসংখ্যান যখন দেখি রীতিমত অবিশ্বাস্য লাগে। মনে হয়, একদিক থেকে তৃতীয়বিশ্বের মানুষ আর এই প্রাণী্রা একরকম, এদের মৃত্যু কে্বল সাংখ্যমান মাত্র! মুয়িন পার্ভেজ, ‘প্র্রবৃত্তির কারাগারে বন্দী’ আমার খুব প্রিয় শব্দাবলী, বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’ এর লাইন সম্ভবতঃ। অবিকল মুখস্ত নেই বলে অবিকল উদ্ধৃতি দিতে পারলামনা।
রেজাউল করিম সুমন - ১৪ মার্চ ২০১০ (৫:০৫ অপরাহ্ণ)
সাগুফতা শারমীন তানিয়ার অসামান্য লেখাটা না পড়লে টিলিকুম নামের এই বন্দি তিমি সম্পর্কে অনবহিতই থেকে যেতাম, যে মাত্র বছর দুয়েক বয়সে মানুষের হাতে ধরা পড়েছিল আইসল্যান্ডের কাছে, ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে; যার জীবন কেটেছে প্রথমে সিল্যান্ড অব দ্য প্যাসিফিক-এ এবং ১৯৯২-এর ৯ জানুয়ারি থেকে সিওয়ার্ল্ড অর্ল্যান্ডো-তে; যার পুত্রকন্যার সংখ্যা বারো (এর মধ্যে দুজন মারা গেছে), নাতি-নাতনি দুজন; বছরের পর বছর ধরে যে দর্শনার্থীদের বিনোদিত করে আসছে খেলা দেখিয়ে; যার নাম জড়িয়ে গেছে তিন তিনজন মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে।
হাসিখুশি প্রশিক্ষিকা Dawn Brancheau-এর সঙ্গে টিলিকুমের ছবিটার দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে — দুজনেরই জন্য…