বর্তমানে বাংলাদেশে ১৯৭১ এ সংঘটিত অপরাধের যে বিচার চলছে তাকে অনেকেই “মানবতাবিরোধী অপরাধ” এর বিচার হিসেবে বর্ণনা করেন। অতীতে বিষয়টিকে “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার” বলেও বর্ণনা করা হতো। বর্তমানে যে বিচার চলছে তাকে বোঝাতে টার্ম হিসেবে দু’টোর কোনোটিই সঠিক নয়।
বাংলাদেশে এখন “মানবতাবিরোধী অপরাধ” এর বিচার হচ্ছে না, ট্রাইবুনালটিও “মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রাইবুনাল” না। হচ্ছে “আন্তর্জাতিক অপরাধ” এর বিচার, এবং ট্রাইবুনালের নাম “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল”।
মন্ত্রীরা এবং অন্যান্যরা এই বিচারকে সেই শুরু থেকে “মানবতাবিরোধী অপরাধ” এর বিচার হিসেবে অভিহিত করে যাচ্ছেন, সেখান থেকেই আসলে বিভ্রান্তির সূচনা। যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যাসহ যে কয়েক ধরণের অপরাধের বিচার হচ্ছে, তার মধ্যে “মানবতাবিরোধী অপরাধ” হল মাত্র এক জাতীয় অপরাধ – আর বিচার্য এই সব ধরণের অপরাধকে এক কথায় বলা হয় “আন্তর্জাতিক অপরাধ”। শুধু “মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার” বা “যুদ্ধাপরাধের বিচার” বললে পুরো প্রক্রিয়াটির ব্যাপ্তিকেই ধারণ না করে একে অনেক বেশী সংকীর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়ে যায়।
তাই বিচার সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনা এবং ডিসকোর্সে যতোটা সম্ভব সঠিক টার্মগুলো ব্যবহার করাটাই হয়তো উচিত হবে আমাদের।
যে সব অপরাধের বিচার চলছে সেগুলোকে এক কথায় বর্ণনা করতে হলে বলতে হবে – “আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার”। আর যে আদালতে বিচার চলছে সেটাকে বলতে হবে – “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল”।
অপরাধ তো হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে, বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে, তাহলে এগুলোকে “আন্তর্জাতিক অপরাধ” বলা হচ্ছে কেন?
বলা হচ্ছে, কারণ, ধরে নেয়া হয় এই জাতীয় অপরাধগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের সীমানার মধ্যে ঘটলেও তা আসলে সংঘটিত করা হয় পুরো মানবজাতির বিরুদ্ধে। এ কারণে যখনই এই জাতীয় অপরাধ কেউ করে তখন তা পুরো বিশ্বেরই (international community) মাথাব্যাথা (concern), তখন এটা কেউ বলতে পারে না যে – ‘এসব আমাদের নিজের দেশের আভ্যন্তরীন বিষয় আশয়’!
“আন্তর্জাতিক” শব্দটা যুক্ত থাকার ফলে কি বিচারটাও “আন্তর্জাতিক”? কিংবা এই ট্রাইবুনাল কি তার ফলে “আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল” হয়ে গেল?
দু’টো প্রশ্নের উত্তরই হল – “না”। এখানে “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল” কথাটার মধ্যে গুরুত্বারোপ করতে হবে অপরাধের ধরণবাচক “আন্তর্জাতিক অপরাধ” শব্দটির ওপর, ট্রাইব্যুনাল ভবনের ভৌগলিক অবস্থানের উপর না। অর্থাত, যে ধরণের অপরাধের বিচার হচ্ছে কেবল সেগুলোর নাম “আন্তর্জাতিক অপরাধ”, আর বিচারটা কিন্তু হচ্ছে দেশীয় ট্রাইবুনালে, বাংলাদেশের সংসদে পাশ করা আইন দিয়েই। আইনটির নাম হল – International Crimes (Tribunals) Act 1973 । আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে বিচার হচ্ছে না। তার দরকারও নেই, যতক্ষণ রাষ্ট্র নিজেই উদ্যোগী হয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ নিজে থেকেই বিচারের পদক্ষেপ নিয়েছে, সুতরাং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ নিয়ে টানাটানির আর প্রয়োজন থাকছে না।
এখন কেউ কেউ কূট-প্রশ্ন তুলতেই পারেন – বাংলাদেশের এই বিচারের পদক্ষেপ নেয়ার পেছনে আইনগত বা নীতিগত ভিত্তিটি আসলে কি? আদৌ আছে কি না?
তাদের উদ্দেশ্যে বলছি – আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুযায়ী – প্রতিটি রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হল এই জাতীয় অপরাধে অপরাধীদের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর এই “ব্যবস্থা গ্রহণ” আসলে প্রতিটি রাষ্ট্রের ন্যায্য অধিকারের মধ্যেও পড়ে। দেরীতে হলেও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার সেই “দায়িত্ব”-পূরণ এবং “অধিকার”-এর চর্চা করছে মাত্র, প্রায় চার দশক ধরে ঝুলতে থাকা অপরাধগুলোর বিচার প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে।
………………………………
* অণুব্লগটি ফেসবুকে আইসিএসএফ পাতায় ছবি-স্টেটাস হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ৩ জুলাই ২০১২ তারিখে। বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে ব্লগেও প্রকাশিত হল
** ছবি সৌজন্য: রাকেশ ফাতমী, ফ্লিকার এ পাওয়া
রায়হান রশিদ
জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
You must be logged in to post a comment.