গত ২৯ জুলাই মুক্তাঙ্গন ব্লগে শ্রদ্ধেয় প্রবীণ লেখক দ্বিজেন শর্মার লাউয়াছড়ার শেকড় শিরোনামে একটি পোস্ট প্রকাশিত হয়। পোস্টটিতে মন্তব্য করতে গিয়ে লক্ষ করলাম কথায় কথায় তা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। তাই ভাবনাগুলোকে আলাদা পোস্টের আকারে তুলে ধরাই সমীচীন মনে হল।
১.
দ্বিজেন শর্মার লেখাটিতে সাম্প্রতিক কালের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একসাথে উঠে এসেছে। তার মধ্যে যে কয়েকটি খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায়, সেগুলো হল : জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশের পানির নীচে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা; জৈব জ্বালানীর লাগামহীন উত্তোলন, ব্যবহার এবং তার সাথে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্পর্ক; দেশীয় তেল গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর ওপর বিদেশী কোম্পানিগুলোর আধিপত্যমূলক আগ্রাসন এবং এ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঘরে-বাইরে গজিয়ে ওঠা স্বার্থান্বেষী মহল; পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনিবার্যতা; এবং সাম্যবাদী সমাজকে ঘিরে লেখকের স্বপ্ন। শিরোনামে লাউয়াছড়ার উল্লেখ থাকলেও পুরো লেখাটির প্রথম বাক্যটি ছাড়া আর কোথাও লেখক এর আর কোনো উল্লেখ করেননি, যা বিশেষভাবে চোখে পড়ে। দরকার পড়ে না হয়তো। কারণ, যে অনেকগুলো বিষয়কে ঘিরে এই পোস্ট, তার প্রায় সবগুলোই কীভাবে যেন লাউয়াছড়ার মতো যা কিছু সবুজ, যা কিছু প্রাকৃতিক তার সাথে একসূত্রে গাঁথা। সে অর্থে লাউয়াছড়া কিছু গাছ আর দুর্লভ প্রজাতির প্রাণীর আবাসই শুধু নয়, এর শেকড় বুঝি আমাদের সময়ের আরো অনেক গভীরে প্রোথিত। নিশ্চিত নই, তবে লেখক হয়তো তা-ই বোঝাতে চেয়েছেন।
২.
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে বিস্ফোরণের জন্য দায়ী অক্সিডেনটাল কর্পোরেশনকে ততদিনে স্থলাভিষিক্ত করেছে ইউনোকল নামের আরেক বিদেশী কোম্পানি। তারা ২০০৪ সালে হাতে নিল পাইপ লাইন তৈরির কাজ (এখানে দেখুন)। বাংলাদেশ সরকারও খুব খুশি। নির্মিতব্য সে পাইপ লাইনের গতিপথ ঠিক করা হল মৌলভীবাজারে অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় পার্কের ভেতর দিয়ে। (এখানে লাউয়াছড়ার কিছু স্থিরচিত্র আছে)। (এই তথ্য বাংলাদেশের এক স্বনামধন্য পরিবেশ আইনজীবীর কাছ থেকে শোনা)। যে সময়ের কথা তখন এই পার্কটির সংরক্ষিত স্টেটাসের ব্যাপারটি নাকি (তাঁর মতে) এখনকার মতো এত স্পষ্ট ছিল না। ফলত পরিবেশবাদীরা কিছুটা বেকায়দাতেই পড়ে যান পাইপ লাইনটির প্রস্তাবিত রুটের বিরোধিতা করতে গিয়ে। কারণ সরকারের এক গোঁ — ‘পরিবেশবাদীরা যদি প্রমাণ করতে পারেন যে বনটি সরকারি নীতি অনুযায়ী “সংরক্ষিত”, কেবল তখনই বিষয়টা বিবেচনা করা হবে’। অদ্ভুত শর্ত! সরকারি দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে পরিবেশবাদীদেরই নাকি খুঁজে বের করতে হবে প্রয়োজনীয় তথ্য। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম : আমার পাওনাদারকেই প্রমাণ করতে হবে দেনাদারের কোন্ লুকানো সিন্দুকে কত টাকাকড়ি আছে; প্রমাণ করতে পারলে তবেই টাকা ফেরত দেয়ার প্রশ্ন। যাই হোক পরিবেশবাদীরা শেষ পর্যন্ত সরকারি নথিতে প্রয়োজনীয় প্রামাণিক তথ্যটি খুঁজে পেয়েছিলেন (পুরো গল্পটা জানা হয়নি) এবং সরকারকে বিষয়টি আমলে আনতে রাজি করাতে পেরেছিলেন। তখন সরকার এবং ইউনোকল মিলে উত্থাপন করল আরেকটি বিষয়। বলা হল, পাইপলাইনটিকে বনভূমি এড়িয়ে নিতে হলে হিসেবের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হবে। সে হিসেবটিরই বা ভিত্তি কী ছিল, তা অবশ্য জনগণের কোনোদিনই জানার সৌভাগ্য হবে না, সংশ্লিষ্ট পরিবেশবাদীদেরও সম্ভবত হয়নি। যাই হোক, পাইপলাইনটি শেষ পর্যন্ত হয়েছে, কিছুটা এদিক ওদিক ছাড় দিয়ে (এখানে দেখুন)। সে অন্য কাহিনী। এরপরের ঘটনা সবারই জানা। ইউনোকল থেকে দায়িত্ব বুঝে নিল আরেক বিদেশী কোম্পানি শেভরন। তারা চাইল ব্যয়বহুল ত্রিমাত্রিক ভূ-জরিপ (3d scan) পরিচালনা করতে (এখানে দেখুন)। লাউয়াছড়ার বেশ কিছু অংশও সে জরিপের আওতায় পড়ল। সমস্যা একটাই — আর তা হল পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর এ ধরণের জরিপের নেতিবাচক প্রভাব। বনের ভেতর দিয়ে পাইপলাইন তৈরির শুরুতেই পরিবেশবাদীরা যে আশঙ্কাটি করেছিলেন শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটল এ বছর — অগ্নিকাণ্ড। বাংলাদেশে পরিবেশ সংক্রান্ত অনেক বিধিমালা ও নীতিমালা থাকলেও, আর সব বারের মতো এবারও বিদেশী বিনিয়োগের কাছে পরিবেশের স্বার্থটি হয়ে গেল গৌণ। এখানে দেখুন। দুঃখজনক হল, এই বাস্তবতাটি শুধু যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু না।
৩.
ভূগর্ভস্থ সকল জ্বালানী সম্পদের মালিক দেশের জনগণ (সংবিধান: ১৪৩- ১৪৫ অনুচ্ছেদ)। কিন্তু জনগণের সে সম্পদ নিয়ে সরকার কীভাবে কী করছে, সে সব যদি জনগণ না জানতে পারে তাহলে তারা কীভাবে জানবে যা ঘটছে তা ঠিক না বেঠিক? সমস্যা হল, দেশে দেশে জ্বালানী সেক্টরগুলো কড়া গোপনীয়তার মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। কিছু কিছু দেশে একে এমনকী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তামূলক সেক্টরগুলোর মতো করে পরিচালনা করা হয়। সাধারণত এ সেক্টরে তথ্যের গোপনীয়তা শুধু আইন দিয়েই রক্ষা করা হয় না, পক্ষগুলোর মধ্যে চুক্তির মাধ্যমেও সে গোপনীয়তার জালকে আরো মজবুত করা হয়। এ গোপনীয়তার ভিত্তি কী, বা সে সব কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে পৃথক আলোচনাই হতে পারে। কিন্তু আমাদের মত দেশে এ গোপনীয়তা অনেক ধরণের সুযোগ ও জটিলতার সৃষ্টি করে। সুযোগ তৈরি করে পর্দার অন্তরালে সংঘটিত দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড লুকিয়ে রাখার। সুযোগ তৈরি করে জনগণের সামনে জবাবদিহিতা না করার; নিয়মিত পর্যাপ্ত তথ্য পেশ না করার।
৪.
‘তথ্যের স্বচ্ছতা’ এবং ‘তথ্যাধিকার’ এই বিষয়গুলো তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ, যদিও জ্বালানী সেক্টরে সেসবের স্বরূপ কী হবে তা নিয়ে রয়েছে স্পষ্ট মতভেদ। এ প্রসঙ্গে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী এক আইনজীবীর মন্তব্য মনে পড়ছে। তাঁর ভাষ্যমতে এ ধরণের স্বচ্ছতার কথা নাকি চিন্তা করাও “হারাম”। আরেক সরকারি কর্মকর্তার কথা মনে পড়ছে যিনি সরকারি খরচে বিদেশে জ্বালানী বিষয়ে পিএইচডি করতে যাবার প্রস্তুতি হিসেবে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করেছিলেন, সম্ভবত এই ভেবে যে সে সব তাঁর গবেষণার কাজে লাগতে পারে। ঠিক বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে একদিন তাঁর ঘরে পুলিশ রেইড হয় এবং তারপর তিনি বেশ অনেককাল বন্দী জীবন যাপন করেছেন বলে শুনেছি। (এই ঘটনাটি আরেক উচ্চপদস্থ প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে শোনা)। গ্রেফতারকৃত কর্মকর্তাটির অপরাধ হল অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন (১৯২৩) এর লংঘন; তিনি নাকি রাষ্ট্রীয় ‘গোপনীয়’ তথ্য অবৈধভাবে নিজের সংগ্রহে রেখেছিলেন। এখন সমস্যা হল, ঔপনিবেশিক আমলের এই আইনটি ঢালাওভাবে এবং বলা যায় একরকম নিয়ন্ত্রণহীনভাবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে আমাদের দফতরগুলোতে। ফলে কোন্ তথ্যটি সত্যিই গোপনীয় আর কোনটি তা নয়, তার কোনো স্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে বলে আমার জানা নেই। সুতরাং, কোনোদিন যদি কাউকে পেনসিল-ইরেজার কেনার রসিদ হেফাজতে রাখার অপরাধে এই আইনের আওতায় শাস্তি পাওয়ার কথা শুনি আমরা, তাতেও হয়তো অবাক হবার কিছু নেই।
৫.
নিজের কোনো কোনো ছাত্রকে বা বন্ধুকে সজ্ঞানে বিদেশী কোম্পানির হয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করতে দেখে দ্বিজেন শর্মার যে দুঃখ, তা আরো অনেকেরই। যাঁরা জেনে শুনে সরাসরি দুর্নীতিমূলক কাজে লিপ্ত তাঁদের কথা তোলার মানে হয় না। কিন্তু “স্বার্থান্বেষীদের” একটা বড় অংশের আওতায় পড়েন সে সব মানুষ, যাঁদের কথা দ্বিজেন শর্মা উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। সে কারণেই হয়তো এঁদের কার সংশ্লিষ্টতা সমাজ বাস্তবতা-জনিত আর কারটা লোভ বা ব্যক্তিগত সুবিধাবাদ-জনিত সে বিভাজনটি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এখানে উল্লেখ্য যে, নৈতিক বিচারে দুটি ভূমিকার কোনোটিই অনুমোদনযোগ্য নয়। তবে কৌশলগত দিক থেকে দেখতে গেলে, দেশীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে কে শত্রু, কে মিত্র, বা কার মাঝে একজন নীরব মিত্র লুকিয়ে রয়েছে — তা চেনার জন্য সমাজ বাস্তবতার এ বিষয়গুলো মনে রাখা সম্ভবত জরুরি। এ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে যে সব উদাহরণের মুখোমুখি হয়েছি, তার কয়েকটি এখানে দেয়া যেতে পারে। এইসব “স্বার্থান্বেষীদের” কেউ কেউ হয়তো স্রেফ তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন; আবার কেউ-বা তাঁর বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের প্রয়োগ করছেন। যেমন ধরা যাক, দেশীয় যে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কোনো প্রজেক্টে কনসালটেন্সি করার জন্য, তিনি হয়তো চেষ্টা করবেন এমন কিছু না বলার বা না করার যাতে করে ভবিষ্যতে এ ধরণের কনসালটেন্সির কাজ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আবার ধরা যাক, “ক” বিষয়ে “খ” নামের ব্যক্তিটি একজন বিশেষজ্ঞ এবং সে বিষয়ে কাজ পাওয়া এবং তা করা-ই তাঁর জীবিকা। এখন বাংলাদেশ সরকার যদি তাঁকে নিয়োগ না দেয় নির্দিষ্ট কোনো কাজে রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য, তাহলে “গ” নামের বিদেশী কোম্পানি যখন তাঁকে কাজ দিতে চাইবে, তখন কি “ক” সেটা ফিরিয়ে দেবেন? আবার ধরুন, শরাফত নামের (কল্পিত) গবেষণা কর্মকর্তা তাঁর সরকারি চাকুরিটিতে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না, কারণ তাঁর সব সময় মনে হয়েছে তাঁর পরামর্শগুলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমলেই আনছেন না, সরকারি দফতরে তাঁর যোগ্যতা বা সম্ভাবনা কোনোটাই স্বীকৃতি পাচ্ছে না। একদিন শরাফত সাহেব চাকুরির প্রস্তাব পেলেন বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে, এবং সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে তিনি কাজ করা শুরু করলেন তাদের পক্ষ নিয়ে। আবার ধরা যাক, তেল গ্যাস আন্দোলনে আমাদের অনেক নেতৃস্থানীয় সহচরদের অনেকেই প্রাক্তন (উচ্চপদস্থ) সরকারি কর্মকর্তা। এখানে যে বিষয়টি লক্ষ করার মতো তা হল — তাঁরা সবাই “প্রাক্তন”। চাকুরিতে থাকা অবস্থায় তাঁদের কাউকেই কিন্তু আন্দোলনে পাওয়া যায়নি। কিংবা ধরা যাক, সরকার ঠিক করল এই দফায় কোনো বিশ্বমানের স্বাধীন কনসালটেন্ট ফার্মকে নিয়োগ দেবে কোনো কাজে প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য। এখন মনে রাখতে হবে ফার্মটির কর্মকাণ্ড রয়েছে পৃথিবীর ৪০টি দেশে, এবং মক্কেলের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন কর্পোরেট হাউস এবং তেল কোম্পানিও। সুতরাং ফার্মটি কি চাইবে একটি ব্রিফে বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে আরো দশটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মক্কেলের সাথে চিরতরে সম্পর্ক নষ্ট করতে? এখানে ফার্মটির অবস্থাও অনেকটা দেশীয় অধ্যাপকটির মতো। সুতরাং এই পরিপ্রেক্ষিতগুলি ভুলে গেলে চলবে না।
উপরের বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে আশা করি আরো আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে। তার আগ পর্যন্ত, দ্বিজেন শর্মাকে আবারও ধন্যবাদ তাঁর চমৎকার লেখাটির জন্য।
অন্যত্র প্রাসঙ্গিক লিন্ক:
–লাউয়াছড়া নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল রিসোর্স গ্রুপের এই রিপোর্টটি পড়লে কনসালটেন্টদের দেয়া পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে কিছু সাধারণ ধারণা পাওয়া যাবে। এখানে।

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক ‘ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম’ (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
