এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বেইজিং এখন বিশ্ব শিল্পকলার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বেইজিং-এর গুরুত্ব ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পৃথিবীবিখ্যাত বড় বড় মিউজিয়ামের ট্রাভেলিং এক্সিবিশন-এর তালিকায় বেইজিং-এর নাম অনেক আগেই উঠে গেছে। বেইজিং-এর মিউজিয়ামগুলোর অবকাঠামোগত ভাবেও হয়েছে ঈর্ষণীয় উন্নতি। দু হাজার আট সালের অলিম্পিক অবশ্য বেইজিং শহরটিকেই যেন এনে দিয়েছে অন্য এক মাত্রা। ইতিমধ্যে এই শহরে ঘুরে গেছে রদ্যাঁ, দালি সহ আরো সব বিখ্যাত শিল্পীরা (মানে তাঁদের শিল্পকর্ম)। কয়েক মাস আগে দেখলাম জার্মান শিল্পী রিখটার-এর সারা জীবনের কাজ। আর এই সব প্রদর্শনীর মূল আয়োজক চীনের জাতীয় প্রদর্শনশালা “ন্যাশনাল আর্ট মিউজিয়াম অব চায়না”, আগে যার নাম ছিল চায়না আর্ট গ্যালারি। এই মিউজিয়ামটিই এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নানামুখী শিল্প-কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র।
সম্প্রতি প্রদর্শিত হলো বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী টার্নারের সারা জীবনের চিত্রকর্মের এক দুর্লভ সম্ভার। টেট ব্রিটেনের সংগ্রহ থেকে এই প্রদর্শনীর আয়োজন। বেইজিং-এ বসে টার্নার! এ যেন অকল্পনীয়। এ যেন এক অসম্ভব এক স্বপ্নপূরণ। কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছিল না। তবে চীনা বন্ধুদের প্রতিনিয়ত আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বুঝতে পারলাম বেইজিং-এ একটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে। বেইজিং এতো বড় শহর — এই প্রান্ত থেকে বোঝার উপায় নেই ওই প্রান্তে কি ঘটছে। তবে টার্নারের প্রদর্শনী যথেষ্ট প্রচার পেয়েছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে বেশ কয়েকবার ফলাও করে এই প্রদর্শনীর খবর প্রচারিত হয়েছে। এবং রেকর্ড সংখ্যক চীনা দর্শক এই প্রদর্শনী উপভোগ করেছে। টার্নার আমারও খুবই প্রিয় শিল্পী। আমরা যখন চারুকলার প্রথম দিককার ছাত্র, তখন প্রায়ই কানে বাজতো টার্নার ও কনস্টেবল — এই দুটি নাম। রোমান্টিসিজম শিল্প ঘরানার ব্রিটিশ মানিকজোড়। টার্নার বাস্তবিকই শিল্পকলার ইতিহাসে এক মহান অমর শিল্পী, যাঁর ক্যানভাসে প্রথম দেখা যায় এক অন্য রকমের বর্ণিল উচ্ছ্বাস। ভেসে ওঠে আধ্যাত্মিকতার ছবি, অন্তরের ছবি, আমরা দিব্যদৃষ্টিতে যা দেখি তাকে ছাপিয়ে অন্যরকম ছবি। ক্যানভাস যেন অনেক বর্ণিল হয়ে ওঠে। রঙই সর্বস্ব। ছবি মানেই রঙ, সেই ফবিস্টদের কথা – তার সূচনা কোথায় ছিল, হয়তো-বা এই টার্নারেই ছিল। যাকে বলে শিল্পের পরম্পরা। আর ইম্প্রেশনিস্টরা এতো বর্ণময় আভা কোথা থেকে পেল। কোনো কিছুই তো ভুঁইফোড় নয়, একটা যোগসূত্র তো থাকে। ব্রিটিশরা সবসময় দাবি করে আসছে, টার্নারই ইম্প্রেশনিজমের জনক, হয়তো এই ঘরানার তিনি নিঃসঙ্গ পথিক, আর ফরাসি ইম্প্রেশনিস্টরা দল বেঁধে আন্দোলনে পরিণত করেছিল। টার্নারই বোধ হয় একমাত্র ভাগ্যবান শিল্পী যিনি সময় থেকে এগিয়ে থেকেও, জীবদ্দশাতেই মূল্যায়ন পেয়েছেন; তাঁকে ভ্যান গগের ভাগ্য বরণ করতে হয়নি।
প্রদর্শনী দেখতে বেরোব, দেখি আকাশ কালো হয়ে এসেছে, কৃষ্ণ মেঘের ছড়াছড়ি। মনে মনে ভাবলাম এই তো মাহেন্দ্র ক্ষণ টার্নারের ছবি দেখার। পথে নামতেই আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টি নামল। তুমুল বর্ষণ। বেইজিং-এ অবশ্য বৃষ্টির জন্য কোনো কিছু থেমে থাকে না। বাসে চেপে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে পৌঁছানো গেল কোনোমতে। মিউজিয়ামের ভিতরে ঢুকে অবাক, এত তুমুল বর্ষণের মধ্যেও প্রচুর দর্শক, একেবারে লোকে লোকারণ্য।
বেইজিং-এ বসে টার্নার দেখার সুযোগ বোধ হয় কেউ হাতছাড়া করতে চাইছে না। প্রদর্শনীকক্ষে ছবি তোলা নিষেধ। যাক, অন্তত শটার পতনের একঘেয়ে ঘচাং ঘচাং আওয়াজ থেকে বাঁচা গেল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। এক গাইড ভদ্রমহিলা এত উচ্চস্বরে তাঁর মুগ্ধ শ্রোতাদের টার্নার-মহিমা বয়ান করে যাচ্ছেন যে, আরেকটু হলে ছবিগুলো সব চিৎকার করে উঠতো। সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে ছবি দেখায় মগ্ন হলাম। একে একে দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। শতাধিক তৈলচিত্র, তারও অধিক সংখ্যক জলরং, এবং নানা মাধ্যমের কাজের এক অপূর্ব সমাহার। বই-পুস্তকে আমরা শুধু কয়েকটি ছবি দেখেছি। আমরা টার্নারকে জানি শুধু নিসর্গচিত্রী হিসাবে, তবে এই প্রদর্শনী দেখে সেই ধারণাও ভেঙে গেল। দেখতে পেলাম নানা আঙ্গিক নানা বিষয়ের ছবি। জীবনের বিভিন্ন স্তরের ছবি। এখানে এসে যেন পুর্ণাঙ্গ টার্নারকে খুঁজে পেলাম।
টার্নার জন্ম গ্রহণ করেন ১৭৭৫ সালের ২৩শে এপ্রিল, লন্ডনে। পারিবারিকভাবে খুব একটা স্বচ্ছল ছিলেন না। বাবা ছিলেন নরসুন্দর, সেই সাথে পরচুলা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মা মনোরোগী। তাই পারিবারিক আবহটা খুব ভালো ছিল না। খুব অল্প বয়সেই টার্নারের প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে। পারিবারিক ঝঞ্ঝাটের কারণে তাঁকে প্রেরণ করা হয় পিতৃব্যের গৃহে। সেটা ছিল এক অপরূপ নৈসর্গিক স্বর্গ। টেম্স্ নদীর তীরে। সম্ভবত এখান থেকেই তাঁর নিসর্গপ্রীতির উন্মেষ। টার্নার মূলত চিত্রকলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তাঁর অসাধারণ সব নিসর্গ চিত্রমালার কারণেই। তবে তাঁর এই প্রদর্শনীর অপরাপর ধারার চিত্রসমূহও এক অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে। মানব দেহ অঙ্কনেও যথেষ্ট দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। কিছু কিছু চিত্রে মানুষ ও প্রকৃতি একাকার হয়ে গেছে । রোমান্টিক ধারার এই শিল্পীর চিত্রকর্মের যে-বিষয়গুলো আমাদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে : প্রকৃতির রুদ্র রূপকে ক্যানভাসে তুলে ধরা, সেই সাথে উঠে আসে প্রকৃতির বিশালত্ব, ঝড়ঝঞ্ঝা সহ বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেমন ছবির বিষয়বস্তু, তেমনি রৌদ্র ছায়া, বর্ণিল আকাশ, নীল সমুদ্র, ঝড়ে-পড়া জাহাজ, সবই যেন ক্যানভাসে এক এপিক রূপ পরিগ্রহ করে। আসলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের রোমান্টিক শিল্পধারার চরিত্রটাই ছিল এমন; একদিকে মানবের বীরগাথা আর অন্যদিকে প্রকৃতির রুদ্র মূর্তি।
এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ছবিগুলো টার্নারের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নেওয়া, প্রথম পর্যায়ের কিছু অনুশীলনধর্মী কাজও আছে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধের ক্যানভাসগুলোতে অনেক বেশি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ছবি ফুটে উঠেছে; যেমন – “হানিবল ও তার সেনাবাহিনীর আল্প্স্ অতিক্রমের চিত্র” (১৮১২) এবং “ওয়াটার লুর ময়দান” (১৮১৮), দুটি ছবিই তেলরঙে আঁকা। তবে উনিশ শতকের চল্লিশের দশকের ছবিগুলোকেই বলা যেতে পারে তাঁর জীবনের মাইলফলক ছবি। এই সময়টিতে যেন প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধ বর্ণিল রূপটিই ধরা দেয় ক্যানভাসে। যেমন “লেকের উপর সূর্যাস্ত” (তেলরঙ , ১৮৪৪–৪৫) এবং “নরহাম ক্যাসেলে সূর্যোদয়” (তেলরঙ, ১৮৪৫)। তবে পুরো প্রদর্শনী ঘুরে আমার কাছে মনে হয়েছে টার্নার মনে-প্রাণে একজন নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী। চিত্রকলার নানা মাধ্যমে তিনি বিচরণ করেছেন। যেমন তেলরঙ, জলরঙ থেকে পেন্সিল, কন্টি সহ নানা মিশ্রমাধ্যম। জলরঙের ছবিগুলো দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। বলা যেতে পারে এটি আমার জন্য একটি দুর্লভ সুযোগ, টার্নারের এতগুলো জলরঙের ছবি একসঙ্গে দেখার। জলরঙের ছবিগুলো বেশিরভাগই ছোট আকারের। এই ছবিগুলো দেখলে সত্যি মুগ্ধ হতে হয়, স্বচ্ছ ব্রিটিশ কায়দার জলরঙ, যা বলা যেতে পারে একটি ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ ধারা। বিষয়বস্তু বেশিরভাগই নিসর্গ দৃশ্য। ব্রিটিশ কায়দার নিসর্গ জলরঙ চিত্রের প্রধানতম একজন গুরু হিসাবে ধরা হয় টার্নারকে। কোম্পানি আমলে যে ব্রিটিশ চিত্রকরেরা ভারতবর্ষে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন এই নিসর্গিচত্র ঘরানার। আমাদের দেশের “নদী-নৌকা” আঙ্গিকের যে চিত্র ধারাটি প্রচলিত আছে তার সাথেও কোথায় যেন মিল খুঁজে পাওয়া যায় এই ব্রিটিশ ঘরানার নিসর্গ চিত্রের। আর এ-কথা তো বলাই বাহুল্য যে, আমাদের দেশের শিল্পশিক্ষা পুরোপুরিই ব্রিটিশ আশ্রিত।
একের পর এক ছবি দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এ তো শুধু ছবি দেখা নয় – যেন একটি স্বপ্ন পূরণ, টার্নারের অরিজিনাল ছবি দেখা। একটা ছবির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম; ছবির নাম “সমুদ্রের মাঝি” (ফিশার ম্যান এট সি), অনেকক্ষণ ছবিটি দেখে মানসপটে ভেসে উঠলো মানিকের “পদ্মা নদীর মাঝি”র চিত্রকল্প। এবং অনুভব করলাম আন্তঃদেশীয় এক সাংস্কৃতিক ঐকতান। শিল্পের রোমান্টিক ধারা কি শুধু চিত্রকলায় ছিল? তা তো নয়, কবিতা ও উপন্যাসেও এর প্রভাব ব্যপক। সমস্ত পৃথিবী যেন কয়েক শ’ বছর এই রোমান্টিক ধারাতেই আচ্ছন্ন। শিল্পী টার্নারের প্রথম দিকের ছবি বাস্তবতা-নির্ভর হলেও, পরবর্তীকালে তাঁর ছবি খুব বেশি মাত্রায় বর্ণাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। ক্যানভাস থেকে যেন রঙ ঠিকরে বেরুচ্ছে। সূর্যাস্তের রক্তিম আভা টার্নারের আগে কোনো শিল্পী এই ভাবে দেখেছেন কিনা জানা নেই। সেই টার্নার-ইমেজ যেন পৃথিবীকে এখনো আচ্ছন্ন করে রেখেছে । আমরা যখন সমুদ্রে যাই, তখন ভাবি আমাদের কে শেখালেন এই সূর্যাস্ত দেখা। মানসপটে ভেসে ওঠে টার্নারেরই ছবি।
বলা যেতে পারে বেইজিং-এর এই ন্যাশনাল আর্ট মিউজিয়ামে টার্নারের এই রেট্রোস্পেকটিভ যথেষ্ট সফল। প্রতিদিন হাজার হাজার চীনা দর্শক এসেছে দেখতে, যাকে বলে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ার মতো অবস্থা। বেইজিং-এ বসবাসরত প্রবাসীরাও উপভোগ করেছে এই প্রদর্শনী। আমার সহপাঠী ওয়াং পো সুন-কে জিজ্ঞেস করলাম, চীনাদের এই টার্নার প্রীতির কারণ কী? ওর জবাব ছিল, টার্নার চীনাদের খুব প্রিয় শিল্পী, বিশেষ করে তাঁর ল্যান্ডস্কেপগুলির কারণে। চীনা ঐতিহ্যও ল্যান্ডস্কেপের, যা “পাহাড় ও জলধারা” চিত্রশৈলী নামে পরিচিত। হয়তো-বা সেই কারণেই চীনারা একটি যোগসূত্র খুঁজে পায়। তবে এটাও তো ঠিক, সুদূর ব্রিটেনে গিয়ে কয়জনের ভাগ্য হয় টার্নার দেখার। সুতরাং সেই টার্নার যখন খোদ বেইজিং-এ কে ছাড়ে এই সুযোগ!
প্রদর্শনী দেখে যখন রাস্তায় বেরোলাম, তখন বৃষ্টি থেমে গেছে – আকাশে শুরু হয়ে গেছে রৌদ্র-মেঘের খেলা, ঠিক যেন টার্নারের ছবির মতো!
