মাসুদ খানের গোধূলিব্যঞ্জন

স্ত্রীবাচক শব্দ ‘গোধূলি’ সংস্কৃত বংশজাত একটি কাব্যানুকূল বিশেষ্য। বাংলাভাষায় শব্দটি এখনো তৎসম চরিত্র নিয়েই অবিকল টিকে আছে, অর্থাৎ এ যাবৎ এর কোনো তদ্ভব রূপ সৃষ্টি হয় নি। বঙ্গীয় শব্দকোষ জানায়, বহুব্রীহি সমাসনিষ্পন্ন এই পদটির ব্যাসবাক্য হলো ‘গোখুরোত্থিত ধূলি যে সময়ে’, অর্থাৎ কিনা গোধূলি হলো গো-প্রচারদেশ হতে গোসমূহের গৃহে আগমণকালে খুরোত্থাপিত ধূলিযুক্ত সময়বিশেষ। উল্লিখিত কোষগ্রন্থটি গোধূলির ঋতুনিষ্ঠায় ভরা একটি সংজ্ঞাও সরবরাহ করে। জানা যায়, ‘হেমন্তে ও শিশিরে সূর্য্য মৃদুতাপ-পিণ্ডীকৃত হইলে, বসন্তে ও গ্রীষ্মে সূর্য্য অর্দ্ধাস্তমিত হইলে এবং বর্ষায় ও শরতে সূর্য্য অস্তগত হইলে, গোধূলি হয়।’ বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুসারে শব্দটির প্রতীকী মানে হলো সন্ধ্যাবেলা, সায়ংকাল, সূর্যাস্তকাল প্রভৃতি। গরুর পাল গৃহে ফেরার সময় তাদের খুড়ের আঘাতে প্রান্তরে যে ধূলি উড়ে, সূর্যের ডুবি-ডুবি সময়ের লালাভ আলোর প্রেক্ষাপটে ওই ধূলি এক বিশেষ বর্ণময়তা সূচিত করে। আমূল ওই ছবিটিকে ধারণ করে বলে কাব্যাঙ্গনে শব্দটির বিশেষ সুখ্যাতি আছে। কালে কালে কবিদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করবার নেপথ্যে হয়ত শব্দটিতে নিহিত ওই অসাধারণ চিত্রময়তাই দায়ী। বাংলাভাষায় বিভিন্নকালে রচিত বিভিন্ন কবির কবিতা থেকে শব্দটি প্রয়োগের বিস্তর উল্লেখ সম্ভব। কোনোরূপ তুলনামূলক আলোচনার উদ্যম এ যাত্রা রহিত বলে এখানে সেসবের কয়েকটির নমুনা-উৎকলন মাত্র করা হলো। কৌতূহলী রসিক পাঠকগণ ইচ্ছে হলে নিজেরাই পরস্পরের মিল-অমিল খুঁজে দেখতে পারেন। আসুন পড়ি, ‘গোধূলি সময় বেলি’ (বিদ্যাপতি), ‘গোধূলি-ধূসর, বিশাল বক্ষস্থল’ (জ্ঞানদাস), ‘আইলা গোধূলি, আইলা রতন ভালে’ (মধুসূদন), ‘ঊর্দ্ধপুচ্ছ গাভী ঐ পাইয়া গোধূলি। ধাইতেছে ঘরমুখে উড়াইয়া ধূলি।।’ (হেমচন্দ্র), ‘মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল, বিদায় গোধূলি আসে ধূলায় ছড়ায়ে ছিন্নদল’ (রবীন্দ্রনাথ) এবং ‘ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,— স্বপন ক’দিন রয়! এসেছে গোধূলি গোলাপিবরণ,— এ তবু গোধূলি নয়!’ (জীবনানন্দ)।

শব্দটির ওপর বিস্তর শাসন ছিল জীবনানন্দ দাশের। শুধু ‘ঝরাপালক’ গ্রন্থেই শব্দটির আছে ডজনখানেক বিশিষ্ট প্রয়োগ। এমনকি তাঁর ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থে “গোধূলিসন্ধির নৃত্য” এবং ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ গ্রন্থে “মহাগোধূলি” নামেই কবিতা রয়েছে। পরম্পরাবাহিত হয়ে কবি মাসুদ খানের কবিতায়ও শব্দটি জায়গা খুঁজে নিয়েছে। আমাদের মনে হয় শব্দটি দ্বারা তিনি বিমোহিত। আক্রান্তও কি বলা যায় ? পূর্বাহ্ণেই জানিয়ে রাখি, ব্যাখ্যাত এক কৌতূহলে জরিপ চালিয়ে যাবৎ প্রকাশিত তাঁর তিনটি গ্রন্থের আটটি কবিতায় এগারোবার ‘গোধূলি’ অথবা গোধূলিজাত সঙ্কর শব্দ আবিষ্কার করা গেছে। তিনটি গ্রন্থ মিলে কোনো শব্দের এগারোসংখ্যক উপস্থিতির এ তথ্যটি মোটেই চমকে দেবার মতো নয়, যেমন চমক দেয় এ তথ্য দু’টি যে কেবল ‘মানস সুন্দরী’ কবিতাটিতেই রবীন্দ্রনাথ বিভিন্নরকম চুরাশিটি উপমা ব্যবহার করেছিলেন, কিংবা কালিদাস তাঁর সমুদয় কাব্যে উপমার ব্যবহার করেছিলেন সাড়ে বারোশটি। যাহোক, একটি কোনো শব্দ ও সেই শব্দের আত্মীয়স্বজন ধরে সংখ্যাগত হিসেবনিকেশ করলে সন্দেহ নেই মাসুদ খানে বর্ষা-মেঘ-বৃষ্টি-জল-নদী-সমুদ্র– এই ভেজা শব্দগোষ্ঠীরই আধিপত্য লক্ষণীয় হবে। সেক্ষেত্রে মাত্র এগারোটি স্বল্পালোমণ্ডিত ‘গোধূলি’র আবিষ্কার এমন কী তাৎপর্য বয়ে আনে ? এ প্রশ্নের জবাব এরকম যে, খানকে যিনি মোটামুটি অধ্যয়ন করেছেন তিনিও তাঁকে বৃষ্টি বা বর্ষাসম্মোহিত বলে চিনতে পারেন। বর্ষার খাঁটি প্রেমিক এই কবির হাতে অজস্র উত্তীর্ণ মেঘমল্লার (!) রচিত হয়েছে (দৈনিক কাগজগুলোর সাময়িকীতে প্রতি বর্ষায় ‘বর্ষার পদাবলি’ ছাপা হয় বলে জোর করে এগুলো লিখিত নয় বলেই জানি)। তাই বর্ষা-মেঘ-বৃষ্টি-জল-নদী-সমুদ্র কিংবা এ বংশলতিকার অন্য শব্দাদির ব্যবহার সেখানে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু খান কখনোই গোধূলিপ্রেমিক বলে স্বীকৃত নন এবং তিনি এ যাবৎ একটিও গোধূলিমল্লার (!) রচেন নি। কাজেই এরকম একটি আপাত পরকীয়ার খবর নিতে আমরা এখানে এ আশায় উদগ্রীব হয়েছি যে, বিষয়টি নিয়ে গপসপ হলে একসময় এটিও তাঁর নিজকীয় এলাকা বলে পরিগণিত হবার অবকাশ তৈরি করতে পারে।

মাসুদ খান কর্তৃক প্রয়োগকৃত গোধূলি এবং গোধূলিজাত শব্দে লক্ষ করা যায় গোধূলির অধিক গো-ধূলিব্যঞ্জনা, যা অভিধানের সীমাকে প্রায়শ টপকে-মুচড়ে প্রসারিত করে দিয়েছে নবতর সম্ভাবনার দিকে। সৃজনশীল লেখকের (প্রধানত কবিদের) হাতে-যে শিল্প নির্মিত হওয়ার অধিক বিভিন্ন শব্দের নতুন অর্থপ্রাপ্তির ভিতর দিয়ে ভাষাও সমৃদ্ধ হয়, এসব গোধূলি-উদাহরণ এখানে তার কিছু প্রমাণ স্থাপন করবে বলে মনে করা যায়।

‘পাখিতীর্থদিনে’, ‘নদীকূলে করি বাস’ এবং ‘সরাইখানা ও হারানো মানুষ’— এই তিনটি গ্রন্থের তিনটি কবিতায় মাসুদ খান একবার করে সরাসরি ‘গোধূলি’ শব্দটির প্রয়োগ করেছেন। ‘পাখিতীর্থদিন’এর ‘স্রোত’ কবিতার ১১তম পর্বে তিনি শব্দটিকে ‘অতীত’-এর একটি রূপান্তর হিসেবে দেখেছেন এবং যে রূপান্তরটি ঘটিয়েছে অতি অবশ্যই অঘটনঘটনপটিয়সী বৃষ্টি। এই দেখাটি সেখানে এতই অসাধারণ হয়ে উঠেছে যে ওই বৃষ্টিরই সঙ্গে তাঁর পিতার বহুচূর্ণ হাসিরেখার ঝাপসা ঝলক লেগে থাকাকে, যতই অসম্ভব বোধ হোক, অন্তশ্চক্ষে দিব্য করা যায়। পড়া যাক— ‘অতীতকে গোধূলি বানিয়ে, সঙ্গে নিয়ে, বৃষ্টি আসে/ আর আচম্বিতে এক ঝলক ঝাপসা হাসিরেখা, পিতার,/ বহুচূর্ণ।’ পাঠক নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছেন যে এখানে শব্দটি আভিধানিক অর্থের সীমাকে কতদূর পর্যন্ত টপকে গেছে।

‘নদীকূলে করি বাস’-এর ‘মা’ কবিতার গোধূলিকে আপাতভাবে সায়ংকাল ধরনের আভিধানিক অর্থসদৃশ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে শব্দটির ইলাস্ট্রিসিটি দীর্ঘ যন্ত্রণান্তে সংঘটিত প্রত্যাশিত বিলয় পর্যন্ত প্রসারিত। অপরাহ্ণকালীন দিগন্তের ধোঁয়া-ধোঁয়া আবহাওয়ার মধ্যে অক্সিজেন নল, স্যালাইন, ক্যাথেটার প্রভৃতি প্লাস্টিক-পলিথিনের লতা-গুল্মে মায়ের জড়িয়ে পড়ার পর কবির ‘মনে হলো, বহুকাল পরে যেন গোধূলি নামছে।’ শব্দটি যে অবসান-আনন্দ ধরে রেখেছে, তাতে তার পাশে ক্রন্দন নয়, ‘উচ্ছল প্রগলভতা’, ‘অর্বাচীন সুরবোধ’ এবং ‘অস্পষ্ট বিলাপরীতি’ই কেবল মানায়।

“সভ্যতা বিষয়ে আরো কয়েক পঙক্তি” কবিতাটি ‘সরাইখানা ও হারানো মানুষ’এর “সভ্যতা” নামধেয় কবিতাটিরই প্রলম্বন (“সভ্যতা” নামে ‘নদীকূলে করি বাস’-এও একখানি কবিতা আছে)। আলোচ্য কবিতার “সভ্যতা : ঝাপসা ইতিহাসপর্ব”-এ ইতিহাসের গায়ে ভূগোল পোড়ার তীব্র গন্ধের বিকট এক ঝাপটা মারার কথা বলা হচ্ছে, যার ফলে ইতিহাসের গা থেকে উড়তে লেগেছে ব্যাপক ধোঁয়া এবং ধূলি। এরকম প্রেক্ষাপট সৃষ্টির পরই আবির্ভাব তাঁর গোধূলিভাবনের। ‘এত ধোঁয়া ও ধূলি যে, গোধূলি বলে আর থাকবে না কিছুই এই গ্রহে!/ দিন ও রাত্রি সব ভাগ-ভাগ হয়ে যাবে একদম!’। এ আবার কেমন কথা গো! দিন ও রাত্রি তো ভাগ-ভাগ হয়েই আছে চিরকাল। দিনের ভিতরে রাত কিংবা রাতের ভিতরে দিনও কোথাও আছে নাকি ? অবশ্য কখনো কখনো এরকম মনে-হওয়া আছে বৈকি। তুমুল কুয়াশাকালে প্রলম্বিত রাত্রির বেড়াজাল ভাঙছে-না বলে বিছানা ছাড়ার প্রয়োজনকে পিছিয়ে দিচ্ছি কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত, কার-না এমন অভিজ্ঞতা আছে ; কিংবা ভরাজোছনায় দিনের আমেজ ফুরোচ্ছে না বলে তাকে রাতই ভাবছি না! অনেকেরই মনে পড়তে পারে যে ‘মিডনাইট সান’ বলে একটা টার্মের বহুল ব্যবহার আছে দেশে ও বিদেশে, এমনকি ঢাকায় এ নামে একটি রেস্তোঁরাও আছে। যাহোক, আপাতভাবে সময়বাচক ওই গোধূলিহীনতার আশংকাটি পাঠক হিসেবে আমাদের খুব ছুঁয়ে যায়। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু নেই হয়ে যাবার আর্তিতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায় মন।

আভিধানিক প্রতীকী অর্থে ‘গোধূলিবেলায়’ শব্দটির ব্যবহার রয়েছে ‘নদীকূলে করি বাস’-এর “আতাফল” কবিতায়। ‘একদিন গোধূলিবেলায়, পিতামহ, ঘুম থেকে সহসাই জেগে উঠে, অনেকটা রহস্যের নায়কের মতো গেলেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেই ভিটায়। হাওয়ায় আন্দোলিত পোড়ো ভিটা।’ এখানে শব্দটি স্রেফ অপরাহ্ণ বা সন্ধ্যা বা সূর্যাস্তকাল হিসেবেই ব্যবহৃত। কিন্তু যেখানে বলা হচ্ছে ‘বিদেশী অরণ্য আজ আতায় গ্রেনেডে তোলপাড় এই গোধূলিবেলায়।’ সেখানে এর অর্থকে প্রথমোক্তের চেয়ে ব্যাপ্ত ও প্রসারিত বলে মনে হয়। এই ‘গোধূলিবেলায়’ মানে সংকটকালে, কারণ ওইসব বিদেশী অরণ্যে (শুধু কি বিদেশেই ?) আজ আতার মতো বিধ্বংসী মারণাস্ত্র গ্রেনেডও ফলছে। আতা যদি বেহেশতি মেওয়াফল গ্রেনেড তবে ইহফল, মাসুদ খান জানাচ্ছেন। এই অস্তমাখা কাতর গ্রেনেডফল বা ইহফলকে তিনি বলছেন মিরাকল, যা ‘রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু রৌদ্রছায়াময় দেশে দেশে’। ডানহাতে মেওয়াফল আতা, বাঁ’হাতে ইহফল গ্রেনেড ও মাঝখানে হৃদপিণ্ড নিয়ে স্বর্গসড়কের মহাবিপজ্জনক সাঁকো পেরোচ্ছে অনেক কিশোর সন্ত্রাসী। স্বর্গোন্মাদনাগ্রস্ত এসব কিশোর সন্ত্রাসীদের তথাকথিত বিপ্লবী তৎপরতায় দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে বিপন্নতা বোধ ক্রিয়াশীল, সে সংক্রান্ত সঙ্গত উদ্বেগটিই ধ্বনিত হয়েছে এই কবিতায় এবং ‘গোধূলিবেলায়’ শব্দটি জঙ্গিকণ্টকিত আমাদের ওই বিপন্ন বর্তমানকেই মূর্ত করেছে।

একই কবিতার ‘পিতামহের বিরল-বসন্ত-চিহ্নিত ফর্সা অবয়ব আর লম্বা-লম্বা গোধূলিরঙের দাড়ি, আমাকে, আমার শিহরণগুলোকে আচ্ছাদিত করে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল একটানা প্রবল হাওয়ার ভেতর’-এর দাড়ির ‘গোধূলিরঙের’ বিশেষণটি লক্ষণীয়। হতে পারে গোধূলিরঙ বলতে গোধূলির কনে-দেখা-আলোর গোলাপি আভা বা মেহেদী পরা দাড়িকে বোঝানো হচ্ছে। অথবা পুরো জীবনকে একটি দিনের সমান ভেবে গোধূলিবেলাকে জীবনের সায়ংকাল ধরে বর্ষীয়ান মানুষের দাড়ির স্বাভাবিক রঙ শাদাও গোধূলিরঙের প্রতিপাদ্য হতে পারে। ঠিক এই একই অর্থে ‘সরাইখানা ও হারানো মানুষ’-এর “ছক” কবিতায় আরেক বর্ষীয়ানকে চিত্রিত করেছেন মাসুদ খান। ‘একবার গোধূলিরঙের লম্বা-লম্বা চুলদাড়িঅলা এক বুড়ো পথিক ক্ষণিকের জন্যে থামালেন তার পথচলা।’ কিন্তু ‘নদীকূলে করি বাস’-এর “বাজার” কবিতার গোধূলিরঙ মেহেদী বা শাদারঙ নয় মোটেই, পূর্বকথিত মেহেদী বা শাদা এখানে বদলে গেছে নিষ্প্রভতার দিকে। এই গোধূলিরঙের অর্থ মলিন, দুর্বল, অক্ষম ইত্যাদি। পড়া যাক, ‘এবং এদিকে খুব উত্তেজিত রাত্রিরঙা টাকাগুলো সারা রাত/ তাড়া করে ফিরছে যত গোধূলিরঙের টাকাদের/ পূর্ব থেকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে ক্রমশ পশ্চিমে…’। ডলারের তাড়া খেয়ে আমাদের মলিন টাকার এই পশ্চিমমুখীনতা দরিদ্র দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিণতিকেই মূর্ত করে বলে মনে হয়।

‘সরাইখানা ও হারানো মানুষ’-এর “জাদুপুস্তক” কবিতার দুটি ‘গোধূলি’প্রয়োগই অসাধারণ— ‘তবে তুমি যেখানটাতেই থাকো না কেন পুঁথিটার, থেকে যাও/ স্পষ্ট-অস্পষ্টের মাঝামাঝি, আকার ও নিরাকার আর/ লেখ্য ও কথ্যের গোধূলিসংকটে।’ এই গোধূলিসংকট একটি অস্থির পরিসরের প্রতি ইঙ্গিত করে, যেটি সতত দোলায়মান। এই পরিসর দ্বারা না-স্পষ্ট না-অস্পষ্ট, না-আকার না-নিরাকার, না-লেখ্য না-কথ্য এরূপ এক অমীমাংসিত অবস্থা চিত্রিত হয়। দিন ও রাত্রির মাঝখানকার প্রাকৃতিক গোধূলিবেলা বিষয়ে একটি অভিজ্ঞতাজনিত স্পষ্টতা আমাদের সবারই কমবেশি আছে। কিন্তু স্পষ্ট ও অস্পষ্ট, আকার ও নিরাকার এবং লেখ্য ও কথ্যের মাঝখানকার দর্শনসম্মত গোধূলিধারণায় আমাদের মধ্যে অনভিজ্ঞতাজনিত অস্পষ্টতা বিদ্যমান। সে কারণেই এ গোধূলি ‘গোধূলিসংকট’। আবার ‘লিখিত বা অলিখিত, কথিত বা অকথিত হয়ে থাকছ, বেশ থেকে যাচ্ছ,/ স্রেফ গোধূলিভাষায়…’-এর গোধূলিভাষাকে দূরাবিষ্কার্য এক সান্ধ্যভাষার প্রতিকল্প ছাড়া আমরা আর কী ভাবব! কারণ ওটি ‘ব্রাহ্মী, নাগরি, নাকি হায়ারোগ্লিফিক্স’ আমরা তা জানি না বস্তুত।

একই বইয়ের “সেতু ও সম্পর্ক” কবিতার ‘গোধূলি-অঞ্চল’ এক রহস্যময় ব্যাখ্যা-অযোগ্য স্থান, সময় প্রভৃতিকে বোঝায় হয়ত। এ ‘গোধূলি-অঞ্চল’ কত নটিক্যাল মাইল বা কত মিলিমিটার কিংবা কত যুগ বা কত সেকেন্ড দীর্ঘ সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। আমরা অনুধাবন করতে পারি যে এ দুয়ের মাঝখানে একটা দূরত্ব থাকা সঙ্গত, যা হবে অবশ্যই ‘কুয়াশাবিধূর’, ‘পারাপারাতীত’ ও ‘প্রহেলীধূসর’। পড়া যাক, ‘প্রাণ আর অপ্রাণের মাঝখানে যেইটুকু গোধূলি-অঞ্চল/ জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে যেটুকু ধূসর ব্যবধান/ সেইটুকু এক নদী, আমাদের মাঝখানে—।’ যতদিন সেতু না তৈরি হচ্ছে, ততদিন যথেচ্ছ সাঁতরানো ছাড়া এখানে আমাদের আর কী করণীয় আছে!

কৈফিয়ত
কবিতা নিবিড় অভিনিবেশে যতখুশি উলটেপালটে আস্বাদনের বস্তু, বড়জোর ইনিয়ে বিনিয়ে ধ্বনিসহযোগে পাঠ করে অন্যকেও আস্বাদনে সহযোগিতা করবার। এর রহস্য তাতে যদি খানিকটা খুলে তো খুলল, না খুললে নাই। নাটবল্টু খুলে এর আলাদা-আলাদা উপায়-উপকরণের দিকে তাকাবার চেষ্টা কখনো কখনো খুব অশ্লীল বোধ হয়। সাধারণত এসব আমি করি না, নীরব নির্জন পাঠেই আমার স্বস্তি। বৈয়াকরণিক রীতিশৃঙ্খলা মেনে অধ্যাপকীয় ঢঙে আলোচনা করবার কায়দাকানুনও আমার বিশেষ রপ্ত করা নেই। শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন ইজমনিষ্ঠ গ্রন্থাদি উলটেপালটে দেখেছি, অপ্রয়োজনীয় ঠেকেছে খুব, পাঠ্য মনে হয় নি। কাব্যালোচনায় বাক্যে বাক্যে এসব ইজম ও তার প্রবক্তাদের নামধাম উচ্চারণ করা না-গেলে, তথা অনেকানেক জেনেশুনে লিখতে বসেছি এরকম ফুটানি না-দেখানো গেলে ওই লেখার দিকে বিশেষ সমীহ নিয়ে না-তাকাবার রেওয়াজ শিল্পাতেলেকচুয়ালদের মধ্যে তুমুলভাবেই আছে। এসব জ্ঞানপনাকে আমার খুব ভয়ও লাগে, যেজন্য এমনকি আড্ডায়ও, ভারী ভারী শিল্পপরিভাষা উচ্চারিত হতে থাকলে আলগোছে কেটে পড়ি। বিভিন্ন ইজমঘনিষ্ঠ অভিধায় চমকিত হয়ে কতক কবিতা পড়তে গিয়ে এক জীবনে অনেক বমনদশাও হয়েছে আমার। কবিতা পাঠের মজাটাই তাতে নষ্ট হয়ে যেতে দেখেছি। আগে একবার দেখেছেন এমন কারো পাশে বসে ফিল্ম দেখবার মতো অতিষ্টকর এই অভিজ্ঞতা। আমি এসবে মোটেই স্বচ্ছন্দ নই। বিশ্বাস ও চর্চা অনুযায়ী আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে কাজেই এই লেখাটি লিখতে শুরু করবারও আগে। মাসুদ খানের কবিতার গোধূলিপ্রবণতা বিষয়ে এই লেখাটি কাজেই আমি লিখি নি, লিখেছে কবি মাসুদ খানের প্রতি জন্ম নেয়া আমার ভিতরকার এক যুগবয়েসি মুগ্ধতা। লেখাটি আপাতত শেষ করে আনার জন্য ওই মুগ্ধতাকে জানাই গোধূলিপ্রণাম।

(প্রথমে হাফিজ রশিদ খান সম্পাদিত পুষ্পকরথ এবং পরে বাঁধ ভাঙার আওয়াজ ও আটর্সবিডিনিউজ-এ প্রকাশিত)

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

17 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
17
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.