সরকারের জবাবদিহিতা নিয়ে কিছু ভাবনা (১): কেবিনেট

গত দু’বছর অনেক সংশয় এবং অনিশ্চয়তায় কাটানোর পর দেশ আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরেছে এখন। ব্যাপক অংশগ্রহণসমৃদ্ধ একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, শপথ নিয়ে নতুন কেবিনেট গঠন করেছে নির্বাচিত দল, সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে এনেছে। সংসদে ৮৫% আসনধারী এই সরকারের কাছ থেকে জনগণের অনেক প্রত্যাশা। অনেকগুলো পাহাড়প্রমাণ চ্যালেঞ্জ নব-নির্বাচিত সরকারের সামনে, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক মুক্তি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, যুব সমাজের কর্ম সংস্থান ইত্যাদি। এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করা যে-কোনো একটি নির্দিষ্ট দলের বা জোটের পক্ষেই খুব কঠিন। সেই কঠিন কাজটি অসম্ভব হয়ে পড়বে যদি বর্তমান সরকার জবাবদিহিতা প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজিয়ে একে কার্যকর করতে না পারে। সরকারের সব সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ যে ঠিক হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে জনগণ সরকারের সিদ্ধান্তগুলোকে অন্তত বোঝার চেষ্টা করবে যদি সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণকেও অন্তর্ভুক্ত করার আন্তরিকতা থাকে। একদিকে জনগণ যেমন জানতে চায় ক্ষমতায় বসে থাকা নেতৃবৃন্দ কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তেমনি কী প্রক্রিয়ায় ও কেন সেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তাও জনগণ জানতে চায়, বুঝতে চায়। এবং এটি জানা জনগণের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের মানুষ আজ যৌক্তিক কারণেই অনেক সন্দিহান। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মূল্যায়নে এ দেশের মানুষ অবুঝ নয়, আবদারিও নয়; তবে ১৫ কোটি মানুষের সামষ্টিক বুদ্ধিবৃত্তিকে হেয় করে কেউ তাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখার চেষ্টা করবে তাও তারা বরদাস্ত করবে না। তাই, জনগণ ও সরকারের মধ্যে বিশ্বাস এবং নির্ভরশীলতার পরস্পরমুখী সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে বিদ্যমান জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। চাই সুষ্ঠু জবাবদিহিতা ও জবাবদিহিতার সরকার।

সরকারি নির্বাহী দফতর, তার ওপরে কেবিনেট, তারও ওপরে সংসদ — সাধারণভাবে এই হল আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার সিঁড়ি।

সরকারি নির্বাহী দফতর, তার ওপরে কেবিনেট, তারও ওপরে সংসদ — সাধারণভাবে এই হল আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহিতার সিঁড়ি। তিন পর্বের এই পোস্টটিতে এই ধাপগুলোরই আনুষঙ্গিক কিছু বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। শুরু করা যাক কেবিনেট দিয়ে।

কেবিনেট

গতকাল নবনিযুক্ত কেবিনেট ঘোষিত হয়েছে; এ পর্যন্ত তা নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন। নতুন কেবিনেটে অনেক নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বে নারী নেতৃত্ব নির্বাচন সংখ্যার ও দায়িত্বের গুরুত্ব বিচারে যুগান্তকারী। মামলায় অভিযুক্ত বা দণ্ডিত ব্যক্তিদের কেবিনেট থেকে দূরে রাখা হয়েছে। শোনা যায়, অন্যান্য বারের মতো এবারেও বিদেশী কূটনৈতিক পর্যায়ে লবিইং-এরও চেষ্টা ছিল যাতে পছন্দসই প্রার্থীদের কেবিনেটে রাখা হয়। সেটি এড়াতে নির্বাচিত দলের নেত্রীর ভূমিকা প্রশংসনীয়। প্রচার মাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী এমনকী দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বকেও কেবিনেটে মনোনয়ন দানের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। সে-সবের আলোকে বলা যেতে পারে এবারের গঠিত কেবিনেট অনেকাংশেই ‘ভেতর ও বাইরের’ হস্তক্ষেপমুক্ত। এ তো গেল মন্ত্রী নির্বাচনে হস্তক্ষেপের কথা। ভবিষ্যৎ কার্যক্ষেত্রেও এই একই কেবিনেটকে ‘ভেতর ও বাইরের’ প্রভাব মুক্ত রাখা হবে বিরাট চ্যালেঞ্জ। সে-বিষয়ে যে-সংশয়গুলো এ মুহূর্তে মনে উঁকি দিচ্ছে, সেগুলো হল :

(১) দু’একজন বাদে কেবিনেটের বেশির ভাগ সদস্যই তাঁদের নিজ নিজ দফতরের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। তাঁদের বেশির ভাগই ইতিপূর্বে এ ধরণের দায়িত্ব পালন করেননি কখনো। এটি একটি দুশ্চিন্তার কারণ। আগামী পাঁচ বছর এই মন্ত্রীদের কাজ করতে হবে আমলাদের সাথে। আর একথা তো সবাই জানি আমরা যে, আমলাতন্ত্রের রয়েছে নিজস্ব প্রথা, কর্ম ও চিন্তাপদ্ধতি, যা এমনকী দলীয় সমর্থনেরও ঊর্ধ্বে। আর সেখানে রয়েছে অনেক খানাখন্দ, গলি-ঘুপচি। সরকারি দফতরের বিভিন্ন জটিল কার্যপদ্ধতি, প্রোটোকল, লাল ফিতে, নীল ফিতে সম্পর্কে আমলারা ভেতরের মানুষ হিসেবে যতটা ভালভাবে জানেন, নতুন একজন মন্ত্রীর সে-সব বুঝে উঠতে বেশ অনেকটা সময় লাগার কথা। একারণে, এমনকী সংসদীয় গণতন্ত্র যে-সব দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত, উন্নত সে-সব গণতান্ত্রিক দেশেও সুযোগ পেলেই আমলারা নাকি নির্বাচিত মন্ত্রীদের ঘোল খাইয়ে ছাড়েন। তবে দেশপ্রেম, সততা, সদিচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে যে-কোনো সীমাবদ্ধতাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব; কারণ দায়িত্ববোধ মানুষকে যোগ্য করে তোলে। তাই অনেক সংশয় সত্ত্বেও আশাবাদী না হবার কোনো কারণ দেখি না। নতুন কেবিনেটের নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য অন্তত এই সুযোগটি প্রাপ্য।

(২) দেখা যাচ্ছে, ঘোষিত কেবিনেটে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতেই আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় রেখেছেন, সেগুলো হল: জ্বালানি, প্রতিরক্ষা, পূর্ত, সংস্থাপন এবং নারী ও শিশু। পূর্ববর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রীও তাই করেছিলেন। এ ধরণের সিদ্ধান্তের সপক্ষে প্রধানমন্ত্রীদের নিজস্ব কিছু রাজনৈতিক যুক্তি নিশ্চয়ই আছে; তবে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। যেমন ধরা যাক জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিষয়টি।

প্রথমত, গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়টি গঠিত হয়েছে ‘জ্বালানি’ ও ‘বিদ্যুৎ’ নামের দু’টি আলাদা বিভাগের সমন্বয়ে। একজন পূর্ণমন্ত্রীর পক্ষেই এই ব্যাপক কাজ সুসম্পন্ন করে ওঠা কঠিন, সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পক্ষে কেবিনেট, সরকার এবং দলের আর দশটা প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতি বিশেষ মনযোগ প্রদান একরকম অসম্ভবই বলা যায়। বলাই বাহুল্য বর্তমানের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্ত্রণালয়টি এখন বিশেষ মনযোগ দাবি করে।

দ্বিতীয়ত, গত সরকারের আমলের বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার সাথে আলাপ করে জেনেছি যে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে থাকলে জ্বালানি-সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন ধরা যাক, প্রধানমন্ত্রী নিজে যদি এই সেক্টরটি ব্যক্তিগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাহলে দেশী/বিদেশী কোম্পানীর প্রতিনিধিরা সরাসরি তাঁর সাথে এপয়েন্টমেন্ট করেই ‘উপর থেকে’ সব সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত (বা প্রভাবিত) করার চেষ্টা করে থাকেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা তখন পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন — এসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোকে ডিঙিয়ে বা কোনোরকম পাত্তা না দিয়েই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে অনুমোদন নেয়ার চেষ্টা করেন। এতে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ডই শুধু বিঘ্নিত হয় না, প্রধানমন্ত্রীও ব্যক্তিগতভাবে বিদেশী সংস্থাগুলোর সহজ নাগালের মধ্যে চলে আসেন; ফলে বহির্বিশ্বের চাপ সামলানো তাঁর পক্ষে আরো কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এভাবেই বিদেশী শক্তির কাছে দুর্বলতর হয়ে পড়ে। তাই ‘চেইন অব কমান্ড’ই বলি, ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টই বলি’, অথবা ‘সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে নিরপেক্ষ বিযুক্তিকরণের’ (objective disassociation) কথাই বলি, প্রধানমন্ত্রীর এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মন্ত্রণালয় ধরে রাখা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

তৃতীয়ত, ধরা যাক জ্বালানি খাতে সরকার ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হল। সেক্ষেত্রে জনগণ যদি পদত্যাগ দাবি করে, তবে কোন্ মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করবে তারা? জ্বালানি মন্ত্রীর না কি প্রধান মন্ত্রীর?

চুতর্থত, মন্ত্রণালয়ের কাজগুলোর ওপর নজরদারির জন্য রয়েছে বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট সংসদীয় কমিটি। প্রধানমন্ত্রী যদি নিজেই একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন, দলীয় জ্যেষ্ঠতা এবং অবস্থানগত কারণে সংসদীয় কমিটিগুলোর (যেগুলোর বেশিরভাগেরই প্রধান সরকারি দলের সিনিয়র সাংসদবৃন্দ) প্রধানমন্ত্রীকে তলব করে প্রশ্ন করা নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

[প্রিয় পাঠক, উল্লেখ-করা বিষয়গুলোর ওপর আপনাদের মতামত পেলে আমরা সবাই উপকৃত হব। এটি আলোচনার শুরু মাত্র। এর সাথে আর কী কী যোগ করা যেতে পারে? উল্লিখিত কোনো বিষয় ভিন্ন আলোকে দেখার সুযোগ থাকলে তাও এখানে মন্তব্যাকারে লিখে জানানোর সবিনয় অনুরোধ থাকলো। এই পোস্টের আগামী পর্বে সংসদীয় কমিটিগুলোর সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার চেষ্টা থাকবে। ধন্যবাদ — পোস্ট লেখক]

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

9 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
9
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.