বেইজিং-এর পথে
হংকং-এ বেশ কিছুদিন কেটে গেল। কখনো ধীর লয়ে, আবার কখনো দ্রুত গতিতে। প্রায় দু সপ্তাহ। এর মধ্যে রুটিন ওয়ার্কের মধ্যে ছিল মাঝে মাঝে গ্যালারিতে গিয়ে বসা এবং দর্শনার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়া। এর মধ্যে মিশালের সাথে গিয়ে একটি অকশন পার্টিও দেখে এসেছি। আমাদের স্মৃতি বিজড়িত চুংকিং ম্যানশনে গিয়েছি একবার। অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ল; কিছু সংস্কার করা হয়েছে। আগে দেখতাম অনেক বাঙালি ভাইয়েরা এদিক-সেদিক বসে থাকত, ভেসে আসত বাংলা কথা। এবার তাদের একজনকেও দেখলাম না। হংকং-এর ভিসা পাওয়া এখন অনেক কঠিন হয়ে গেছে, তাই অনেকেই এখন এমুখো হয় না। আমার সমসাময়িক কয়েকজন ছাত্র বেইজিং-এ পড়াশুনা শেষ করে হংকং-এ থিতু হয়েছে, তাদের সাথেও যোগাযোগ হলো। একদিন মিলিত হয়েছিলাম ডিনারে। আগে সংখ্যায় অনেক ছিল; অনেকেই চলে গেছে কানাডায়, এখন আছে মাত্র তিনজন। সাইফুল ভাই, ফরহাদ ভাই এবং পাশা। ফরহাদ ভাই স্থপতি, সাইফুল ভাই ব্যবসায়ী আর পাশা প্রোকৌশলী। সবাই ভালো করেছে। পাশা সপরিবারে চলে যাচ্ছে কানাডায়। পাশার ফেয়ারওয়েল ছিল, সেখানেই দেখা হলো পুরনো বন্ধুদের সাথে, প্রায় দেড়যুগ পরে। আমি যে আবার বেইজিং-এ ফিরে এসেছি এদের অনেকেই জানত না; সুতরাং দেখা হওয়াটা ছিল একটা সারপ্রাইজ। অনেক কথা হলো, বেইজিং-এর বিষয়ই ঘুরেফিরে আসছিল। তারুণ্য-ভরপুর সেই সময়গুলোতেই যেন বার বার ফিরে যাচ্ছিলাম। বেইজিং-এ আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিলাম। ইতিমধ্যে ট্রেনের টিকেট কেটে ফেলেছি। পরের দিনই ফিরে যাব বেইজিং-এ, যার জন্য একটু তাড়াও ছিল।
মক ভাই কী যেন এক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন; সিসিসিডির কর্মীরা সবাই ব্যস্ত। তাই আমাকে বিদায় জানাতে পারবেন না বলে আগেই দেখাসাক্ষাৎ এবং বিদায়পর্ব সেরে নিয়েছি; তবে লক আর মকচাই আমাকে ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে দেবে। যেদিন চলে আসব সেদিন সকাল সকাল মকচাই ও লক চলে এল। আমরা সকালে একসাথে নাস্তা সারলাম একটি রেস্তোরাঁয়। আবার ফিরে গেলাম রুমে। সেখানে আড্ডা এবং আমার গোছগাছ দুটোই সমান তালে চলছিল। মকচাই ও লক পরস্পরের পূর্বপরিচিত, লক মকচাইয়ের স্বামী ফু-এর বিশেষ বন্ধু ছিল। মকচাইয়ের সাথে লকের অনেকদিন পরে দেখা হলো। দেখতে দেখতে আমাদের স্টেশনে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। বাসে যেতে হবে কিছু পথ। আমার ব্যাগ আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম, সাথে বন্ধু লক এবং মকচাই। বাসে যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম নানা কিছু। এবার খুব ইচ্ছা ছিল আমার স্মৃতিময় সেই জায়গাটিতে যাওয়ার, অর্থাৎ ল্যানথাও আইল্যান্ড। এক অপূর্ব স্বর্গ। ১৯৯২ সালে চীন থেকে আমার ডিগ্রি শেষ করে হংকং হয়ে দেশে ফিরছিলাম; তখন কয়েকদিনের জন্য ল্যানথাও আইল্যন্ডে থাকার সুযোগ হয়েছিল। মক ভাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধুর বাসায় থাকার। কাউলুন থেকে আগে দু ঘণ্টা লাগত ফেরিতে। সেখানে একটি সপ্তাহ চমৎকার কেটেছিল। ছবির মতো একটি দ্বীপ। মনে হয়েছিল এক স্বপ্নের দেশে চলে এসেছি। বিস্তীর্ণ শণক্ষেত, তার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে কংক্রিটের সরু রাস্তা, শুধু দুটি সাইকেল পাশাপাশি যেতে পারে। আমিও একটি সাইকেল জোগাড় করে নিয়েছিলাম। প্রতিদিন কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে সমুদ্রের পারে চলে আসতাম, বড্ড নির্জন সমুদ্রসৈকত। একটি কাফেতে বসে থাকতাম আর হংকং-এর বিখ্যাত আইস টি খেতাম। এবার যাওয়া হলো না সেই ল্যানথাও আইল্যান্ডে। তবে শুনেছি ওই দ্বীপে আগের সেই নির্জনতা আর নেই। উন্নয়নের জোয়ারে সব ভেসে গেছে। তাহলে বোধহয় না গিয়ে ভালোই করেছি। মনের পটে যে ছবিটি আঁকা আছে, তাই বেঁচে থাক।
বাস এসে থামলো হোংহাম স্টেশনে, এবার বিদায়ের পালা। মকচাই এবং লকের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। কৃতজ্ঞতা জানালাম লককে তার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য, মকচাইয়ের কাছেও ঋণী হয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে ইমিগ্রেশনের দিকে ঢুকে গেলাম। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলাম। ট্রেন ছাড়তে আরো কিছু সময় বাকি আছে। বসে ভাবছিলাম, কীভাবে পার হয়ে গেল দুটি সপ্তাহ! তবে এই ক’দিনে ঘটে গেছে অনেক কিছু – প্রদর্শনী হলো, পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হলো, আবার যৎকিঞ্চিৎ বেড়ানোও হলো। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে করতে দেখছিলাম বেশ কিছু মহিলা প্রায় সদ্যোজাত শিশুদের কোলে নিয়ে বসে আছে; তারাও এই ট্রেনের যাত্রী, অর্থাৎ চীন মূল ভূখণ্ডের দিকেই যাবে। আমার একটু কৌতূহল হলো; পাশে বসা এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করায় তিনি একগাল হাসলেন, বললেন, এরা সবাই চীন মূল ভূখণ্ড থেকে এসেছেন। চীনদেশে যেহেতু একটির বেশি বাচ্চা নেয়া বেআইনি তাই অনেক বিত্তবান চীনা এখানে এসে একাধিক বাচ্চা নিয়ে থাকে; আর হংকং চীনের নিয়মের আওতায় পড়ে না। এটি এখন নৈমিত্তিক ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি আমার বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হলো। নানাবিধ ভ্রমণের তালিকায় নতুন একটি সংযোজন হতে পারে —প্রসব ভ্রমণ।
ট্রেনের সময় হয়ে গেল, ট্রেনে উঠে পড়লাম। প্রায় সদ্যোজাত শিশুদের মধ্যে কয়েকজন চিৎকার করে উঠল, ট্রেনের সিটিও বেজে উঠল। সিটির আওয়াজ আর কান্নার শব্দ একাকার হয়ে গেল। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল বেইজিং-এর পথে।
(সমাপ্ত)
[প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব]