আজ হিরোশিমা দিবস। ৬৯ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই দিনে আমেরিকানরা জাপানের হিরোশিমা শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল একটা পুরো জনপদ। তার কিছু দিন পর নাগাসাকি শহরেও একই আক্রমণের পুনরাবৃত্তি করা হয়। নির্বিচার এই হত্যাযজ্ঞ নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক অপরাধের আওতায় পড়ে, নানান অজুহাতে যার কোনো বিচার হয়নি।
যে-কোনো বিচারহীনতাই মানুষের এই সভ্যতাকে পিছিয়ে দেয়; হিরোশিমা-নাগাসাকি তার ব্যতিক্রম হবে কেন? আমরা যখন চার দশক আগে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার চাই, তা তো এই বোধ থেকেই চাই।
বিচার যে একেবারেই হয়নি তা কিন্তু নয়। বিচার হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাজি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল যখন শুরু হয়, প্রায় কাছাকাছি সময়ে জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যও টোকিও ট্রায়াল শুরু হয়েছিল (http://bit.ly/1p9Z7Cq)। সেই বিচার সভায় বাঙালী একজন বিচারপতিও ছিলেন, নাম জাস্টিস রাধাবিনোদ পাল (১৮৮৬–১৯৬৭); কুষ্টিয়ায় জন্ম তাঁর (http://bit.ly/1qWCmEP)। হিরোশিমা-নাগাসাকি ইস্যু এবং অন্য আরও কয়েকটি ঘটনার জন্য তিনি মনে করতেন নাজি-জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের বহু মানুষেরও বিচার হওয়া উচিত ছিল। তিনি মনে করতেন বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে যদি সত্যিই মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে তেমনভাবেই তা করা উচিত ছিল। এই কথাগুলো নির্ভীক এই বিচারক টোকিও ট্রায়ালে তার বিশ্ববিখ্যাত সে রায়েও উল্লেখ করেছিলেন, এমনকি বাকি বিচারকদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেই।
তাঁর এই অবস্থানের জন্য জাস্টিস রাধাবিনোদ পাল ব্যাপক সমালোচিতও হয়েছিলেন সে-সময়। অনেক বিতর্কও হয়েছে তাঁকে নিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেরকার বিশ্ব পরিস্থিতিতে, সহকর্মী সব জাঁদরেল বিচারকদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার এই নির্ভীক চর্চা কোনো সহজ কাজ ছিল না। কয়েক দশক লেগেছে রাধাবিনোদ পালের এই বিচারিক সততার দেশ-কাল নিরপেক্ষ যথার্থ মূল্যায়ন হতে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির নিরসনে যে নির্ভীক নামগুলো আজকাল আমরা স্মরণ করি, তাঁদের মধ্যে জাস্টিস রাধাবিনোদ পালের নাম অন্যতম।
কোনো দিন যদি জাপানের কিয়োতো শহরে যান কেউ, তাহলে সেখানকার ‘কিয়োতো রিয়োজেন গোকুকু’ মন্দিরটিতে ঘুরে আসতে ভুলবেন না। এই পুরো সমাধি এবং মন্দির চত্বরটিই জাপানের শ্রেষ্ঠতম মহানায়কদের সম্মানে এবং স্মরণে (http://bit.ly/1tWebqk)। সেখানে আমাদের জাস্টিস রাধাবিনোদ পালের সম্মানে একটি মনুমেন্ট রয়েছে।
কয়েক মুহূর্ত ব্যয় করে এই অসাধারণ মানুষটিকে সম্মান জানিয়ে আসবেন অবশ্যই।
রায়হান রশিদ
জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৫ comments
মাসুদ করিম - ৭ আগস্ট ২০১৪ (৩:১০ অপরাহ্ণ)
এমন বাঙালিদের কথা পড়লেই আনন্দ হয় এমন বাঙালির কথা পড়লেই নিজেদের আরো আন্তর্জাতিকতায় নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।
রায়হান রশিদ - ৭ আগস্ট ২০১৪ (৭:৩৩ অপরাহ্ণ)
সত্যিই, মাসুদ ভাই। এমন সাহসী বিচারকরা কিংবদন্তীর মতো। অনুপ্রেরণা তো বটেই।
মোঃ আনোয়ার হোসেন - ১২ আগস্ট ২০১৪ (১১:৫৭ অপরাহ্ণ)
টোকিও ট্রায়ালে বাঙ্গালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের অংশগ্রহণের কথা জানতাম। তাঁর নির্ভীক নীতিনিষ্ঠতার কথাও শুনেছি। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত আমি কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পি-এইচ ডি গবেষণায় রত ছিলাম। আহা! ‘কিয়োতো রিয়োজেন গোকুকু’ মন্দির এবং সেখানে জাস্টিস রাধাবিনোদ পালের সম্মানে একটি মনুমেন্ট রয়েছে জানা থাকলে অবশ্যই তা দেখতে জেতাম। অধ্যাপক কোজি আসাদা (আমার তত্তাবধায়ক) এবং আমার জাপানী বন্ধুরাও যেতেন। এই সময়ে খুবই প্রয়োজনীয় এ লেখাটির জন্য রায়হান রশিদ আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
মোঃ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রায়হান রশিদ - ৩১ আগস্ট ২০১৪ (৫:৪৭ অপরাহ্ণ)
অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। আমি শুনেছি বিচারপতি রাধাবিনোদ নাকি জাপানের শিক্ষিত মহলে বেশ আলোচিত একজন মানুষ। আপনার অভিজ্ঞতার কথা যদি কোনদিন সবিস্তারে শেয়ার করেন তাহলে আরেকটু জানার সুযোগ তৈরী হয়।
আরাফাত রহমান - ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ (৯:০৬ পূর্বাহ্ণ)
বাঙালি এমনি হওয়া দরকার… আমাদের দেশে বর্তমানে এমন বিচার পতির দরকার ছিল !
বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল সম্পর্কে জানতাম না, জেনে ভাল লাগল – ধন্যবাদ