শীত গ্রীষ্মের পার্থক্য মোটা দাগে অনুভব করা যায় এই বেইজিং-এ বসে। শীতকালে হিমশীতল পত্রপুষ্পহীন-বৃক্ষময় রুক্ষ এক প্রকৃতি, আবার গ্রীষ্মে পত্রপল্লবে উষ্ণতায় এক অপরূপ সবুজ পৃথিবী — এই বৈপরীত্য আমাদের কাছে বিস্ময়কর। কারণ আমরা এমন এক দেশ থেকে এসেছি যেখানে শীতের প্রকোপ নেই বললেই চলে। সারা বছর গরমে দগ্ধ হতে হতে ডিসেম্বর জানুয়ারিতে আমরা যতটুকু শীতের পরশ পাই, তা আমাদেরকে একটু স্বস্তিই এনে দেয়। আমাদের দেশে এই শীতটুকু ভীষণ উপভোগ করি। পিঠে-পুলি তৈরির ধুম পড়ে যায়, সর্বত্র উৎসব উৎসব ভাব। শীতের শাক-সবজির স্বাদই যেন আলাদা, শীত মানেই আমাদের দেশে এক ধরনের সতেজতা, কি খাবারদাবার কি জীবনযাপনে যেন এক আরামদায়ক সুখী সুখী ভাব। শীতের সময় সদ্য-ওঠা ফুলকপির সাথে কই মাছের ঝোল যেন অমৃত সমান। অথচ এই বেইজিং-এ যেন সম্পূর্ণ উল্টো, এখানে শীত মানে বিভীষিকা, মাইনাস ডিগ্রি তাপমাত্রায় আর যাই হোক শীতকে উপভোগ করা যায় না। আর প্রকৃতি এত রুক্ষ হয়ে যায় যে মনটা কেমন যেন ভার ভার ঠেকে, গাছের পাতা সব ঝরে যায়, মৃত গাছগুলি দাঁড়িয়ে থাকে সটান। শীতের সাথে সাথে উত্তুরে বাতাস আর ধুলিঝড়, ঝড়ো বাতাসের আঘাতে পত্রপুষ্পহীন গাছগুলি যেন আর্তনাদ করে ওঠে। আর এই বৃক্ষের আর্তনাদ শুনতে শুনতে কাটাতে হয় পুরো শীতকাল। তবে রক্ষা — হিটিং-এর ব্যবস্থা থাকায় ঘরটা উষ্ণ থাকে; রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে বেইজিংবাসী এই উষ্ণতাটুকু উপভোগ করে। বাইরে শীত, ঘরে উষ্ণতা। আবার ঘর থেকে বাইরে বেরুতে হলে রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বেরুতে হয়, শীতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। গায়ে গলাতে হয় পরতের পর পরত পোশাক, শীতের ব্রহ্মাস্ত্র পোশাকের ঢাল ভেদ করে হাড়ে যেন কাঁপন ধরাতে না পারে। আবার ঘরে এসে ভারী পোশাকগুলো খুলে রাখতে হয়, তা নাহলে ঘরের উষ্ণতার সাথে সমন্বয় হবে না। সেই তুলনায় আমাদের দেশে আমরা যথেষ্ট আরামে থাকি, গায়ে কোনো রকমে একটি পুলওভার চাপালেই হয়ে যায়, বড়জোর একটি শখের জ্যাকেট। জুতো পরারও কোনো বালাই নেই, শীতের সময়ও আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ জুতো পরে না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, দু ফিতার স্যান্ডেলই সম্বল। উত্তরাঞ্চলের মানুষগুলোকে অবশ্য দারিদ্র্য ও শীত দুটোর সাথেই লড়াই করতে হয়। চীনদেশ এ পর্যায় অতিক্রম করে এসেছে অনেক আগেই, তবে এক পর্যায়ে চীনকেও নানান প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এখানে গ্রামের চাষীবউরা নিজেরাই জুতো বানায় কাপড় দিয়ে, এই স্বহস্তে তৈরি পাদুকাই তাদের শীত-গ্রীষ্মের সাথী। শীতের তীব্রতার বিরুদ্ধে চীনকেও লড়াই করতে হয়, ঘরে ঘরে হিটিং-এর ব্যবস্থা করতে হয়। এটি যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ, তাই সমগ্র চীনকে হিটিং-এর আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
সাধারণত চীনকে ভৌগোলিকভাবে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ইয়াংশ নদীকে কেন্দ্র করে আবহাওয়াগত ভাবে উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে বিভাজন করা হয় এ দেশকে — ইয়াংশ নদীর দক্ষিণ দিককে উষ্ণ মণ্ডলীয় এবং উত্তরাঞ্চলকে শীতপ্রধান হিসেবে ধরা হয়। তাই কৃচ্ছ্রতা সাধনের জন্য দক্ষিণ চীনে হিটিং-এর কোনো ব্যবস্থা নেই, যদিও কখনও কখনও দক্ষিণে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নেমে আসে। ইয়াংশ নদীর ওপারে হওয়ায় সাংহাই, ক্যান্টন, চেংদু-র মতো বড় শহরগুলো হিটিং ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। বেইজিং উত্তরের শহর আর শীতের তীব্রতাও এখানে প্রচণ্ড; আর তাই ঘরে ঘরে রয়েছে হিটিং-এর ব্যবস্থা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মার্চের পনেরো তারিখে হিটিং বন্ধ হয়ে যায়, তখন মাস খানেক সময় আমাদের অস্বস্তিতে ভুগতে হয়, কারণ তখনও তাপমাত্রা মাঝে মাঝে এক-দুই ডিগ্রিতে নেমে আসে। তবে এপ্রিলেই বেইজিং-এর চেহারাটা পালটে যায়, পুষ্পে-পত্রে বৃক্ষগুলো যেন আবার প্রাণ ফিরে পায় । বসন্তদিনের আবহে বেইজিং হয়ে ওঠে প্রাণোচ্ছল ।
তীব্র শীতার্ত সময়ে বসন্তেরই প্রতীক্ষায় থাকে যেন সবাই — কবে বসন্ত আসবে, কবে কেটে যাবে এই স্বেচ্ছা-গৃহবাস। অবশেষে বসন্ত দ্বারে কড়া নাড়ে। বেইজিং-এ এ বছর বসন্তের অভিষেক হয়েছে জানুয়ারির ছাব্বিশ তারিখে, যাকে ‘চীনা নববর্ষ’ও বলা হয়; যদিও প্রকৃতি তখনও হিমশীতল, তবুও বসন্তের আগমনে চীনারা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। এই আগমনবার্তা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য চীনারা পটকা ফোটায়, বাজি পোড়ায়। দু সপ্তাহ ব্যাপী চীন যেন এক বসন্ত-যুদ্ধে মেতে উঠে, শীতার্ত নীরবতা ভেদ করে চারিদিক পটকার শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে । লক্ষ-কোটি টাকা যেন বাজির আওয়াজেই উবে গেল, আবার এও জানিয়ে গেল যে চীনাদের ট্যাঁকে টাকা এসেছে। বারুদের আবিষ্কর্তা যে চীনারা তাও যেন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল এই বেইজিং-এ বসে।
চীনাদের বসন্ত উৎসব যখন শুরু হয়, তখনও বেশ শীত; তবে প্রকৃত বসন্ত উপভোগ করা যায় এই এপ্রিল মাসে। এই সময় বেইজিং-এর আবহাওয়া খুবই মনোরম, না ঠাণ্ডা না গরম। বেইজিং-এর আকর্ষণীয় পুষ্প উদ্যান (গার্ডেন পার্ক) গুলো ফুলে ফুলে ভরে ঠে। চেরি ফুল ফোটে সর্বত্র, বেইজিং হয়ে ওঠে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। বেইজিং শহরের প্রাণ হচ্ছে তার উদ্যানগুলো, বয়সে প্রাচীন এই উদ্যানগুলো পুরোপুরিই চীনা চরিত্রের। প্রাচীন বৃক্ষের সমাহার, নানা প্রজাতির ফুল, জলাধার, হ্রদ, হ্রদের উপর চীনা কায়দার সেতু আর হ্রদে ফুটে থাকা বিশালাকার পদ্মফুলের সমাহার — এ সবই এক অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রদান করে উদ্যানগুলোকে। আর এই এপ্রিল মাসেই যেন রূপ-যৌবন ফিরে পায় উদ্যানগুলো। মানুষেরাও বেশ আমুদে হয়ে ওঠে এই সময় — শীতকালীন গোমড়া ভাবটা কেটে যায়, সবার মনেই বসন্তের রং লাগে। রাস্তায়, বাসে, পাতাল-ট্রেনে কপোত-কপোতীদের আরো ঘনিষ্ঠ হতে দেখা যায়। কারো হাতে ফুল, কারো হাতে উপহার। বেইজিংবাসী এই বসন্তের সময়টুকু প্রাণ ভরে উপভোগ করে। আমাদের দেশের প্রকৃতি সারা বছরই সবুজ, তাই আমাদেরকে শুনতে হয় না পত্রপুষ্পহীন বৃক্ষের বিলাপ, আমরা অনেক ভাগ্যবান। তবে গ্রীষ্মকালে বেইজিংও অনেক সবুজ। চীনারাও যথেষ্ট বৃক্ষপ্রেমিক, তাই বেইজিং-এর যথেষ্ট নগরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ গাছগুলিকে তারা রক্ষা করতে পেরেছে। গ্রীষ্মকালের বেইজিং যেন অন্য চেহারা নেয়, রাস্তার ধারে নানা বর্ণের ফুলের সমাহার। বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে, সরকারি আয়োজনে ফুলের টবকে নানাভাবে সাজিয়ে নানা ধরনের নকশা তৈরি করে, যা রাস্তার ধারে শোভা পায়। এই ধরনের আয়োজনে বোধ হয় বেইজিং অনন্য। বিশালাকৃতির এই শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে অনেকগুলি উদ্যান বা পার্ক। এই উদ্যানগুলি এই শহরকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। পার্কগুলি প্রতিদিন প্রবীণ নবীন শিশু কিশোরদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। আর বসন্তে সেগুলি যেন আরো বেশি প্রাণোচ্ছল।
এই শহরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শহরের মাঝখান দিয়ে কয়েকটি লেক বয়ে গেছে, যা বেইজিং নগরীকে করে তুলেছে আরো মোহনীয়। শীতের সময় লেকগুলিতে বরফ জমে থাকে, আর বসন্তে বরফ গলে রূপ নেয় স্বচ্ছ জলধারায়। পুষ্প, বৃক্ষ, জলধারায় বসন্তে আরো বর্ণিল হয়ে ওঠে প্রাচ্য নগরী বেইজিং।