"পাকিস্তানে কোথাও সমন্বিত চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নেই": মেহরিন জব্বার

মেহরিন জব্বার একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা। নিয়মিত টেলিফিল্ম পরিচালনা করছেন। হংকং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, সান ফ্রান্সিসকো এশীয়-মার্কিন চলচ্চিত্র উৎসব, ইংল্যান্ডের লিডস্ চলচ্চিত্র উৎসব সহ বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। নতুন ধারায় গল্প বলার নিজস্ব ধরন পাকিস্তানে তাঁকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করেছে এবং অনেক পুরস্কার এনে দিয়েছে। পাকিস্তানের নারীদের প্রাত্যহিক জীবন এবং দ্বন্দ্ব চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর চলচ্চিত্রে এবং নাটকে। ‘জজবাহ ম্যাগাজিন’-এর জন্য মেহরিন জব্বারের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন লায়লা কাজমি। সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশের বাংলা রূপান্তর :

. . .

জজবাহ : আপনার নির্মিত প্রথম নাটক কোনটি?

মেহরিন : আমি প্রথম নাটক নির্মাণ করি ১৯৯৪ সালে। ইসমত চুগতাই-এর গল্প অবলম্বনে তৈরি এ নাটকটির নাম ছিল ‘নিওয়ালা’ (‘গ্রাস’)। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বিশেষ নীতির কারণে এ নাটকটি তারা সম্প্রচার করেনি। আমার মনে হয়, ভারতীয় কোনো লেখককে তারা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার সুযোগ দিতে তখন প্রস্তুত ছিল না। কয়েক বছর পর এ নাটকটি একটি প্রাইভেট চ্যানেলে দেখানো হয়।

জজবাহ : আপনার নাটক এবং চলচ্চিত্রে কী ধরনের বিষয় দেখাতে চেষ্টা করেন?

মেহরিন : সত্যি কথা বলতে কি, আমি বিষয় নিয়ে ভাবি না। আমি জোর দিই গল্পের উপর। পারিবারিক জীবনে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব কিংবা দুজন মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব — এ রকম ছোটখাটো যে বিষয়গুলো আমাকে ভাবায়, আমি সেগুলোই পর্দাতে দেখাতে চাই।

জজবাহ : অভিনয়ের প্রতি কি আপনার কখনো আগ্রহ ছিল? অভিনয়ের চেয়ে পরিচালনাতেই আপনি বেশি আনন্দ পান কেন?

মেহরিন: না, অভিনয়ের প্রতি আমার কখনোই কোনো আগ্রহ ছিল না। এটি খুবই কঠিন কাজ আর আমার পক্ষে সম্ভবও না। পরিচালনাতেই আমি স্বচ্ছন্দ। এর মাধ্যমেই আমি আমার মতো করে গল্পগুলো দেখাতে পারি। পরিচালনা হচ্ছে কোনো কিছু জন্ম দেওয়া, কোনো কিছু সৃষ্টি করার মতো ব্যাপার। চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্যামেরা, ক্রু সবার সমন্বয়ে এই যে একটা সম্পূর্ণ জিনিস তৈরি হচ্ছে এটা দেখার আনন্দ অন্য কোনো কিছু দিয়ে ভরানো যাবে না।

জজবাহ : আপনি কি নিজের নাটকগুলো নিজেই লিখেন?

মেহরিন : নাটকগুলো আমি নিজে লিখি না, কিন্তু লেখকদের সাথে বসে এক সাথে কাজ করি। আমরা একটা গল্প ঠিক করি, কখনো লেখকদের কাছ থেকে গল্পটা আসে, আবার কখনো আমি তাদেরকে গল্পের যোগান দিই। তারপর আমি তাদের সঙ্গে বসি, তারা লেখে। এভাবে আমরা পুরো চিত্রনাট্য শুরু থেকে শেষ করি। মিলেমিশে একটা পরিণতি দেওয়ার চেষ্ট করি। আসলে এটি একটি যৌথ প্রক্রিয়া।

জজবাহ : আমরা জানি, আপনি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানান। পাকিস্তান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে কি আপনার?

মেহরিন : না, লাহোর কেন্দ্রিক যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়েছে সেখানে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা আমার নেই। আমরা স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটা দল ‘কারা চলচ্চিত্র উৎসব’ শুরু করেছি। এটিই পাকিস্তানের একমাত্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। প্রযোজক এবং পরিচালকদের চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহিত করার জন্য এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এ উৎসবের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ছবি এবং নির্মাতাদের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটছে পাকিস্তানের দর্শকদের।

জজবাহ : পাকিস্তান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অবনতির পেছনে কী কারণ আছে বলে আপনার মনে হয়?

মেহরিন : অনেক কারণ।

জজবাহ : অর্থের অভাব? না কি অন্যকিছু?

মেহরিন : আসলে ইন্ডাস্ট্রিতে যারা যুক্ত হয়েছে তারা কেউ প্রকৃত কারণে যুক্ত হয়নি। সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের ক্রম অবনতি শুরু হয়েছে। তখন থেকে গুটি কয়েকটি ছবি বাদ দিলে অধিকাংশ ছবিই নির্মিত হয়েছে কল্পনাশক্তিহীন মাঝারি মানের পরিচালকদের হাতে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি অনেকটা ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে।

জজবাহ : পাকিস্তান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির উন্নতির জন্য কী করা যেতে পারে? ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে বিভিন্নভাবে সমর্থন দানের জন্য সরকারের কি কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত?

মেহরিন : পাকিস্তান সরকার ‘বিনোদন কর’ প্রত্যাহার করে নিয়েছে, এতে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেকটা সহায়তা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে কোনো চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠান নেই, যেমন, পাকিস্তানে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে গিয়ে আপনি চলচ্চিত্রের উপর শিক্ষা লাভ করতে পারবেন। চলচ্চিত্রের মতো কোনো কিছু যদি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, শিল্পে পরিণত না হয়, তাহলে একে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে না। সরকার স্কুল কলেজগুলোতে চলচ্চিত্র এবং মিডিয়াকে পাঠ্য বিষয় হিসেবে প্রচলন করতে পারে। সবাই চাকরি লাভের জন্য লেখাপড়া করে, এই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা।

জজবাহ : অভিনয় নিয়ে পড়াশোনার জন্যও পাকিস্তানে কোনো স্কুল নেই?

মেহরিন : চলচ্চিত্রের সাথে সম্পর্কিত কোনো স্কুল নেই এখানে। করাচি ইউনিভার্সিটি, ইন্ডাস ভ্যালি স্কুল অব আর্কিটেকচার, ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টস — এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছোটখাটো কিছু প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু এগুলো খুবই সামান্য আর এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষা লাভ করার মতো সামর্থ্যও সবার নেই। পাকিস্তানে কোথাও সমন্বিত চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নেই। অভিনয়, চিত্রনাট্য রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা — কোনো কিছুর জন্যই কোনো প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই।

জজবাহ : আপনি কি মনে করেন, যদি স্কুল চালু হয় তাহলে লোকজন আগ্রহী হবে?

মেহরিন : অবশ্যই। প্রচুর আগ্রহী লোকজন আছে, কিন্তু তারা জানে না কোথায় যেতে হবে, তারপর কী করতে হবে। প্রযোজনা-প্রতিষ্ঠান এবং প্রাইভেট চ্যানেলগুলোতে সবার যোগাযোগ থাকে না আর সেসব জায়গাতে গিয়ে সবার পক্ষে প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভবও না। আর এ কারণেই সমাজের সব শাখার লোকজনের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আমরা তাদের পাই না। এতে করে প্রতিভা উঠে আসছে না।

জজবাহ : আপনার ছবি ‘বিউটি পার্লার’ সম্প্রতি নিউইয়র্কে প্রদর্শিত হয়েছে, এছাড়াও আমাদের জানামতে এটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে। এ ছবি সম্পর্কে কিছু বলুন।

মেহরিন : এটি বিশ মিনিটের একটি চলচ্চিত্র। চারটি চরিত্র রয়েছে এতে, এদের একটি সেলুনের ভিতর দেখতে পাব। তাদের জীবনের সামান্য কিছু মুহূর্ত আমরা দেখতে পাব। দুই বন্ধু, এক কনে যে তার বিয়ের ম্যাক-আপ নিচ্ছে, একজন যৌনকর্মী প্রসাধন নিতে ব্যস্ত আর সেলুনে কর্মরত একজন হিজড়াকেও দেখা যাবে। এটি আসলে আত্মপরিচয় আর কামনা এ বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে।

জজবাহ : আপনি কি পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন?

মেহরিন : আমি পরিবার থেকে অবিশ্বাস্য রকম সহযোগিতা পেয়েছি।

জজবাহ : আমরা শুনেছি, সমপ্রতি পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল ‘এমএমএ’ এর নেতৃবৃন্দ পেশওয়ার শহরে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছেন বা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। যেসব নেতৃবৃন্দ এবং যুবক সত্যিই বিশ্বাস করে যে সঙ্গীত আর চলচ্চিত্র ইসলাম বিরোধী — তাদের সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?

মেহরিন : আমি তাদের বলব সঠিকভাবে এবং বুদ্ধিবিবেক খাটিয়ে কোরান পড়ার জন্য, কারণ তারা যা বলে তা কোরানে নেই। তাদেরটা সঙ্কীর্ণ এবং একপক্ষীয় ব্যাখ্যা। একবিংশ শতকের আলোকে কোরানকে সঠিকভাবে পড়ার এবং ব্যাখ্যা করার কোনো প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে নেই। ইসলাম একটি প্রগতিশীল ধর্ম। কিন্তু যারা মনে করে তাদের ব্যাখ্যাই একমাত্র সঠিক এবং সত্য, তারা এ ধর্মটিকে লুণ্ঠন করছে।

জজবাহ : আমাদেরকে কথা বলার সময় এবং সুযোগ দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মেহরিন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

সাইদুল ইসলাম

জন্ম : ১৮ আগস্ট ১৯৭৭। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ইংরেজি সাহিত্যে। কবি। কাব্যগ্রন্থ : অনন্তর জেগে থাকে দীঘল পিপাসা; আহত চড়ুই। সম্পাদক : ফলক; চর্যাপদ। সংগীত ও চলচ্চিত্র মাধ্যমে আগ্রহী।

২ comments

  1. অলকেশ - ১৮ অক্টোবর ২০০৮ (৩:৩০ অপরাহ্ণ)

    মনে হচ্ছিল যেন মেহরিন বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছিলেন, বিশেষ করে এই লাইনগুলিঃ

    কয়েকটি ছবি বাদ দিলে অধিকাংশ ছবিই নির্মিত হয়েছে কল্পনাশক্তিহীন মাঝারি মানের পরিচালকদের হাতে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি অনেকটা ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে।

    আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ব্লগে এই বিষয়টি তুলে আনার জন্য।

  2. সায়মা সুলতানা - ১৮ অক্টোবর ২০০৮ (৪:৫৮ অপরাহ্ণ)

    এ নাটকটির নাম ছিল ‘নিওয়ালা’ (’গ্রাস’)। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বিশেষ নীতির কারণে এ নাটকটি তারা সম্প্রচার করেনি।

    এই রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের নীতিমালা বানান যারা, তারা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জেনারেল এবং ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক-মোল্লাদের প্রতিনিধি এবং ভৃত্য। রাতে এরা নিজেদের বাসায় বোম্বাইয়া ফিল্মের নায়িকাদের মনোহারী দৈহিক কসরত দেখেন, দিনের বেলায় ইসলাম ধবংসকারীদের খুঁজেন। নিজেকে এরা নিজেই খুঁজে বেড়ান।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.