আমাদের একমাত্র ছেলে প্রত্নপ্রতিম পড়ে ছায়ানটের নিয়মিত সাধারণ স্কুল নালন্দা বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। ঈদ-পূজা মিলিয়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ওদের স্কুল প্রায় একমাসের জন্য ছুটি হয়ে গেছে। ঈদের সময় ভ্রমণ খুব ঝক্কিপূর্ণ বিধায় অগ্রবর্তী দল হিসেবে ২১ সেপ্টেম্বর সকালে আমার বউ ছেলেকেসহ বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ চলে গেছে। দু’দিনের সাপ্তাহিক ও শবেকদরের একদিনসহ তিনদিন ছুটির পর আগামী ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর আমার অফিস চলবে বলে আমাকে ঢাকায়ই থেকে যেতে হয়েছে।
পাঁচতলার ছাদে, চারকক্ষের ছোট ফ্ল্যাটে আমি একা। সকালে কলা-বিস্কুট খাই, দুপুরে অফিসের মেসে আর রাতে কখনো হোটেলে কখনো বাসায়। বাসায় খাবার আয়োজন করাই আছে, মিনিট ত্রিশেক সময় দিতে পারলেই হলো। বউ এক-পাতিল গোমাংস ভুনা ও ডালচর্চরী করে রেখে গেছে। আমি কেবল মুঠোখানেক চাল ফুটাই, মিনিট পাঁচেক মাংসের পাতিলটা গরম করি ও জলপাই আচার মাখিয়ে চুটিয়ে খাই। ২১/২২ এর রাতদুটো আমার পড়া-লেখা-ব্লগিং মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কাটে। বিপত্তি ঘটে ২৩-এ এসে। মাসখানেক রোগভোগের পর ওই রাতে বাড়িওয়ালি মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনাটা ঘটে রাত এগারোটায়। আমি তখন ব্লগিংয়ে ব্যস্ত। দোতলার ফ্ল্যাট থেকে জানালা গলিয়ে কান্নার আওয়াজ পেলেও আমি বিশেষ গা করি নি। মনে হচ্ছিল, অনেক দূর থেকে আসছে আওয়াজটা। এরকম নানা রঙচঙে আওয়াজ বড়ো শহরের রাতজাগা বাসিন্দারা হামেশাই পেয়ে থাকেন। সব তাতে কান পাতলে তো আর চলে না। এজন্য আমিও পাতি নি। অবশ্য গ্রামের জীবন ছিল ঠিক এর উলটো। কান্নার আওয়াজ পেলে কাছে-দূরে কোনো ব্যাপারই না, যত রাতই হোক আমিও হয়ত কাজ ফেলে ছুটে যেতাম।
স্বাভাবিক নিয়মে কাজকর্ম সেরে রাত আড়াইটার দিকে বিছানায় যাই, ঘুম আসে না, দুজন বন্ধুকে দুটো মেসেজ পাঠাই। একটা কল রিসিভ করি। ঘুমাই খুব সম্ভব সোয়া তিনটায়। সাড়ে চারটায় অপ্রত্যাশিতভাবে কলিং বেল বেজে ওঠে। ঢুলতে ঢুলতে ছাদের মূল দরজা খুলে দিয়েই শুনি দুঃসংবাদটা। মৃতার তিন নাতনি এসেছে গোসলের প্রয়োজনে মাটি নিতে। আমি মাটি কোথায় পাব?
ওরা বলে যে, ছাদের টব থেকে নেব।
বলি, আচ্ছা নাও।
মাটি শক্ত হয়ে আছে, কীভাবে উঠাবে? গাছহীন একটা টবই নিয়ে যেতে বলি, ওরা তাই করে।
ওরা চলে গেলে পাঁচতলা থেকে সিঁড়িপথে উঁকি দিয়ে দেখি লাশ নামানো হচ্ছে নিচে। ছাদে এসে নিচে তাকিয়ে দেখলাম, বাড়ি ও বাড়ির নিরাপত্তা দেয়ালের মাঝখানে নিয়ে লাশটিকে শুইয়ে দেয়া হলো। গোসলের আয়োজন চলছে। সুতরাং আমি সরে আসলাম। ঘরে এসে ভাবলাম, আমার কি যাওয়া উচিত? শরীর সায় দিচ্ছে না। এদিকে যেতে গেলে আবার হাতমুখ ধুতে হবে, থ্রিকোয়ার্টার খুলে ফুলপ্যান্ট পরতে হবে, গায়ে শার্ট/গেঞ্জি চাপাতে হবে। অনেক ঝামেলা বোধ হলো। সকালে গেলেই হবে ভেবে শুয়ে গেলাম। যে কক্ষে শুয়েছি, সেখানে তিন-তিনটা জানালা খোলা। মনে হলো জানালাগুলো বন্ধ করে দেই। কিন্তু ঘুমের চাপ খুব বেশি থাকায় করা হয়ে উঠলো না। অ্যালার্ম শুনে জাগলাম সকাল সাতটায়। অফিস যাবার পথে খোঁজ নিয়ে জানলাম মৃতার ফ্ল্যাটে কেউ নেই। জানা গেল, একটা জানাজা শেষে লাশ নিয়ে সবাই চলে গেছে বিক্রমপুরের গ্রামের বাড়িতে।
ফোনে বউকে মৃত্যুর ঘটনা জানালে সে স্বাভাবিক নিয়মে অনেক আফসোস করল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখ প্রকাশ করল শেষমেষ দেখতে পারল না বলে। আলাপ শেষে আমাকে পরামর্শ দিল, রাতে যেন একা বাসায় না শুই। আমি যেন কোনো বন্ধুকে আমার সঙ্গে রাত্রিযাপনের জন্য আমন্ত্রণ জানাই (বান্ধবীর কথা বলে নি অবশ্য), অথবা কোনো বন্ধুর বাসায় গিয়ে যেন শুই।
আমি বলি, তার কোনো দরকার নেই। আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না। সুতরাং ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই।
ওই রাতে একইভাবে কাজকর্ম সেরে আড়াইটায় শুতে যাই। চারপাশে সুনসান নীরবতা। আশপাশের সব ফ্ল্যাটের লাইট নিভে গেছে। আমার কেমন কেমন যেন বোধ হলো। শুয়ে শুয়ে ভাবছি একেই কি ভয় বলে? কেন লাগবে এমন? যিনি মরেছেন তিনি তো চলে গেছেন অনেক দূরে। গেছে তার সর্বাঙ্গই। স্মৃতি ছাড়া কিছুই তো থাকে নি তাঁর। তাহলে এমন কেন লাগে? কোনো ব্যাখ্যা নেই। ঠিক এসময় বউয়ের ফোন।
আঁতকে উঠে বলি, এত রাতে ফোন করলে কী মনে করে?
তোমার কথা ভাবছি, ভয়টয় পাচ্ছ কি না আবার… সে বলল।
বলতে কী, আমি বিরক্তই হই। বলি, ভয় পাব কেন? তুমি তো জান, রাতবিরেতে একা চলাফেরা আমার সারাজীবনের অভ্যেস। আজ নতুন করে ভাবছ কেন যে আমি ভয় পাব? (বলি না যে, গা ছমছম একটা অনুভূতির সাথে আমি ইতোমধ্যেই লড়ছি।)
সে বলল, আরে না, এমনি মনে হলো আর কি! আমারও ঘুম আসছে না তাই ফোন করলাম।
ও ফোন রেখে দিলে উপলব্ধি করলাম যে, আমার আসলেই একটা ভয়ানুভূতি হচ্ছে। দরকার নেই তবু আলমারি খুলে একটা কাঁথা চাপালাম গায়ে। তাতে খানিক স্বস্তি বোধ হলো। কিন্তু চোখ বন্ধ না করে খোলা জানালায় তাকিয়ে থাকি কিছু দেখা যায় কি না। কোথাও একটু শব্দ হলে চমকে উঠি। কেন করি এরকম? ব্যাখ্যা নেই।
বিষাক্ত সাপকে ভয় পাই।
ঢাকা শহরের ভিতরে চলে যেসব ভাঙাচোরা মিনিবাস এদের সামনে দিয়ে রাস্তা টপকাতে ভয় পাই।
অনেক রাতে ফাঁকা রাস্তায় একা হাঁটতে ভয় পাই।
নির্মাণাধীন বাড়ির নিচে দিয়ে হাঁটতে ভয় পাই।
সমুদ্রস্নানে নেমে অনেক গভীর জলে যেতে ভয় পাই।
দূরপাল্লার বাসের চালক বেপরোয়া ড্রাইভিং করলে ভয় পাই।
এ জাতের ভয়গুলোর সবই লজিক্যাল। কিন্তু বিল্ডিংয়ে একজন বৃদ্ধা মারা গেছেন, যার লাশও একদিন আগে চলে গেছে অনেক দূরে। তার জন্য আমি ভয় পাব কেন, যেখানে আমি জিন-শয়তান, ভূত-প্রেত, মৃতের আত্মার বেঁচে থাকাটাকা ইত্যাদি কিছুতেই বিশ্বাসী নই? এটা তো লজিক্যাল না। অনেক সময় ধরে নিজে নিজে নিঃশব্দ তর্কে মত্ত থেকে একসময় ঘুমিয়ে যাই।
আজ মৃতার ঘরের সমস্ত কাপচোপড় ধুয়ে ছাদে শুকানো হলো। স্বজনেরা হয়ত মুছে ফেলতে চাইছে তাঁর স্মৃতি। সবাই তাই করে থাকে। কিন্তু আমি কি মুছে ফেলতে পেরেছি আমার ভয়ানুভূতি? নাকি আজ রাতেও আমার গা শিরশির করবে? করলে কেন করবে? যুক্তি কি আছে কোনো?
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
ইমতিয়ার - ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:২৯ অপরাহ্ণ)
রাখেন আপনার ভয়, গো-মাংস আর ডালের যে-বর্ণনা দিলেন, আমার তো ভাই অবস্থা খারাপ… কতদিন গো-মাংস খাই না…
ভালো কথা, আপনার কি সত্যিই ভয় হচ্ছে? না কি ভয়ানুভূতি হচ্ছে? আপনি কি সত্যিই কয়েকদিন হয় গো-মাংস খাচ্ছেন? গো-মাংস খেলে তো এরকম হওয়ার কথা না।
মুজিব মেহদী - ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৫:৫৫ অপরাহ্ণ)
শুধু কি গো-মাংস শামীম ভাই, সঙ্গে জলটলও থাকছে নিয়মিত।
আপনি ঢাকায় থাকলে আমার ভয় কিংবা ভয়ানুভূতি কোনোটাই কাজ করত না হয়ত। রাতে রাতে দেখা হয়ে যেত আমাদের, যেতই।
রণদীপম বসু - ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (১:০৫ অপরাহ্ণ)
মুজিব ভাই, আপনার মতো আমারও এক অবস্থা। ভয়ের কথা বলছি না, গিন্নী গেছে বাপের বাড়ি সিলেটে একমাত্র সন্তান প্রান্তিককে নিয়ে। সকালে অফিস যাবার পথে কাজী হোটেলে ঢুকে ভালো করে ডিম পরোটা ডাল ভাজি গিলে ভাগনের ঝুপড়িতে সিগারেট টানতে টানতে কড়া লিকারে চা আর এক নম্বর হাকিমপুরি জর্দা দিয়ে পান চিবিয়ে অফিসে ঢুকি। দুপুরে নেমে আসি এবং কলা পাউরুটি চা আর..। অফিস শেষে চারটের দিকে আবার কাজী হোটেল। গলা পর্যন্ত ভাত গিলে সোজা বাসায়। তারপর সেই ব্লগিং আর ব্লগিং। কম্পু ছেড়ে আর খেতে বেরোয় কে ? ঘরে বিস্কুট চানাচুর এইসব।
এবারে আপনার ভয়ানুভূতির বিষয়ে আমার ধারণাটা বলি। আপনার ভয় পাওয়ার পেছনে অবশ্যই যুক্তি রয়েছে। উঁহু, মৃতের আত্মার কথা বলছি না। মানুষের জীবনে সংস্কার একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সেই শৈশবে মা খালা দাদীরা অজান্তেই ঠাট্টাচ্ছলে বা অন্য কোন কারণে ভুতের বা অশরীরী যে ভয়গুলো শিশুমনে গেঁথে দিয়েছেন, ওগুলো তো আমাদের অবচেতন মনে খুব যত্ন সহকারে সংরক্ষিত রয়েছে। মুছে নাই কিন্তু। আমরা বড় হতে হতে জ্ঞান বিজ্ঞান যুক্তিশীলতার চর্চার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ওগুলোকে চাপা দিয়েছি বটে, কিন্তু তা তো ডিলিট হয় নি। তাই অযৌক্তিক জেনেও যখনই তেমন কোন গা ছমছমে খুব নিরিবলি একা একটা আবহ তৈরি হয়ে ওঠে, যুক্তিবোধ মাথায় রেখেও সেই দূরাগত ভয়টা একটু একটু করে চাড়া দিতে থাকে।
তাও হয়তো এই ভয়ানুভূতি এভাবে আসতো না। কিন্তু ক্ষেত্রটা কিন্তু খুব অজান্তে তৈরি করে দিয়েছেন আমাদের ভাবীই। কীভাবে ? আপনার যুক্তিশীল চিন্তায়ও হয়তো আসতো না যে বাড়ীওয়ালী মারা গেছেন, তার অতৃপ্ত আত্মা আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে পারে। কিন্তু ভাবী একা না থাকার কথা বলার সাথে সাথে সেই সংরক্ষিত জমাকৃত ভয়ের ঘরটাতে টোকা পড়ে গেছে। এখন অজান্তেই আপনার চিন্তা ধাবিত হচ্ছে কোন অশরীরী অস্তিত্বের সন্ধানে আর ভয়ানুভূতিটাও পুষ্ট হবার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
মূলত এটাই আমার মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ। তবে মনস্তত্ব নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন তারাই হয়তো ভালো বলতে পারবেন, প্রকৃত বিষয়টা।
এবার কানে কানে বলি, ভুনা গোমাংশে চেহারা ভেসে আসতেই জীভেও পানি আসা শুরু করে দিয়েছে আমার। কানে কানে দাওয়াত দিয়ে ফেলতে পারেন। দেইখেন কাউকে বলতে যাবেন না আবার। তাহলে গিন্নী শুনলে আমার খবর আছে ! হা হা হা !
মুজিব মেহদী - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:২০ অপরাহ্ণ)
অযৌক্তিক ভয়ের একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যাই হাজির করেছেন আপনি। ব্যাখ্যাটা আমার পছন্দ হলো। এজন্য, জনান্তিকে ভুনা গোমাংসের দাওয়াত দিয়ে রাখলাম।
ঠিকই শৈশবে আমার এ ধরনের অনেক ভয়জাগানিয়া কথাবার্তা শুনতে হয়েছে। তখন তো এসব বিশ্বাসেরই অংশ ছিল। আসে আস্তে বিশ্বাস অবিশ্বাসে রূপ নিয়েছে, কিন্তু ভয়ের স্মৃতিমোচন হয়ত ঘটে নি পুরোপুরি। ক্রমশ এই স্মৃতি ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হতে হতে বিলীন হয়ে যাবে না কি? নাকি এরকম থেকেই যাবে? আপনার ব্যাখ্যা কী বলে?
এই দিনলিপিটা যে সন্ধ্যায় পোস্ট করলাম তারপর থেকে দুই রাত পার হয়েছে। আজকেরটা নিয়ে তিন রাত। গত দু’রাতে আর ২৪-এর রাতের মতো ভয়ানুভূতি কাজ করে নি। আজকেও করবে না মনে হচ্ছে। এটা কি ঘটনা থেকে সময়ের দূরত্ব রচিত হচ্ছে বলেই শুধু, নাকি আমি ভয়ানুভূতির কারণটা জেনে যাচ্ছি বলেও?
পার্থ সরকার - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ)
রণদীপম বসুর যুক্তিটা ভাল। ভয়ের কারণ হয়তো তাই। তবে আমার মনে হয়, বিভিন্ন কারণে, হয়তো তার বেড়ে উঠার ভেতরই কারণ গুলি নিহিত থাকে, মানুষের ভয় পাবার বস্তু ও সময়ে (বয়সের) তফাৎ ঘটে। আমি চোখের সামনে এক মহিলাকে ট্রেনের চাকার নীচে পড়ে ছয় টুকরা হয়ে যেতে দেখেছি, এক যুবককে দেখেছি ট্রেন লাইনে শুয়ে আছে, মাথাটা শুধু ধড় থেকে আলাদা, তার মুখে একটু হাসিও লেগে আছে, পরিপাটি করে গোফঁ ছাটা, দু’টোই অপমৃত্যু। দু’টি স্মৃতিই মাথার মধ্যে টাটকা পুরে নিয়ে একা ঘুমিয়েছি, ঘটনার বীভৎসতার কারণে দৃশ্যগুলি মাথার মধ্যে বার বার ঘোরা ফেরা করেছে, মাঝ রাতে “যাঃ বাবা, ঘুমাতে দে” বলে শূণ্যে হাতের বাড়ি দিয়ে দৃশ্যগুলিতে তাড়িয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়েছি কিন্তু সত্যি বলছি ভয় পাইনি।
অনেকের ভয় পাবার অনেক কারণ থাকে, সত্যি। কিন্তু ভেবে দেখলাম কারণগুলিও অদ্ভুত। যেমন, আমি রাস্তা পার হবার সময় গাড়ি ছুটে আসলে ভয়ের বদলে হিসাব করি, কি গতিবেগে গাড়িটা আসছে আমি কি গতিবেগে রাস্তা পার হয়ে গেলে নিরাপদেই অপর প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারবো, একদিন অবশ্য হিসাবে সামান্য গোলামাল হওয়াতে পা ঘেঁষে একটি প্রাইভেট কার চলে যায় এবং যাবার সময় আমার সেন্ডেল ছিঁড়ে দিয়ে যায়, চমকে উঠেছিলাম কিন্তু ভয় পাই নি।
দয়া করে ভাববেন না, এ কোন হারকিউলিস ! সাহসের ফিরিস্তি দিচ্ছি নারে ভাই, তফাৎটা বলছি।
একদিন আমি ও আমার দুই বন্ধু (তিনজন) rickshaw করে যাচ্ছিলাম, পাহাড়ী রাস্তা, উচুঁ থেকে নীচুতে নামতে হবে। রিঙ্াওয়ালা নামছে তো নামছে, তাতেও গতি বাড়ানোর জন্য প্যাডেল ঘোরাচ্ছে, সামনের দিকে তাকিয়ে ভয়ে আমার গা কাঁপতে লাগলো থর থর করে, আতঙ্কে চিৎকার করছি, ও ভাই থামাও। থামাও। দুই বন্ধু হাসতে লাগল, তাদের হাসিতে যোগ দিয়েছে রিঙ্াওয়ালাও। তার রিঙ্া থামাবার বা গতি কমাবার কোন লক্ষণই নেই। আমি শরমের মাথা খেয়ে পেছন থেকে ঝাপটে ধরলাম রিঙ্াওয়ালাকে, এই ব্যাটা, রিঙ্া পাশে রাখ, সে গতি কমাতেই আমি লাফ দিয়ে নেমে গেলাম রিঙ্া থেকে। কলিজায় পানি আসল। যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। বললাম, দরকার হলে হেঁটে যাব। তোরা আগে যা। তারাও নেমে গেল এবং বাকী সামান্য পথটা আমরা হেঁটে গেলাম। সত্যি, রিঙ্া যখন কোন উচুঁ রাস্তা থেকে তীব্র গতিতে নীচে নামতে থাকে, এমন ভয় পাই যে এখনি ভাবতেই পা শির শির করছে!
আরেকটা জিনিস ভয় পাই, আমার পেছনে যখন কোন ছেলে ব্যাটিং করে। রাস্তার ক্রিকেট বেশ ভাল জমজমাট দেশে। রাস্তার উপর যখন কেউ ক্রিকেট খেলে এবং আমি যখন ঐ রাস্তা দিয়ে আসি, খেলোয়াড়দের পার হয়ে আসার পরে বার বার পেছনে তাকাই বলটা আমারই দিকে ছুটে আসছে কিনা। তখন কিছুটা ভয়ই কাজ করে।
To download Unicode Bangla fonts from the http://www.ekushey.org/projects/otf_bangla_fonts/.
মুজিব মেহদী - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮ (৩:৩৮ অপরাহ্ণ)
প্রকৃতপক্ষে আমিও ভয় পাই নি, বলছিলাম ভয়ানুভুতির কথা। ওই যে আপনি হাত ঝাড়া দিয়ে বললেন, ‘যাঃ বাবা, ঘুমাতে দে’, এর মধ্যেও কিন্তু আমি ওই অনুভূতির ছিটেফোঁটা দেখতে পাচ্ছি।
রাস্তা তো আমাকেও প্রতিনিয়ত পার হতে হয়। হইও। সবসময় যে ভয় পাই তাও নয়। কিন্তু বিশেষ এক ধরনের গাড়ি (গুলিস্তান-মিরপুর, আজিমপুর-গাবতলী জাতীয়), যেগুলো ঢাকা শহরে চলে প্রশিক্ষণবিহীন আনাড়ি চালকদের হাতে, এদের সামনে দিয়ে আমি পারতপক্ষে যেতে চাই না। কারণ এরা সিগন্যাল মানে না অথবা বোঝে না। এরকম ক্ষেত্রে হিসেবনিকেশ কী এমন কাজে লাগবে বলুন!
রিক্সায় ঢালুপথে নামতে গিয়ে আপনি কিন্তু সর্বনাশ করে ফেলেছিলেন প্রায়। নিচদিকে নামছে যখন, তখন ওটা যে গতিটা প্রাপ্ত হয়েছে তার একটা নির্দিষ্ট ছন্দ আছে, ত্বরণ আছে ; রিক্সাওয়ালাকে জাপটে ধরে ওই ছন্দে আপনি যখন পতন ঘটালেন, তখন নির্ঘাৎ ওটার খাদে পড়ে যাবার কথা। কেন যে পড়ল না সেটাই ভাবছি।