বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ নানা খ্যাতিমান লোকদের বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামাত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি প্রসঙ্গে বিভ্রান্তি মূলক মতামতে সবাই বিস্মিত হলেও এটা অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। এই বিষয়ে আমি একটি ছোট্ট ঘটনা আলোকপাত করে কিছু বলতে চাই।
২০০৭ সালে বাংলাদেশে ১/১১-এর পরে সেনা সমর্থিত অনির্বাচিত সরকারের প্রতি বাংলাদেশের প্রধান সারির গণমাধ্যমের সমর্থন দেখে মিডিয়া ও রাজনীতি বিষয়ে আমার আগ্রহ জন্মায়। Noam Chomsky’র বই Manufacturing Consent ও Media Control পড়ে আমি যথেষ্ট উপকৃত হই। পছন্দের মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগত আগ্রহে Noam Chomski-এর সাথে ইমেইলে যোগাযোগ করি এবং তাঁকে তৎকালীন বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে আমি জানতে চাই আমাদের কিভাবে এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা উচিত। কয়েকবার কথোপকথনের পর তিনি আমাকে জানালেন, বাংলাদেশ বিষয়ে তাঁর খুব ভালো ধারণা নেই। এরপর তিনি আমাকে তাঁর চেনা কয়েকজন ব্যক্তির সাথে আলোচনা করতে বলেন, যাঁরা সবাই কম-বেশি ভারত ও পাকিস্তানের পিএইচডি-করা রাজনৈতিক তাত্ত্বিক এবং এই বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। বেশির ভাগই ইউরোপ আমেরিকায় অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত। আমি ভড়কে গিয়ে খুব বেশি দূর আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাইনি।
আমার মানুষগুলো নিয়ে কোন আপত্তি নেই। তবে, একটি বিষয় আমাকে একটু ভাবিয়েছিল — নোম চমস্কির মতো একজন মানুষ যিনি ইসরায়েল/প্যালেস্টাইন/আমেরিকা তথা আরব মুসলিম সমস্যা নিয়ে এতো সোচ্চার, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিনীদের কট্টর সমালোচক, গণমাধ্যমের রাজনৈতিক চরিত্র বিষয়ে অনন্যসাধারণ গবেষক — তিনি বা তাঁর মতো অনেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির বিষয়ে জানতে পারেন বা জেনে থাকেন ভারত ও পাকিস্তানের কলম দিয়ে। অবশ্য রাজনীতিবিদ বা তাঁদের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ব্যাপারটা অন্যরকম।
পাকিস্তানের ইস্যুতে ভারতের নানা দরদ আছে, যেহেতু তারা নিজেদের একধরনের জমজ ভাই হিসেবে দেখে। কিন্তু বাংলাদেশ ইস্যুতে তাদের উভয়ের আচরণটা সবসময় বৈমাত্রেয়। পাকিস্তান তো রীতিমতো বাংলাদেশকে অবাঞ্ছিত মনে করে। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, আমরা যে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুকে জাতীয় নেতার সম্মান দিই ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে, তাঁরই ভাইয়ের (শরৎ বসু) নাতনী শর্মিলা বসু কি করে Dead Reckoning: Memories of the 1971 Bangladesh War (যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত) বইটি লেখেন, যেখানে পাকিস্তানী শাসকদের বয়ান থেকে বাংলাদেশের যুদ্ধকে তিনি নানাভাবে ভুল ব্যাখা করেছেন? একারণে তিনি পশ্চিমা দেশগুলোতে বাহবা পেলেও ভারতে (কিছু অংশে) এবং আমাদের দেশে সমালোচিতও হয়েছেন। শোনা যায় বইটি আমাদের দেশের বিএনপি-জামাত ঘরানায় ব্যাপক জনপ্রিয় (অবশ্য প্রকাশ্যে নয়)। দেখলাম তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিকাল ইকোনমি নিয়ে পিএইচডি করেছেন। ফলে অনেকের কাছেই তাঁর কথার গুরুত্ব থাকবে, একে সত্যি বলে বিবেচনা করা হবে! আমাদের দেশের খেত-মজুররা যে বন্দুক হাতে যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে; দেশের জন্য, পরিবারের জন্য, মায়ের জন্য প্রান দিয়েছিল অবলীলায় — তাদের তো অক্ষর জ্ঞানই ছিল না ঠিক মতো, পিএইচডি ওয়ালাদের সাথে যুদ্ধ বা তর্ক করে তারা সত্য প্রতিষ্ঠা করবে কি করে? ফলে তাদের কথা হল মিথ্যা আর অভিজাত হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেম্রিজ ওয়ালা হলেন চিরসত্য। বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারত-আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স যে দেশের নাগরিক হন না কেন, হার্ভার্ড ওয়ালারা কেবল নিজেদের লেখা বা কথাই বিশ্বাস করেন — এর বাইরের কারো না।
এরপর আসি, নতুন সময়ে (১৯৭১ সালের পটভূমি শেষে) আমাদের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর দুর্ভিক্ষ, সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড — নানা বৈরিতার ভিতর দিয়ে চলতে চলতে ত্রাহি অবস্থা, শিক্ষা লাভের সুযোগ কোথায়। শিক্ষিত যে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়টি ছিল, তারা তাদের সীমিত শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জোরে দেশে নিজেদের শ্রেণীর অবস্থান পাকাপোক্ত করতে নানা ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিল। এর পূর্বে জামাতসহ পাকিস্তানীরা জঘন্য ও বর্বরোচিত একটি কাজ করলো ১৪ ডিসেম্বরে — স্বাধীনতা-উত্তর দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি করবেন যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তাঁদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেলো। দেশে থাকলো বিরাট সংখ্যায় মেডিওকার বুদ্ধিজীবী — তাঁরা নিশ্চিতভাবে সর্বস্তরের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দিকে না গিয়ে, কেবল সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তের (তাঁর নিজের সম্প্রদায়) স্বপ্ন ও মূল্যবোধ বাস্তবায়নে নিরন্তর নিয়োজিত থাকলেন, যা যুদ্ধ-পরবর্তী সমস্ত শাসককুলকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সুবিধা করে দিয়েছিল। এরপর আশির দশকে স্বৈরশাসক হিসেবে প্রেসিডেন্ট এরশাদ দারুণ দুটো অভাবনীয় ক্ষতি করলেন, একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা যা এই দেশকে বিশ্বের কাছে ছোট করলো এবং দ্বিতীয় কাজটি হল — ঢালাওভাবে সর্বস্তরের বাংলা ভাষা চালু। (এই বিষয়টি স্পর্শকাতর। যে কেউ আমার উপর ক্ষেপে যাওয়ার আগে অনুরোধ — লেখাটি পাঠ শেষ করে আমার উপর রাগ করুন।)
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী আমদের ভাষার লড়াইয়ে যে আত্মত্যাগ তাকে অনেক বড় জায়গায় স্থান দিতে হবে। ভাষা ছাড়া যেমন জাতির অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি জাতি উন্নত না হলে ভাষার মর্যাদাও সুপ্রতিষ্ঠিত হয় না। আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে যতটুকু আত্মম্ভরি ও স্পর্শকাতর, ‘বাঙালী’ জাতি চরিত্র উন্নয়নে ততটুকু উদাসীন। ফলে, জনসংখ্যার দিকে থেকে অষ্টম ভাষাভাষীর জাতি হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আমরা বিশ্বজনীন করতে পারিনি। আমরা ভাষা নিয়ে কেবল নিজেদের খেলার মাঠে নিজেরা ইচ্ছেমত গোল দেয়াতে চরম আত্মতৃপ্ত। আর ইংরেজ, আমেরিকান, বা পাশের ভারতীয়দের দেখে (ঘৃণা থেকে নয়, যৌক্তিকভাবে পাকিস্তানকে কোন জাতি মনে করার কারন নেই) আমরা ধরেই নিয়েছি জাতি হিসেবে আমাদের আর কোন সম্ভাবনা নেই উন্নত হবার।
কিন্তু আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না, পৃথিবীর পরিবর্তন হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীরা নানাভাবে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। এদের আক্রমন, নিপীড়ন কিংবা ঘায়েল করার কৌশলও পাল্টেছে। দেখা যায়, আমাদের একগুঁয়েমিপূর্ণ জাতীয়তাবাদ ও দেশভক্তির সুযোগ নিয়ে তারা নতুন চাল চেলে আমাদের অন্যভাবে দুর্বল করে তোলার জন্য। আমরা পৃথিবীর বাইরে কোন দেশ না। পৃথিবীতে আমরা এক ঘরে থাকতে পারি না। এমনকি আমরা অর্থনীতি বা রাজিনীতিতে ফ্রান্স,রাশিয়া, জার্মানি, জাপানের মতো নই যে ইংরেজি ছাড়া আমাদের বিশ্বে অবস্থান করে নেয়া সম্ভব। সর্বস্তরের বাংলা ভাষা চালুর সরাসরি প্রভাবটা গিয়ে আঘাত করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নানা স্তরে। নব্বইয়ের দশকে এরশাদের পতন ঘটলো, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে ইংরেজি বা আইন সহ গুটি কয়েক বিষয় বাদ দিলে (এবং অবশ্যই তুখোড় মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বাদ দিলে ) সাধারণ গড় ছাত্রদের ইংরেজি ভাষার দখল খুবই দুর্বল হতে শুরু করলো। বর্তমানে দেখা যায় আমাদের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক পদের নানা ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশির ভাগ লোকজনের ইংরেজি জ্ঞান তথৈবচ। মন্ত্রী বা এমপিদের কথা নাহয় বাদ দিলাম, কিন্তু সচিব বা প্রশাসনিক শ্রেণীর লোকদের যোগাযোগ দুর্বলতা কোনো ভাবে কাম্য হতে পারে না। নানা আন্তর্জাতিক হিসেব-নিকেশে প্রায়শ বাংলাদেশের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। আমি একে শুধুমাত্র ইংরেজি না-জানার দুর্বলতা বলছি না। কিন্তু দেখা যায়, একধরনের হীনমন্যতা আমাদের পেয়ে বসে ভিনদেশীদের সাথে মুখোমুখি হলে, যেখানে পর্যাপ্ত লেনদেন বিষয়ে শর্তারোপ বা তর্ক করা কঠিন হয়ে পড়ে। দেখা যায়, আমাদের ইংরেজি জানা লোকজন গণহারে বিদেশী নানাকিছু অনুবাদ কর্মে লিপ্ত থাকেন — এই ভেবে যে তাঁরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন। কিন্তু ভাল ইংরেজি জানা লোকজনের এও ভাবা উচিত তাঁরা আমাদের ভাষায় লিখিত (কবি ও ঔপন্যাসিকদের ) সাহিত্যকে যথার্থ অনুবাদের মাধ্যমে কতটুকু আন্তর্জাতিক করতে পেরেছেন? বাংলা ভাষা চর্চার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে কলকাতা সেক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। কিন্তু তারা আমাদের মতো ইংরেজি বিমুখ মানসিকতার নয়। আবার এও পরিলক্ষিত হয় যে, বাংলা ভাষা নিয়ে চরমপন্থী লোকজন, নিজেদের সন্তানদের যথেষ্ট সুবিধা দিয়ে আধুনিক ও সুশৃঙ্খল উন্নত প্রতিষ্ঠানে (ইংরেজি মিডিয়াম বা কাছাকাছি স্ট্যান্ডার্ড) পড়ান, যাতে প্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতায় তাদের সন্তানদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে। সমস্যা হল কেবল সাধারণ মানুষের সন্তানদের পাঠ্যক্রম নিয়ে। আন্তর্জাতিক ভাষা চর্চার এই দুর্বলতা, দেশের আপামর প্রজন্মকে দুর্বলভাবে পরাশ্রয়ী হয়ে টিকে থাকার দিকে ঠেলে দেয়। এই বিষয়টি কি আমাদের বিদগ্ধ শিক্ষিত সমাজ জানতেন না! এই ক্ষেত্রে কলোনিয়াল ভাষা চর্চা জনিত আধো-পরিষ্কার তত্ত্বগুলো আমলে নিয়ে লাভ-ক্ষতি বিচার্য বিষয়। কলোনিয়াল মানসিকতার ঝমেলাটা কিন্তু আছে। উচ্চশিক্ষিত লোকজন দেশে বা বিদেশে সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়া মাত্র নিজেদের সাফল্য ও স্বাচ্ছন্দ্য বিষয়ে চরমভাবে উৎসাহী হয়ে পড়েন এবং এক্ষেত্রে তাঁরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শে, দেশী-বিদেশী সংস্থাগুলোর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চলতে থাকেন।
এর পরও বলতে হয়, আমাদের দেশের মানুষেরা — কৃষক-শ্রমিক কিংবা ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা ছাত্রছাত্রী — নিজস্ব বিচার, বুদ্ধিমত্তা ও শক্তিতে এই দেশকে এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। দেশে সুযোগ না পেলেও ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের যোগ্যতায় উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যাচ্ছে। কেননা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একদিকে যেমন নিজস্ব অর্থায়নে গবেষণা খাতগুলোকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, বাজেট দেয়া হচ্ছে না, তেমনি অন্যদিকে এখান থেকে ডিগ্রী নিয়ে বা স্কলারশিপ নিয়ে বিশ্বের বড় বড় বিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা নিতে যাওয়া সম্ভব না। দেশে অনেকগুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সুবিধা তৈরি হয় কিন্তু সেটা কোনোভাবে ব্যপক বা সর্বসাধারণ-বান্ধব নয়। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোন ধারাবাহিক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে না। শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া দেশগুলো বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কোটা, বা আসন সুবিধা তৈরি করে। এর মধ্যে অগ্রণী ভুমিকায় আছে চীন, ভারত, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম ইত্যাদি রাষ্ট্রসমূহ। ভারতের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রভাষা হিন্দি হলেও, সারা ভারতের লোকজনের ইংরেজির উপর নির্ভরশীলতা বেশী। ফলে তাদের পক্ষে আজ বলা সম্ভব হচ্ছে, ভারতের উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পন্য হছে, ভারতের দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তি। আমাদের দেশের গরিব লোকজনও বাইরে যায় অর্থ উপার্জন করতে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু ইউরোপ বা আমেরিকা সহ নানা উন্নত দেশে শ্রমিক হিসেবে না গিয়ে শিক্ষিত শ্রেণীর মুখপাত্র হওয়া খুব কম লোকের ভাগ্যে জোটে। ফলে বিদেশে কর্মরত অশিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণী ওই দেশের নানা নিয়মনীতির বেড়াজালে আটকে পড়ে। ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি বড় দিক, তাদের শত বছরের ব্যবসায়িক ও সামাজিক অভিজাত শ্রেণী। তারা নিজেদের সুবিধার জন্য বিশ্বের নানা জায়গায় নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়তে, শিখতে পাঠিয়ে দেন। তারা হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড থেকে শিক্ষিত হয়ে এসে গণমানুষের হাল ধরেন। উপকার কতটুকু করেন তা হয়তো তাঁদের জনগণ বলতে পারবেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার, জাতিসঙ্ঘ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া সংগঠনগুলিতে এই সব উচ্চশিক্ষার মানুষেরা বসে আছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। পাকিস্তান ও ভারত মানসিকতার মধ্যে যে একটি সূক্ষ্ম ‘বাংলাদেশ স্লেশ’ (অর্থনীতি ও শিক্ষার দীনতা নিয়ে) কাজ করে তা কেবল মাত্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা বুঝতে পারেন। এই দেশেও অনেকে বোঝেন।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও অভিজ্ঞ, শিক্ষিত ও দক্ষতা সম্পন্ন পরিচালকের অভাবে আমাদের দেশে নানা বড় বড় ফ্যাক্টরি, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও মালটি-ন্যাশনাল কোম্পানি গুলো ইউরোপ-আমেরিকা সহ ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের নানা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কাজ করছেন। এ নিয়ে আমাদের দেশীও অর্থ নিজেদের কাছে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আবার উচ্চশিক্ষিত লোকজনকে বাইরে পাঠিয়েও আমরা বৈদেশিক মুদ্রা ঘরে আনতে পারছি না। একমাত্র ভরসা যে গরিব দুঃখী মানুষগুলো নিজেদের সর্বস্ব বিলীন করে মধ্যপ্রাচ্যে মানবেতর জীবনে কাজ করে দেশে টাকা পাঠান। তাঁদের জন্যও আমরা কোন সুযোগ সুবিধা তৈরি করতে পারি না, রাষ্ট্রও যেন তাঁদের ক্ষেত্রে উদাসীন। যদিও তাঁরা দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা রাখেন। বিদেশেরর মাটিতে তাঁদের একই চেহারা ও কাছাকাছি সংস্কৃতির মানুষ হওয়ার কারণে পাকি বা ভারতীয়দের হাতে নিগৃহীত হতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যের গণমাধ্যমগুলোর (আল-জাজিরা সহ) দক্ষিণ এশীয় বিভাগে পাকিস্তানী ও ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়। তারা ঢালাওভাবে নিজেদের লোকজনের যে-কোন গুরুতর অপরাধের আগে প্রচার করে বাংলাদেশীদের লঘু অপরাধের খবরগুলো। ফলে, কোন কথাবার্তা ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে গণহারে বাংলাদেশী ছাঁটাই শুরু হয়। অপরাধ না করেও একজন হয়তো পরদিন অফিসে গিয়ে পুলিশের হাত ধরে পাসপোর্ট-টিকেট সমেত এক-কাপড়ে দেশে ফিরে আসে।
আমি এইখানে ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের আমাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন না। তারা তাদের দেশকে ভালবাসবে, তাদের দেশের জনগণের জন্য ভাববে — এতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি শুধু আমাদের দেশকে নিয়ে ভাববো। আমি উদ্বিগ্ন, আমার এই কথাগুলো আমার মতো অনেকের আগে বুঝে নিয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। তারা আমাদের যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আন্তর্জাতিক নানা মহলে বাংলাদেশের আরেকটি পরিচয় তুলে ধরেছে। তারা এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য-সহ ইসলামী দেশগুলোতে ধর্মের সাযুজ্য তৈরি করে ইসলামী মনোভাবাপন্ন একটি পরিবেশ তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় একটু উদার ইসলামী আবহে বৃহৎ ইসলামী ও মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় ডক্টরেট বা ব্যারিস্টার হয়েছেন। আমাদের হার্ভার্ডের ডিগ্রিধারীদের কাছে এদের পরিচয় ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে। পাকিস্তানী-ভারতীয়-আমেরিকান যাই হোক না কেন ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ দেশবিদেশের বিদ্যাচর্চার মহলে এদের অবস্থান শক্ত। এরা আধুনিক (ধার্মিক), সম্ভ্রান্ত এবং উচ্চ শিক্ষিত। ফলে এরা যখন আমাদের আভ্যন্তরীণ ও যুদ্ধাপরাধের মতো বিষয়কে ব্যাখা করেন সরকারের ইসলামপন্থীদের উপর নির্যাতন হিসেবে তখন আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল মহল একে ইরাক, ইরান ও সিরিয়ার উপর মার্কিন ষড়যন্ত্রমূলক আক্রমণ ভেবে নেন। একইভাবে এই উচ্চশিক্ষিত মানবতাবাদী লোকগুলো সন্ত্রাসবাদের নামে ‘ইরাকের সাদ্দাম হুসেনের ফাঁসি’, ভারতের ইসলামপন্থী নিধনের নামে ‘আফজাল গুরু’র ফাঁসির সাথে আমাদের দেশের একাত্তরের গনহত্যার অপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসিকে গুলিয়ে ফেলেন। কারণ তাঁরা ওই নিজেদের ঘরানার (ডক্টরেট/ব্যারিস্টার) লোকেদের কথা বিশ্বাস করে । আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের মনে রাখা ইতিহাস বা বিশাল তরুণ সমাজের দিনের পর দিনের কষ্টকর শ্লোগান-বিক্ষোভে তাদের কি এসে যায়।
আমি মনে করি, আমাদের সময়োপযোগী উচ্চ ও উন্নতর শিক্ষার উপর যথার্থ মনোনিবেশ করা উচিত। যে-কোন ভাবে হোক না (দারিদ্র্য, দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকা সত্ত্বেও) বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষা ও নারী শিক্ষায়নে বিশাল সাফল্য দেখিয়েছে। পত্রপত্রিকায় সারা দেশে এতো নৈরাজ্যের চিত্রের মাঝে আমাকে দারুণ আশাবাদী করে — বছরের প্রথম দিনে সরকার প্রদত্ত নতুন বই হাতে হাস্যোজ্জ্বল শিশুদের একটি ছবি । এরাই আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ করা কৃষক-স্রমিকদের উত্তরসূরি । এই শিশুদের যেমন প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হবে, তেমনি আমাদের সুচাগ্রচিত্তে লক্ষ্য হবে এদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা। আমরা যারা এখন তরুণ আছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছি, নানা কোম্পানিতে চাকরি করছি, আমাদের কাজ হবে সেই পথ তৈরি করা যাতে ওরা দেশপ্রেমিক যথার্থ শিক্ষিত শ্রেণী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। এরা যাতে আর শ্রমিক-কুলি-মজুর হয়ে মারা না যায় মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে, নয়তো মালয়শিয়ার পাইন বনে। এই শিশুরা যেন দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশের মান-সম্মান বাড়াতে ও দেশের হাল ধরতে পারে। দেশ ও দেশের মানুষকে শুধু স্বদেশের মাটিতে নয়, যে-কোন দেশের মাটিতে, যে-কোন পরিবেশে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাখতে পারে। বাংলাদেশ আমাদের দেশ। আমাদের আর কোন ঠিকানা নাই, পরিচয়ও নাই।
পুনশ্চঃ আমি অপেক্ষা করছি, আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রকাশনা সংস্থা ভারত বা পাকিস্তানের কোন লেখকের THE DEATH OF KADER MOLLA বইটি প্রকাশ করার দায়িত্বটি পাবেন।
চলচ্চিত্র কর্মী, সমালোচক, নির্মাতা এবং গবেষক ।
