বাড়িভাড়া আইন, কাজীর কিতাব এবং তোঘলকি বাস্তবতা…!

@ যে গল্পের উপসংহার নেই, ভূমিকাও নেই

অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান ; মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এই পাঁচটি অধিকার যে আসলে একটা কিতাবী বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়, আজকাল এটা যেকোনো নির্বোধও বোঝে। তাই বোধ করি কেউ এখন আর এটা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেন না বা করতে চান না। কিন্তু উচ্চবাচ্য করা এবং না করা এই উভয়টাই যে ব্যক্তির অন্যতম মৌলিক অধিকার এটাও কি সবাই বুঝেন ?

আমার বউ আমার, গরীবের বউ সবার- দেশে এরকম একটা সম্ভ্রান্ত নীতির জয়জয়কারে আজ আর আশ্চর্য হই না মোটেও। কেননা সমাজের একজন মানুষ এবং রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে ন্যুনতম নৈতিকতা এবং দায়বোধ যখন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হারিয়ে ফেলে, তখন সে কি আর মানুষ থাকে ? হয় যন্ত্র, নয় পশু হয়ে যায়। বাজার পরিস্থিতিকে অস্বাভাবিক করে তোলে দ্রব্যমূল্যের যথেচ্ছচারিতা আর নৈরাজ্য দেখলে এই ছোট্ট গরীব দেশটা কোনো মনুষ্য সমাজের অন্তর্ভূক্ত ভাবতেও কষ্ট হয় খুব। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন বা বাজার অর্থনীতির স্বঘোষিত মা-বাপ বনে গেছেন, এরা কি ভোক্তা সাধারণকে গরু-ছাগলের চাইতে বেশি কিছু ভাবেন ? সন্দেহ। আর আমাদের রাষ্ট্রপিতারাই বা তখত-এ-তাউসে বসে অভাজন নাগরিকদেরকে কী চোখে দেখেন এটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। সীমিত আয়ের নিরূপায় অসহায় নাগরিক হিসেবে আমাদের ভাবনা একটাই- সারাদিনের কর্মক্লান্ত ন্যুব্জ শরীরটাকে টেনে হিছড়ে বাজার নামক একটা অসম যুদ্ধক্ষেত্রে তুলোধুনা করিয়ে শেষ পর্যন্ত ভাড়া-বাসা নামের একটা মহার্ঘ খোয়াড়ে নিয়ে যখন ছুঁড়ে দেই, তখন এই শরীরটা কি আর কোনো মানুষের শরীর থাকে ? শরীরগতভাবে মানুষ আর পশুতে প্রভেদ কতটুকু ? মানুষের বোধ, সম্মান ও অধিকার নামের ধারণাগুলো আমাদের এই শরীর থেকে যারা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে সুকৌশলে, তারা কারা ?

কদিন আগে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর একটি জরিপের ফলাফল দেখলাম বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। এতে বলা হচ্ছে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ১১৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। পক্ষান্তরে এই সময়ে বাড়িভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, ২৫৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এই জরিপকালের পর পরই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যে অতীতের সমস্ত রেকর্ড চুরমার করে আকাশে গিয়ে ঠেকেছে, সেটা জরিপে আসার সুযোগ হয়তো পায়নি এখনো। ক্যাবের জরিপে বলা হয়েছে, গতবছর ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়া বেড়েছে ২১ দশমিক ৬৫ ভাগ, আধাপাকা বাড়িতে ১৮ দশমিক ৫৭ ভাগ, টিনশেড কাঁচা বাড়িতে ২৩ দশমিক ৩৩ ভাগ, মেসরুমে ২৬ দশমিক ৯৮ ভাগ এবং বস্তি বাড়িতে ১৪ দশমিক ১৪ ভাগ। গত বছর এই বৃদ্ধির গড় হার ২১ দশমিক ৪৮ ভাগ। অথচ ২০০৬ সালে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির এই হার ছিল ১৪ দশমিক ১৪ ভাগ। চলতি বছরে এটা কত হবে ? তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর অন্যায় অবিচার ও দুর্নীতির ব্যাপারে যেটুকুই হোক উদ্যোগ নিলেও সিন্ডিকেট ব্যবসা বন্ধ ও ফ্রি স্টাইলে বাড়িভাড়া বৃদ্ধিরোধ বিষয়ে যেহেতু কোনো পদপে গ্রহণ করতে পারেনি, তাই যে দুঃসহ আশঙ্কা এই প্রশ্নকে আরো ব্যতিব্যস্ত করে তোলে তা হাঁড়ে হাঁড়ে অনুভব করেন কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট এই মহানগরীর আশিভাগ দুর্ভাগা নাগরিক নামের দ্বিতীয় শ্রেণীর বিশাল এক জনগোষ্ঠী ; যারা বর্তমান বাজার পরিস্থিতির স্বাপেক্ষে কৌতুকময় হাস্যকর আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন অনিবার্য ব্যয়ের ভারে বস্তুতঃই দিশাহারা। এদের কষ্ট এরাই বুঝে। বাকিরা তা বুঝার কথা নয়। কেননা তারা যে কেউ কেউ আমাদের স্বঘোষিত আশ্রয়দাতা মা বাপ, আর অন্যরা গোষ্ঠীবদ্ধ সৌম্যবেশধারী বিবেকহীন একদল বাড়িভাড়া ব্যবসায়ী !

@ বাড়িভাড়া, এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম !

নাগরিক জীবন-ভাবনার সাথে যে অনুষঙ্গটি আজ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতো জড়িয়ে আছে অবিচ্ছেদ্যভাবে, তা হচ্ছে বাসাভাড়া বা বাড়িভাড়া। সারা মাসের বেতনের সিংহভাগ তুলে দেয়া নীতিবিবর্জিত বাড়িওয়ালা নামের এক নির্বিকার হাতে, কোন টোকেন রশিদ প্রমাণপত্রহীন। তার পর গৃহিণী নামের আরেক দুর্ভাগা প্রাণীর উপর নিজের সব অক্ষমতার ক্ষোভ ঢেলে ঢেলে সারা মাস ভাতের বদলে আঙুল চোষা। আর তাই মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বা সীমিত আয়ের মানুষের চোখে বাড়িভাড়া মানেই এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ! যার সুনির্দিষ্ট আকার নেই, অবয়ব পাল্টানোর বাঁধাধরা কোন সময়গ্রাহ্যতা নেই, অস্থির পরিমাণবাচক এই বিশেষ বস্তুটির সাথে যখনতখন আয়তন পাল্টানোর মহিমায় সহমতের ভিন্নতা মানেই ঠাঁই খুঁজো অন্যত্র। আবারো সেই পুরনো চক্র, পুনরাবর্তন। সপ্তবুহ্যের মতো, ঢুকার রাস্তা আছে বেরোবার নেই। কিন্তু কেন ?

আগে জানতাম, ভালোবাসা এবং যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই। হালে আরেকটি যে বিষয় নতুন অহমিকা আর ক্ষমতা দিয়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে, তার নাম ব্যবসা। প্রকৃতই সেবামূলক মনোভাব নিয়ে পৃথিবীতে কোন ব্যবসার জন্ম হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। এমন গোটাকয়েক যদি থেকেও থাকে, তাকে ব্যতিক্রমের ক্যাটেগরিতেই সসম্মানে রেখে দেয়া যায়। কাকে ব্যবসা বলে, ব্যবসার ধারণাগুলো কী কী বা ব্যবসার অর্থনৈতিক দর্শনটা কোথায় বাস করে এসব পূঁথিগত আলোচনা করার জন্য আমাদের দেশে অনেক ব্যবসা ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। নীতিহীন অর্থের হাহাকারে পিষ্ট আমাদের মতো মোটাচোখা দৃষ্টিধারীদের কাছে আজকাল ব্যবসা আর বর্বর ডাকাতির মাঝে কোন পার্থক্য কি আদৌ ঠাহর হয় ? এর অন্যতম উৎকৃষ্ট উদাহরণই হচ্ছে ঢাকার বাড়িভাড়া ব্যবসা। যেখানে সর্বশক্তিমান প্রভুর মতোই হও বললেই হয়ে যায় ! ইচ্ছাই যথেষ্ট। বাড়িওয়ালা নামের এই স্বৈরক্ষমতাধর ব্যক্তিটির কাছে ভাড়াটিয়া হলো সহজ উচ্চারণে ‘ভাড়াইট্ট্যা’, মানে বাদাইম্যা। আর সহজ বাংলায় বাদাইম্যা শব্দের পোশাকি অর্থ হচ্ছে যার কোন চালচুলো নেই, ঠিকানাহীন। বাহ্ ! ভাড়াটিয়া শ্রেণীর প্রাণীদের কী সম্মান ! পোষালে থাকো, নইলে দূর হও।

ডাকাতির মতো ব্যাভিচারী ব্যবসায়ও বোধকরি কিছু কিছু নীতিমালা থাকে। কিন্তু বাড়িভাড়া ব্যবসায় আদৌ কি কোন নীতিমালা আছে ? যদি বলি নেই, আমার কথায় বিজ্ঞজনেরা হয়তো মাইন্ড করবেন। সাথে সাথে ঢাকা সিটি কর্পোরেশানের বাড়ী ভাড়ার দর (Dhaka City Corporation::House Rent Rate) ওয়েব সাইটটিও হয়তো দেখিয়ে দেবেন কেউ কেউ। যেখানে কিছু তথ্য ছক আর কতকগুলি তালিকা দেয়া আছে। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ঢাকা শহরকে ১০টি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে আলাদা আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে ডিসিসি। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডিসিসি আবাসিক এলাকাগুলোকে কয়েকটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করেছে। প্রধান সড়কের পাশে হলে এক রকম ভাড়া, গলির তিনশ’ ফুটের মধ্যে হলে এক রকম ভাড়া, আর গলির তিনশ’ ফুটের বাইরে হলে আরেক রকম ভাড়া। ওগুলোকে আবার আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প- এ তিন ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এ ছাড়া হোল্ডিং নম্বর, নির্মাণের সময়কাল, কাঠামো, নির্মাণশৈলী, অবস্থান ও পজেশান হস্তান্তরের শর্তের ওপর ভিত্তি করে ভাড়ার তারতম্য হতে পারে বলেও ডিসিসির বিধান রয়েছে।

বলতেই হয়, বিশাল কাজ করেছে ডিসিসি ! ঠুঁটো জগন্নাথের জন্য বহু কষ্ট করে ওরিজিনাল ইটালিয়ান জুতো বানিয়েছে ! কিন্তু জগন্নাথ যে ঠুঁটো ! তার জন্যে আগে পা বানিয়ে হাঁটানোর ব্যবস্থা করতে হবে সেটা কি এরা জানে না ? অবশ্যই জানে। এবং একটু বেশি করেই জানে যে, জগন্নাথ হাঁটা শুরু করলে রাষ্ট্রের ওইসব চক্ষুলজ্জাহীন অসৎ কর্মচারিদের বসে বসে টু-পাইস কামানোর ধান্ধা কমে যাবে। বরং এলাকাভিত্তিক এই বাস্তবায়নহীন ভাড়াতালিকা বানিয়ে ধান্ধার পসার আরেকটু বাড়ানো হয়েছে মাত্র। সরকারের প্রাপ্য কোটি কোটি টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া এবং লক্ষ লক্ষ ভাড়াটিয়াদের নির্দয় পেষণে সহায়তাকারী এরাই যখন বিনয়ের অবতার সেজে বলে, ডিসিসি ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও এটা মানতে বাধ্য করার মতো কোন আইন ডিসিসির আছে বলে জানা নেই, তখন দুঃখ হয় খুব। হাসিও পায় !

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করা যায়, ঘাস কাটা চলে না ; ঘাস কাটতে কাঁচির দরকার। অদরকারী ঘাস কাটার মুরোদহীন এইসব তলোয়ারবিদদের কাছে জানতে ইচ্ছে হয়, এই দেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ নামে যে একটি আইন রয়েছে সেটা কি তারা জানেন ? ওটার দেখভাল করার দায়িত্ব কাদের ? কারা এটাকে অতি সযত্নে শুধুই কিতাবী আইন বানিয়ে রেখেছে ? কেবল একটু সদিচ্ছা থাকলেই যে আইনটিকে বাংলাদেশে অতিসহজে ও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করে সিংহভাগ নগরবাসীর অসহনীয় দুর্ভোগ মুক্তির পাশাপাশি সরকারের বিরাট রাজস্ব আয়ের বন্ধ দরজাটা নিমেষেই উন্মুক্ত করে দিতে পারে তা হচ্ছে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ বা Premises (House) Rent Control Ordinance, 1991.
তাহলে আসুন দেখি এ আইন কী বলছে আমাদের ?

@ বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা

আমাদের দেশে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারী করা হয় পাকিস্তান আমলে ১৯৬৩ সালে। এর অধীনে ১৯৬৪ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়, যা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর একযুগেরও বেশি সময় ধরে ১৯৮৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ ছিল। অতঃপর তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এইচ এম এরশাদ কর্তৃক ১৯৮৬ সালের ২২ নং অধ্যাদেশ দ্বারা বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারী করে ১৯৬৩ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। এর মেয়াদ ছিল তিন বছর এবং তা ১৯৮৯ সালে শেষ হয়ে যায়। তিন বছর পরে আবার বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন জারী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু ইতিপূর্বে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। নইলে জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করে আইনটি পাশ করা যেতো। তাই জাতীয সংসদের অবর্তমানে বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ক্ষমতাবলে তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ বর্তমানে প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ জারী করেন। এ আইনে কোন মেয়াদের কথা উল্লেখ করা হয় নি। সব আইনই যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তা কিন্তু নয়। তাই নতুন কোন প্রণীত আইনকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করার জন্যে নতুন নতুন বিধি প্রণয়নেরও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু বর্তমান আইন অর্থাৎ ১৯৯১ সনের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৪ ধারায় বিধি প্রণয়নের ক্ষমতার বিধান থাকলেও সরকার অদ্যাবধি এই আইনের অধীনে কোন নতুন বিধি প্রণয়ন করেন নাই। ফলে ১৯৬৪ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাই কার্যকর রয়ে গেছে।

অতএব, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বা বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য আমাদের দেশে কার্যকর আইন হচ্ছে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৯১ (৩নং আইন) এবং তা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রয়োগের জন্য বিস্তারিত বিধি-বিধান হচ্ছে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ১৯৬৪। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা কতটুকু সচেতন ? নিজেদের প্রয়োজনেই আজ এই প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা সম্পর্কে আমাদের নিজ নিজ ধারণাগুলো স্পষ্ট হয়ে যাওয়া আবশ্যক।

১৯৯১ সনের ৩নং আইন হিসেবে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১-এ বিভিন্ন উপধারা সংবলিত ৩৬ টি আইনী ধারা রয়েছে। তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে।

[ধারা ১.০] সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তনঃ

এ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে যে, এই আইন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, ১৯৯১ নামে অভিহিত হবে। (২) উপধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের ধারা ২৩, ২৪, ২৫, ২৬ এবং ২৭ অবিলম্বে বলবৎ হবে এবং উক্ত ধারাগুলো ব্যতীত অন্যান্য ধারাসমূহ যে সকল এলাকায়.(Premises Rent Control Ordinance) প্রেমিসেস রেণ্ট কণ্ট্রোল অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৬ ২৬ শে মার্চ, ১৯৮৯ ই তারিখে বলবৎ ছিল সেই সকল এলাকায় ২৭ শে মার্চ, ১৯৮৯ ইং তারিখে বলবৎ হয়েছে বলে গণ্য হবে।

(২) উপধারায় আরো শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, সরকার সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দ্বারা যে কোন এলাকায় এই আইন বা তার অংশবিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত তারিখ হতে বলবৎ হবে মর্মে নির্দেশ দিতে পারবেন। অনুরূপভাবে এই আইনের কোন অংশ কোন এলাকায় কার্যকরী হবে না মর্মেও নির্দেশ দিতে পারবেন।

[ধারা ২.০] সংজ্ঞাঃ

এ ধারায় বাড়ি, বাড়ির মালিক, ভাড়াটিয়া, মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক ইত্যাদি প্রয়োজনীয় শব্দের আইনী সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে।
(ক) “নিয়ন্ত্রক” অর্থ ৩(১) এর আওতায় নিযুক্ত কোন নিয়ন্ত্রক এবং ধারা ৩(২) এর আওতায় নিযুক্ত কোন অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপনিয়ন্ত্রকও এর অন্তর্ভূক্ত হবে,
(খ) “বাড়ি মালিক” অর্থ কোন ব্যক্তি যিনি আপাততঃ নিজের বা অপর কোন ব্যক্তির পক্ষে অথবা অপর কোন ব্যক্তির উপকারার্থে কিংবা কোন ব্যক্তির ট্রাষ্ট বা রিসিভার হিসেবে কোন বাড়ির ভাড়া পান বা পাবার অধিকার রাখেন বা যিনি বাড়িটি ভাড়া দেয়া হলে অনুরূপ ভাড়া পেতেন বা ভাড়া পাবার অধিকারী হন এবং Ges .Code of Civil Procedure, 1908 (Vol 1908).এ সংজ্ঞায়িত কোন আইনগত প্রতিনিধি উপভাড়া প্রদানকারী কোন ভাড়াটিয়া এবং বাড়ির মালিক হতে স্বত্ব প্রাপ্ত কোন ব্যক্তিও তার অন্তর্ভূক্ত হবে।
(গ) “বাড়ি” অর্থ কোন দালান বা দালানের অংশবিশেষ বা কোন কাঁচা ঘর বা ঘরের অংশবিশেষ, যা আবাসিক বা অনাবাসিক অথবা উভয় উদ্দেশ্যে পৃথকভাবে ভাড়া দেয়া হয়েছে কিংবা ভাড়া দেবার ইচ্ছা পোষণ করা হয়েছে এবং তৎসংলগ্ন বাগান, উঠান ও কাছারী ঘরও এর অন্তর্ভূক্ত হবে।
(ঘ) “মানসম্মত ভাড়া” অর্থ এই আইনের অধীনে নির্ধারিত বা নির্ধারিত বলে গণ্য মানসম্মত ভাড়া।
(ঙ) “ভাড়াটিয়া” অর্থ কোন ব্যক্তি যার দ্বারা অথবা যার পক্ষে কোন বাড়ির জন্যে ভাড়া পরিশোধ করা হয় এবং .Code of Civil Procedure, 1908 (Vol 1908).এ সংজ্ঞায়িত কোন আইনগত প্রতিনিধি এবং ভাড়ার সময়সীমা সমাপ্ত হবার পরও বাড়ি দখলকারী কোন ব্যক্তিও এর অন্তর্ভূক্ত হবে।
(চ) “ভাড়া” বলতে বাড়ি ভাড়াকে বোঝাবে ;
(ছ) “বিধি” বলতে এই আইনের অধীনে প্রণীত বিধিকেই বোঝাবে।

[ধারা ৩.০] নিয়ন্ত্রক ইত্যাদি নিয়োগঃ

এই ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের যথাযথ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তিকে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক, (২) উপধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ-নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করতে পারবেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ইতিপূর্বে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, সিনিয়র সহকারী জজগণ বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে অদ্যাবধি সরকার অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ-নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাউকেই নিয়োগ করেন নাই।
উপধারা (৩) ও (৪) দ্বারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

[ধারা ৪.০] দরখাস্তের শুনানীঃ

এ ধারায় বাড়িভাড়া সম্পর্কীত কতিপয় দরখাস্তের চূড়ান্ত শুনানীর ক্ষেত্রে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রককে সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। উপধারা (১) অনুযায়ী বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় নিয়ন্ত্রকের কাছে দাখিলকৃত প্রত্যেকটি দরখাস্তের শুনানী তিন মাসের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে।
কোন বিশেষ কারণে তা সম্ভব না হলে পরবর্তী বাকী উপধারা অনুযায়ী তার কারণ লিপিবদ্ধ করে নিয়ন্ত্রক উক্ত সময়ের পর যতশীঘ্র সম্ভব দরখাস্তের শুনানী সমাপ্ত করবেন।

[ধারা ৫.০] বাড়ি মালিক ও ভাড়াটিয়ার প্রতি নোটিশ:

আলোচ্য ধারায় বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক কর্তৃক এই আইন দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করার পূর্বে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াকে নোটিশ প্রদানের বিধান বর্ণিত হয়েছে।

[ধারা ৬.০] বাড়িতে প্রবেশ ও পরিদর্শনের ক্ষমতাঃ

এই আইনের আওতায় কোন মামলাজনিত তদন্তের উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রক কর্তৃক যে কোন সময় কোন বাড়িতে প্রবেশ ও পরিদর্শনের ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা বর্ণিত হয়েছে। এই ধারার ভাষ্যমতে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক তদন্তের উদ্দেশ্যে সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্তের মধ্যে যে কোন সময় সংশ্লিষ্ট বাড়িতে প্রবেশ ও পরিদর্শন করতে পারবেন। তদুপরি বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক তার অধীনস্থ কোন কর্মকর্তাকেও অনুরূপভাবে প্রবেশ ও পরিদর্শনের ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবেন।

[ধারা ৭.০] ভাড়া বৃদ্ধির উপর বিধি নিষেধঃ

এই আইনের বিধান অনুযায়ী, কোন বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার বেশি বৃদ্ধি করা হলে অনুরূপ অতিরিক্ত ভাড়া কোন চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না।
অর্থাৎ আলোচ্য ধারায় বাড়িওয়ালার খেয়াল-খুশিমত ভাড়া বৃদ্ধির উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, কোনক্রমেই মানসম্মত ভাড়ার বেশি বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে না। এমনকি বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে এই মর্মে কোন চুক্তি থাকলেও মানসম্মত ভাড়ার বেশি ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে না।

[ধারা ৮.০] বাড়ি মালিক কর্তৃক উন্নয়ন এবং আসবাবপত্র সরবরাহের জন্যে ভাড়া বৃদ্ধিকরণঃ

এই ধারায় অতিরিক্ত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের বিধান বর্ণিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বাড়ি মালিক বাড়িভাড়া দেবার পরেও নিজ খরচে বাড়িটির এমন কিছু উন্নয়ন সাধন করেন অথবা আসবাবপত্র সরবরাহ করে থাকেন যাকে বাড়ি মেরামত বলা যায় না, তবে বাড়ি উন্নয়ন বলা যায়। এরূপ ক্ষেত্রে বাড়ি মালিক ও ভাড়াটিয়া পরস্পর সম্মত হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবেন এবং উক্ত অতিরিক্ত ভাড়া ভাড়াটিয়া কর্তৃক মানসম্মত ভাড়ার ভিত্তিতে দিতে হবে। অর্থাৎ মানসম্মত ভাড়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নির্ধারণ করতে হবে।

[ধারা ৯.০] কর প্রদানের কারণে ভাড়া বৃদ্ধিঃ

আলোচ্য ধারার ভাষ্যমতে কোন বাড়ির পৌরকর, টোল ইত্যাদি ভাড়াটিয়া কর্তৃক প্রদেয়, তবে ভাড়ার শর্ত মোতাবেক তা পরিশোধ করতে বাড়ির মালিক রাজী হয়ে থাকলে উক্ত ভাড়াটিয়াকে অনুরূপ পরিশোধযোগ্য অতিরিক্ত টাকা তার বাড়ি মালিককে প্রদান করতে হবে।

[ধারা ১০.০] প্রিমিয়াম ইত্যাদির দাবী নিষিদ্ধঃ

আলোচ্য ধারায় ভাড়া দেয়া বা ভাড়া নবায়ন করা অথবা ভাড়ার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে বাড়ির মালিক কর্তৃক ভাড়ার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত বা অনুরূপ কোন টাকা দাবী বা গ্রহণ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি অনুরূপ কোন প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত প্রদানে কোন ভাড়াটিয়াকে বাধ্য করা যাবে না। এ ছাড়াও বাড়ি মালিক বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া অগ্রীম ভাড়া হিসেবে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা দাবী বা গ্রহণ করতে পারবেন না।

[ধারা ১১.০] উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ভাড়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমঃ

ধারা (১০)-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, যদি নির্মাণ অথবা পুনঃ নির্মাণের দ্বারা উন্নয়নের উদ্দেশ্যে কোন বাড়ি কমপক্ষে বিশ বছর মেয়াদের জন্যে ভাড়া দেয়া হয় এবং যদি উক্ত মেয়াদ তা শুরু হবার তারিখ হতে দশ বছরের মধ্যে বাড়ি মালিকের ইচ্ছানুযায়ী বাতিলযোগ্য না হয়, তাহলে বাড়ি মালিক ভাড়ার অতিরিক্ত হিসেবে কোন প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত অথবা অনুরূপ কোন অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন।

[ধারা ১২.০] আসবাবপত্র ক্রয় ভাড়ার শর্ত হবে নাঃ

কোন বাড়ি ভাড়ার জন্যে বা তার নবায়ন বা মেয়াদ বৃদ্ধির জন্যে কোন ব্যক্তি তার আসবাবপত্র ক্রয়ের কোন শর্ত আরোপ করতে পারবেন না।

অর্থাৎ কোন বাড়ির মালিক তার বাড়ি ভাড়া বাবদ ভাড়াটিয়ার আসবাবপত্র ক্রয় করতে পারবেন না। তদুপরি ভাড়া নবায়ন কিংবা মেয়াদ বৃদ্ধির শর্ত যদি বাড়ি ভাড়া চুক্তিতে থেকেও থাকে তা সত্ত্বেও ভাড়াটিয়া বাড়িভাড়া নবায়ন না করে, তাহলে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার আসবাবপত্র আটক বা ক্রয় করতে পারবেন না।

[ধারা ১৩.০] ভাড়া আদায়ের রশিদ প্রদানঃ

আলোচ্য ধারায় বাড়িওয়ালার প্রতি ভাড়া পরিশোধের রশিদ প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাড়ি মালিক যখনই ভাড়া গ্রহণ করবেন তখনই বাড়ি ভাড়া পরিশোধের একটি রশিদ ভাড়াটিয়াকে প্রদান করবেন। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ১৯৮৬ এ উল্লেখিত ফরমে বা ছকে রশিদ ছাপিয়ে নিয়ে ঐ রশিদ দ্বারাই বাড়ি মালিককে ভাড়া পরিশোধের রশিদ প্রদান করতে হবে। রশিদ ইস্যু করার সময় বাড়ি মালিক রশিদের মুড়িতেও লিখে রাখবেন এবং তা অবশ্যই বাড়ি মালিককে সংরক্ষণ করতে হবে।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ভাড়া রশিদ আদায় করার দায়িত্ব অনেকাংশেই ভাড়াটিয়ার উপর নির্ভর করে থাকে। তবে ভাড়াটিয়া ভাড়া রশিদ ছাড়া ভাড়া পরিশোধ করে থাকলে অনুরূপ ভাড়া পরিশোধ প্রমাণ করা ভাড়াটিয়ার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা আদালতে দলিলী সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি।

[ধারা ১৪.০] অনাদায়যোগ্য ভাড়া ইত্যাদি ফেরতঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৪ ধারায় বাড়ি মালিক কর্তৃক যে সকল অনাদায়যোগ্য ভাড়া নেয়া হয়েছে তা ফেরত প্রদানের কথা বলা হয়েছে। যখন কোন বাড়ি মালিক ভাড়াটিয়ার কাছ হতে এরূপ কোন টাকা গ্রহণ করেন বা জমা নেন যা এই আইনের বিধানের পরিপন্থী বা প্রিমিয়াম, সালামী অথবা জামানত বাবদ অগ্রীম কোন টাকা প্রদানে ভাড়াটিয়াকে বাধ্য করা হয়ে থাকে যা এই আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাহলে ভাড়াটিয়ার দরখাস্ত বলে অনুরূপ টাকা প্রদান বা জমাদানের তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে উক্ত টাকা ফেরত দেবার জন্যে অথবা অন্যভাবে সমন্বয় করে নেয়ার জন্যে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক বাড়ি মালিককে নির্দেশ দিতে পারবেন। যেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক অনুরূপ আদেশ প্রদান করেন সেক্ষেত্রে যে আদালতে বকেয়া বাড়ি ভাড়া আদায়ের ডিক্রির জন্যে মামলা করা যেতো তা সেই আদালতেরই ডিক্রি বলে গণ্য করতে হবে।

অনেক সময় দেখা যায় যে, বাড়ি মালিক নানা ছল-চাতুরীতে অযৌক্তিকভাবে ভাড়াটিয়ার কাছে অর্থ দাবী করে বসে। দাবীকৃত অর্থ পরিশোধ না করলে উচ্ছেদের হুমকী পর্যন্ত দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রায় বাধ্য হয়েই উচ্ছেদের ভয়ে ভাড়াটিয়া অযৌক্তিকভাবে দাবীকৃত অর্থ পরিশোধ করে থাকে। তবে এরূপ ক্ষেত্রে কোন ভাড়াটিয়া যদি বাড়ি মালিকের বেআইনী দাবীকৃত ও পরিশোধিত টাকার প্রতিকার চান তাহলে উক্ত অর্থ জমা প্রদানপূর্বক রশিদ গ্রহণ করতঃ ৬ মাসের মধ্যে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন।

[ধারা ১৫.০] নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা ও দায়িত্বঃ

বাড়ি মালিক বা ভাড়াটিয়ার দরখাস্তের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রক কোন বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারন করতে পারবেন এবং এরূপভাবে তা নির্ধারণ করবেন যেন তার বাৎসরিক পরিমাণ বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ধার্যকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের বেশি না হয়।

এই ১৫(১) ধারা অনুযায়ী বাড়ির বাজার মূল্য নির্ধারণের উপায় কী ? এক্ষেত্রে আমাদেরকে দেখতে হবে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৬৪।
বিধিমালায় বলা হয়েছে: (০১) পাকা বাড়ির ক্ষেত্রে ভূমির মূল্য, ভূমি উন্নয়ন ব্যয় ও বাড়ি নির্মাণ ব্যয় থেকে অবচয় (যখন মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে তখনকার সময় পর্যন্ত) বাদ দিয়ে যা থাকবে সেটাই বাড়ির বাজার মূল্য। প্রথম তিন বছরে কোনো অবচয় নেই এবং পরবর্তী প্রত্যেক বছরে অবচয় শতকরা ১ ভাগ।
(২)আধা পাকা বাড়ির ক্ষেত্রেও এই নিয়ম। তবে আধা পাকা বাড়ির কোন অবচয় প্রথম দুবছর ধরা হবে না এবং তৃতীয় বছর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত অবচয় শতকরা ২ ভাগ এবং ১৯ তম বছর থেকে এ অবচয়ের হার শতকরা ৩ ভাগ।

[ধারা ১৬.০] মানসম্মত ভাড়া কার্যকর হবার তারিখ এবং তার মেয়াদঃ

নিয়ন্ত্রক কর্তৃক মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করার পর উক্ত মানসম্মত ভাড়া কোন্ তারিখ হতে বলবৎ হবে এবং কতদিন পর্যন্ত চালু থাকবে তারই বিধানাবলী ১৬ ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে। এই ধারার মূল বক্তব্য হলো, এই আইনের ১৫ ধারা মতে ভাড়া হ্রাস বা বৃদ্ধির জন্যে দরখাস্ত করা হলে অনুরূপ দরখাস্ত দাখিলের পরবর্তী মাস হতে মানসম্মত ভাড়া প্রদান করতে হবে। কাজেই নিয়ন্ত্রক মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণের সিদ্ধান্ত যে দিনই প্রদান করুন না কেন, এই আইনের বিধান মোতাবেক তা দরখাস্ত দাখিলের পরবর্তী মাস হতেই মানসম্মত ভাড়া কার্যকরী হবে। এই ধারায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানসম্মত ভাড়া কার্যকরী হবার তারিখ হতে দুই বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। দুই বছর পর মানসম্মত ভাড়ার পরিবর্তন করা যাবে।

[ধারা ১৭.০] কতিপয় ক্ষেত্রে ক্রোক পরোয়ানা ইত্যাদিঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের এই ধারায় বকেয়া বাড়ি ভাড়া আদায়ের জন্যে ক্রোক এবং প্রয়োজন বোধে ভাড়াটিয়াকে জেলে আটকে রাখার বিধানাবলী বর্ণিত হয়েছে। ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের বিধান মোতাবেকই বকেয়া বাড়ি ভাড়া আদায়ের ডিক্রি জারী করা হয়। তবে বাড়ি মালিক তার দরখাস্তের সাথে উক্ত ভাড়া অনাদায়যোগ্য নয় বলে এফিডেবিট দাখিল না করলে কোন প্রকার ক্রোক বা গ্রেফতারী পরোয়ানার আদেশ দেয়া যাবে না।

[ধারা ১৮.০] অনুমোদনযোগ্য ভাড়া প্রদান করা হলে সাধারণতঃ উচ্ছেদের আদেশ দেয়া হবে নাঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের এই ধারাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ধারায় ভাড়াটিয়ার অধিকার ও কর্তব্যের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এতে উল্লেখ রয়েছে যে, ১৮৮২ সনের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বা ১৮৭২ সনের চুক্তি আইনের বিধানে যাই থাকুক না কেন, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়ি ভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৮ ধারার ১ উপধারামতে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (গ) (ড) এবং (ত) দফার বিধানের পরিপন্থি কোন কাজ করলে বা কোন চুক্তির অবর্তমানে ভাড়াটিয়া বাড়ি মালিকের অনুমতি ব্যতীত বাড়ি বা বাড়ির কোন অংশ উপভাড়া প্রদান করলে বা ভাড়াটিয়া যদি এরূপ কোন আচরণ করেন যা পার্শ্ববর্তী বাড়ি দখলকারীদের জন্যে বিরক্তিকর বা উৎপাতজনক হয় অথবা ভাড়াটিয়া যদি বাড়িটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন বা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে থাকেন অথবা বাড়িটি বাড়ি মালিকের বা তার লোকজনের প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন হয়ে পরে যা আদালতের কাছে সঙ্গত বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে।
সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (গ) (ড) এবং (ত) দফায় যথাক্রমে বর্ণিত হয়েছে যে, ভাড়াটিয়া নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করতে থাকলে যতদিন ভোগদখলের চুক্তি রয়েছে ততদিন ভাড়াটিয়া নির্বিঘ্নে ভোগদখল করতে পারবেন।

সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (গ) দফাঃ
ইজারাদাতা ইজারা গ্রহীতার সাথে এই মর্মে চুক্তি করেছে বলে ধরে নেয়া হবে যে, ইজারা গ্রহীতা যদি ইজারা অনুসারে বরাদ্দকৃত খাজনা দেয় এবং তার উপর বাধ্যকরী চুক্তির শর্ত সমূহ পালন করে তাহলে বিনা বাধায় সে ইজারায় নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত উক্ত সম্পত্তি ভোগ দখল করতে পারবে। এরূপ চুক্তির সুবিধা ইজারা গ্রহীতার স্বার্থের সাথে সংযুক্ত থাকবে এবং তা তার উক্ত স্বার্থের সাথে বলবৎ থাকবে এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি উক্ত স্বার্থ বা তার অংশবিশেষের সাথে জড়িত হবে সে তা প্রয়োগ করতে পারবে।

সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (ড) দফাঃ
ইজারা গ্রহীতা উক্ত সম্পত্তির দখল নেবার সময় তা যে অবস্থায় ছিল সেরূপ ভাল অবস্থায় রাখবে এবং ইজারার মেয়াদ শেষে তা সেরূপ অবস্থায় ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু ব্যবহার জনিত যুক্তিসঙ্গত কোন ক্ষয়-ক্ষতির জন্যে সে দায়ী হবে না। ইজারার মেয়াদ বলবৎ থাকাকালে সে ইজারাদাতা বা তার প্রতিনিধিদেরকে উপযুক্ত সময়ের মধ্যে ইজারা সম্পত্তিতে প্রবেশ করতে এবং তার অবস্থা পরিদর্শন করতে দিতে বাধ্য থাকবে এবং সম্পত্তির অবস্থার কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে ইজারাদাতা সেই সম্পর্কে নোটিশ দিবে বা জারী করবে এবং উক্ত ত্রুটি ইজারাগ্রহীতা তার চাকর বা প্রতিনিধিগণ কর্তৃক সংঘটিত হলে নোটিশ প্রদান বা জারী করার তারিখ হতে তিন মাসের মধ্যে ইজারা গ্রহীতা উক্ত ত্রুটি সংশোধন করতে বাধ্য থাকবেন।

সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারার (ত) দফাঃ
কৃষিকার্যের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে ইজারাগ্রহীতা ইজারাদাতার বিনা অনুমতিতে উক্ত সম্পত্তির উপর কোন স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করবে না।

[ধারা ১৯.০] কতিপয় পরিস্থিতিতে ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া জমাঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯ ধারাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া জমা দেবার বিধান বর্ণিত আছে। ১৯ ধারার ১ উপধারার ভাষ্যমতে যেক্ষেত্রে কোন ভাড়াটিয়া বাড়ি মালিকের বরাবরে ভাড়ার টাকা মানিঅর্ডার যোগে প্রেরণ করার পরে তা বাড়ি মালিক গ্রহণ করার অস্বীকারের কারণে ফেরত আসে সেক্ষেত্রে যে তারিখে ভাড়াটিয়ার হাতে মানিঅর্ডার ফেরত আসে সেই তারিখ হতে ১৫ দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রকের কাছে বাড়ি ভাড়া মানিঅর্ডারযোগে প্রেরণের খরচসহ জমা দিতে হবে।
আবার বাড়ি ভাড়া কে বা কারা পাবেন এ বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে বা নিশ্চিত না হওয়া গেলে ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রকের কাছে বাড়ি ভাড়া জমা দিতে থাকবেন।
১৯ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে যে, যেখানে বাড়ি মালিক তার ঠিকানা পরিবর্তন করেন এবং তার ঠিকানা বা অবস্থান সম্পর্কে ভাড়াটিয়া জ্ঞাত না থাকেন এবং ভাড়া গ্রহণ করার মতো বাড়ি মালিকের কোন প্রতিনিধিও না থাকে তাহলে উক্ত ভাড়া যে তারিখে পরিশোধযোগ্য হয় সেই তারিখ হতে ১৫ দিনের মধ্যে ভাড়াটিয়ার উক্ত ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা দিতে পারবেন। এমন কি যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়ি মালিকের ঠিকানা ও অবস্থান জানা না থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত পরবর্তী সময়ের বাড়ি ভাড়াও নিয়ন্ত্রকের কাছে জমা দিয়ে যেতে থাকবেন।
তবে এক্ষেত্রে শর্তারোপ করে নিয়ন্ত্রকের একটি কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে এবং তা হলো, যে তারিখে জমা হবে তা হতে সাত দিনের মধ্যে বাড়ি মালিকের সর্বশেষ জানা ঠিকানায় নিয়ন্ত্রককে রেজিষ্ট্রি ডাকযোগে উক্ত ভাড়া যে জমা দেয়া হচ্ছে তা সম্পর্কে একটি নোটিশ প্রেরণ করতে হবে।

[ধারা ২০.০] মানি অর্ডারযোগে ভাড়া গ্রহণ বা ভাড়া উঠানোর বিষয়ে হেফাজতঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে যে, ভাড়াটিয়া কর্তৃক নিয়ন্ত্রকের কাছে বাড়ি মালিকের নামে যে ভাড়ার টাকা জমা দেয়া হয়েছে উক্ত ভাড়ার টাকা বাড়ি মালিক যদি উঠিয়ে নেন তাহলে তা দ্বারা এ গণ্য করা যাবে না যে, ভাড়াটিয়া তার দরখাস্তে যে কারণসমূহ উল্লেখ করেছেন তা বাড়ি মালিক স্বীকার করে নিয়েছেন অথবা বাড়ি মালিক ভাড়াটিয়াকে প্রদত্ত উচ্ছেদ নোটিশ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বাড়ি মালিক নিয়ন্ত্রকের আদালতে বাড়িভাড়া নিয়ে মামলা বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও বাড়ি মালিক নিয়ন্ত্রকের আদালতে জমাকৃত ভাড়ার টাকা উঠিয়ে নিতে পারবেন। কারণ এই বাড়ি ভাড়া বাড়ি মালিকেরই প্রাপ্য। তবে বাড়ি ভাড়ার জমাকৃত টাকা কে বা কারা পাবেন সে সম্পর্কে কোন বিরোধ বা সন্দেহ থাকলে উক্ত বিরোধ নিস্পত্তি বা সন্দেহ দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত জমাকৃত ভাড়ার টাকা উঠিয়ে নেয়া যাবে না।

[ধারা ২১.০] ভাড়াটিয়া কর্তৃক মেরামত ইত্যাদিঃ

বাড়ি মালিক ইচ্ছা করলেই ভাড়াটিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী বা অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের উপযোগী করে বাড়িটি প্রস্তুত রাখতে বাড়ি মালিকের উপর এই আইন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। অর্থাৎ বাড়ি মালিক তার বাড়িটি বসবাসের উপযোগী করে রাখতে আইনতঃ বাধ্য। ভাড়াটিয়াকে পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা প্রদান করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনবোধে লিফটের সুবিধাও দিতে হবে। কিন্তু উক্তরূপ সুবিধা প্রদানে বাড়ি মালিক অনীহা প্রকাশ করলে ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে পারবেন। আবার বাড়িটি মেরামতের প্রয়োজন হলেও ভাড়াটিয়া দরখাস্ত করতে পারবেন।
ভাড়াটিয়া কর্তৃক অনুরূপ দরখাস্ত পাবার পরে নিয়ন্ত্রক বাড়ি মালিককে নোটিশ প্রদান করবেন এবং বাড়ি মালিককে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে শুনানীর সুযোগ দেবেন। শুনানী শেষে প্রয়োজন মনে করলে বাড়িটি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করার আদেশ দেবেন। এই আদেশ দেবার ত্রিশ দিনের মধ্যে বাড়ি মালিক যদি মেরামত বা করতে ব্যর্থ হন তাহলে ভাড়াটিয়া তা নিয়ন্ত্রককে জানিয়ে সে নিজে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য দরখাস্ত করতে পারবে। তবে এরূপ দরখাস্তের সাথে আনুমানিক একটি খরচের হিসাব অবশ্যই নিয়ন্ত্রকের কাছে দাখিল করতে হবে। নিয়ন্ত্রক তদন্ত করার পরে সন্তুষ্ট হলে ভাড়াটিয়াকে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের অনুমতি দেবেন।
ভাড়াটিয়া নিজে বাড়িটির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করলে যে অর্থ ব্যয় হবে তা বাড়ি ভাড়া হতে কর্তন করে নিতে পারবেন। তবে পূর্বে বাড়িটি মেরামত করার জন্য যে হিসাব দেয়া হয়েছিল তার অপেক্ষা অধিক অর্থ মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ব্যয় করা যাবে না। ব্যয় করলে উক্ত অতিরিক্ত ব্যয়িত অর্থ বাড়ি ভাড়ার সাথে সমন্বয় করা যাবে না। আবার এও বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অনুরূপ খরচ এক বছরে বাড়ি ভাড়ার মোট অর্থের এক ষষ্ঠাংশের বেশি হবে না।

আবার মেরামত যদি জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন হয় তাহলে সেভাবেই নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে হবে। নিয়ন্ত্রক আদেশ প্রদান করলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত কার্য সম্পাদন করতে হবে। বাড়ি মালিক ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত কার্য সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে ভাড়াটিয়া নিজ দায়িত্বে উপরে বর্ণিত নিয়মে বাড়িটি মেরামত করে নিতে পারবে। এক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া বাড়ি মেরামতের যে অর্থ ব্যয় করেছেন সেই অর্থ বাড়ি ভাড়া হতে কর্তন করে নিতে পারবেন। তবে অনুরূপ ব্যয়িত অর্থ অবশ্যই উক্ত বাড়ি ভাড়ার এক ষষ্ঠাংশের বেশি হতে পারবে না।

[ধারা ২২.০] ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক বাড়ি মেরামত ইত্যাদিঃ

জনস্বার্থে কোন বাড়ির আরও মেরামতের প্রয়োজন হতে পারে। তাই জনস্বার্থের গুরুত্ব বিবেচনা করেই বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২২ ধারায় ডেপুটি কমিশনারকে নিজ উদ্যোগে কোন বাড়ি মেরামত করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাঁর কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, বাড়িটি দিন দিন ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছে এবং বাড়িটি ধ্বসে পড়লে জানমাল এমনকি পার্শ্ববর্তী বাড়িসমূহেরও ক্ষতি হবে তাহলে তিনি নিজ উদ্যোগেই অতিসত্বর উক্ত বাড়ি মেরামত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অনুরূপ মেরামতের জন্যে যত টাকা খরচ হবে তা বাড়ি মালিকের পাওনা বাড়ি ভাড়া হতে ক্রোক করে ১৯১৩ সালের সরকারী পাওনা আদায় আইনের বিধান মোতাবেক আদায় করে নিতে পারবেন।

[ধারা ২৩.০] মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের দণ্ডঃ

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারায় বাড়ি মালিক কর্তৃক মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে জরিমানা বা দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মানসম্মত ভাড়ার চাইতে কম ভাড়া নিলে সেক্ষেত্রে আইনের কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আইনসম্মত ভাড়ার চাইতে বেশি বাড়িভাড়া নিলে তা আইনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই আইনের ৮ ধারা এবং ৯ ধারায় বর্ণিত কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানসম্মত ভাড়া অপেক্ষা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অধিক বাড়িভাড়া আদায় করলে সেক্ষেত্রে প্রথমবারের অপরাধের জন্যে মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন। তৎপরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্যে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয়েছে তার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন।

আবার ১১ ধারায় বর্ণিত কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানসম্মত ভাড়ার অপেক্ষা অতিরিক্ত কোন ভাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বা অনুরূপ কোন টাকা গ্রহণ করলে বা দাবী করলে কিংবা প্রদানের জন্যে প্রস্তাব করলে প্রথমবারের অপরাধের জন্যে দুই হাজার টাকা এবং পরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিককে দণ্ডিত করা হবে।

অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রক আদালতের লিখিত আদেশ ছাড়া অগ্রীম ভাড়া বাবদ এক মাসের অধিক ভাড়া গ্রহণ করলে প্রথমবারের এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ বাড়ি মালিক গ্রহণ করেছেন তার দ্বিগুণ এবং পরবর্তী প্রত্যেক অপরাধের জন্যে এক মাসের অতিরিক্ত যে ভাড়া গ্রহণ করা হয়েছে তার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন।

[ধারা ২৪.০] সুখাধিকার ইত্যাদিতে বাধা প্রদানে দণ্ডঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৪ ধারাটি ভাড়াটিয়ার পদাধিকার, ব্যবহারস্বত্ব বা সুখাধিকারের অধিকার সম্পর্কিত বিধান প্রবর্তন করেছে। যেমন, অন্যের জমির উপর দিয়ে চলাফেরার অধিকার, অপরের দালনের কারণে নিজ বাড়ির আলোবাতাস বন্ধ হতে না পারে এ মর্মে যে অধিকারসমূহ আইনে স্বীকৃতি পেয়েছে তাই হলো সুখাধিকার বা ইজমেণ্ট রাইট। যে বাড়িতে ভাড়াটিয়া বসবাস করছেন বা যে বাড়িতে ভাড়াটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন তার সাথেও ইজমেণ্টরাইট বা সুখাধিকার ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এ ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ অধিকার স্বীকৃত না হলেও প্রথাগতভাবে যতটুকু সুখাধিকার ভোগ ব্যবহার করা সম্ভব তাতে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।

অনেক সময় বাড়ি মেরামত করার প্রয়োজন হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে পৌর কর্তৃপক্ষের নির্দেশও পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে যদি সুখাধিকারে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েও থাকে তথাপি তাতে কোন অপরাধ হবে না। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে যদি বাড়ির সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সুখাধিকারে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় বা বাড়ির সাথে স্থায়ীভাবে ব্যবহারযোগ্য কোন জিনিস সরিয়ে ফেলে বা অপসারণ করে, ধ্বংস করে বা অব্যবহারযোগ্য করে তোলে অথবা ভাড়ার শর্তাধীনে কোন সরবরাহ বা সুবিধা বন্ধ করে দেয় তাহলে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করলে নিয়ন্ত্রক সাহেব বিষয়টি অনুসন্ধানপূর্বক সন্তুষ্ট হলে অপরাধীকে পাঁচশত টাকা জরিমানা বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন। অনুরূপভাবে পুনরায উক্তরূপ কোন অপরাধ সংঘটন করলে সেক্ষেত্রে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রক সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন।

[ধারা ২৫.০] বাড়ি মালিকের ভুল নাম বা ঠিকানা দেবার দণ্ডঃ

ভাড়াটিয়া কর্তৃক কোন কোন ক্ষেত্রে অসৎ উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে তার বাড়ি মালিকের নাম ও ঠিকানা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুল দেয়া হতে পারে। এ কারণেই বাড়ি মালিকের নাম ও ঠিকানা নিয়ন্ত্রকের কাছে ভুল দিলে তার জন্যে এই ২৫ ধারা প্রণয়নের মাধ্যমে জরিমানা ও অর্থদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, কোন ভাড়াটিয়া তার বাড়ি মালিকের নাম ও ঠিকানা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল দিলে উক্ত ভাড়াটিয়া পাঁচশত টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে বাড়ি মালিকের নাম ও ঠিকানা যে ভুল দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে অবশ্যই ছয় মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রকের কাছে বাড়ি মালিককে দরখাস্ত করতে হবে।

[ধারা ২৬.০] বাড়ির দখল বুঝিয়ে দেবার ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ার ব্যর্থতার দণ্ডঃ

ভাড়াচুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভাড়াটিয়া বাড়ি মালিককে খালি বাড়ির দখল বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকবেন। যদি ভাড়াটিয়া তার ভাড়ার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বাড়িটির দখল বাড়ি মালিককে বুঝিয়ে না দেন তাহলে উক্ত ভাড়াটিয়া দণ্ডিত হবেন। তবে ভাড়াটিয়ার সাথে বাড়ি মালিকের যদি উপভাড়া প্রদানের শর্ত বা চুক্তি কিংবা তার সম্মতি থাকলে ভাড়াটিয়ার বাড়ি মালিককে বাড়ি বুঝিয়ে দেবার বাধ্যবাধকতা থাকে না। বাড়ি ভাড়ার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে যদি ভাড়াটিয়া বাড়িটির দখল বুঝিয়ে দিতে অস্বীকার করেন বা ব্যর্থ হন তাহলে বাড়ি মালিককে ভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে মামলা দায়ের করতে হবে। এই অভিযোগ পাবার পরে নিয়ন্ত্রক অনুসন্ধান এবং শুনানী গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হলে মানসম্মত ভাড়ার দশগুণ অর্থদণ্ডে ভাড়াটিয়াকে দণ্ডিত করতে পারবেন।

[ধারা ২৭.০] রশিদ প্রদানে ব্যর্থতার দণ্ডঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৭ ধারায় বাড়ি মালিকের উপর ভাড়া গ্রহণের রশিদ প্রদানের ব্যর্থতার জন্যে দণ্ড আরোপ করা হয়েছে। এই আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া পরিশোধ করা হলে বাড়ি মালিক তৎক্ষণাৎ ভাড়া প্রাপ্তির রশিদ বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে (১৯৬৪ সালের বাড়িভাড়া বিধিমালায় রশিদ ফরমের নমূনা বিধৃত আছে) যথাস্থানে স্বাক্ষর করে ভাড়াটিয়াকে প্রদান করবেন এবং বাড়ি মালিককে ভাড়ার রশিদের একটি চেকমুরি সংরক্ষণ করতে হবে। এই আইন অমান্য করে কোন বাড়ি মালিক যদি ভাড়াটিয়াকে ভাড়া গ্রহণের লিখিত রশিদ প্রদানে অস্বীকার করেন বা ব্যর্থ হন তাহলে বাড়ি মালিক ভাড়াটিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে আদায়কৃত টাকার দ্বিগুন অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

[ধারা ২৮.০] অভিযোগ দায়ের ইত্যাদিঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৮ ধারায় বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের কাছে অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। ২৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, এই আইনের ২৩, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারার অধীনে যে কোন অভিযোগ লিখিতভাবে দায়ের করতে হবে। তদুপরি চার টাকার কোর্ট ফিস সংযুক্ত করতে হবে।
অভিযোগ পাবার পরে নিয়ন্ত্রক সাহেবকে অভিযোগের সত্যতা তদন্ত করে দেখতে হবে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে নিয়ন্ত্রক দণ্ড প্রদান করবেন। ২৩, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারামতে অর্থদণ্ড প্রদান করা হলে উক্ত অর্থদন্ড প্রদানের তারিখ হতে ত্রিশ দিনের মধ্যে তা নিয়ন্ত্রকের আদালতে জমা না দিলে তাহলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে ১৯১৩ সালের সরকারী দাবী আদায় আইনের বিধান মতে অর্থ দন্ডের টাকা আদায়যোগ্য হবে।
উল্লেখ্য যে, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৮ ধারার বিধানটি বাড়ি মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

[ধারা ২৯.০] অভিযোগ তামাদিঃ

মানুষ তার অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তৎপর থাকবে আইনের এটাই কাম্য। বিলম্ব ন্যায়বিচারকে প্রতিহত করে। এ কারণেই আইনে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারামতে অভিযোগ দায়ের করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, বাড়ি মালিক বা ভাড়াটিয়াকে এই আইনের ২৩, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারামতে অভিযোগ দায়ের করতে হলে অবশ্যই উক্ত অভিযোগের অপরাধ সংঘটনের তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে দায়ের করতে হবে। অন্যথায় অনুরূপ অভিযোগ তামাদি দ্বারা বাতিল হয়ে যাবে।

[ধারা ৩০.০] আপীল ও পুনঃবিবেচনাঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩০ ধারায় বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল এবং রিভিউ বা পুনর্বিচারের বিধান বর্ণিত হয়েছে। এই ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের আদেশ বা সিদ্ধান্ত দ্বারা সংক্ষুব্ধ হলে সেই বাড়িটি যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা জজের কাছে উক্ত আদেশ বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে সেই ব্যক্তি আপীল করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আপীল রুজু করার সময় ৩০ দিন দেয়া হয়েছে। এই সময় গণনা কালে যে দিন নিয়ন্ত্রক আদেশ বা সিদ্ধান্ত দেবেন সেই দিন এবং উক্ত আদেশ বা সিদ্ধান্তের সহিমোহরী নকল তুলতে যে সময় ব্যয় হবে তা বাদ যাবে।

বাড়িভাড়া সম্পর্কিত মামলাসমূহ দেওয়ানী প্রকৃতির মামলা। তাই এক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধির বিধানাবলী অনুসরণ করতে হবে। কাজেই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রককে বাড়িভাড়ার সম্পর্কিত মামলাসমূহ নিস্পত্তিকালে অবশ্যই দেওয়ানী কার্যবিধির পদ্ধতিগত বিধান অনুসরণ করেই বিচার সম্পন্ন করতে হবে।

[ধারা ৩১.০] নিয়ন্ত্রকের আদেশের সত্যায়িত নকল সরবরাহঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩১ ধারায় বাড়িভাড়া সম্পর্কিত মামলার পক্ষসমূহের মামলার যে কোন আদেশ বা সহিমোহরী নকল পাবার অধিকারের বিধান বর্ণিত হয়েছে। এই ধারার মূল বক্তব্য হলো বাড়িভাড়া মামলার যে কোন পক্ষ নির্ধারিত ফি প্রদানপূর্বক নিয়ন্ত্রকের যে কোন আদেশ বা মামলার যে কোন কাগজ-পত্রের সহিমোহরী নকলের জন্য আবেদল করলে সেই পক্ষকে উক্ত সহিমোহরী নকল সরবরাহ করতে হবে। আর অনুরূপ সহিমোহরী নকল সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে। উল্লেখ্য যে, অন্যান্য দেওয়ানী আদালতের মতই সহিমোহরী নকল তোলার পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে।

[ধারা ৩২.০] বাড়ি মালিকের বিনা অনুমতিতে বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাবেনঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩২ ধারায় ভাড়াটিয়াকে তার বাড়ি মালিকের অনুমতি ছাড়াই বিদ্যুৎ সরবরাহ পাবার অধিকার প্রদান করেছে। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, বর্তমানে বলবৎ অন্য কোন আইনে যাই থাকুক না কেন, যে কোন ভাড়াটিয়া তার বাড়ি মালিকের অনুমতি ছাড়াই ভাড়াকৃত বাড়িতে যে কোন লাইসেন্সধারী ব্যক্তির কাছ হতে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারবেন। অন্যদিকে, লাইসেন্সধারী ব্যক্তি বলতে ১৯১০ সালের বিদ্যুৎ আইনের ২ ধারার (জ) দফায় বর্ণিত লাইসেন্সীকে বুঝতে হবে।

[ধারা ৩৩.০] অব্যাহতিঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৩ ধারার বিধান দ্বারা দেশের সরকার ও বিভাগীয় চারটি শহরের যেমন- ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধানাবলী হতে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। কাজেই সরকার ও উক্ত চারটি বিভাগীয় উন্নয়ন কর্তৃপসমূহের দখলীয় বাড়ির ক্ষেত্রে এই আইনের বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে না। এই সকল ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী বাড়িভাড়া সম্পর্কিত বিরোধের নিস্পত্তি হবে।

[ধারা ৩৪.০] বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৪ ধারাই এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকারকে বিধি প্রণয়নের স্বীকৃতি প্রদান করেছে। কারণ কোন আইনের প্রয়োগ করতে হলে তার সাথে কিছু বিধি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন হয়ে পরে। তাই যখন আইন প্রণয়ন করা হয় তখন সে আইনে প্রয়োজনবোধে বিধি প্রণয়নেরও ক্ষমতা সংযুক্ত করে দেয়া হয়। কাজেই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি প্রয়োগ করতে গিয়ে যদি বাস্তবে কোন আইনগত ত্রুটি বা অসুবিধা দেখা দেয় তাহলে এই আইনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্যে সরকার প্রয়োজনবোধে বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন।

[ধারা ৩৫.০] হেফাজতঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৫ ধারার (ঘ) দফায় বলা হয়েছে যে, ১৯৮৬ সনের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের আওতায় দায়েরকৃত কোন মামলা বা আপীল যে সকল আদালতে বিচারাধীন ছিল তাদেরকে বর্তমান বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি কার্যকরী হবার তারিখ হতে এই আইনের আওতায আপীল আদালতের কাছে বিচারাধীন রয়েছে বলে বিবেচিত হবে।
আর অনুরূপ দরখাস্তসমূহ নিয়ন্ত্রকের কাছে বদলী হবার পূর্বে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থা বা পর্যায় হতেই নিয়ন্ত্রক তার কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।

[ধারা ৩৬.০] রহিতকরণ ও হেফাজতঃ

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬ ধারাবলে ১৯৯১ সনের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশকে (অধ্যাদেশ নং ২, ১৯৯১) রদ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এরূপ রদের পূর্বে উক্ত অধ্যাদেশের আওতায় সম্পাদিত কাজকর্ম বা গৃহীত ব্যবস্থাদি এই আইনের আওতায় সম্পাদিত বা গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে।

@ অতঃপর কিতাবী আইন এবং তোঘলকী বাস্তবতাঃ

জাসটিস ডিলে জাসটিস ডিনাই, কথাটা প্রবাদসত্য। যেকোন আইনেরই সাফল্য এর সুষ্ঠু প্রয়োগধর্মী বাস্তবায়নযোগ্যতায়। কাজীর গরু যদি গোয়ালেই না থাকলো, কিতাবী অস্তিত্ব দিয়ে কোন ফায়দা আছে কি ? আইনের স্বাভাবিক ধর্ম হচ্ছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যক্তির পারস্পরিক স্বার্থের সংঘাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করা। এই বাড়ি ভাড়া আইনেও বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া এই দুপক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় প্রয়োজনীয় ভূমিকা রয়েছে। উভয়পক্ষের অবশ্যপালনীয় হিসেবে কিছু বিধান সুস্পষ্টভাবে দেয়া আছে। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে ?

ভাড়ার পরিমাণঃ
বাড়িভাড়ার পরিমাণ নির্ধারণ করতে গিয়ে আইনটিতে মানসম্মত ভাড়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। মানসম্মত ভাড়া সম্পর্কে আইনের ১৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাড়ির বাজার মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগের বেশি হবে না। বাড়ির বাজার মূল্য নির্ধারণ করার পদ্ধতিও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৬৪ তে স্পষ্ট করা আছে। তবে এটাকে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে ঢাকা সিটি করপোরেশান ঢাকা মহানগরীকে দশটি রাজস্ব যোনে ভাগ করে ক্যাটেগরিভিত্তিক যে সম্ভাব্য বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে তাকে ভিত্তি ধরে ঢাকার যে কোন অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করা মোটেও সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু তোঘলকি বাস্তবতায় স্বেচ্ছাচারী বাড়িওয়ালাদের মুখের কথাই আইন হয়ে গেছে। ভাড়াটিয়াদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যে যেভাবে পারে আইনকে সম্পূর্ণ কাঁচকলা দেখিয়ে যথেচ্ছাচারের বলী হতে বাধ্য করা হচ্ছে ভাড়াটিয়াকে। অথচ আইনের ৭নং ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনক্রমেই মানসম্মত ভাড়ার বেশি বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে না। এমনকি বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে এই মর্মে কোন চুক্তি থাকলেও মানসম্মত ভাড়ার বেশি ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে না।

ভাড়া আদায়ের রশিদঃ
বাড়িভাড়া আইনের ১৩ ধারায় বাড়িওয়ালার প্রতি ভাড়া পরিশোধের রশিদ প্রদানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাড়ি মালিক যখনই ভাড়া গ্রহণ করবেন তখনই বাড়ি ভাড়া পরিশোধের একটি রশিদ ভাড়াটিয়াকে প্রদান করবেন। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ১৯৮৬ এ উল্লেখিত ফরমে বা ছকে রশিদ ছাপিয়ে নিয়ে ঐ রশিদ দ্বারাই বাড়ি মালিককে ভাড়া পরিশোধের রশিদ প্রদান করতে হবে। রশিদ ইস্যু করার সময় বাড়ি মালিক রশিদের মুড়িতেও লিখে রাখবেন এবং তা অবশ্যই বাড়ি মালিককে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা আদৌ কি মানা হচ্ছে ? আমার জানামতে ব্যক্তি ভাড়াটিয়ার ক্ষেত্রে কোথাও এটা মানা হচ্ছে না। ভাড়াটিয়াকে বাড়িওয়ালার বাড়িতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বানিয়ে রাখা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। ফলে প্রয়োজনে ভাড়াটিয়া আইনের আশ্রয় নিতে সুস্পষ্টভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং বাড়িওলার স্বেচ্ছাচারিতা কোনরূপ জবাবদিহিহীনতার প্রশ্রয়ে আরো যথেচ্ছাচারী হয়ে ওঠছে। বৈধভাবে ভাড়া পরিশোধ করেও লেনদেনের কোন প্রমাণপত্র না পাওয়া সুস্পষ্টভাবেই ব্যক্তির মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। এছাড়াও এই বাড়িভাড়া প্রাপ্তির প্রমাণপত্র না দেয়ার পেছনে বাড়িওয়ালার অন্য যে দুরভিসন্ধি কাজ করে তা হলো হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ না করে সরকারের রাজস্ব আয় ফাঁকি দেয়া। এটা কি নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের আওতায় আসে না ? অথচ আইনের ২৭ ধারায় বলা আছে, এই আইন অমান্য করে কোন বাড়ি মালিক যদি ভাড়াটিয়াকে ভাড়া গ্রহণের লিখিত রশিদ প্রদানে অস্বীকার করেন বা ব্যর্থ হন তাহলে বাড়ি মালিক ভাড়াটিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে আদায়কৃত টাকার দ্বিগুন অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। আর রাজস্ব ফাঁকির জন্য কী দণ্ডের বিধান আছে তা সংশ্লিষ্ট আইনের অধ্যায় খুঁজে দেখা যেতে পারে।

অগ্রিম ভাড়া ও জামানতঃ
আলোচ্য বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১০ নং ধারায় বলা আছে, ভাড়া দেয়া বা ভাড়া নবায়ন করা অথবা ভাড়ার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে বাড়ির মালিক কর্তৃক ভাড়ার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত বা অনুরূপ কোন টাকা দাবী বা গ্রহণ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি অনুরূপ কোন প্রিমিয়াম, সালামী, জামানত প্রদানে কোন ভাড়াটিয়াকে বাধ্য করা যাবে না। এ ছাড়াও বাড়ি মালিক বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া অগ্রীম ভাড়া হিসেবে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা দাবী বা গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে কি তা মানা হচ্ছে ? অথচ বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারায় সুস্পষ্টভাবে নির্দেশিত আছে যে, বাড়ি মালিক এই আইনের ৮ ধারা এবং ৯ ধারায় বর্ণিত কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানসম্মত ভাড়া অপেক্ষা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অধিক বাড়িভাড়া আদায় করলে সেক্ষেত্রে প্রথমবারের অপরাধের জন্যে মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন। তৎপরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্যে এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ আদায় করা হয়েছে তার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন।

আবার ১১ ধারায় বর্ণিত কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানসম্মত ভাড়ার অপেক্ষা অতিরিক্ত কোন ভাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বা অনুরূপ কোন টাকা গ্রহণ করলে বা দাবী করলে কিংবা প্রদানের জন্যে প্রস্তাব করলে প্রথমবারের অপরাধের জন্যে দুই হাজার টাকা এবং পরবর্তী প্রত্যেকবারের অপরাধের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিককে দণ্ডিত করা হবে।

অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রক আদালতের লিখিত আদেশ ছাড়া অগ্রীম ভাড়া বাবদ এক মাসের অধিক ভাড়া গ্রহণ করলে প্রথমবারের এক মাসের ভাড়ার অতিরিক্ত যে অর্থ বাড়ি মালিক গ্রহণ করেছেন তার দ্বিগুণ এবং পরবর্তী প্রত্যেক অপরাধের জন্যে এক মাসের অতিরিক্ত যে ভাড়া গ্রহণ করা হয়েছে তার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বাড়ি মালিক দণ্ডিত হবেন।

ভাড়াটিয়া উচ্ছেদঃ
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৮ নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ১৮৮২ সনের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বা ১৮৭২ সনের চুক্তি আইনের বিধানে যাই থাকুক না বেন, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়ি ভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমনকি ১৮(২) ধারা মতে বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলে ও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
তবে আইনসম্মত ভাড়া দেয়ার পরও যেসব কারণে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে-
১.০ কোন চুক্তির অবর্তমানে ভাড়াটিয়া বাড়ি মালিকের অনুমতি ব্যতীত বাড়ি বা বাড়ির কোন অংশ উপভাড়া প্রদান করলে বা
২.০ ভাড়াটিয়া যদি এরূপ কোন আচরণ করেন যা পার্শ্ববর্তী বাড়ি দখলকারীদের জন্যে বিরক্তিকর বা উৎপাতজনক হয় অথবা
৩.০ ভাড়াটিয়া যদি বাড়িটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন বা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে থাকেন অথবা
৪.০ বাড়িটির নির্মাণ পুনঃনির্মাণ অথবা বাড়ি মালিকের বা তার লোকজনের প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন হয়ে পরে যা আদালতের কাছে সঙ্গত বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে।
এ ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া বাড়ি ছেড়ে দেয়ার পরবর্তী দুমাসের মধ্যে বাড়িওয়ালা যদি নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ বা মেরামতের কাজ শুরু না করেন অথবা সাবেক ভাড়াটিয়া বাড়ি ছেড়ে দেয়ার ছয় মাসের মধ্যে যদি বাড়িওয়ালা অন্য কোনো ভাড়াটিয়ার কাছে বাড়ি ভাড়া দেন তবে আদালত বাড়িটি সাবেক ভাড়াটিয়ার দখলে দেয়া বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া বা উভয়ই দেয়ার জন্য বাড়িওয়ালাকে আদেশ দিতে পারেন।
৫.০ চুক্তিতে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে বা এ রকম কোন চুক্তি না থাকলে মাসিক ভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে যদি ভাড়াটিয়া পরিশোধ না করেন তাহলে উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে। এছাড়াও
৬.০ যদি ভাড়াটিয়া ভাড়া নেয়ার সময় যে অবস্থায় বাড়িটি পেয়েছেন তা বজায় রাখতে ব্যর্থ হন, বাড়ির অবকাঠামোর কোনো ক্ষতি করেন এবং বাড়িওয়ালা এ রকম ক্ষতির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নোটিশ দেয়ার তিন মাসের মধ্যে ক্ষতি মেরামত না করেন। অথবা
৭.০ বাড়িওয়ালার লিখিত সম্মতি ছাড়া ভাড়াটিয়া যদি বাড়ির কোনো স্থায়ী অবকাঠামোর ক্ষতি করেন।

কিন্তু বাস্তবতা কী বলে ? সামনের মাস থেকে বাড়ি ছেড়ে দেবেন, বাড়িওয়ালার মৌখিক নির্দেশই কোনঠাসা ভাড়াটিয়ার জন্যে ফরয-ই-আইন হয়ে বাধ্যগত আজাব নেমে আসে।

বাড়ি মেরামতঃ
বাড়ি মালিক ইচ্ছা করলেই ভাড়াটিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী বা অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের উপযোগী করে বাড়িটি প্রস্তুত রাখতে বাড়ি মালিকের উপর এই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২১ নং ধারায় বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। অর্থাৎ বাড়ি মালিক তার বাড়িটি বসবাসের উপযোগী করে রাখতে আইনতঃ বাধ্য। ভাড়াটিয়াকে পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা প্রদান করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনবোধে লিফটের সুবিধাও দিতে হবে। কিন্তু উক্তরূপ সুবিধা প্রদানে বাড়ি মালিক অনীহা প্রকাশ করলে ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে পারবেন। আবার বাড়িটি মেরামতের প্রয়োজন হলেও ভাড়াটিয়া দরখাস্ত করতে পারবেন।
ভাড়াটিয়া কর্তৃক অনুরূপ দরখাস্ত পাবার পরে নিয়ন্ত্রক বাড়ি মালিককে নোটিশ প্রদান করবেন এবং বাড়ি মালিককে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে শুনানীর সুযোগ দেবেন। শুনানী শেষে প্রয়োজন মনে করলে বাড়িটি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করার আদেশ দেবেন। এই আদেশ দেবার ত্রিশ দিনের মধ্যে বাড়ি মালিক যদি মেরামত বা করতে ব্যর্থ হন তাহলে ভাড়াটিয়া তা নিয়ন্ত্রককে জানিয়ে সে নিজে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য দরখাস্ত করতে পারবে। তবে এরূপ দরখাস্তের সাথে আনুমানিক একটি খরচের হিসাব অবশ্যই নিয়ন্ত্রকের কাছে দাখিল করতে হবে। নিয়ন্ত্রক তদন্ত করার পরে সন্তুষ্ট হলে ভাড়াটিয়াকে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের অনুমতি দেবেন।
ভাড়াটিয়া নিজে বাড়িটির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করলে যে অর্থ ব্যয় হবে তা বাড়ি ভাড়া হতে কর্তন করে নিতে পারবেন। তবে পূর্বে বাড়িটি মেরামত করার জন্য যে হিসাব দেয়া হয়েছিল তার অপেক্ষা অধিক অর্থ মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ব্যয় করা যাবে না। ব্যয় করলে উক্ত অতিরিক্ত ব্যয়িত অর্থ বাড়ি ভাড়ার সাথে সমন্বয় করা যাবে না। আবার এও বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অনুরূপ খরচ এক বছরে বাড়ি ভাড়ার মোট অর্থের এক ষষ্ঠাংশের বেশি হবে না।

আবার মেরামত যদি জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন হয় তাহলে সেভাবেই নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে হবে। নিয়ন্ত্রক আদেশ প্রদান করলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত কার্য সম্পাদন করতে হবে। বাড়ি মালিক ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত কার্য সম্পাদন করতে ব্যর্থ হলে ভাড়াটিয়া নিজ দায়িত্বে উপরে বর্ণিত নিয়মে বাড়িটি মেরামত করে নিতে পারবে। এক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া বাড়ি মেরামতের যে অর্থ ব্যয় করেছেন সেই অর্থ বাড়ি ভাড়া হতে কর্তন করে নিতে পারবেন। তবে অনুরূপ ব্যয়িত অর্থ অবশ্যই উক্ত বাড়ি ভাড়ার এক ষষ্ঠাংশের বেশি হতে পারবে না।
কিন্তু বাস্তব বলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। ভাড়াটেদের খোয়াড়ি জীবনই এর ভাষ্য।

ভাড়া পুনঃনির্ধারণের সময়কালঃ
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৬ ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানসম্মত ভাড়া কার্যকরী হবার তারিখ হতে দুই বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। দুই বছর পর মানসম্মত ভাড়ার পরিবর্তন করা যাবে। কিন্তু বাস্তব কী বলে ? চলতি বছরের জানুয়ারিতে গোটা ঢাকাতেই বাড়িওয়ালারা খুব অন্যায়ভাবে বাড়িভাড়া একদফা বাড়িয়ে দিলেও জুলাই থেকেই শুনা যাচ্ছে যে আরেকদফা ভাড়াবৃদ্ধি ঘটে গেছে অনেক এলাকায় এবং অন্য অনেক এলাকায় ইতোমধ্যে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের কাছে মৌখিক এলান দিয়ে ফেলেছে, দ্রব্যমূল্যের যা দাম ! আগামী মাস থেকে ভাড়া হবে এতো। নইলে বাড়ি ছেড়ে দেবেন। বাড়ি ছাড়লেই যে বাড়িওয়ালার লাভ ! নতুন ভাড়াটিয়াকে ঠিকই বর্ধিত ভাড়ায় বাসা ভাড়া দেবেন।

কিতাবে বন্দী আইনের সাথে বাস্তবতার তোঘলকি ব্যাভিচার যে কতোটা সঙ্গতিহীন ও বিপরীতমুখি, এরই গুটিকয় নমূনা উদাহরণ দেয়া হলো শুধু। তা প্রতিকারের কোনো উপায় কি নেই ? আইনের শোভন বাক্যবন্ধে এটাও স্পষ্ট বলা আছে যে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার উপর অবিচার হচ্ছে এমন মনে করার কারণ ঘটলে তিনি যথানিয়মে আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার রাখেন। এবং বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, বাড়ি মালিক বা ভাড়াটিয়াকে এই আইনের ২৩, ২৫, ২৬ ও ২৭ ধারামতে অভিযোগ দায়ের করতে হলে অবশ্যই উক্ত অভিযোগের অপরাধ সংঘটনের তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে দায়ের করতে হবে। অন্যথায় অনুরূপ অভিযোগ তামাদি দ্বারা বাতিল হয়ে যাবে। আইনের এরকম আশ্রয় যদি থেকেই থাকে, তাহলে প্রশ্ন আসে, তা সত্তেও এমন ভুক্তভোগী ভাড়াটিয়ারা কেনই বা প্রতিকার চেয়ে আইনের যথাযথ আশ্রয় নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন ?

@ আইনের আশ্রয়ে যেতে ভয় কোথায় ?

স্বার্থসংশ্লিষ্টতার সংঘাতে এসে জগতের তাবৎ সম্পর্কই আসলে পরস্পরবিরোধী শোষক ও শোষিত, অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত সম্পর্কে উপনীত হয়। একপক্ষ যদি হয় মার্জার বা বিড়াল, অপরপক্ষ মুষিক। আইনের দৃষ্টিতেও এই দুই পক্ষকে ঘিরেই ধারা উপধারাগুলো আবর্তিত হয়ে থাকে, আইনী ভাষায় যাকে বলা হয় বাদী ও বিবাদী। অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই ক্ষমতাবান শোষকপক্ষের বিপরীতে শোষিতপক্ষ দুর্বল ও নিস্পেষিত হয় বলে এরাই অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে আইনী আশ্রয়ে সন্তুষ্টি খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু জ্বলন্ত বাস্তবতায় এই প্রতিকার চাওয়াটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বল পক্ষের জন্য আরো অসংখ্য সমস্যা ও প্রতিকূলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবং ক্ষেত্রবিশেষে আর্জি অনুযায়ী আইনী বিচারের রায় আবেদনকারীর পক্ষে গেলেও পরবর্তী বাস্তবতায় উদ্ভুত নতুন নতুন সমস্যা ও ভোগান্তিগুলো এমনই প্রত্যক্ষতা নিয়ে আসে যে, ওই আইনী প্রতিকার আর আদৌ কোনো উপকারে আসে বলে মনে হয় না। বরং ক্রমাগত দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এসব দুর্ভোগের কাহিনী যখন অন্যদের কাছে জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে, অনুরূপ ভুক্তভোগীরাও খুব যুক্তিসঙ্গত কারণেই তখন প্রত্যক্ষভাবে এরূপ আইনী আশ্রয় নিতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনী প্রক্রিয়া আবেদনকারীর আর্জি অনুযায়ী সুবিচার হয়তো করতে পারে ঠিকই, কিন্তু আর্জিকারীর প্রত্যক্ষ নিরাপত্তা ও অনাগত সম্ভাব্য সমস্যা নিরসনে নিরঙ্কুশ আশ্রয় কি দিতে পারে ? আর তাই এই বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়া বিরোধে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটা করতে যাবে কে ?

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে এতো চমৎকার সব বিধান থাকা সত্ত্বেও কেন বাড়িভাড়া সংক্রান্ত যথেচ্ছাচারে ভুক্তভোগী ভাড়াটিয়ারা আইনী আশ্রয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে পারছেন না তার কারণ হিসেবে সম্ভাব্য কিছু প্রেক্ষিত সরেজমিন অনুসন্ধানে ওঠে আসে।
১.০ বাড়িভাড়া আইন ও বিধিমালা সম্পর্কিত ধারণা অধিকাংশ ভাড়াটিয়ার কাছেই পরিষ্কার নয়। ফলে তাদের কাছে কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ তাও স্পষ্ট নয়।
২.০ বাড়িভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে বাড়ি মালিকের ইচ্ছাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এখানে ভাড়াটিয়ার কোন মতামত গ্রাহ্য হয় না এবং তা প্রযোজ্যও নয় বলে মনে করা হয়। ফলে ভাড়াবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া পক্ষান্তরে বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার সামিল।
৩.০ বাড়ি মালিকরা সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। এবং সঙ্গত কারণেই বাড়িওয়ালাদের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থগত কারণে একটা স্থায়ী গোষ্ঠীবদ্ধতা বা সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। অন্যদিকে ভাড়াটিয়ারা অস্থায়ী এবং কার্যকারণে খুব ক্ষণস্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় ভাড়াটিয়াদের মধ্যে সেরকম কোন পারস্পরিক সামাজিক বন্ধন গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। ফলে সঙ্ঘবদ্ধ বাড়িওয়ালা সিন্ডিকেটের সাথে ব্যক্তিভাড়াটিয়ার অসম সংঘাত কোনভাবেই ভাড়াটিয়ার পক্ষে যাবার সম্ভাবনা নেই। পক্ষান্তরে ঐ এলাকায় উক্ত ভাড়াটিয়ার জন্য বাসা ভাড়া পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
৪.০ সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভাড়াটিয়ার কোন সামাজিক শেকড় নেই বলে আইনের আশ্রয় নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতে গেলে উদ্ভুত নানান সমস্যায় পড়তে হয়। ছেলে মেয়ে পরিবার নিয়ে ভাড়াটিয়াকে নানান লাঞ্ছনারও শিকার হতে হয়।
৫.০ ছেলেমেয়ে নিকটস্থ স্কুল কলেজে অধ্যয়নরত এবং বাসার কাছে প্রাইভেট শিক্ষক বা কোচিং এর ব্যবস্থা থাকায় হুট করে বাসা স্থানান্তর সম্ভব নয়। ফলে ভাড়াটিয়াকে বাড়িওয়ালার অন্যায় আবদার মেনে নিতেই বাধ্য হতে হয়।
৬.০ অফিস বা কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকার সুবিধাজনক অবস্থায় পুনরায় বাসা ভাড়া পাওয়া অনিশ্চিৎ।
৭.০ যখন তখন যেকোনো উছিলায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করা মূলত বাড়িওয়ালাদের একটা ইচ্ছানির্ভর সঙ্ঘবদ্ধ হীনপ্রয়াস। তাই এক বাড়ি ছেড়ে সমমানের অন্য বাড়ি ভাড়া নিতে গেলেও ভাড়াটিয়াকে অধিক ভাড়াই গুনতে হয়।
৮.০ বাসা ছেড়ে দেয়া মানেই ভাড়াটিয়াকে আরেকটি বাসায় ওঠতেই হবে। বাসা স্থানান্তর জনিত অতিরিক্ত ব্যয় আর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ বিবেচনায় নিলে একান্ত বাধ্য না হলে এই বিড়ম্বনায় কেউ পড়তে চায় না।
৯.০ আইনী প্রক্রিয়ায় যথাযথ সাক্ষীসাবুদ নিশ্চিৎ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। একজন বাড়িওয়ালা অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণেই পার্শ্ববর্তী বাড়িওয়ালার স্যাসহায়তা পেয়ে যান অনায়াসে। অপরপক্ষে সমদুর্ভোগে ভুক্তভোগী হওয়া সত্ত্বেও পার্শ্ববর্তী অন্য ভাড়াটিয়ারা আত্মকেন্দ্রিকতার বৃত্তে আবদ্ধ থেকে এরকম আইনী কোন ঝামেলায় সহজে জড়ানোর ঝুঁকি নিতে চান না। ফলে বিচারের বাণীকে হয়তো বা নিভৃতে কাঁদা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। এক কথায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষীসাবুদ উপস্থাপন করা একজন সাধারণ ভাড়াটিয়ার পক্ষে দুঃসাধ্য।

গভীর অনুসন্ধানে এরকম আরো অনেক প্রেক্ষিতই হয়তো বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সবগুলোর পেছনেই রয়েছে ভাড়াটিয়া নামের বিশাল এক সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক জনগোষ্ঠীর নিরূপায় অসহায়ত্ব। আর এখানেই সেই মোক্ষম প্রশ্নটিই সামনে চলে আসে, আইন কেন আইন ? এবং আইন আসলে কার নিরাপত্তা বিধান করে ? একজন ফরিয়াদী যখন আইনের কাছে সুবিচারপ্রার্থী হতে ইচ্ছা প্রকাশ করে, এটা কি তার অপরাধ ! নইলে তার আর্জির বিষয়বহির্ভূত অন্য আরো যেসব জীবনঘনিষ্ঠ এন্তার বিষয় রয়ে গেছে সেগুলো এমন অরক্ষিত হয়ে যাবে কেন ?

আইনের সাফল্য আর কার্যকারিতা নির্ভর করে তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নযোগ্যতার উপর। খুনের ঘটনা সংঘটিত হলে এবং প্রকাশ্যে আলামত দৃষ্ট হলে বাদী হিসেবে স্বতঃপ্রণোদিত সংক্ষুব্ধ কাউকে পাওয়া না গেলে রাষ্ট্র নিজেই বাদী হয়ে আইনের শাসন সংরক্ষণ করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটাই আইনের বাস্তবায়নযোগ্যতা এবং স্বয়ৎক্রিয়তা। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনেও যেসব নির্বিচার অপরাধ প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে, যার সাথে রাষ্ট্রের বিরাট অংকের একটা রাজস্ব আয়ের বিষয়ও জড়িত, সেই আইনটির স্বতঃস্ফূর্ত সংরক্ষণের কোন বিধান কি আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে কোথাও নেই ? তাহলে এ থেকে প্রতিকারের উপায়ই কী ?

@ এর কি কোন প্রতিকার নেই ?

প্রতিটা আইনেরই দুটো ভাগ রয়েছে। একটা হচেছ .Substantive law. বা মূল আইন, যা প্রয়োজনীয় দণ্ডবিধিগুলোকে ধারণ করে। অন্যটা .Executive law বা প্রায়োগিক আইন, যা তার বাস্তবায়নযোগ্যতা প্রকাশ করে। এ আইন কোথায় কীভাবে কখন প্রয়োগ হবে তাই বাস্তবায়নযোগ্যতা। এই বাস্তবায়নযোগ্যতা আবার দু’ধরনের। আর্জি নির্ভর ও স্বয়ংক্রিয়। আর্জি নির্ভর হচ্ছে আইনী সহায়তা পেতে ইচ্ছুক কোন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনসম্মত কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদনের মাধ্যমে ইচ্ছা প্রকাশ করতে হয় এবং তার আবেদনের বৈধতা আবেদনকারীকেই তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে প্রমাণ করতে হয়। দেওয়ানী আইনসমূহ এ ধরনের হয়। অন্যদিকে স্বয়ংক্রিয় আইন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সুশাসন নিশ্চিৎ ও অব্যহত থাকার নিমিত্তে যে আইন নিজে নিজে সচল হয়ে ওঠে। ফৌজদারী আইনগুলো মূলত এই ক্যাটেগরিতে পড়ে। এ কারণেই জনগুরুত্বপূর্ণ আইনগুলোকে হতে হয় স্বয়ংক্রিয়।

এ ক্ষেত্রে খুবই উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিনিয়ত বাড়ি মালিক কর্তৃক ভাড়াটিয়াকে আর্থিক, মানসিক ও কখনো কখনো শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রাপ্য হোল্ডিং ট্যাক্স ও আয়কর ফাঁকি দেবার মতো ফৌজদারী অপরাধ সংঘটিত হলেও অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, আমাদের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ এর ৩০ ধারা মোতাবেক আইনটিকে দেওয়ানী আইন বিধির অন্তর্ভূক্ত করে আইনের স্বয়ংক্রিয়তা নষ্ট করে এটাকে চলমান বাস্তবতায় পঙ্গু করে রাখা হয়েছে।

আমরা চাই আইনের স্বতঃস্ফূর্ততা, স্বয়ংক্রিয়তা। জনগুরুত্ব বিবেচনা করে এটাকে কীভাবে সম্ভব করা হবে তা নিযে আইনী বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ দেয়া অত্যন্ত জরুরি। এখানে সময়ক্ষেপন মৌলিক মানবাধিকার নীতিকেই ক্ষুণ্ন করে বলে মনে করি। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নাগরিক হিসেবে আমরাও, যদিও আইনজ্ঞ নই তবুও, মোটাদাগে কিছু প্রস্তাবনা যথাযথ কর্তৃপক্ষের ভাবনা ও বিবেচনার জন্য পেশ করতে পারি।

০১) বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও স্বয়ংক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণের নিমিত্তে এ আইনের ৩৪ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সরকার কিছু বিধি প্রণয়ন করে কোন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে আইনটির স্বতঃস্ফূর্ত তদারকি ক্ষমতা দিতে পারে। যারা নিয়মিত ভ্রাম্যমান টীম হিসেবে যে কোন এলাকায় যে কোন বাড়ি পরিদর্শন করে ভাড়াটিয়া বা বাড়ি মালিকের কাছে সংরক্ষিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করে দেখবেন। বিধি না মানার কারণে সংশ্লিষ্ট বাড়ি মালিকের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী উদ্যোগ নেবেন। দায়বদ্ধতা নিশ্চিৎকরনের লক্ষ্যে যে বাড়ি পরিদর্শন করবেন, তদারকী কর্তৃপক্ষ বা পরিদর্শন দল অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ভাড়াটিয়ার কাছে স্বাক্ষর, তারিখ ও বিষয় উল্লেখ করে একটি পরিদর্শন রশিদ প্রদান করবেন যার একটি অংশ কর্তৃপক্ষের কাছে সংরক্ষিত থাকবে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এরকম ক্ষেত্রে বাড়ির মালিক হয়তো পরিদর্শনকারীর কাছে প্রকৃত ভাড়াটিয়াকেও আত্মীয় পরিচয় দিয়ে পূর্ব থেকে বাধ্য করতে পারে। এটাও পরিদর্শনকারীর নিশ্চিত হতে হবে। জাতীয় পরিচয় পত্র এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
০২) যেহেতু বাড়িভাড়ার সাথে সরকারের প্রাপ্য হোল্ডিং ট্যাক্স বা রাজস্ব আয় জড়িত, তাই এই তদারককারী কর্তৃপক্ষের সাথে বিশেষ আইন দ্বারা রাজস্ব বিভাগ বা বোর্ড ও সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জড়িত করা যেতে পারে।
এই বাড়িভাড়া আইন তদারকীর দায়িত্বে সরকারের কোনো দপ্তর বা স্বাধীন কর্তৃপক্ষ রয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে যথাযথ আইনজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে ঢাকা সিটি করপোরেশান যেহেতু হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের দায়িত্বে রয়েছে এবং গোটা ঢাকা অঞ্চলের সম্ভাব্য বাড়িভাড়ার একটা নমূনাও নির্ধারণ করে দিয়েছে, ধারণা করছি যে, ডিসিসির এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। এছাড়া বাংলাদেশের আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ (১৯৮৪ এর ৩৬ নং অধ্যাদেশ) এর অধীন আয়কর রিটার্ন ফরম আইটি- ১১গ এর তফসিল-২ (গৃহসম্পত্তির আয়) কলামে প্রত্যেক করদাতাকে বাৎসরিক বাড়িভাড়া আয় বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করতে হয়। তাই উপস্থাপিত তথ্যের সঠিকতা যাচাইয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপরও কোন না কোনভাবে এই দায়িত্ব অর্পিত আছে বলে ধরে নিতে পারি। কিন্তু এই অর্পিত দায়িত্ব তারা কীভাবে পালন করছেন তা দেখার দায়িত্ব কার ? এই গরীব রাষ্ট্রের এতো বিশাল একটা আয়ের খাতের আদৌ কোন পরিচর্যা হচ্ছে কি না, তার-ই বা দেখার দায়িত্ব কাদের ?
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে এ বিষয়টাকেও সরকার কোন বিধি দ্বারা স্পষ্ট করে দিতে পারেন।

০৩) গঠিত এ তদারকী কর্তৃপক্ষ যে অর্পিত দায়িত্ব পালনের উছিলায় আরেকটা অনিয়মের অত্যাচারী ঘাঁটি হয়ে ওঠবে না তার সম্ভাব্য বাস্তবতা মেনেই দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেল থাকতে পারে। তারা ঐ তদারকী কর্তৃপক্ষের এলাকা পরিদর্শন রিপোর্টগুলো নিয়মিত যাচাই করবেন এবং স্বেচ্ছাকৃত দায়িত্ব অবহেলার জন্য প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা নেবেন।
০৪) সাধারণ নাগরিকদের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা দপ্তর থেকে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিণ্ট মিডিয়ায় নিয়মিত বিজ্ঞাপন বিজ্ঞপ্তি প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এই বিজ্ঞপ্তিতে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রধান প্রধান দণ্ডবিধিগুলো প্রচার করতে হবে এবং তা পালিত না হলে সুনির্দিষ্টভাবে কোন যোগাযোগ নম্বরে রিং করে অবহিতকরণের জন্য নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে যিনি অবহিত করবেন তার পরিচয় প্রদান বাধ্যমূলক নয়।
০৫) প্রচারিত নমূনা বিজ্ঞপ্তিতে কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে, যেমন-
৫.১ আপনি কি বাড়িভাড়ায় থাকছেন ? আইনসম্মত বৈধ ভাড়াটিয়া হিসেবে আপনি আপনার সংশ্লিষ্ট মাসের বাড়িভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে অথবা ভাড়াচুক্তিতে উল্লেখিত তারিখের মধ্যে পরিশোধ করুন।
৫.২ আপনার পরিশোধকৃত বাড়িভাড়ার রশিদ সংশ্লিষ্ট বাড়ি মালিক বা তার প্রতিনিধির কাছ থেকে তাৎক্ষনিক বুঝে পেয়েছেন কি ? বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন/অধ্যাদেশ ১৯৯১ এর ১৩ ও ২৭ ধারা মোতাবেক বাড়ির মালিক তা দিতে বাধ্য।
৫.৩ বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ এর ১০ ও ২৩ ধারা মোতাবেক বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোন ভাবেই বাড়ি মালিক তার ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অগ্রীম বাবদ এক মাসের বাড়িভাড়ার অধিক কোন প্রকার ভাড়া, জামানত, প্রিমিয়াম বা সেলামি গ্রহণ করতে পারবেন না। তা হলে দণ্ডবিধি ২৩ ধারা মোতাবেক তিনি দণ্ডিত হবেন।
এর কোন ব্যত্যয় হলে আপনার অভিযোগ এই নম্বরে ……….. জানিয়ে দিন।

এভাবে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ আইন, বাড়িভাড়া কত হবে বা বাড়িভাড়া পুনঃনির্ধারণের সময়সীমা ইত্যাদিও উক্ত বিজ্ঞাপণে প্রচার করা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য যোগাযোগ ঠিকানা উল্লেখ করা যেতে পারে। দুনীতি দমন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কোন ঠিকানা বা অভিযোগ নম্বরও প্রচার করা যেতে পারে।

@ মিডিয়া পারে অনেক কিছুই বদলে দিতে

তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এসে মিডিয়ার যে কী বিস্ময়কর ক্ষমতা. এতে আশা করি কেউ দ্বিমত করবেন না। গণমাধ্যম হিসেবে আমাদের ইলেকট্রনিক ও প্রিণ্ট মিডিয়াগুলো সদিচ্ছা দেখালে অনেক কিছুই বদলে দিতে পারে। তার প্রমাণ আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পেয়েছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক জনগোষ্ঠীর গলায় ফাঁস লাগানো বাড়িভাড়া সংক্রান্ত এই নিরবচ্ছিন্ন সমস্যাটিকেও আমাদের মিডিয়াগুলো একটা ব্যাপক ও বৃহত্তর সমস্যা হিসেবে আন্তরিকভাবে বিবেচনা করলে তা নিরসনে খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে অবশ্যই। প্রিণ্ট মিডিয়ায় বিশেষ করে দৈনিকগুলোতে মাঝেমধ্যে এ বিষয়ে কিছু রিপোর্টিং হলেও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এক্ষেত্রে কেন যে এতো বিস্ময়করভাবে নীরব ভূমিকা পালন করছে তা বোধগম্য নয়। কেবলমাত্র বাড়ি মালিক সম্প্রদায়ভুক্ত কেউ হয়তো এটা চাইবেন না যে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ এ দেশে যথাযথ কার্যকর হোক। নইলে আর কারো তো তা না চাইবার কথা নয়। তাহলে কি অবৈধ সুবিধাভোগিতার দীর্ঘ কালো হাত ওই নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও শিকড় গেঁড়েছে ?

মিডিয়াই পারে এই নিষ্ক্রিয়তাটাকে ভেঙে দিতে। বিশেষ করে জলজ্যান্ত ভিজ্যুয়াল মাধ্যম হিসেবে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে এখনই এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিৎ। নাহলে তাদের নিষ্ক্রিয়তা আমাদেরকে কি দুঃখজনকভাবে এটা ভাবতে বাধ্য করবে না যে, আশা ভরসার চতুর্থ বিশ্ব হিসেবে মিডিয়া কর্তৃত্বও অবৈধ সুবিধা বাণিজ্যের কাছে পরাজিত ? টিভিতে নানান ধরনের টক শো আমরা দেখি। কিন্তু বাড়িভাড়ার অনিয়ম অসংগতি প্রতারণা থেকে কীভাবে পার পাওয়া যায়, কীভাবে এই অবৈধ ঘটনাগুলো রোধ করা যায়, এ নিয়ে এখনো সেরকম কোন টক শো কি আমরা আদৌ দেখেছি ? অথচ দু-একটা সরেজমিন অনুসন্ধানী রিপোর্ট ও মনিটরিং কী না করতে পারে ?

টিভির কোন একটা চ্যানেলের নবটা অন করতেই কৌতূহলি দর্শক হঠাৎ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে টিভি পর্দায় দেখতে পেলেন যে মুভিসরঞ্জামসহ একদল টিভিক্রু ঢাকার কোন একটি আবাসিক এলাকায় আকস্মিক উপস্থিত। কডলেস মাইক্রোফোন হাতে উপস্থাপক বলছেন, দর্শকমণ্ডলি আমরা এখন ঢাকার অমুক এলাকার তমুক হোল্ডিং এর এতো নম্বর বাড়িতে। তারপরই দলটি বহুতল ভবনের গেট পেরিয়ে ঢুকে গেলো ভেতরে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় কয়েকটি ফ্ল্যাটের বা বাসার ভাড়াটিয়ার ভাড়া সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সনাক্ত করার তাৎক্ষণিক রিপোর্ট নিয়ে প্রাপ্ত অসংগতিগুলো যাচাই করতে গিয়ে বাড়ি মালিকের অযৌক্তিক জবাবদিহিতাগুলোও রিপোর্ট করলো। এরপরেই দেখা গেলো ঢাকা সিটি কর্পোরেশানের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পূর্বোক্ত হোল্ডিংয়ের তথ্য অনুসন্ধান করে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে প্রকৃত অবস্থার বৈষম্য উদ্ঘাটন করতে। একইভাবে হয়তো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দপ্তরে আয়কর রিটার্নসের প্রযোজ্য ফরমে প্রদত্ত অসত্য তথ্যের সত্যতাও যাচাই করলেন এরা। শেষে একজন আইন বিশেষজ্ঞের সাথে গোটা অবস্থাটি নিয়ে একটা আইনী মতামতও প্রচার করা হলো। পরিশেষে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিনীতভাবে তাঁর সমাপ্তি বক্তব্য টানলেন-

দর্শকমণ্ডলি, ভয়াবহ জনসংখ্যায় ফুলে ফেঁপে ওঠা আমাদের এই ঢাকা মহানগরী আজ মানুষের ভীড়ে রীতিমতো পর্যুদস্ত। এতো মানুষের চাপ সয়ে এই নগরীর নাগরিক সুবিধাগুলো আজ হুমকীর সম্মুখীন। পানি সমস্যা, বিদ্যুৎ সমস্যা, গ্যাস সমস্যা, রাস্তাঘাট যোগাযোগ সমস্যা, ড্রেনেজ সমস্যা, পরিবহন সমস্যা, সমস্যা আর সমস্যা। কিন্তু এতো সব সমস্যার মাঝে অন্য যে গভীর সমস্যাটি নগরীর মোট জনসংখ্যার প্রায় আশিভাগ নাগরিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রধান একটি মানবিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো আবাসন সমস্যা। আর এই মানবিক সমস্যাটিকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর অসাধু বাড়িভাড়া ব্যবসায়ী বা বাড়িওয়ালা অত্যন্ত অমানবিক উপায়ে নিরূপায় ভাড়াটিয়াকে জিম্মি করে, বলা যায় প্রতারণা করে, সরকারের প্রাপ্য কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। এ দেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। ঢাকার সবকটা এলাকার জন্য যে মানসম্মত ভাড়া ঢাকা সিটি কর্পোরেশন আইন অনুযায়ী নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার থেকে দ্বিগুণ তিনগুণ এমনকি তারচে’ও অনেক বেশি ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য করা হচ্ছে অসহায় ভাড়াটিয়াদেরকে। দুয়েকজন ব্যতিক্রম বাদ দিলে অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠেছে যে, প্রায় কোন বাড়িওয়ালাই ভাড়া পরিশোধের কোন বৈধ রশিদ ভাড়াটিয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। রাষ্ট্রীয় আইনে যে কোন বৈধ লেনদেনে বিধিবদ্ধ রশিদ বা প্রমাণপত্র থাকতে হবে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সুস্পষ্টভাবে ভাড়া পরিশোধকারীকে ভাড়া বুঝে পাওয়ার স্বাক্ষরিত রশিদ দেয়া বাড়ি মালিকের জন্য বাধ্যতামূলক করা আছে এবং আইন অমান্যকারীর জন্য জরিমানাসহ শাস্তির বিধান রয়েছে । তারপরেও এ আইন মানা হচ্ছে এরকম কোন তথ্য আমাদের অনুসন্ধানী রিপোর্টে আসেনি। ফলে ওই লেনদেনের বৈধতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই বাড়িভাড়ার সাথে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে সরকারের রাজস্ব আয়ের খাত হোল্ডিং ট্যাক্স নীতিমালারও। এটা কোন লুকোছাপা বিষয় নয় আজ। কিন্তু তা দেখার কেউ নেই। আমাদের সরেজমিন রিপোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের আলোচনা থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, এই সেক্টরে অত্যন্ত নগ্নভাবে বিষয়টি প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। এবং তা সুস্পষ্ট প্রতারণা ও আর্থিক নির্যাতনের মাধ্যমে একদিকে যেমন রাষ্ট্রের কিছু অসাধু কর্মচারিদের সহায়তায় কিছু লোকের অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠছে, অন্যদিকে ফাঁকিতে পড়ে যাচ্ছে সরকারের বিপুল অংকের রাজস্ব আয়। আইনজ্ঞদের দৃষ্টিতে তা অত্যন্ত জঘন্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এবং একই সাথে তা মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কর্মকাণ্ডও। শুধু ঢাকাতেই নয়, গোটা দেশেই এই অপরাধ বিস্তৃত। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত এবং সীমিত আয়ের অসহায় নাগরিক জনগোষ্ঠীকে এই ফাঁদ থেকে কীভাবে উদ্ধার করা যায় এবং সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয়কে কীভাবে সঠিক খাতে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, কর্তৃপক্ষ এবং সচেতন নাগরিকদেরকে এখনি ভাবতে হবে। আর কালক্ষেপনের সময় নেই। আশা করি সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন।

এটা একটা কাল্পনিক টিভি রিপোর্ট। কিন্ত তা বাস্তবায়িত করা কি সত্যিই অসম্ভব ?

@ তবু কি সেলুকাস ?

এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কারো কাছে অনুনয় বিনয় অনুরোধ উপরোধ করার মতো সার্বজনীন বিষয় ছিলো না এটা। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের বিষয় ছিলো তা। তবু কোন স্বাভাবিক কাজ স্বাভাবিকভাবে না হওয়াটাই দুর্ভাগা জাতি হিসেবে আমাদের নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে গেছে হয়তো। তাই আগামীতে আবার যদি কখনো কৌতুক করেও বলতে হয়, ‘হা সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ !’ তা কি নিজের উপর নিজে থুথু ছিটানোই হবে না ? কেননা কখনো কখনো থুথু নিক্ষেপ থুথুরই অবমাননা হয়ে যায় !

কৃতজ্ঞতা:
০১) বাড়ী ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১/ সৈয়দ হাসান জামিল/ বাংলাদেশ ‘ল’ বুক সেণ্টার/ ফেব্রুয়ারি, ২০০০ ইং।
০২) বাড়ি ভাড়ার আইনি নিষ্পত্তি/ মোহাম্মদ আরজু/ যায়যায়দিন (আইন ও বিচার)/ ৩০ মে ২০০৮ইং।
০৩) বাড়িওয়ালার কাছে ভাড়াটিয়ার জিম্মি দশা দূর করুন/ দাস প্রভাস/ দৈনিক ভোরের কাগজ/ ০৪ জানুয়ারি ২০০৮ইং।
০৪) রাজধানীতে বাড়ি ভাড়ায় নৈরাজ্য/ রিয়াজ উদ্দীন/ দৈনিক ডেসটিনি/ ১৪ মার্চ ২০০৮ইং।
০৫) দ্রব্যমূল্যের দ্বিগুণ হারে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া/ দুলাল আহমদ চৌধুরী//দৈনিক আমাদের সময়/ ৩১মার্চ ২০০৮ইং।

[Bari Vara Aain/House Rent Law/Ranadipam Basu]
(১৭/০৮/২০০৮)

রণদীপম বসু

‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’ -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রী.পূ.)

৪ comments

  1. সৈয়দ তাজরুল হোসেন - ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:৩২ অপরাহ্ণ)

    রণদীপম বসু’কে অনেক ধন্যবাদ বাড়ীভাড়া সম্পর্কে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত আইনটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য । তবে লেখাটি আকারে আরেকটু ছোট (দৈর্ঘ্যে, বক্তব্যে নয়) হলে বোধহয় পাঠকের পক্ষে সহজ হত । বিশেষ করে বাড়ীভাড়া নিয়ন্ত্রন অধ্যাদেশের বিশ্লেষনে পুরো আইনটি এতটা বিষদে আলোচনা না ক’রে, যদি শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ধারা গুলো আলোচনা করা হত, তাহলে লেখাটি পড়তে গিয়ে মাঝে মধ্যে যে ধৈর্য্যচ্যুতির মত অবস্থা তৈরী হচ্ছিল, সেটি এড়ানো যেত ।

    আলোচ্য পোষ্টটিতে লেখক আইনের কঠোর বা যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বাড়িভাড়া’র অস্বাভাবিক উর্ধগতি রোধ সম্ভব ভাবছেন বলে মনে হয় । এবিষয়ে আমি কিঞ্চিত দ্বিমত পোষন করবো, আইনের প্রয়োগে অবস্থার হয়ত সামান্য পরিবর্তন সম্ভব, তবে সেটি সমস্যার ব্যাপকতার নিরিখে অকিঞ্চিতকর হবে বলেই আমার ধারনা ।

    সমস্যাটির শেকড় আসলে নিহিত জনসংখ্যার অনুপাতে অপ্রতুল সংখ্যক বাড়িতে । ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি, এই বিপুল জনসমষ্টির আবাসনের সঙ্কুলান কি ঢাকায় আছে? নাকি প্রতি বছর ঢাকার জনসংখ্যা যে পরিমানে বাড়ছে সে তুলনায় যথেষ্ট পরিমানে নতুন বাড়ী তৈরী হচ্ছে ? সেক্ষেত্রে অর্থনীতির সাধারন সূত্র অনুযায়ী যেহেতু চাহিদার সংগে যোগানের বিষাল ফারাক, তার ফায়দা তো বাড়ীওয়ালারা পাবেই । যোগানের স্বল্পতাহেতু বাড়ীভাড়ার এই উর্ধগতি আইন ক’রে আমাদের মত বাজার অর্থনীতির দেশে থামানো যাবে বলে মনে হয়না । যদি যেত, তাহলে আর কিছু হোক না হোক অন্তত খাদ্য দ্রব্যের মূল্য নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্য নিকট অতীতেও সরকার তার সর্বোচ্য চেষ্টা করতো ।

    উপরন্তু, বাড়ীভাড়া সম্পর্কিত সমস্যা নিরসনের জন্য প্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হল, বর্তমানে প্রাপ্য ভাড়া বাড়ীর উপর চাহিদার চাপ কমানো । তার জন্য দরকার শহরকে ছড়িয়ে দেয়া, সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রধান কার্য্যালয় অন্যান্য শহরে স্থানান্তর করা , ঢাকার সংগে আশেপাশের এলাকার সহজ, কার্য্যকর ও সুলভ যোগাযোগ ব্যাবস্থা গড়ে তোলা, তাহলে অনেক মানুষ শহরতলীতে থাকবে, কার্যপোলক্ষে রোজ ঢাকায় আসবে এবং ঢাকার বাইরে চলে যাবে।

    ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ, কিন্তু প্রতিদিন আরো প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ লোক রোজকার কাজের জন্য লন্ডনে আসেন এবং চলে যান । এটি সম্ভব হয়েছে, লন্ডন ও তার আশে পাশের এলাকা ঘিরে মাকড়শা’র জালের মত বিছানো যোগাযোগ ব্যাবস্থার কল্যানে ।

    সুতরাং, আমাদেরকেও সমস্যার প্রায়োগিক সমাধান খুঁজতে হবে এবং হ্যাঁ, সেই প্র্যাক্টিকেল সমাধানের প্রয়োগে নিশ্চয়ই আইনের প্রয়োগ আবশ্যক হতে পারে।

    • ইনসিডেন্টাল ব্লগার - ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৭:০৪ অপরাহ্ণ)

      @ সৈয়দ তাজরুল হোসেন

      জোগান আর চাহিদা নিয়ে আপনার যে আলোচনা তার সাথে একমত। সরকারের এ সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদী আবাসন পরিকল্পনার অভাবের বিষয়টিও সত্যি। আপনাকে বুঝতে হবে আমাদের সরকারদের এসব করার মত বাড়তি সময় হাতে নেই। এসবই যদি তারা করবেন, তাহলে পারসেন্টেজের টাকা গুনবেন কখন? একে শাস্তি তাকে পুরস্কার দেবেন কখন? আর নিজেদের আরাম আয়েশই বা করবেন কখন?

      তবে দ্বিমত করবো আরেকটি ব্যপারে। আমার কিন্তু মনে হয়েছে লেখক রণদীপম বসু আইনের ধারাগুলো বিধৃত করে আমাদের উপকারই করেছেন। নাহলে, যারা আইনজীবি নন, তাদের সবার কি সম্ভব লাইব্রেরীতে ছুটে গিয়ে ধারাগুলোর কনটেন্ট জেনে আসা? আর এখানে এক জায়গায় পুরো আলোচনাটা পড়তে পেরে বাড়ীভাড়া আইন সম্বন্ধে আমার অন্তত অনেক অজানা তথ্য জানা হল। পরেরবার বাড়ীওয়ালার সাথে চুক্তি করতে বসলে বিষয়গুলো মাথায় থাকবে।

    • রণদীপম বসু - ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৭:৩০ পূর্বাহ্ণ)

      @ সৈয়দ তাজরুল হোসেন

      হাঁ, আপনার সাথে আমি সহমত পোষণ করি যে লেখাটি ধৈর্যচ্যুতি ঘটানোর মতোই দীর্ঘ। এক্ষেত্রে একান্তই যাঁরা ধৈর্য্যকে বাগে রাখতে পারবেন না, তাঁরা এর আটত্রিশটি ধারাসহ আইন ও বিধিমালা অংশটা বাদ দিয়ে পড়লে অর্ধেকেরও বেশি অংশ কাটছাট করে ফেলতে পারেন এবং এতে লেখার বিষয় বক্তব্য এতটুকুও ক্ষুন্ন হবে না।
      লেখাতে সচেতনভাবেই ধারাগুলো অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণের জন্য। অনলাইন খুঁজে খুঁজে এ বিষয়গুলো না পেয়েই আমাকে বাড়তি কাজটা করতে হয়েছে।

      আপনার সুচিন্তিত মূল্যবান মতামতের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
      অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

  2. Pingback: |House Rent Law| বাড়িভাড়া আইন, কাজীর কিতাব এবং তোঘলকি বাস্তবতা…! « horoppa-হরপ্পা

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.