শিল্পীর সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক চিরকালই খুব ওতপ্রোত। যদিও তা সবসময় দৃশ্যমান নয়। কিংবা শিল্পের বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতার কারণে বহু ক্ষেত্রেই তা প্রত্যক্ষ নয়। কারণ শিল্পের যেমন কোনো সরল পথ নেই, তেমনি তার ভাষার পৃথিবীও এত বহুমাত্রিক যে, কোনো ছাঁচ দিয়ে তাকে আবদ্ধ করার উপায় নেই। কিন্তু শিল্পী যা-ই করেন না কেন, চিরকালই তাকে সমাজের দিকে চোখ তাক করে রাখতে দেখা যায়। এ কথা যেমন প্রাচীন মহাকবি হোমার বা ভার্জিল, গ্রিক নাট্যকারগণ, চর্যাপদের কবিকুল কিংবা ময়মনসিংহ গীতিকার কথাকারদের ক্ষেত্রেও সত্য ছিল, আজ তা আরো বেশি সত্য।
সব কালে, সব বাস্তবতায় সমাজকে অবলম্বন করে, সমাজের সুখ-দুঃখ, জরা, আশা-আকাঙ্ঙক্ষাকে কেন্দ্র করেই শিল্পকলার সকল শাখা তার সুগভীর পথ নির্মাণ করেছে। এবং এসবের স্রষ্টা শিল্পীরা জীবন ও প্রকৃতির যা কিছুকে নিজের অন্তর্গত করে নিয়েছেন, সবকিছুকেই দেখেছেন সমাজের এক-একজন সদস্য হিসেবে, কিংবা সমাজের বহু দৃষ্টি ও স্ব্বর এসে মিলিত হয়েছে তাদের চৈতন্যে। কারণ শিল্পীরা তাদের সমাজেরই জাত এবং মানবীয় অভিজ্ঞতার বাইরে তাদের কোনো বিস্তৃত চিন্তাবিশ্ব নেই। শিল্পীর অন্তরে যত সুগভীর রহস্য থাক কিংবা তাদের সৃষ্টিতে যত বিস্ময়ই থাক, সবই তৈরি হয়ে ওঠে সমাজ বাস্তবতা থেকে।
সুপ্রাচীন কাল থেকে বর্তমানে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমানের মানবীয় উৎকর্ষের যুগে আমরা মানুষের চেতনাপ্রবাহের চিহ্নস্বরূপ যা কিছু শিল্পনির্দশন দেখি (যেমন : চিত্রকলা, স্থাপত্য, কাব্য, কথাসাহিত্য, নাটক, সঙ্গীত প্রভৃতি), আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, সামাজিক ও মানবিক পরিবর্তনের, ধারাবাহিকতার, বিবর্তনের নানা রূপ তাতে কী গভীরভাবে আকীর্ণ হয়ে আছে! মানুষের আনন্দ ও বেদনার, সাধনা ও সংগ্রামের, স্বপ্ন ও সত্যের কী তীব্রতা তাতে ছড়িয়ে আছে! কিন্তু শিল্পী তার সমাজের হুবহু অনুকারক নন কিংবা দৃশ্যমান সমাজকাঠামোই তার সমাজবিশ্ব নয়। কেননা, একই সমাজের রয়েছে বহুমুখী বাঁক, বাস্তবতার আড়ালে অন্তর্বাস্তবতা, আপাত সত্যের আড়ালে গূঢ় সত্য। তাই শিল্পীর সমাজ-ধারণাও সাধারণীকরণের বিষয় নয়। শিল্পীর সমাজ বাস্তবতা সমসাময়িক সমাজ বা দৃশ্যমান সমাজ শুধু নয়, বরং সাধারণ কিংবা আপাত ধারণার বাইরে অন্তর্গত বাস্তবতাবোধে, চেতনাপ্রবাহে, স্বপ্ন-সংগ্রাম-সত্য-বোধ-মনন-রক্ত-মাংসে তার সমাজচেতনা সমুজ্জ্বল। এজন্য সবসময় তা মোটাসোটাভাবে আমাদের সামনে ধরা পড়ে না। কেননা, শিল্পী সমাজের সদস্য হিসেবে এর দর্শকমাত্র নন কেবল, বরং তিনি একাধারে এর গভীর পাঠক, বিশ্লেষক ও বর্ণনাকারী। তিনি তার চেতনায় গ্রহণ করেন এক বিশেষ প্রক্রিয়ায়। এবং তিনি তা ব্যাখ্যা বা বর্ণনাও করেন এক নিজস্ব নিবিড় প্রক্রিয়ায়। তা কখনো কখনো আসে চিহ্ন বা প্রতীকের আবরণে, কোনো সংকেতে বা রূপকে। কখনো অতীতের ছদ্মাবরণে, কখনো ভবিষ্যতের ঘটনা হিসেবে। কারণ শিল্পী একই সঙ্গে স্থানিক ও বৈশ্বিক, অতীত ও ভবিষ্যৎ পাঠক।
কিন্তু তাই বলে শিল্পীর সত্য ধার্মিকের সত্য কিংবা জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী নয়। আবার দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক সত্যও নয়। বরং এসব কিছুর মধ্য দিয়ে এবং ভিন্নতর এক মনীষার মাধ্যমে শিল্পী তার সত্য প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পীকে দেখা যায় সমাজের ভেতরে অবস্থান করেও অন্য এক সমাজ-মানসভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকতে_ একই দেশকাল-সমাজের ভেতর দাঁড়িয়ে থেকেও ভিন্ন এক দেশ-কাল-সমাজে অবস্থান করতে। ফলে শিল্পীর এই পৃথক চেতনা বা মানস এক নিজস্ব অন্তর্কাঠামো তৈরি করে। এভাবেই শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি ও মননবিশ্ব এক পৃথক সত্য সৃষ্টি করে, যাকে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পসত্য বলে অভিহিত করে থাকি।
যদিও শিল্পসত্য অন্যান্য সত্য থেকে পৃথক এবং এর রয়েছে একটি নিজস্ব ধর্ম, তাই বলে এটি আকাশচারী কিংবা বায়বীয় কিছু নয়। এর শেকড়ও প্রোথিত আছে সমাজেরই গভীরে। কারণ শিল্পী এই সত্য লাভ করেন সমাজের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর থেকেই। এর সঙ্গে শিল্পীর ব্যক্তিক ও মানসিক গঠন, তার সময়, নানাবিধ মানসক্রিয়া, বাস্তবতা, আশা-আকাঙ্া, নৈতিকতা, পারিপাশির্্বকতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূগোল ইত্যাদির সংশ্লেষণেই শিল্পীর সত্য ও ধর্ম নিণর্ীত হয়। তাই শিল্পী তার সমাজের ফসল এবং সময়েরই সন্তান। শিল্পী তার সমাজ ও সময়ের যাবতীয় সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, কুসুম ও কেদ, জীবন-মৃতু্য, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন ও সংগ্রামে নিজেকে জারিত করে তার শিল্পজগৎ নির্মাণ করেন। আর এ নির্মাণের ভেতর দিয়েই শিল্পীর সামাজিক দায় বা কর্তব্য চিহি্নত হয়ে থাকে।
২.
একজন শিল্পী সব সময়েই তার সমাজ, মানুষ ও বিশ্বের প্রতি সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায় বহন করেন। কখনো কখনো এই দায় সেই শিল্পীকে তার সমাজ ও সময়ের বিরুদ্ধে তীব্র দ্বন্দ্বে লিপ্ত করে। তার ওপর নেমে আসে অবিচার ও নির্যাতন। সেখানে তার প্রতিপ হিসেবে আসে ঘুণেধরা-কায়েমি সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র, বণিক এবং তাবৎ বিদ্যমান ব্যবস্থা রাকারীর দল। আর মানবতাবাদী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও প্রতিবাদী শিল্পীরা এ ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে চান। কারণ তারা জানেন এইসব ব্যবস্থার ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সময় খুবই কম এসেছে, যে সময় মানুষ সার্বিকভাবে, সত্যিকার অর্থে মহৎভাবে বেঁচেছে। বরং মানুষের ইতিহাস পান্তরে নিরন্তর সংগ্রামেরই ইতিহাস_ অন্যায়, অসত্য, শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা, ুধা, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আত্মপ্রতিষ্ঠার ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাস। আর এ সংগ্রাম যতটা না প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষেরই বিরুদ্ধে_ এক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আরেক শ্রেণীর মানুষের।
এই মানবিক সংগ্রামে শিল্পীকে প্রথমত একজন মানুষ হিসেবে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়; দ্বিতীয়ত, একজন শিল্পী হিসেবে তার ওপর পৃথক দায় অর্পিত হয়। কেননা একজন শিল্পী তার সময়ের সবচেয়ে মেধাবী, সহূদয়, প্রাজ্ঞ, অনুভূতিশীল ও মহৎ গুণসম্পন্ন মানুষের অন্যতম। এজন্যই একজন শিল্পীর মানসে সামাজিক প্রপঞ্চগুলো সবচেয়ে বিশ্বস্তভাবে ধরা দেয়। যুগে যুগে দেখা গেছে, সমাজের আন্তঃকাঠামো_ সামাজিক মানুষের বিভিন্ন আশা-আকাঙ্া, স্বপ্ন ও বাস্তবতা শিল্পীর চোখেই গভীরভাবে প্রতিভাত হয়েছে। এবং এই গভীর-দেখার মতাবলেই শিল্পী সমাজের ত, পচন বা বৈসাদৃশ্যগুলো নিবিড়ভাবে ল করেন, যা থাকে সমাজের আপাত চাকচিক্যের অন্তরালে, খুব গভীরে, উপরিকাঠামোর বিপরীতে একেবারে শেকড়ে প্রোথিত।
যদিও বলা হয় শিল্পী সৌন্দর্যস্রষ্টা এবং আনন্দই তার ভিত্তিভূমি, তবু আনন্দের আড়ালে যে বেদনা, আপাত সঙ্গতির আড়ালে যে অসঙ্গতি তাকেও তিনি খুঁড়ে বের করেন এবং এগুলো তাকে নানাভাবে সংুব্ধ করে। এই সংুব্ধতাই তাকে সত্য প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু তার সত্য অধিকাংশ সময়েই প্রচলিত ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং শাসকশ্রেণীর নীতির বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। কেননা সমাজপতিরা চিরকাল সমাজের উপরিকাঠামোকে মসৃণ রেখে ভেতরের ােভ ও য়, পচন ও ঘা ঢেকে রেখেছে আর শিল্প চিরকালই এর বিপরীতে অবস্থান করে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থেকেছে। এরই ফলস্বরূপ আমরা দেখি মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম কবি দান্তেকে নির্বাসিত করা হয়েছে, লোরকাকে হত্যা করা হয়েছে, নজরুলকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। এমনি করে নানাভাবে বিভিন্ন সময়ে শিল্পীদের ওপর নেমে এসেছে হত্যা-জেল-জুলুমসহ অমানবিক সব নির্যাতন।
শাসকগোষ্ঠী বা ক্ষমতাবান শ্রেণীর শিল্পীদের দাবিয়ে রাখার অপকৌশল এবং এর বিরুদ্ধে তাদের সত্য প্রকাশের অঙ্গীকার_ এ সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবহমান। ফলে শিল্পচর্চার ইতিহাস ও উৎকর্ষ মানুষের প্রগতির ধারাবাহিকতা ও উৎকর্ষেরই সমান্তরাল। আজকের পৃথিবীর যে অগ্রগতি, যে বিকাশ, তার নেপথ্যে সম্ভবত শিল্পেরই অবদান সবচেয়ে বেশি। মানুষের জ্ঞান ও চেতনার বিস্তারে শিল্পের চেয়ে কার্যকর মাধ্যম আজও অনাবিষকৃত। সেই প্রাচীনকাল থেকে শিল্পীরাই ছিলেন চেতনার, মুক্তির, সংগ্রামের, সভ্যতার অগ্রপথিক। আগামী শুভ্র সমুজ্জ্বল দিনের গান তাদের কণ্ঠেই প্রথম ধ্বনিত হয়েছে। শোষণ, নিপীড়ন, বন্দিত্বের শেকল ভেঙে ফেলতে তারাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন। এ জন্যই প্রায় হাজার বছর আগে অভিজাত ব্রহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে চর্যাপদের এক কবিকে নিজের অন্ত্যজ বাঙালিত্বের সদদ্ভ বিজয় ঘোষণা করতে দেখি। টলস্টয়কে দেখি বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার বাস্তবকে সবচে প্রগাঢ়ভাবে তুলে ধরতে (পুনরুজ্জীবন)। হাওয়ার্ড ফাস্টকে দেখি মার্কিন শাসকশ্রেণীর চরিত্রের নিবিড় বিশ্লেষণ করতে (লাস্ট ফ্রন্টিয়ার, লোলা গ্রেগ-এর উপাখ্যান)। এরকম লাখো উদাহরণ ছড়িয়ে আছে হাজার বছরের শিল্প-সাহিত্যে।
প্রকৃত প্রস্তাবে পৃথিবীর সব মহৎ বিপ্লবের নেপথ্যেই শিল্পীরা ছিলেন অগ্রপথিক। ফরাসি বিপ্লবের সাফল্যে শিল্পীদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। রুশ লেখক-শিল্পীরা সমাজের অসাম্য, অবিচার ও তগুলো সঠিকভাবেই চিহি্নত করতে পেরেছিলেন বলেই রুশ বিপ্লব ত্বরান্বিত হয়েছিল। তাছাড়া মানবিক মুক্তির প্রশ্নে শিল্পীদের অধিকাংশেরই মহৎ মানবিক ভূমিকা রয়েছে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে পৃথিবীর অধিকাংশ লেখক-শিল্পীই নৈতিকভাবে ফ্যাসিস্তবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, আমাদের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শিল্প-সাহিত্যিকদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। আজও যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দেশে দেশে অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, তখন তার আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে পৃথিবীর সব বিবেকবান শিল্পীই সোচ্চার।
৩.
যে কোনো শিল্পীর প্রথম দায় নিঃসন্দেহে শিল্পের প্রতি তার গভীর নিষ্ঠা, শিল্পের উৎকর্ষ ও এর বিকাশে গভীর সাধনা। কিন্তু একজন সামাজিক জীব হিসেবে, উন্নত মনোজগতের অধিকারী এবং সময়ের সচেতন ও মেধাবী মানুষ হিসেবে তার ওপর বিশেষ সামাজিক দায় অর্পিত হয়। সত্যিকার অর্থে একজন শিল্পী অধিকাংশ সময়েই তার সময় ও সমাজের বিবেক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যদিও কখনো কখনো এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি সমাজের দ্বারাই আক্রান্ত হন, তবু তার বিবেক ও নীতিবোধ তাকে সত্যের পথেই পরিচালনা করে। এর বড় উদাহরণ আমাদেরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি প্রচল মতের বিরোধিতা করতে গিয়ে কম সমালোচিত হননি। কিন্তু মানুষ স্বভাবগতভাবেই বহু অঘটনঘটনপটিয়সী। সে যেমন ভালো করে, মন্দও কিছু কম করে না। তার মস্তিষ্কের ভেতর আছে বহু বিধ্বংসী উপাদান। তাই ধ্বংস ও নির্মাণ, সৃষ্টি ও বিনাশ এবং উত্তম ও অধম একই সঙ্গে তার মধ্যে অবস্থান করে। মানুষ হিসেবে শিল্পীও এর বাইরে নন। এজন্য শিল্পীর সামাজিক দায়ের এ প্রক্রিয়ায় রয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলতা, সুবিধাবাদ, ব্যক্তিস্বার্থ, আপসকামিতা এবং অনেকেই তাদের আদর্শ থেকে বিচু্যত হয়ে বিভ্রান্তি বা সুবিধাবাদের দিকে চালিত হন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় কিংবা বর্তমানেও এ দৃষ্টান্ত অজস্র রয়েছে যে, একজন মহৎ শিল্পী তার ন্যায় ও সঠিক দায়িত্ব পালনে কুণ্ঠিত নন, বরং তার আদর্শের জন্য সক্রেটিসের মতো হলাহল পান করতেও তিনি প্রস্তুত।
৪.
শিল্পীর সামাজিক দায়ের বিষয়টি আপেকি ও বহুমাত্রিক। সমাজ ও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণাটিরও রূপান্তর ঘটে। একশ বছর আগে শিল্পীর যে দায় ছিল বর্তমানে তা ভিন্নমাত্রায় বিদ্যমান। আবার একই সময়ে বিভিন্ন দেশে তা বিভিন্ন রকম। কেননা, এর সঙ্গে আর্থ-সামাজিক, রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক ও অধিকারগত স্বাধীনতার প্রশ্নটি গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। তাছাড়া শিল্পীর ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রেণীগত পার্থক্যের কারণে একই সমাজে, একই সময়ে তা বিভিন্ন রকম হতে পারে। কিন্তু ধারণাগত পার্থক্য যা-ই থাক, মৌলিক উদ্দেশ্য প্রায় এক এবং চিরায়ত। আর তা হচ্ছে সুন্দর, সত্যনিষ্ঠ, ুধা-দারিদ্র্য-শোষণমুক্ত, সাম্য ও কল্যাণময় এক বিশ্ব নির্মাণ। আবহমানকাল ধরে মানুষ এই স্বপ্নের দিকেই ধাবিত হচ্ছে- এই স্বপ্নের জন্য আত্মাহুতি দিচ্ছে_ এই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার জন্য অনাগত ভবিষ্যতের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে।
বর্তমান তথাকথিত গণতন্ত্র ও যান্ত্রিক প্রগতির যুগে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের সদস্য হিসেবে আমাদের শিল্পীদেরও বিশেষ দায় বিদ্যমান। আমাদের সমাজ আজো বন্দি হয়ে আছে রথের চাকায়, অথচ পৃথিবীর গতি ধাবমান সুদূর মহাবিশ্বের দিকে।
ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য, অশিা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বন্ধ্যত্ম, শোষণ, আগ্রাসন, আত্মপ্রবঞ্চনা আমাদের সমাজে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। অন্যদিকে কথিত বিশ্বায়ন বা ভুবনীকরণ এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা, জাতীয়তাবোধ ও স্ব্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠাকে বিলুপ্ত করতে বদ্ধপরিকর। যদিও উপনিবেশের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে আমরা নিজেদের স্বাধীন বলে মনে করছি, তবু নির্মম সত্য এই যে, দৃশ্যমান উপনিবেশবাদী শক্তির চেয়েও নির্মম ও ভয়াবহ নব্য উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী অদৃশ্য শক্তি আজ আমাদের তার শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি করে ফেলেছে। সাম্রাজ্যবাদের পুঁজি, প্রচার মাধ্যম, অবাধ বাণিজ্য, সামরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মতা, সাহায্য কৌশল এবং দেশীয় লুটেরাদের দ্বারা পরিচালিত শোষণ প্রক্রিয়া খুবই সূক্ষ্ম এবং আশ্চর্য মতাসম্পন্ন। আর এ প্রক্রিয়াকে এমনই মানবিক গুণসম্পন্ন বলে প্রতীয়মান করানো হচ্ছে যে, এর বিরোধিতা করা যেন তথাকথিত গণতন্ত্র বা প্রগতিরই বিরুদ্ধতা।
অথচ এর উপরিতলের আবরণ খুলে ফেললে দেখা যাবে, আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, যুদ্ধ-হত্যা-মৃতু্য-আগ্রাসন ও রক্তাক্ততার কদর্য ইতিহাস। বিশ্বময় এক ভয়াল দানবের বিকট মূর্তি। আর এসবের বীভৎস রূপ দেখেই হয়তো কানকুন সম্মেলনে কোরিয়ার এক সরল কৃষককে নিজের পেট ফেঁড়ে ফেলে নিজেকেই হত্যা করে ফেলতে দেখি। লোলজিব দানবের ভয়াল আক্রমণ আজ সমগ্র পৃথিবীকে এক ত্রাসের রাজ্যে পরিণত করেছে। পৃথিবীর কোটি কোটি জনতা, শ্রমিক, কৃষক, নারী, শিশু আজ ুধা, রোগ, শোক, বঞ্চনা ও দারিদ্র্যে লাঞ্ছিত। পৃথিবী যেন আজ অনেকটা এগিয়ে এসে আবার পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। আর তাই একজন শিল্পীর এখন আরো কঠিন দায় উপস্থিত হয়েছে। কেননা এই সূক্ষ্ম চোরাপথগুলো অতিক্রম করার জন্য তারও দরকার আরো সূক্ষ্মতম মনীষা, চেতনার নতুন বিন্যাস। এখন তার শত্রু বাইরের চেয়ে ভেতরেই বেশি এবং লড়াইটা তাকে চালাতে হবে নিজের বিরুদ্ধেই। লড়াইটা যদিও এখন পর্যন্ত আত্মিক কিংবা ব্যক্তিগত, ভবিষ্যতে হয়তো তা দরকার হবে সামগ্রিকভাবেই। কেননা, নতুন পৃথিবী নির্মাণের কঠিন দায়িত্ব পৃথিবী আবার যেন শিল্পীদের কাঁধেই অর্পণ করেছে। তার যথাযথ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই নির্ণীত হবে আগামীর পৃথিবী।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
প্রবীর পাল - ৩ নভেম্বর ২০০৮ (৪:৫১ পূর্বাহ্ণ)
“যারা বন্দুক হাতে নিয়েছেন তাদের পাশে আমার থাকা উচিত। কিন্তু বন্দুকের জন্য আমি ক্যামেরা ছেড়ে দিতে রাজী নই। আমি মনে করি শিল্প এক বিশেষ বন্দুক। সব আইডিয়াও বন্দুক। অনেক লোকই আইডিয়া থেকে এবং আইডিয়ার জন্যই মারা যাচ্ছেন। আমি মনে করি বন্দুক হল কার্যকর আইডিয়া এবং একটি আইডিয়া হল তাত্ত্বিক বন্দুক। চলচ্চিত্র হল এক তাত্ত্বিক বন্দুক এবং বন্দুক হল এক কার্যকর ছবি।” : জঁ-লুক গদার
সৈকত হাবিব - ৬ নভেম্বর ২০০৮ (১০:৪১ পূর্বাহ্ণ)
প্রিয় প্রবীর, অনেক ধন্যবাদ। বেশ কদিন পর ব্লগ খুলে আপনার মন্তব্যটি পড়লাম। ভালো লাগল। এ নিয়ে একটি বিস্তারিত লেখা পোস্ট করুন না, কারণ বিষয়টা অনেক কথা দাবি করছে। আমাদেরও কিছু উপকার হবে।
আজ দেখি ব্লগটাকে বেশ ফ্রেশ ও স্বচ্ছ লাগছে। আগের চেয়ে অনেক আরাম পাচ্ছি। এজন্য নিশ্চয়ই সুমন আর নির্মাণ-বাহিনীকে বড়-সড় একটা থ্যাংকু দেওয়া উচিত।
ভালো থাকবেন।