১৯৭১-এর ইতিহাস আমাদের কারও অজানা নয়। সারা দেশের মানুষের মনেও কোনো সন্দেহ নেই সেখানে অপরাধী পক্ষ এবং অপরাধী ব্যক্তিরা আসলে কারা। কিন্তু এই জানাটাই শেষ কথা নয়। আমাদের এই জানা, এবং ইতিহাসের এই সত্যকে আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করাটাও সমান জরুরি।।
বিচার কোন্ গতিতে এগোচ্ছে, কোন্ গতিতে এগোনো উচিত, আদৌ ঠিক গতিতে এগোচ্ছে কি না তা নিয়ে জনমনে নানা ধরণের প্রশ্ন এবং দুর্ভাবনা রয়েছে। মিডিয়া এবং রাজনৈতিক অঙ্গনও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় সরগরম। নানা জন সুযোগ পেলেই মন্তব্য করছেন এ নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো — বিচারের রয়েছে নিজস্ব একটা গতি। বাস্তবতা হলো — এই বিচার তখনই সম্পন্ন হবে যখন তা আইনানুগভাবে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা। এর আগেও না, পরেও না।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন এই অপরাধগুলোর শুধু বিচার হলেই হবে না, সেই বিচারকে দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যও হতে হবে। এই গ্রহণযোগ্যতা শুধু যে আমাদের ইতিহাসের জন্যই জরুরি তা কিন্তু না। ১৯৭১-এর সকল ভিকটিম এবং স্বজনহারা মানুষেরও এই জাতির কাছে ন্যূনতম চাওয়া হলো একটা সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য বিচার। এ কারণে আমাদের বুঝতে হবে বিচারটা আসলে কীভাবে হচ্ছে এবং প্রতিদিন এই বিচার কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। আমাদের বুঝতে হবে সেখানে প্রতিটি ধাপের ঠিক কোথায় কতটুকু সময় লাগছে বা সময় দরকার। কেবল তখনই আমরা বুঝব বিচারটা কেমন গতিতে এগোচ্ছে। সে-সব না বুঝে বা না বুঝতে চেয়ে আমরা যদি কেবল ঢালাওভাবে ‘বিচার চাই’, ‘দ্রুত বিচার চাই’, ‘এখনি ফাঁসি চাই’ বলতে থাকি, তবে তা হবে এক ধরণের দায়দায়িত্বহীন হঠকারিতা। কারণ, তাতে বিচার কিংবা ১৯৭১-এর ভিকটিম কারোই কোনো মঙ্গল হবে না। এই বিচারের প্রক্রিয়াকে যদি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাবো সেখানে অনেকগুলো বিষয় বুঝবার আছে, যা সরকার, বিরোধী দল, বা রাজনীতির সমীকরণের চেয়েও ভিন্ন কিছু। সেখানে চ্যালেঞ্জ আছে, ইতিবাচক দিক আছে, সীমাবদ্ধতা আছে, ইতিবাচক দিকগুলোকে পরিচর্যার ব্যাপার আছে, সীমাবদ্ধতার দিকগুলো এক এক করে কাটিয়ে ওঠারও ব্যাপার আছে। মূল কথা — সেখানে অনেক “কাজ” আছে। আমাদের মন্তব্য বা “কথা” দিয়ে তাতে কিছু পরিবর্তন হবে না, হওয়া উচিতও হবে না।
এই বিচার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, এই বিচার বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসানের জন্য, এই বিচার ১৯৭১-এর ভিকটিমদের জন্য। আমরা ইতিহাসের সঠিক পথে হাঁটছি। কিন্তু এই পথ সহজ নয়। আমাদের এখন করণীয় হলো — এই বিচার প্রক্রিয়াকে বোঝার চেষ্টা করা, এবং কীভাবে সত্যিকার অর্থে তাতে সাহায্যকারী ভূমিকা রাখা যায় সে বিষয়ে ভাবা এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সক্রিয় হওয়া। কথা নয়, কাজ দিয়েই আমাদের সবার প্রমাণ করতে হবে যে আমরা সত্যিই ১৯৭১-এ সংঘটিত অপরাধগুলোর বিচার চাই।
………………………………….
* চলমান বিচার প্রক্রিয়া এবং এর অনিবার্য টাইমটেবিল বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন ও ছড়িয়ে দিন আইসিএসএফ সদস্য নিঝুম মজুমদারের এই লেখাটি।
** ছবি সৌজন্য: গুগল ইমেজেস।
*** ফেসবুকের উপযোগী এই স্টেটাস-পোস্টটি লিখেছেন আইসিএসএফ সদস্য রায়হান রশিদ। লেখাটি আইসিএসএফ-এর ফেসবুক পাতা থেকে মুক্তাঙ্গনে অণুব্লগ হিসেবে সংকলিত হলো।
রায়হান রশিদ
জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
নীড় সন্ধানী - ২৫ জুলাই ২০১২ (২:০৭ অপরাহ্ণ)
বিচার তার নিজস্ব গতিতে চলুক। কিন্তু বিচারের ধীরগতির( এবং আওয়ামীলীগ নেতাদের বিচার বিষয়ক দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা) ঋনাত্মক ফলাফল হলো, রাজাকারসমাজ এটাকে আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক এজেণ্ডা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করছে এবং বাংলাদেশের মধ্যমনষ্ক আশিভাগ মানুষ সেটায় আস্থা স্থাপন করে বলে মনে হয়েছে।
রায়হান রশিদ - ২৬ জুলাই ২০১২ (১:২৪ অপরাহ্ণ)
আপনার সাথে একমত – এখানে আসলে এক ধরণের আস্থার সংকটের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। একটা বিচার প্রক্রিয়া এতো বেশী বিস্তৃত যে তার প্রতিটি দিক সমান গতিতে সমান মানে এগোয় না, এগোনো বাস্তবসম্মতও না। কিন্তু আস্থার সংকট যখন দানা বাঁধতে থাকে তখন খুব যুক্তিযঙ্গত জিনিসও জটিল মনে হয়, সীমাবদ্ধতাগুলো আরও বড়ো হয়ে চোখে ধরা দেয়। সরকারের আর দশটা বিষয়ে সমালোচনাগুলো (যেমন: বিদ্যুত, দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি) এখানে বিচারের ইস্যুর সাথে মিলে মিশে এক ধরণের লেজেগোবরে অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এভাবে এক বিষয়কে কেন্দ্র করে জনগণের মনোভাব অন্য বিষয়গুলোকেও এফেক্ট করছে বলেই মনে হয়। তবে এখানে একটা বিষয় মনে আমাদের মনে রাখা দরকার, তা হল – বিচার হবে তার নিজের গতিতে, এবং সেটা হবে স্বাধীন ট্রাইবুনালে, কারও তোয়াক্কা না করে। সেখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ (ভালো খারাপ যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন) থাকা যেমন উচিত না, তেমন আশা করাটাও ঠিক না। অন্তত প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল (দ্বিতীয়টি এখনো পর্যবেক্ষণাধীন) এর কার্যক্রম দেখে একে এখনো স্বাধীন বলেই মনে হচ্ছে।
এস. ডি. রবিন - ২৬ জুলাই ২০১২ (৩:১৫ অপরাহ্ণ)
আমরা ইতিহাসের সঠিক পথে হাঁটছি। কিন্তু এই পথ সহজ নয়। লাইন দু’টো খুবই গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকার তাঁর জনগণকে বুঝাতে পরোপুরি ব্যর্থ। আওয়ামী লীগ কেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না?? ১৯৭২-১৯৭৫ আমলের সরকার ব্যর্থ বলে এই দেশের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া হলো। সেই সময়কে ফিরে পেতে আমাদের কতশত বছর লাগবে তা কি এই দেশের মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে? আমি মনে করি, না। সরকারকে আরো সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে হবে, কাল ক্ষেপণ করা মোটেও উচিত হবে না…
রায়হান রশিদ - ২৬ জুলাই ২০১২ (৪:১৫ অপরাহ্ণ)
১১০% সত্য এই কথা। শুধু দেশের ভেতরেই জনগণকে বোঝাতে ব্যর্থ তাই না, বিদেশেও।