উনিশ শ সাতচল্লিশ সাল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর, এই বছরই ভারত স্বাধীনতা অর্জন করল। বিষয়টি যেমন একদিকে আনন্দের, পাশাপাশি একটি বেদনার্ত পরিবেশও তৈরি হলো। ভারত ভেঙে দু-ভাগ হলো – একদিকে পাকিস্তান, অপর দিকে ভারত। আর দাঙ্গার ক্ষত নিয়ে কেউ-বা ওপারে যাচ্ছে, কেউ-বা এপারে আসছে। ঠিক এই সময় শিল্পী সফিউদ্দীন কলকাতা ছেড়ে ঢাকা চলে এলেন। অনেকটা শিকড় ছিন্ন করে চলে আসা। ইতিমধ্যে সফিউদ্দীন কলকাতায় একজন সফল শিল্পী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, শিক্ষকতা করছেন প্রখ্যাত কলকাতা গভর্মেন্ট আর্ট স্কুলে। সর্বভারতীয়ভাবে ছাপচিত্র শিল্পী হিসাবে তার সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিভার স্বীকৃতি হিসাবে বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন। আর সফিউদ্দীন তাঁর সমস্ত খ্যাতি যশ আর প্রতিষ্ঠাকে পেছনে ফেলে ঢাকায় চলে এলেন। পা বাড়ালেন এক অনিশ্চয়তার পথে।
ঢাকা তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী, অবকাঠামোগতভাবে খুবই দূর্বল, অন্তত কলকাতার তুলনায়। এবং কলকাতার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জগতের তুলনায় ঢাকা কিছুটা পিছিয়েই তখন। নাটক থিয়েটার গানের জলসা আর চিত্র প্রদর্শনীর শহর কলকাতা ছেড়ে এসে পাণ্ডববর্জিত এই শহরে এসে শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের মানসিক অবস্থা কী হয়েছিল তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে। তবে ঢাকা শহরে আসার পিছনে তাঁদের যে মিশন ছিল, তাও কম মহৎ নয়।
এ-শহরে একটি শিল্পের কেন্দ্র গড়ে তোলা। এবং শিল্পচার্য জয়নুলের নেতৃত্বে তাতে অতি দ্রুতই সফল হয়েছিলেন। বিষয়টি ছিল অনেকটা অভিযাত্রিকের মতোই। তাঁদের এই যাত্রা পুরোটাই ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। যদিও জয়নুলের জন্য ছিল নিজস্ব জল-হাওয়া-মাটি কিন্তু সফিউদ্দিনের জন্য যেন এক অচেনা বাঙ্গাল মুলুক। এবং এই অচেনা ভুবনের সাথে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নেয়া মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। তাহলে কীভাবে এই মাটিতে তাঁর শিকড় প্রোথিত করেছিলেন? শিল্পই কি ছিল তাঁর একমাত্র অবলম্বন? গগ্যাঁর মতো। যিনি তাহিতিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন এক ধরনের আদিম জ়ীবনের সন্ধানে। যাঁর শিল্পে খুঁজে পাওয়া যায় প্রিমিটিজম। সফিউদ্দিনও প্রিমিটিজমের সন্ধান করেছিলেন সাঁওতালদের মধ্যে। কলকাতার নাগরিক কোলাহল ছেড়ে চলে যেতেন সাওতাল পরগনায়। তিনি এঁকেছেন সাঁওতাল নারীদের, এঁকেছেন তাদের জীবন সংগ্রাম। তবে গগ্যাঁর তাহিতিতে চলে যাওয়া আর সফিউদ্দিনের ঢাকায় চলে আসাকে হয়তো একসূত্রে গাঁথা যায় না, কিন্তু এখানে কি এক ধরনের শিল্পীসুলভ অ্যাডভেঞ্চারিজম কাজ করেনি? শিল্পী মাত্রই তো অভিযাত্রিক – নতুন বিষয়ের সন্ধানে, নতুন প্রেরণার খোঁজে নিজের জীবনপাত করতেও কসুর করেন না। পিকাসো শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও স্পেন থেকে চলে এসেছিলেন প্যারিসে, শাগালও শিল্প-অভিবাসী হয়েছিলেন একই তীর্থে। শিল্পীদের এক শহর থেকে আরেক শহরে, দেশ থেকে দেশান্তরে চলে যাওয়া যেন এক প্রাচীন কৃষ্টি, দা ভিঞ্চি যেমন অভিবাসী হয়েছিলেন ফ্রান্সে।
সফিউদ্দীন এই বঙ্গে এসে খুঁজে পেলেন নতুন প্রেরণা, পাল্টে গেল তাঁর ছবির বিষয়। নতুন দেশ, নতুন প্রেরণা। গভীর পর্যবেক্ষণের ফলস্বরূপ তাঁর চিত্রপটে উঠে আসে বাংলার জলজ জীবন। মৎস্যকুল, মাছধরার জাল, আর জলের নিনাদ হয়ে ওঠে ছবির বিষয়বস্তু। যদিও তিনি ১৯৪৬ সালে এঁকেছেন সাওতাল পরগনার নিসর্গ ও মানুষ, এবং তাঁর উড এনগ্রেভিংয়ের দক্ষতায় তা হয়ে উঠেছে সাদাকালোর যাদু, তবু তার ধারাবাহিকতা এই ঢাকা পর্বের ছবিতে মেলে না। যদিও তাঁর সমসাময়িক শিল্পী ছাপচিত্রী হরেন দাস আজীবন এঁকে গেছেন মানুষ এবং নিসর্গের ছবি। দুজনেই ছাপচিত্রের ওস্তাদ শিল্পী। হরেন দাস কাঠখোদাই চিত্রের বাস্তবধর্মী শিল্পী হয়ে রইলেন আর সফিউদ্দীন এই বঙ্গে এসে বেছে নিলেন শিল্পের নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ। সফিউদ্দীনের ঢাকা আসার একশ বছরেও বেশি পূর্বে এই শহরে এসেছিলেন চার্লস ডয়েলি, তাঁর চোখে ধরা পড়েছিল ঢাকার নিসর্গের চমৎকারিত্ব এবং বিচিত্র জনজীবন। তাঁর স্কেচগুলিতে উঠে আসে সেই সময়ের চিত্র, অতঃপর তা এনগ্রেভিংয়ে ছেপে বই করলেন – ‘এন্টিকুইটিস অব ঢাকা’। ডয়েলির এই এনগ্রেভিংগুলোই বোধ হয় ঢাকা বিষয়ক ছাপচিত্রের প্রথম নমুনা। সফিউদ্দীন ঢাকাকে ডয়েলির চোখে দেখেননি, বরং আরো গভীরে গিয়ে এই বঙ্গের মানুষের শেকড়ের অনুসন্ধান করেছেন। ডয়েলি ঢাকায় এসেছিলেন ক্ষণিকের অতিথি হিসাবে এবং তাৎক্ষণিক মুগ্ধতার ছবি ফুটে উঠে তাঁর চিত্রকর্মে। সফিউদ্দিন এসেছিলেন এই শহরে থিতু হতে এবং শিল্প আন্দোলন গড়ে তোলার মহৎ ব্রত নিয়ে।
সফিউদ্দীনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাপাই ছবির প্রচার, যার নাকি এ-বঙ্গে চর্চা ছিল না বললেই চলে। এবং কালক্রমে তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায়, এই ছাপচিত্র মাধ্যমটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং শিল্পচর্চার প্রধানতম একট অনুষঙ্গে পরিণত হয়।
ছাপাই ছবির কুশলী রূপকার সফিউদ্দীন একদিকে যেমন দক্ষ ছিলেন বাস্তবধর্মী চিত্ররীতিতে তেমনি নিরীক্ষাধর্মী আধাবিমূর্ত-বিমূর্ত ধারাতেও সফল। তিনি একবৃত্তে কখনো স্থির থাকেননি, অনবরত নিজেকে অতিক্রম করে গেছেন। তাঁর জীবনে একটি ‘ত্রিভুজ ভ্রমণ’ যেন অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে। যেমন কলকাতা থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে লন্ডন। কলকাতা থেকে ঢাকা এসে তিনি নতুন আঙ্গিকে নিজস্ব চিত্রভাষা তৈরিতে সচেষ্ট হন, এবং সমকালীন শিল্পের যে-ধারা চলছিল তার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। বাস্তবধর্মী রীতিকে অতিক্রম করে তাঁর ছবি হয়ে ওঠে জ্যামিতিক এবং আরো বেশি প্রকাশমুখী। এইসময় তিনি পঞ্চাশ দশকের ইউরোপীয় চিত্রকলার আন্দোলনের ব্যপারে আরো আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৫৬ সালে লন্ডনে গমন করেন। এই সময় থেকে তাঁর ছবি আরো বেশি আধুনিক হয়ে ওঠে। তিনি যেন ধাবিত হন এক রেখাময় বিমূর্তার ভুবনে। সমস্ত ইউরোপ জুড়ে চিত্রকলার জগতে তথা ছাপচিত্র মাধ্যমে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নতুন চিন্তার মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল, সফিউদ্দিনও তাতে শামিল হলেন। এক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিলেন জগদ্বিখ্যাত ছাপচিত্রী হেইটার। শোভন সোমের ভাষায়,
সফিউদ্দিন যখন ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন তখনও ভারতে মুকুল চন্দ্র, রমেন্দ্রনাথ, হরেন্দ্রনারায়ণের পরের ছাপছবিতে আধুনিক ইউরোপিয়ান করণকৌশল আসেনি, সাবেক এচিং, ড্রাই পয়েন্ট, লাইন এনগ্রেভিং চলছিল। এদিক থেকে সফিউদ্দিনকে কেবল বাংলাদেশেরই নয়, উপমহাদেশেরও পথিকৃত বলা যায়। (নিরন্তর, ফাল্গুন, ১৪০৬)
সফিউদ্দীনের ছপচিত্র নিয়ে নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সাহসী পদক্ষেপ ছাপচিত্রের এই মাধ্যমটিকেই এক উচ্চাঙ্গের আসনে পৌঁছে দিয়েছে। তিনি যখন ছাপচিত্রের চর্চা শুরু করেন তখন তাঁর আদর্শ ছিল ড্যুরার কিংবা বেউইক, একাডেমিক বা বাস্তবধর্মী শৈলীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পারদর্শী। তবে এখানেই তিনি থেমে থাকেননি; নানা পথ পরিক্রমায় হেইটারে এসেই যেন সার্থকতা পেয়েছিলেন। তিনি মূলত ছিলেন সৃষ্টিশীলতার যাত্রাপথের এক নিরন্তর পথিক।
. . . . . . . . . . . . .
(প্রথম প্রকাশ : কালি ও কলম, সফিউদ্দীন আহমেদ সংখ্যা, নবম বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা, শ্রাবণ ১৪১৯)
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
রায়হান রশিদ - ৯ আগস্ট ২০১২ (৩:৫৭ অপরাহ্ণ)
পরিচয় ছিল না, পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য রশীদ আমিন ভাইকে ধন্যবাদ।