আইসিটির পুরো ইতিহাসে সংঘবদ্ধভাবে সবচেয়ে বেশী আইনগত এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার যে ব্যক্তিটি হয়েছেন তিনি হলেন বিচারপতি নিজামুল হক। তাঁকে সরানোর সব ধরণের চেষ্টা চালিয়েছে ওরা শুরুর দিন থেকেই। যাকে ভয় দেখানো যায় না, যাকে কিনে নেয়া যায় না, তাকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় কি? সে জন্য তারা ষড়যন্ত্রে নামে [..]

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে আজ শপথ গ্রহণ করেছেন। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে গতকাল থেকেই যথারীতি বাঁশেরকেল্লা ঘরানার জামাত-শিবিরের পেইজগুলোতে এবং ‘আমার দেশ’ গোষ্ঠীর সাংবাদিক-দুর্বৃত্তদের কলমে প্রবল আহাজারি, মাতম, আর অপপ্রচার শুরু হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে, দুঃখজনক হলেও সত্যি, প্রগতিশীল ৭১ এর পক্ষের মানুষরা এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের খবরটি হয় লক্ষ্য করেননি, কিংবা এই নিয়োগের তাৎপর্য অনুধাবন করেননি, কিংবা করলেও একে অভিনন্দন জানানোর, কিংবা প্রচার করবার প্রয়োজনীয়তাটুকু অনুভব করেননি।

এটা আমাকে অত্যন্ত ব্যাথিত করেছে।

আমরা নিশ্চুপ বিস্মৃতিতে নিমজ্জিত থাকলেও বাঁশেরকেল্লারা কিন্তু নিশ্চুপ থাকে না। আমরা আমাদের ইতিহাসের প্রকৃত হিরোদের কথা ভুলে গেলেও ইতিহাসবিরোধী জামায়াত-শিবির আর ওদের সাঙ্গাতরা কখনো তাদের প্রকৃত শত্রুদের কথা ভোলে না। তাই কিছু কথা মনে করিয়ে দেয়ার তাগিদ থেকে এই পোস্টটি লেখা। এ প্রসঙ্গে দু’বছর আগে যা লিখেছিলাম তা থেকেও কিছু অংশ পূনরাবৃত্তি করছি নিচে।

বিচারপতি নিজামুল হক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল (এবং পরবর্তীতে ট্রাইবুনাল-১) এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে পুরো বিচারিক প্রতিষ্ঠানটিরই নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০১২ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত, স্কাইপ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁকে বিতর্কিত করে তাঁর পদত্যাগ নিশ্চিত করার আগ পর্যন্ত। যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল সংক্রান্ত আইনটি পড়ানো পর্যন্ত হয়নি কোনদিন [এই ব্লগটি পড়ুন], যে দেশে আইনজীবি, আইনের শিক্ষক থেকে শুরু করে এমনকি বিচারকদের মধ্যেও এই সুনির্দিষ্ট আইনটির ক্ষেত্রে (অর্থাৎ: গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ) পেশাগতভাবে অবগত/দক্ষ একজনকেও খুঁজে পাওয়া কঠিন – সেই দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের দায়িত্ব নিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিনতম এবং সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়াটি এবং প্রতিষ্ঠানটি তিল তিল করে গড়ে তোলার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব জাস্টিস নিজামুল হক-এর। এই আইনটির এবং এই পুরো বিচার প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি বাঁকের অনুসরণীয় মাইলফলকগুলি, প্রতিটি ব্যাখ্যার আইনগত রোডম্যাপ তাঁর নিজের হাতে গড়া – যে তাত্ত্বিক এবং সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর ভর করে পরবর্তীতে এতগুলো রায় আজ ঘোষিত হয়েছে।

১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এই বিচারক প্রায় পুরো পেশাগত জীবনটাই সক্রিয়ভাবে কাটিয়েছেন একজন নির্ভীক মানবাধিকার আইনজীবি হিসেবে। সে পুরো সময়টাতে যাঁর একার হাত দিয়েই পেশ করা অন্তত কয়েক শতাধিক রীট আবেদনের সুবিধা পেয়েছেন বিশেষ ক্ষমতা আইনে অবরুদ্ধ শত শত রাজনৈতিক বন্দী ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা। তিনি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণ আদালতের সেক্রেটারিয়েটেরও একজন সদস্য ছিলেন। এর সবটাই হাইকোর্টে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাবার আগে। ব্যক্তিজীবনেও অত্যন্ত সৎ এবং সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত বলে সবাই জাস্টিস হককে চেনেন।

আমরা যারা প্রগতিশীল বলে নিজেদের দাবী করি, তারা সবসময়ই নিজেদের বন্ধু আর শত্রু চিনতে ভুল করি। এটা একটা অভিশাপ, যার নজির ছড়িয়ে আছে আমাদের জাতির পুরো ইতিহাস জুড়েই। আমরা যতোই ভুল করি জামাত-শিবিরের প্রতিক্রিয়াশীল হিংস্র শক্তিটি কিন্তু কখনোই তাদের প্রকৃত শত্রু বা প্রতিপক্ষ চিনতে ভুল করে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারাধীন আসামী পক্ষ এবং তাদের মিলিয়ন ডলার ‘বিভ্রান্তির যন্ত্র’-ও কখনো ভুল করেনি তাদের মূল টার্গেটকে চিহ্নিত করতে।

তাই এ বিষয়ে অবগতমাত্রই জানেন – আইসিটির পুরো ইতিহাসে সংঘবদ্ধভাবে সবচেয়ে বেশী আইনগত এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার যে ব্যক্তিটি হয়েছেন তিনি হলেন বিচারপতি নিজামুল হক। তাঁকে সরানোর সব ধরণের চেষ্টা চালিয়েছে ওরা শুরুর দিন থেকেই। যাকে ভয় দেখানো যায় না, যাকে কিনে নেয়া যায় না, তাকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় কি? সে জন্য তারা ষড়যন্ত্রে নামে এবং সাজিয়ে তোলে স্কাইপ ষড়যন্ত্র। ভাড়া করা হয় মার্কিন এক বেসরকারি সিকিউরিটি/গোয়েন্দা ফার্মকে যাদের বিশেষত্বই হল এসপিওনাজ এবং হ্যাকিং। ভাড়া করা হল ব্রিটিশ এক পিআর ফার্মকে, ইউরোপের মিডিয়া এবং পশ্চিমের রাজনৈতিক মহলের গভীর পর্যন্ত যাদের যোগাযোগের হাত বিস্তৃত। জড়িয়ে ফেলা হল যুক্তরাজ্যের অত্যন্ত ক্ষমতাধর দু’টো মিডিয়া হাউজকে; এছাড়াও বাংলাদেশে তাদের কাজ করে দেবার মতো খুচরো আমারদেশ-মাহমুদুররা তো ছিলোই সবসময় প্রস্তুত হয়ে সাহায্যকারী হিসেবে। এভাবেই ট্রাইবুনালের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ বিচারপতি নিজামুল হক এবং তার মাধ্যমে পুরো বিচার প্রক্রিয়ার উপর আক্রমণের ষড়যন্ত্র হয়।

বিতর্ক এবং বিভ্রান্তির হাত থেকে বিচার প্রক্রিয়াকে রক্ষা করার লক্ষে বিচারপতি হক নিজেই তখন পদত্যাগ করে ফিরে গেছেন সুপ্রীম কোর্টে তার নিজের বেঞ্চে। কিন্তু এতো কিছু করেও শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা জিততে পারেনি। কারণ, ততদিনে পুরো বিচার প্রক্রিয়ার তাত্ত্বিক এবং আইনী দিক-নির্দেশনাগত ভিত্তিমূল ভালভাবে রচিত হয়ে গেছে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে। এই চলমান স্রোতকে থামায় এমন শক্তি ছিল না, যার সুফল আজ পাচ্ছেন ১৯৭১ এর সকল ভিকটিমেরা।

আমাদের স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। কিংবা অন্যভাবে বললে, আমরা ভুলে যেতে পছন্দ করি। আর সম্ভবত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই – বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অন্ধকারের আনাচ কানাচ থেকে নানান তালেবর পিলপিল করে বেরিয়ে আসে মানুষকে নতুনভাবে ইতিহাস শেখাতে। সেদিন দেখলাম একজন পুরো আইসিটি এবং এর বিচার প্রক্রিয়ার অবদান/ভূমিকা নিয়েই কটাক্ষ করছে, বাকিরা আবার তাতে হাততালিও দিচ্ছে!

গতকাল আইসিএসএফ (International Crimes Strategy Forum​) এর পক্ষ থেকে বিচারপতি হক এর এই যথার্থ নিয়োগকে তাৎক্ষণিকভাবে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা এই শেষ কথাগুলোর মর্মার্থ আশা করি আজ না হলেও অন্তত ভবিষ্যতের বাংলাদেশ একদিন হৃদয়ে অনুধাবন করবে সেই আশাবাদ থাকলো:

“Justice Nizamul Huq’s outstanding contributions towards the human rights movement of Bangladesh, towards ending impunity for international crimes, towards delivering justice keeping the victims of such crimes in mind, and most importantly towards tackling the near impossible task of brick-by-brick building this historic institution called the International Crimes Tribunal – are now undeniably a part of Bangladesh’s glorious history. He has served, and hopefully be serving for a long time to come – the cause of justice in its truest sense against monumental odds and conspiracies without faltering. For this alone, if not anything else, he will always rightly be remembered as an inspiration within the ranks of justice activists, campaigners, and groups representing victims’ interests dedicated to end impunity for international crimes.”

সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস নিজামুল হক-রা ফেসবুকিং করেন না, টুইটিং করেন না, সংবাদ সম্মেলন করেন না, বিবৃতি দেন না, ব্লগ লেখেন না। নিজেরা তাঁদের অবস্থান বা অবদানের কথা কখনো তুলে ধরেন না, ধরতে পারেন না। তাই ভাবলাম – এই কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়া দরকার ছিল।

ধন্যবাদ, ভালো থাকুন সবাই। শান্তিতে থাকুন।

রায়হান রশিদ

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.