যারা ধরেই নিয়েছেন পেশাগত অসদাচারণ কেবলমাত্র দেশী আইনজীবিদের পক্ষেই বেশী সম্ভব এবং বিদেশী আইনজীবিরা ধোয়া তুলসী পাতা, তাদের সাথে একমত হওয়া কঠিন। এখানে দেশ বা বিদেশ কোন বিষয় না, অসদাচারণ করা আইনজীবির কোনো দেশ নেই, তারা যে কোন দেশেই মক্কেলের স্বার্থে পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে যাবেনই [...]

যে কোনো মামলার মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের মামলাগুলোর ক্ষেত্রেও আইনজীবিদের দায়িত্ব হল পেশাগত আচরণবিধি এবং “আইনের সীমানার ভেতরে থেকে” তার মক্কেলের পক্ষে লড়ে যাওয়া। আইনজীবির কাজ মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বানানো না, বরং, আদালতের একজন সাহায্যকারী অফিসার হিসেবে বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করা। যে কারণে আইন পেশা এবং আইনজীবির ভূমিকাকে “স্বাধীন” বলে ধরে নেয়া হয়, এমনকি যখন একজন আইনজীবি কোনো একটি নির্দিষ্ট পক্ষের দ্বারা নিযুক্ত হন তখনও।

বাস্তবে এই সীমানা সবসময় মানা হয় না। মামলার সাথে জড়িয়ে থাকে মামলার পক্ষরা। আর পক্ষের এই মক্কেলদের আর্থিক প্রতিপত্তি এবং সক্ষমতা সবার ক্ষেত্রে সমান না। এ কারণে আইনী দায় থেকে যে কোনো মূল্যে মুক্তির জন্য একেক মক্কেলের আর্থিক বিনিয়োগ একেকরকম। তার সাথে যুক্ত হয় সংশ্লিষ্ট আইনজীবির ব্যক্তিগত দর্শন, নৈতিক বুনিয়াদ, পেশার প্রতি একাগ্রতা, পেশাদারিত্ব ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গ। ফলে পেশাগত দায় বনাম মক্কেলের স্বার্থ, সত্য উদঘাটন বনাম যে কোনো মূল্যে মক্কেলকে রক্ষা – এই সীমানাগুলো কখনো কখনো ঝাপসা হতে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষীণ হতে হতে এমনকি মিলিয়েও যায়!

এক.

গত ২৯ জুন ২০১২, কম্বোডিয়ার গণহত্যা ট্রাইবুনাল (এক্সট্রা-অরডিনারি চেম্বার্স ইন দ্য কোর্টস অব কম্বোডিয়া – ECCC) অভিযুক্ত আসামী নুওন চির নিযুুক্ত দুই আইনজীবির বিরুদ্ধে অসদাচরণ এবং পেশাগত নিয়মভঙ্গের কারণে শাস্তিমূলক এক আদেশ জারী করেছে। আইনজীবি দু’জন হলেন – মিশিল পেস্টম্যান (এ্যামস্টারডাম বার এসোসিয়েশন) এবং এনড্রুু ইয়ানুজি (নিউ ইয়র্ক বার এসোসিয়েশন)। এর এক সপ্তাহ আগে এই দুই আইনজীবিকেই ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইবুনালের আদেশে যে অভিযোগগুলো তুলে ধরা হয় সেগুলো হল:

“wilful violation of court orders, unauthorized disclosure to the press of confidential or strictly confidential material, and statements in court which are disrespectful or which otherwise do not accord with the recognized standards and ethics of the legal profession.”

উপরোক্ত আদেশ ঘোষণার পাশাপাশি এই দুই আইনজীবির বিরুদ্ধে তাদের স্ব স্ব বার এসোসিয়েশন যাতে যথাযথ শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে সে সুপারিশও করা হবে বলে কম্বোডিয়া ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে জানানো হয়। [বিস্তারিত: এখানে]

দুই.

যে অভিযোগে দন্ডিত হলেন কম্বোডিয়া ট্রাইবুনালের দুই আসামী পক্ষের আইনজীবি, সে একই ধরণের পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আসামী পক্ষের কিছু কিছু আইনজীবির বিরুদ্ধেও রয়েছে। যেমন:

<>  ট্রাইবুনালের বিচারিক পদ্ধতিমালার অপব্যবহার;

<> ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়ায় কালক্ষেপনের চেষ্টা;

<> মিডিয়ার কাছে বিচারের প্রয়োজনীয় দলিলপত্র দিয়ে দেয়ার মাধ্যমে বিচারটিকে “মিডিয়ার বিচারে” পরিণত করার অপচেষ্টা;

<> আদালত কক্ষের পাশাপাশি মিডিয়াকে বিচার এবং লবিইং এর অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা;

<> প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের হয়রানী এবং হুমকি প্রদান;

<> প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাথে ট্রাইবুনালের বাইরে গিয়েও আলাদাভাবে যোগাযোগ করা এবং ভাষ্য আদায় করা;

<> সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য যে গোপন “সেফ হাউস” রয়েছে, সেখানকার দলিলপত্র “সংগ্রহ” করা যার ভেতর সাক্ষীদের পরিচয় এবং অন্যান্য গতিবিধির বিস্তারিত লিপিবদ্ধ ছিল, যা কঠোরভাবে গোপনীয়;

<> অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা;

<> বিচারাধীন বিষয়ে ট্রাইবুনালের বিচারপতিকে সরাসরি চিঠি লিখে (পদ্ধতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক পিটিশন নয়) তাঁকে বিচারকের আসন থেকে নেমে যেতে বলা।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযুক্ত আসামীদের পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবিদের মধ্যে দেশীয় আইনজীবিদের পাশাপাশি বিদেশী কয়েকজন আইনজীবিও রয়েছেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, শেষোক্ত অপকর্মটি করেছিলেন জামায়াত নিযুক্ত তিন বিদেশী আইনজীবি। তারা হলেন যুক্তরাজ্যের “নাইন-বেডফোর্ড রো” নামের চেম্বারের: স্টিভেন কে (কিউসি), জন ক্যামেহ (ব্যারিস্টার), এবং টোবি ক্যাডম্যান (ব্যারিস্টার)।

দেখা যাক কি ঘটেছিল।

ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের নাম ‘৯০ দশকে নাগরিকদের তৈরী একটি গণ তদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েটের সদস্য-তালিকায় পাওয়া যায়। তখন তিনি বিচারক ছিলেন না। একে কেন্দ্র করে গত বছর (২৭ অক্টোবর) সাঈদীর আইনজীবিদের পক্ষ থেকে ট্রাইবুনালে একটি আবেদন পেশ করা হয় চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছা-অপসারণ প্রার্থনা করে, নিরপেক্ষ বিচারের স্বার্থে। বিধি অনুযায়ী ১১ নভেম্বর ধার্য হয় আবেদনের শুনানীর দিন হিসেবে, সেই সাথে এও ঠিক করা হয় যে – যেহেতু চেয়ারম্যানকে নিয়েই আবেদন, সেহেতু তিনি শুনানীর দিন এজলাসে বসবেন না। বিষয়টি যখন এমনিতেই বিচারাধীন এবং শুনানীর জন্য ধার্য, তখন হঠাত ৯ নভেম্বর উপরোক্ত তিন বি্রটিশ আইনজীবির স্বাক্ষরে সরাসরি চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠিতে তাঁকে সরে দাঁড়াতে বলা হয়। শুধু তাই নয়, সেই চিঠির অনুলিপি ডেইলী স্টার, দৈনিক সংগ্রাম ইত্যাদি পত্রিকার কাছেও কোনো এক দৈব উপায়ে পৌঁছে যায়! চিঠিটির পিডিএফ কপি এই লিন্কে

বলাই বাহুল্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করেন। কারণ, এভাবে সরাসরি কোনো বিচারকের কাছে বিচার্য বা বিচারাধীন বিষয়ে চিঠি লেখা বা যোগাযোগ করা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। এ ধরণের আচরণ কেবল বাংলাদেশের বিচারালয়ের প্রথাতেই অবমাননা হিসেবে বিবেচিত না, সভ্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিষয়টি এভাবেই দেখা হয়। এমনকি যুক্তরাজ্যেও, যেখান থেকে এই তিন আইনজীবি আমদানীকৃত। বিষয়টির ওপর ট্রাইবুনাল একটি আদেশ জারী করেন যেখানে এই তিন আইনজীবির বিরুদ্ধে পেশাগত অসদাচরণের জন্য ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের বার কাউন্সিলের Bar Standards Board এ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়, এবং সে মর্মে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৪ নভেম্বর জারী করা ট্রাইবুনালের সে আদেশের কপি এখানে রয়েছে।

আসামী পক্ষের তিন বিলেতি আইনজীবির বিরুদ্ধে ট্রাইবুনালের দেয়া আদেশটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:

Personal correspondence with a judge of Supreme Court and sending the said e-mail to the print media is unheard of and definitely ungentle procedure as well as contemptuous.
. . .
[T]here is no proof of their engagement in the record as defence lawyers to stand on behalf of the accused before this tribunal. Yet in their various statements they claim themselves as the member of the defence team and also claim the accused Delwar Hossain Sayeedi as their client . . . So a lawyer who claims an accused to be his client, he has to maintain and respect the Code of Conduct of his own Bar as well as the Code of Conduct of the country where the accused resides.
. . .
The Registrar of the Tribunal, or in his absence the Deputy Registrar, is directed to send a copy of this Order along with a copy of the E-letter to the “Bar Standards Board, UK, for information and necessary action, if any, in considerations of the contents of the Order.

Let a copy of this Order be sent to the Secretary to the Ministry of Law, Justice and Parliamentary Affairs to undertake and facilitate the above mentioned process before the Bar Standards Board.
[Typos corrected]

প্রসঙ্গত:

‘ ৯০ এর অনানুষ্ঠানিক সেই গণ তদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল (এক) এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের সংশ্লিষ্টতা কেন বিচারের নিরপেক্ষতাকে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ ট্রাইবুনাল একটি বিশদ রায় প্রদান করেন। সুলিখিত এই রায়টির ডাউনলোডযোগ্য কপি রয়েছে আইসিএসএফ এর ই-লাইব্রেরীতে, এখানে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় এই বিষয়টির ওপর বিস্তারিত আইনী ব্যাখ্যাসহ এটিই প্রথম রায় যা ভবিষ্যতের জন্যও একটি দিক নির্দেশনা হতে পারে।

অনুসিদ্ধান্ত-১: যারা মনে করেন আন্তর্জাতিক উদ্যোগে গঠিত ট্রাইবুনালগুলো সেখানকার পক্ষসমূহের নানান ধরণের পেশাগত অসদাচরণের রাহু মুক্ত, তারা আসলে ঠিক কথা বলেন না। জাতিসংঘের ছত্রছায়ায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের সক্রিয় কারিগরি সহায়তায় তৈরী কম্বোডিয়ার ট্রাইবুনাল এর উদাহরণ। উল্লেখ প্রয়োজন – ডাঃ এম এ হাসানসহ বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের অনেকেই, এবং এমনকি জামায়াতে ইসলামীও বহুদিন ধরে দাবী করে আসছে যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আদালতে না হলে নাকি সুবিচার নিশ্চিত করা সম্ভব না। কম্বোডিয়ার ঘটনা একথাই আবারও প্রমাণ করে যে – আইনজীবিদের অসদাচারণজনিত বিচারে বিঘ্নতা যে কোনো বিচারালয়েই ঘটতে পারে, তা সে দেশী ট্রাইবুনাল হোক বা বিদেশী! আইনজীবির অসদাচারণের সাথে ট্রাইবুনাল দেশী কি বিদেশী তার আসলে কোনো সম্পর্ক নেই।

অনুসিদ্ধান্ত-২: যারা ধরেই নিয়েছেন পেশাগত অসদাচারণ কেবলমাত্র দেশী আইনজীবিদের পক্ষেই বেশী সম্ভব এবং বিদেশী আইনজীবিরা ধোয়া তুলসী পাতা, তাদের সাথেও একমত হওয়া কঠিন। এখানে দেশ বা বিদেশ কোন বিষয় না, অসদাচারণ করা আইনজীবির কোনো দেশ নেই, তারা যে কোন দেশেই মক্কেলের স্বার্থে পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে যাবেনই। তত্ত্ব হল – আইনজীবির কাজ হল তার মক্কেলকে ‘আইনের আওতার ভেতরে’ থেকে সহায়তা প্রদান করা; আর বাস্তবতা তার থেকে অনেক আলাদা।

রায়হান রশিদ

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

৩ comments

  1. মাসুদ করিম - ২ জুলাই ২০১২ (৬:১৩ অপরাহ্ণ)

    বিশ্বায়নের যুগে দেশি/বিদেশিকে খারাপ/ভাল এই অর্থে পর্যবসিত হতে বেশি দেখা যাচ্ছে। অথচ বিশ্বায়নের যুগে দেশি খারাপ বিদেশি ভাল বা বিদেশি খারাপ দেশি ভাল এই ভেদরেখা মুছে গিয়ে খারাপ ভাল দেশি বিদেশি সবখানেই সমান সম্ভব এটাই প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা বেশি কাঙ্ক্ষিত ছিল।

    • রায়হান রশিদ - ২৩ জুলাই ২০১২ (৯:২৯ পূর্বাহ্ণ)

      কাঙ্খিত ছিল, কিন্তু হয়নি। কারণ, এখনো আমরা ‘বিদেশী’ সবকিছুকে মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে দেখি, আর যারা এর সুযোগ নেবার তারা ঠিকই নেয়।

  2. সালেহীন - ৩১ জুলাই ২০১২ (৮:৪৮ অপরাহ্ণ)

    Bar Standards Board, UK-এর কাছে চিঠি দেয়া হয়েছিল কি ?
    ঐ ৩ ব্রিটিশ আইনজীবির কোন শাস্তি হয়েছিল? দয়া করে জানালে খুশি হব।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.