১৯৭১ সালের অপরাধসমূহের যে বিচার প্রক্রিয়া তার বিরুদ্ধে আরেকটি অপ-প্রচার হল – এই প্রক্রিয়াটি নাকি একপেশে কারণ এতে নাকি জামায়াত-বিএনপি’র অপরাধীদেরই কেবল বিচার করা হবে, বা বিচার করা যাবে। কারণ, অপ-প্রচারকারীদের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধকালে যদি মুক্তিযোদ্ধারা কোনো অপরাধও করে থাকেন সে সবের কখনোই তদন্ত বা বিচারের সুযোগ নেই, কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আইন করে সকল এবং সব ধরণের অপরাধকর্মের দায় থেকেই নাকি ‘ইনডেমনিটি’ দেয়া হয়েছিল। এখানে যে বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে সেটা হল – মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাও মুক্তিযুদ্ধের বৈধ (legitimate) কর্মকান্ডের বাইরে গিয়ে কোনো ধরণের যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল কি করেনি সেটা কিন্তু এখানে বিষয় না, কারণ সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এই অপ-প্রচারকারীদের মূল লক্ষ্য হল বিশ্বকে এটা দেখানো যে – এই বিচার প্রক্রিয়াটি একপেশে এবং একচোখা, এবং সেই সাথে এ-ও দেখানোর চেষ্টা করা যে এই পুরো প্রক্রিয়াটিই হল বিজয়ী পক্ষের লেখা ইতিহাসের ভিত্তিতে বিজয়ী পক্ষের বিচার। প্রকৃত ঘটনা, এবং যে ‘ইনডেমনিটি’ আইনটি নিয়ে এতো কান্ড – তার ব্যাপ্তি এবং প্রয়োগ কিন্তু একেবারেই আলাদা।
দেখা যাক আসলে ঠিক কি ঘটেছিল, আর কি ছিল সেই আইনে যা নিয়ে এতো অপ-প্রচার।
মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পর পরই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি বিশেষ দায়মুক্তি আইন প্রণীত হয়েছিল, যেটা নিয়ে বেশ কিছু বিভ্রান্তি প্রায়ই চোখে পড়ে। আইনটির পুরো নাম – The Bangladesh National Liberation Struggle (Indemnity) Order 1973 (P.O. No. 16 of 1973)। ১৯৭৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী তারিখে প্রণীত এই আইনটিকে ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ পর্যন্ত পুরো সময়টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য করা হয়েছিল। একটা আইনকে বুঝতে হলে, সেটার উদ্দেশ্য এবং প্রয়োগের ব্যাপ্তি বুঝতে হলে, সবার আগে বোঝা দরকার আইনটির পটভূমি এবং প্রয়োজনীয়তা। সেটা বিবেচনায় না আনলে আমরা আইনটির শিরোনামে স্রেফ “ইনডেমনিটি” শব্দটি দেখেই আঁতকে উঠে বিভ্রান্ত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। এই বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করতেই এই অণুব্লগটি লেখা।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রণীত এই বিশেষ দায়মুক্তি আইনটি আসলে ছিল ভিন্ন কিছু। সেখানে কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ বা কোনো ধরণের গুরুতর অপরাধের থেকেই কাউকে দায়মুক্তি দেয়া হয়নি, সে যে-ই হোক না কেন। যে অর্থে এই আইনে ‘দায়মুক্তি’ দেয়া হয়েছে তা কেবল মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে সংঘটিত কাজগুলোর ক্ষেত্রে কিংবা এ জাতীয় অন্যান্য আইন ভঙ্গের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এবং এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আরেকটু খুলে বলি।
যেটা বুঝতে হবে সেটা হল – ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। (তারিখটির আইনগত এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য্যের বিষয়ে আরও জানতে এই পোস্টটি পড়ুন)। তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনের প্রয়োজনে যে সব ব্রীজ উড়িয়েছেন, পাওয়ার স্টেশন উড়িয়েছেন, সেগুলো তাহলে কোন্ রাষ্ট্রের সম্পত্তি ছিল? সেগুলো ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে, বাংলাদেশের আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের প্রয়োজনে কখনো কখনো ধ্বংস করতে হয়েছিল, যাতে দ্রুত শত্রুমুক্ত করা যায় দেশ। আরও আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বহু সরকারী এবং সামরিক কর্মচারী-কর্মকর্তারা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কিংবা যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রয়োজনে এমন অনেক কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সময়ের ডাকে যা অন্য যে কোনো পরিস্থিতিতে চাকুরীর শর্ত বিরোধী কাজ বলে গণ্য হতে পারতো, কিংবা রাষ্ট্রদোহিতামূলক কাজ বলেও গণ্য হতে পারতো, যেমন: বাংলাদেশী কূটনীতিকদের পাকিস্তানী মিশন ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরী, বিভিন্ন ছোটো বড় সামরিক অফিসারের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। এই দু’টো উদাহরণের বাইরেও আরও উদাহরণ রয়েছে এবং এ জাতীয় প্রয়োজনীয়তাগুলোর বিবেচনা থেকেই মূলতঃ আইনটির প্রণয়ন।
সাধারণ আইনে এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা, বা সরকারী/সামরিক চাকুরীর শর্ত ভঙ্গ করা তো অপরাধমূলক কাজই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি মৃত্যুদন্ডযোগ্যও ছিল সে সব অপরাধ। একারণেই মুক্তিযুদ্ধের পর পরই এই দায়মুক্তি আইনের প্রয়োজন হয়েছিল, যাতে ভবিষ্যতে কোনো ধরণের আইনগত জটিলতা না তৈরী হয়।
এখানে আরও যে বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে সেটা হল – এই দায়মুক্তির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অপারেশন এবং প্রয়োজনীয়তা বহির্ভুত বা সামরিক প্রয়োজন (military necessity) বহির্ভুত কোনো ধরণের অপরাধমূলক কাজকেই কিন্তু বৈধতা দেয়া হয়নি। যেমন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধার জনসমক্ষে বিচারবহির্ভুতভাবে রাজাকার নিধন এই দায়মুক্তির আওতায় পড়বে না, এবং তা এখনও বিচার ও শাস্তিযোগ্য।
এই সাধারণ বিষয়টা আমাদের সবার খুব ভালোভাবে জানা থাকা দরকার। কারণ, ১৯৭১ সালের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট আসামী পক্ষের মানুষজন দেশে এবং বিদেশে ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে আসছে শুরু থেকেই। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের দায়মুক্তির এই আইনকে পরবর্তীকালের অন্যান্য দায়মুক্তি আইনের (যেমন: ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি আইন, ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিন হার্টের পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া দায়মুক্তি) সাথে আমরা যেন মিলিয়ে না ফেলি। কারণ, ১৯৭৫ কিংবা ২০০২ সালে যে ধরণের ইনডেমনিটি আইনের মাধ্যমে দেয়া হয়েছিল তা হল, প্রথমটির ক্ষেত্রে – আত্মস্বীকৃত কিছু অপরাধীর গুরুতর অপরাধকে দায়মুক্তি দিতে, পরেরটির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে অর্ধশতাধিক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকে আইনের হাত থেকে সুরক্ষা দিতে। ১৯৭৩ সালের ইনডেমনিটি আইনটি তাই নৈতিকতা এবং পলিসি দুই অর্থেই অন্য ইনডেমনিটি আইনগুলোর থেকে আলাদা। আরেকটু খুলে বলি কিভাবে সেটা আলাদা।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশ এক চরম মূল্য দিয়েছে। সে সময় পাকিস্তান বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী-রাজাকার-আলবদর-আল-শামসরা দেশব্যাপী চালিয়েছে যাবতীয় ধরণের গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ, এবং যুদ্ধাপরাধের তান্ডব। তাই দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই গত ৪১ বছর ধরে পুরো জাতি সেই সব অপরাধের বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। এর সাথে জড়িত যে মূল্যবোধগুলোকে সেই শুরু থেকে পুরো জাতি বহন করে চলেছে তার অন্যতম হল বিচারহীনতার সংস্কৃতির সমূল উৎপাটন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। এমন মূল্যবোধ যে জাতি ধারণ করে বা করতে চায়, তার সাথে ১৯৭৩ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি সাংঘর্ষিক নয়, কারণ, এখানে এই নির্দিষ্ট দায়মুক্তিটির পটভূমি, ব্যাপ্তি, উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজন পরবর্তীকালের ন্যাক্কারজনক ইনডেমনিটিগুলোর প্রতিটি থেকে গুণগতভাবেই সম্পূর্ণ আলাদা।
রায়হান রশিদ
জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
রণদীপম বসু - ৭ আগস্ট ২০১২ (১১:২০ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ রায়হান ভাই। এ বিষয়ক লেখা ধারাবাহিক চলুক…