‘সুজন’-সভাপতি দুর্জনের ভূমিকায় : এত নৈতিকতা কোথায় রাখি?

prof-m-ahmed-photoঅনেক ত্যাগ, সংগ্রামের পর গত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ বাংলাদেশের নাগরিকরা নির্বিঘ্নে নির্ভয়ে তাদের অন্যতম নাগরিক অধিকার অর্থাৎ নিজেদের পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার অধিকার ফিরে পেয়েছে। সুযোগ নয়, দেশি-বিদেশি অধিকাংশ সংগঠন ও মানুষের কাছে নির্বাচনটি হয়েছে নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট তিন-চতুর্থাংশের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে জয়ী হয়েছে এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এর মধ্যে প্রধান দুই জোট-নেত্রীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী তারেক-কোকো’র মা বেগম খালেদা জিয়ার নামেও মামলা রয়েছে। মামলাগুলো উচ্চতর আদালতে বিচারাধীন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যাঁরা মামলা দায়ের করেছিলেন এই দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে, সেসব বাদীপক্ষ মামলা প্রত্যাহারের আবেদনও করেছেন ইতোমধ্যে। রাজনীতি করলে মামলা-হামলা থাকবেই, এতেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা অভ্যস্ত। কিন্তু প্রসঙ্গ অন্যত্র। [...]

prof-m-ahmed-photoঅনেক ত্যাগ, সংগ্রামের পর গত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ বাংলাদেশের নাগরিকরা নির্বিঘ্নে নির্ভয়ে তাদের অন্যতম নাগরিক অধিকার অর্থাৎ নিজেদের পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার অধিকার ফিরে পেয়েছে। সুযোগ নয়, দেশি-বিদেশি অধিকাংশ সংগঠন ও মানুষের কাছে নির্বাচনটি হয়েছে নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট তিন-চতুর্থাংশের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে জয়ী হয়েছে এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এর মধ্যে প্রধান দুই জোট-নেত্রীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী তারেক-কোকো’র মা বেগম খালেদা জিয়ার নামেও মামলা রয়েছে। মামলাগুলো উচ্চতর আদালতে বিচারাধীন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যাঁরা মামলা দায়ের করেছিলেন এই দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে, সেসব বাদীপক্ষ মামলা প্রত্যাহারের আবেদনও করেছেন ইতোমধ্যে। রাজনীতি করলে মামলা-হামলা থাকবেই, এতেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা অভ্যস্ত। কিন্তু প্রসঙ্গ অন্যত্র।

গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন গণ্যমান্য বুদ্ধিদীপ্ত সম্মানিত ব্যক্তির বেশ কয়েকটি ফোরাম কাজ করছে। আমরা অতি ক্ষুদ্র, সাধারণ অল্পশিক্ষিত নাগরিকরা তাঁদেরকে ‘সুশীল সমাজ’ বা ‘সিভিল সোসাইটি’ বলেই জানি। এই সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের মধ্যে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাবেক আমলা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, নারী নেত্রী, এনজিও কর্মকর্তা, পুলিশ, বিডিআর ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাও রয়েছেন — অর্থাৎ এককথায় এখানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। দেশ ও জাতির বিভিন্ন সংকটে এই ‘সুশীল সমাজ’ নানা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজন করেন, বিবৃতি ও উপদেশ দিয়ে থাকেন। দেশ-জাতি তাতে উপকৃত কতটুকু হয়েছে তা এদেশের সাধারণ মানুষই ভালো বলতে পারবেন।

দেশে সুশাসন কে না চায়? সবাই চায় দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশিক্ষা-মুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সেই সাথে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ ও রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ — অল্প কিছু জনগোষ্ঠী ছাড়া। এই সুশাসনকে নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছে ‘সুজন’ অর্থাৎ ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ নামে একটি খ্যাতনামা সামাজিক সংগঠন। সাংগঠনিকভাবে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এদের কমিটি রয়েছে। সচেতনতামূলক কাজের জন্য সংগঠনটি বেশ কিছু কাজ করছে। সমাজের বিশিষ্ট বিজ্ঞজনেরা রয়েছেন এই ‘সুজন’-এর সাথে। এর প্রধান নেতৃত্বে রয়েছেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, পরিবেশবাদী সংগঠক, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠন টিআইবি’র (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) প্রধান শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এই বয়সেও তিনি সমাজের বিভিন্ন অনিয়মের ব্যাপারে সোচ্চার কণ্ঠ হয়ে আমাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। ভাবতেই ভালো লাগে বিষয়টি। সংসদ, রাজনীতি, দুর্নীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ, হেন কোনো বিষয় নেই যে বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য নেই।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ‘সুজন’ দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত, ঋণখেলাপী, বিলখেলাপী, যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে এদেশের সাধারণ নাগরিকদের সোচ্চার ও সজাগ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। নির্বাচনের পরেও ‘সুজন’-নেতৃবৃন্দ সাংবাদিকদের কাছে বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন; যেমন: নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের কার কার বিরুদ্ধে মামলা আছে, যুদ্ধাপরাধী কয়জন আছে ইত্যাদি। সম্ভবত নির্বাচনের ২/৩ দিন পরেই অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক ‘টক শো’তে বললেন, “যিনি আসামী তিনি কীভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন?”, “সর্বোচ্চ আদালত থেকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি নিয়ে শপথ নিন” ইত্যাদি। তিনি যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে এসব মন্তব্য করেছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও এতে আইনের কোনো বাধা নেই, অধ্যাপক মোজাফফর এক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্ন তুলেছেন। আমার শ্রবণেন্দ্রিয় যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকে তাহলে বোধহয় এ ধরনের তির্যক মন্তব্যই শুনেছিলাম আমি। সম্ভবত আমার মতো আরো অনেক দর্শক-শ্রোতাই এর সাক্ষী।

অপরদিকে ‘সুজন’ গত ১১ জানুয়ারি ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স রুমে ‘গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এ ব্যাপারে সেদিন বেশ সুন্দর ও মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেন সেদিনের বৈঠকে উপস্থিত সজ্জন বিজ্ঞ নাগরিকবৃন্দ। সেই বৈঠকেই ‘সুজন’-এর সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বললেন, “একটি দল তিন-চতুর্থাংশ মেজরিটি পেলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। তাই গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য এবং মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমাদেরকে নতুন ক্ষেত্র হিসেবে ‘জনতার সংসদ’ গড়ে তুলতে হবে।” (ভোরের কাগজ, ১২ জানুয়ারি ২০০৯)। গত ১২ জানুয়ারিতে বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্রিকাতেই বা মিডিয়াতে প্রফেসর মোজাফফর আহমদের বক্তব্যটি প্রচারিত হয়েছে।

বেসরকারি চ্যানেলটিতে প্রথম যেদিন আমাদের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বক্তব্য শুনছিলাম তখন ঠিক বুঝিনি যে আমি কী শুনেছি। আর গত ১২ জানুয়ারি পত্রিকাতে তাঁর বক্তব্য পড়েও বিষয়টি বোঝার ক্ষমতা হয়নি আমার মত এক নগণ্য সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কি পারবেন না বা তাতে সত্যিকার অর্থে আইনগত বাধা আছে কিনা — তার জবাব সেদিনই খ্যাতনামা আইনজীবী আনিসুল হক ঐ বেসরকারি টেলিভিশনকে জানিয়েছেন। পরে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় বিচারপতি গোলাম রব্বানী অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে আমাদের পবিত্র সংবিধানের বাখ্যা দিয়ে একটি সুলিখিত অভিমত দিয়েছেন। তবে তিনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। কোনো সংগঠনের প্রধানের নামোল্লেখ করেননি তাতে। এমনকী সেদিন টিভি টক শো-তে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শক-শ্রোতারা তাঁদের কঠিন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন ‘সুজন’-সভাপতির মন্তব্যের ব্যাপারে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে একজন নগণ্য নাগরিক হিসেবেই বিবেচনা করি। অন্য অনেকের মতো কথায় ও কাজে ‘কৌশলী’ হতে পারিনি। যা প্রকাশ করতে চাই তা সরাসরিই বলার ও লেখার চেষ্টা করি আমার নগণ্য সামর্থ্যে। তাতে অনেক বিপদও আছে। থাকি তো চট্টগ্রামে। যার নামের সাথেই ‘গ্রাম’ আছে। অর্থাৎ কিনা গ্রাম্য। গ্রামের সাধারণ মানুষ যেভাবে সরাসরি কথা বলে থাকেন কথিত ‘শহুরে’দের মতো অত না-ভেবেচিন্তে ঠিক তেমনি। এজন্য যদি ‘বেয়াদপি’ বা অসভ্য আচরণ হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমাপ্রার্থী। সম্ভবত ৪ দলীয় জোটনেত্রী, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নবম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হচ্ছেন (লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন হয়তো তিনি তা-ই হয়ে যাবেন)। অর্থাৎ পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা তো বটেই, সংসদীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী আরো অনেক মর্যাদার অধিকারী হবেন তিনি। গত ২ বার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শ্রদ্ধেয় ‘সুজন’-সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের যুক্তিগত ও নৈতিক কারণে যদি মামলা থাকার জন্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ‘যোগ্য’ না হন, তাহলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কি সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হওয়ার ‘নৈতিক’ (অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ভাষায়) অধিকার রাখেন?

যতটুকু শুনেছি বন্দুকের নলের মুখে সামরিক উর্দি-পরা জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের আমলে ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ (সুজন)-এর প্রধান কর্তাব্যক্তি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সম্ভবত তিনি অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন। রাতের অন্ধকারে অস্ত্রের জোরে সামরিক পোশাক গায়ে দিয়ে যিনি ক্ষমতা দখল করেন অবৈধভাবে, সেই জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার অংশীদার হওয়া অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সেদিন কি ‘নৈতিক’ কাজটি সম্পন্ন করার জন্যই সামরিক সরকারের উপদেষ্টার পদটি অলংকৃত করেছিলেন? সত্যিই জানতে বড় ইচ্ছে হয়। এদেশের জনগণ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি যে, ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে যুগান্তকারী রায় দেয়া হয়েছিল। রায়ে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনকালে জারিকৃত সকল সামরিক ফরমান অবৈধ ও সংবিধান-পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হয়। মহামান্য হাইকোর্টের রায়ে যে-সরকার ব্যবস্থাকে ও সরকারি শাসককে অবৈধ ও সংবিধান-পরিপন্থী হিসেবে রায় দেয়া হয়েছে সেই সরকারের প্রধান ব্যক্তি লে. জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকারের উপদেষ্টার পদ ‘অলংকৃত’ করা বর্তমান বাংলাদেশের ‘সুশীল সমাজ’-এর অন্যতম প্রতিনিধি ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ তথা ‘সুজন’-এর সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ কোন্ অবস্থানে রয়েছেন তা আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির মস্তিষ্কে না ঢুকলেও সাধারণ জনগণ বুঝবেন নিশ্চয়ই।

শ্রদ্ধেয় প্রবীণ অভিজ্ঞ প্রফেসর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বক্তব্য ও অবস্থান অনুধাবন ও নির্ণয় করতে গিয়ে ‘নৈতিকতা’র মানদণ্ড কী তা নতুন করে জানতে খুব ইচ্ছে হয়। বাংলাদেশের কোটি কোটি ভোটার সহ সাধারণ জনগণ জানেন যে নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেয়া নির্বাচনী ব্যয়সীমা অধিকাংশ প্রার্থীই মানেননি। অনেক যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হননি, আবার যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তাঁরা তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। নিশ্চয়ই জনগণ সেসবের মূল্যায়ন করবেন।

“একটি দল তিন-চতুর্থাংশ মেজরিটি পেলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি হয়” — গত ১১ জানুয়ারি তারিখে অধ্যাপক আহমদের এই বক্তব্যের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার বুদ্ধি-ক্ষমতা আমার নেই। শুধু বলতে চাই, ভোট দিয়েছে জনগণ তথা দেশের সচেতন ভোটার। এসব নাগরিক ও ভোটারদের সচেতন করার জন্যই তো অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে ‘সুজন’ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করেছেন, প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। নিশ্চয়ই সেই প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ভোটাররা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে একটি দলকে তিন-চতুর্থাংশ আসনে নির্বাচিত করেছেন। তাহলে ভোটাররা কি ভুল করলেন তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে গত ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে? তাহলে তো বলতে হয়, ‘সুজন’ যে-প্রচারণা চালিয়েছিল নির্বাচনের আগে ভোটারদের উদ্দেশ্যে তা ভোটাররা ঠিকমতো বোঝেননি। আর না বোঝার কারণেই একটি দলকে তিন-চতুর্থাংশ আসনে জিতিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। আহ্, অবুঝ ভোটাররা কেন যে এমন একটি কাজ করলো! আমাদের সমাজের ‘চিন্তাপতি’দের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। খুবই দুঃখজনক! সত্যিই তো যত দোষ ঐসব নাদান ভোটারদের। তাঁরা যে এমন করে দাবার দানটি উল্টে দেবেন তা হয়তো স্বপ্নেও কল্পনা করেননি জিয়াউর রহমানের সাবেক উপদেষ্টা মহোদয়।

বিগত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোটও দুই তৃতীয়াংশ ভোটে নির্বাচিত হয়েছিল। আর সে-নির্বাচনের আগে ও পরে সেই জোট ও তাদের সরকার সারা দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু আর নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগের উপর কি অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছিল তা তো এদেশবাসী ভুলে যায়নি। দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি পেলে গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকি হয় না; ঝুঁকি হয় সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনে কোনো দল তিন-চতুর্থাংশ মেজরিটি পেলে? হ্যাঁ, অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে এদেশের জনগণ, বর্তমান সরকার, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরকে যাতে সরকার জনগণের স্বার্থেই পরিচালিত হয়। কিন্তু সন্দেহ জাগে যখন ‘গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকি’ কথাটা শুনি অবৈধ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা টিআইবি, সুজন, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বিজ্ঞ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কাছ থেকে।

দুর্মুখেরা বলেন, এই প্রবীণ বিজ্ঞ অধ্যাপক হয়তো মনে খুব কষ্ট পেয়েছেন আওয়ামী লীগ তিন-চতুর্থাংশ আসন পাওয়াতে। আরো বেশি কষ্ট হয়তো তাঁর এই যে, তিনি যেই অবৈধ সামরিক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন (জিয়াউর রহমানের ) তাঁর সুযোগ্য পুত্র তারেক-কোকো’র গর্বিত মা বেগম জিয়াউর রহমান অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট গো-হারা হেরেছে । আমরা দুঃখী বাংলাদেশের ব্রাত্যজনেরা কায়মনোবাক্যে কামনা করি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যাতে ঝুঁকিপূর্ণ না হয়। পাশাপাশি অত্যন্ত বিনীতভাবে এও আশা করব যে, ‘সুজন’-এর শ্রদ্ধাভাজন সভাপতির কাছ থেকে ‘দুর্জন’ সুলভ বক্তব্য আর শুনতে হবে না আমাদেরকে। আমার দুর্বিনীত লেখায় হয়তো বাংলাদেশের সুশীল সমাজের অনেকেই অখুশি হবেন। করজোড়ে মিনতি, অভিনন্দন ভোটারদের — যাঁরা গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্যে তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়ী করেছেন একটি দলকে।

১৪ জানুয়ারি ২০০৯, চট্টগ্রাম

সমরেশ বৈদ্য

সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী।

৭ comments

  1. সুজাউদ্দিন হামীম - ১৭ জানুয়ারি ২০০৯ (১০:২৭ পূর্বাহ্ণ)

    সু-শাসনরে প্রতীক অবস্যই অধ্যাপক মোজাফ্ফর অাহমেদ নন। সেই অধিকার জনগণ তাকে দেয়নি। সু-শাসন প্রতিষ্ঠা করবনে একজন ত্যাগী দেশ-প্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক।

  2. সৈকত আচার্য - ১৭ জানুয়ারি ২০০৯ (৫:১১ অপরাহ্ণ)

    সামরিক জেনারেলদের পঁচা বাসি তত্ত্ব “Own brand of democracy”র কথা নতুন করে শুনিয়েছিলেন জেনারেল মঈন সাহেব। এই গেল বছর তার নামে লেখা একটা বই বেরিয়েছিল। অনেকে বলেছেন, এটা বই মেলায় কিছু মানুষ কিনেছে। বইটি পড়ার সৌভাগ্য হয়ে ঊঠেনি।

    আমাদের দেশে সামরিক অভুত্থানের সাথে সাথে কবি জেনারেল ও লেখক জেনারেলদের অভ্যুদয়ের একটা যোগসূত্র আছে বলে মনে হয়। বিশেষ করে তখন তাদের ভয়ংকর সুন্দর কবি প্রতিভা বা লেখক সত্ত্বা তখন পেটের ভিতর থেকে মোচড় দিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। সেগুলো যখন তারা জনগণের কাছে উগরে দেন, তার কাছে ধারে যাওয়ার রুচি আমার হয় না।

    জনৈক জেনারেল নতুন বাংলাদেশ গড়বে বলে ঘোষনা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রকল্প প্রায় বাস্তবায়ন সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন। স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের সাথে দলটির জন্মাবধি সখ্যতা চিরবহমান ও নিয়তিনির্দ্দিষ্ট বলে মনে হয়। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির ব্যর্থতার কারনে এই অশুভ শক্তির অবস্থান এখনও জোরালো ও অস্তিত্বমান।

    এই ঊর্দিপরা জেনারেলদের নির্দেশে যখন উল্লাপাড়ার ছেলে জেহাদ গণতন্ত্রের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার অপরাধে খুন হয়, সেলিম দেলোয়ারের প্রতিবাদী বুকে কাপুরুষোচিত ট্রাক উঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ আসে আর এথেলবার্ট গোমেজরা যখন লালদীঘির মাঠে পুলিশের গুলিতে পাখির মত লুটিয়ে পড়ে তখন মনে পড়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে কবি জেনারেলের লেখা গান গাওয়া হচ্ছিল, “তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথী হতে আজকের চেষ্টা আমার” কিংবা “যেখানে থাকবেনা দুর্নীতি দুঃশাসন, যেখানে থাকবেনা নিপীড়ণ নির্যাতন”, জাতীয় গান, যে ধরনের বাংলাদেশে কোন জেনারেল ঠিকানা খুঁজে পেতে চান । শুনে মনে হত, যেন পুরো বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার সাথে রসিকতা করা হচ্ছিল।

    সমরেশ বৈদ্য যদি ঠিক তথ্য দিয়ে থাকেন তাহলে বলতে হয়, জিয়াউর রহমানের আশ্রয়ে যারা দিন কাটিয়েছেন, তারা পরে কোন এক সময় সু্যোগ পেয়ে অন্য কোন জেনারেলের বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে যাবেন এবং প্রধান অতিথি হয়ে মোড়ক উন্মোচন করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের দিকে যাত্রার জাতীয় আকাঙ্খার প্রতিফলন এবারের নির্বাচন। এই গণতন্রের সাথে সেই ‘OWN BRAND’ মার্কা গণতন্রের পথের ও মতের যোজন দুরত্ব ।

    সুজন প্রধানদের মতো শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞজনরা যাতে এই কথা ভুলে না যান বা তাদের জনবিচ্ছিন্ন কল্পিত তত্ত্ব আমাদের মতো সাধারন মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে না দেন এই আশাবাদ থাকলো। কারন, এই বোঝা আমাদের জন্য অনেক ভারী, অনেক কষ্টের।

  3. মাসুদ করিম - ১৮ জানুয়ারি ২০০৯ (৩:৪৫ পূর্বাহ্ণ)

    ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ কী করে ‘সুজন’ হয় তা নিয়ে আমি অনেক দিন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলাম। হওয়াতো উচিত ছিল ‘সুজনা’— কিন্তু কেন একটি মোক্ষম আ-কার বাদ পড়লো— এর একটিই কারণ আজ আমার কাছে স্পষ্ট— এছাড়া আর কোনো কারণ থাকতেই পারে না— কুচক্রী কখনো তার নামে তার কাজের আভাস দিতে চায় না— যে সংগঠন প্রতিনিয়ত নেতির চর্চা করবেন সে সংগঠন কী করে প্রকৃত ‘সুজনা’ রূপ শুভ মহরতেই প্রকাশ করে দেবে? কে না জানে ‘মকরের শুরুতে হাসি শেষে কামড়’।

    আমার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে বিষয়টি আমার কাছে এতো স্পষ্ট হয়েছে এবারের নির্বাচনে ‘সুজন’-এর ক্রমাগত ‘না’ ভোটের প্রচারণায়। আর তারই স্বাভাবিকতায় এলো প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণকে কলুষমুক্ত করতে তার ‘না’সাধারণ উপদেশ, এরপর ‘না’নিবার্য তিন-চতুর্থাংশ গরিষ্ঠতার গণতান্ত্রিক ঝুঁকি বিচার, এরপরই ‘না’জনতার সংসদ-এর প্রস্তাব।

    বাংলাদেশে আমাদের সবার পরিচিত একজন MADAM NO আছেন, তিনি আপোষহীন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আমরা এবার পেয়ে গেলাম ‘সুজনা’ কর্ণধার MISTER NO কেও। নুহের নৌকার জোড়া বাছা সম্পন্ন হলো।

    ‘গাত্রদাহ’ বলে একটি শব্দ আছে আমাদের ভাষায়। আমাদের আলোচ্য চরিত্র শব্দটির মূর্তিমান রূপ। তাকে ‘না’পূজায় বরণ করুক বাংলাদেশের ‘গাত্রদাহ’সম্প্রদায়

    পুনশ্চ : সমরেশদা আরেকটি তথ্য কি দিতে পারেন? আমাদের ‘না’স্যারটি কি জিয়া সাহেবের উপদেষ্টা হওয়ার আগে ছিলেন কোনো ভ্রষ্ট বামতন্ত্রী? যারা এখনো ক্ষমতায় যাওয়াকে পছন্দ করেন না, স্বপ্ন দেখেন ক্ষমতা দখলের। আর তাই বাংলাদেশে যারা ক্ষমতা দখলে সিদ্ধহস্ত সেই সামরিক বাহিনী এলেই নিজেদের অপূর্ণ স্বপ্নের কথা উথলে ওঠে তাদের মনে, তারা ভাবেন, বিপ্লব হয়নি তো কী হয়েছে, ক্ষমতা দখল তো হয়েছে, এইবার আমাদের পলিউটেডব্যুরো দিয়ে দেশ চালাবেন বিপ্লবী সেনাপ্রধান। এইবার নানাঅর্থেই তেমনটি হয়নি বলেই মোজাফফর আহমেদ হয়তো সবচেয়ে হতাশ হয়েছেন। সে হতাশাই বারবার ফুটে উঠছে এই সর্বজন ‘না’শ্রদ্বেয়ের সাম্প্রতিক কথাবার্তায়।

  4. parthasarothee - ১৮ জানুয়ারি ২০০৯ (৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ)

    সমরেশ বৈদ্য,প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাই । এখন সময় এসেছে মুখোশধারী ভদ্রলোকদের মুখোশ উন্মোচন করার। আশা করি এমন আরও লেখা পাব।
    জনগনই সকল ক্ষমতার উতস, এ’কথাটি আবারও প্রমাণ হল।

  5. নীড় সন্ধানী - ১৯ জানুয়ারি ২০০৯ (৭:২৯ পূর্বাহ্ণ)

    একজন সাধারন নাগরিক হিসেবে আমারও সংশয়/কৌতুহল রয়ে গেছে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার মামলা বিষয়ের। কদিন আগেও যাঁরা গারদের পেছনে ছিলেন হেন তেন অপরাধ নিয়ে, এখন তাঁরা সংসদের হর্তাকর্তা, দেশের মাথামুন্ডু। সব কিছু তড়িৎ মাফ!! এই দেশে সব সম্ভব? এই নিঃশব্দ মাফ নিয়ে মোজাফফর আহমেদ যদি প্রশ্ন তুলে থাকলে সেটা অন্যায় করেননি। সেজন্য ওনাকে তুলাধূনা করার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। আইন-আদালতকে তামাশা হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলেই তাঁর কথাটা খারাপ লাগছে।

    তবে যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলাগুলো করেছিলেন উদ্দেশ্যমূলকভাবে, রাজনৈতিক দরকষাকষির জন্য, সেহেতু তাদেরই এ ব্যাপারে পরিষ্কার বক্তব্য দেয়া উচিত ছিল। বলা উচিত ছিল -“মাননীয় জনগন, আপনারা এবার হাসিনা খালেদার মামলার বিষয়টা ভুলে থাকতে পারেন, ওটার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে আপাততঃ।”
    কিন্তু আলু বিষয়ে বিস্তর উপদেশ দেয়া হলেও এই ব্যাপারে একটা লাইনও বলা হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। যেন কিছুই হয়নি। এটা গত সরকারের টেকনিক্যাল ব্যর্থতা।

    তবে এরকম চমৎকার একটা নির্বাচন উপহার দেবার জন্য গত সরকারকে আজীবন কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। খালেদা জিয়ার দেশ বাচাও শ্লোগানে সাড়া দিয়ে রাজাকারমুক্ত সরকার গঠনে সাহায্য করেছে তত্ত্ব সরকার। মঈন-ফখরুকে এজন্য স্যালুট জানাই।

  6. Pingback: Global Voices Online » Bangladesh: Elections Over, Now Its Time To Keep Promises

  7. সত্যকথক - ২২ জানুয়ারি ২০০৯ (৯:১৪ অপরাহ্ণ)

    আপনার অসাধারণ লেখার জন্য ধন্যবাদ। আস‍‍‍লে দেশের প্রতি আমাদের সবারই ভালোবাসা থাকা উচিত। এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা‍তে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ণ হয়।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.