অরুণদা-র কাছ থেকে আমরা পালিয়ে বেড়াতাম। দূর থেকে তাঁকে দেখলেই অন্য ফুটপাত ধরে হাঁটতাম উদাস ভঙ্গিতে। কখনও-বা মুখ নামিয়ে কেটে পড়ার তালে থাকতাম। পিছন থেকে হঠাৎ কানে আসত চিরচেনা অথচ পিলেচমকানো ডাক, ‘এই যে সন্দেশ, একটা কথা শোনো তো ভাই!’
অদ্ভুত সব নামে সম্বোধন করতেন আমাদের, এমনকী চা-দোকানের ছেলেটিকেও। মুখ-ভার-করা রিকশাওয়ালাকে ‘দেখি তো, তোমার জিহ্বাটা দেখি’ বলে সম্মোহিত করে দিতে পারতেন মুহূর্তেই। দারুণ গাইতে পারতেন, হাসতে পারতেন হো-হো করে। কিন্তু তাঁর এমন বাজখাঁই গলার গান আর হেসে ওঠাকে বড় বেখাপ্পা লাগত এই কর্মব্যস্ত শহরে, ভদ্রলোকের ভিড়ে। গান আর অট্টহাসি তো কেবল নাটকেই মানায়!
বউ আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ছেলেমেয়েদের কথা যখন বলতেন, তখন তিনি ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের রহমত। শুনে মনে হতো ওরা এখনও শিশুটি রয়ে গেছে। এক বৈশাখে মেয়েকে দেখতে গেছেন ছাত্রীনিবাসে। ফটকের কাছে বিশাল আমগাছ। অরুণদা দারোয়ানকে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়াতে বললেন। দারোয়ান ভাবলেন বাপবেটির গোপন কথা আছে হয়তো। অরুণদা তখন মেয়েকে বললেন, ‘আচ্ছা মামণি, আমি যদি এই গাছ থেকে একটা আম চুরি করি, তাহলে দারোয়ান শাহেব কিছু মনে করবেন?’ মেয়ে মুখে হাত দিয়ে না কি বলেছিল, ‘খবরদার বাবা, আমার বান্ধবীদের সামনে অমন কথাবার্তা বোলো না। আমার মানসম্মান থাকবে না আর!’
আমাদের এই ‘মানসম্মান’ নিয়ে তিনি কৌতুক করতেন সবসময়। জোরাজুরি করতেন চা খাওয়ার জন্য, না খেতে চাইলে বলতেন, ‘চায়ের একটা মানসম্মান আছে না! না খেলে ও তো ভীষণ রাগ করবে!’
আরেক বৈশাখের খাঁ-খাঁ রোদ্দুরে তিনি আমার হাত ধরে নিয়ে চললেন অড়হরডালের খোঁজে, যেন পৃথিবীর কোথাও এই ডাল পাওয়া যায় না আর, তাই টেরিবাজার পেরিয়ে বখশিরহাট পেরিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন দূরের কোনও এক ‘মুকুন্দরামের হাট’-এর দিকে।
ধলঘাটের কথা, যৌথপরিবারের ভাইবোনকাকাপিসিদের মধুর সব স্মৃতিকথা শোনাতে ভালোবাসতেন। বাঙালিজাতির বদমাইশির কথা বলতে গিয়ে খেপে উঠতেন, তখন অবধারিতভাবে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ কথাটা এসে পড়ত তাঁর ক্ষুব্ধ কম্পমান ঠোঁটে। আবার এই তো সেদিন, আন্দরকিল্লার মোড়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলছিলেন বিদ্যাসাগর আর মধুসূদনের কথা। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর অসামান্য স্মৃতিশক্তির প্রসঙ্গ তুলতেই দেখলাম কী এক শান্ত গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর তাম্বুলরসাচ্ছন্ন মুখে। বলছিলেন, ‘বড় ভালো লাগছে তাঁদের কথা বলতে আর শুনতে।’
একদিন, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, সত্যি-সত্যি শুয়োরের মাংসের গল্প শোনালেন। জনৈক ইস্কুলশিক্ষিকার সঙ্গে আলাপপরিচয়ের সময় তিনি একবার শুয়োরের মাংসের খুব প্রশংসা করেছিলেন, যদিও ছুঁয়েও দেখেননি কখনও। পরে না কি ভদ্রমহিলা কবির কথা ভেবে দুকেজি শুয়োরের মাংস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মাংস পেয়ে অরুণদা পড়লেন বিপাকে। বাসায় তো নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে কাছের এক বন্ধুকে ফোন করে আরেক রসের গল্প ফেঁদে মাংস গছিয়ে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।
হাসিঠাট্টাই করে গেলেন সারাজীবন। পকেট থেকে নতুন কবিতা বের করে শুনিয়ে নিজেই হাসতে হাসতে বলতেন, ‘আহা, কী দারুণ একটি কবিতা লিখেছি, তা-ই না?’ ‘ঋতপত্র’ চাইলে আরেকটু গুছিয়ে বের করা যায়, একদিন বন্ধু সাইদুল ইসলাম আর আমি সে-কথা তুলতেই, ভেবেছিলাম বেজার হবেন খুব, কিন্তু হাসিমুখেই বললেন, ‘এই যে তোমরা কাগজটা নিয়ে ভাবছ, তাতেই আমি খুশি। এ তো তোমাদেরই পত্রিকা। আমি মরে গেলে তোমরা কি বের করবে না?’ সুসম্পাদনার কথাই বলছিলাম আমরা দুজন, কিন্তু এ-কাজ যে কত কঠিন, বিশেষত পঞ্চাশোর্ধ্ব এক আত্মভোলা কবির পক্ষে, তা কি ভেবেছিলাম তখন?
কখনও কি ভেবেছি জগৎসংসার-ভুলে-থাকা হৃদরোগ-বয়ে-বেড়ানো মানুষটি আলাপচারিতায়―প্রাসঙ্গিকতা খানিকটা ছাপিয়ে―অমন খেপে উঠতেন কেন? চেরাগির মোড়ে তাঁকে আর দেখতে পাব না জানি, তবু গা বাঁচিয়ে মাথা হেঁট করে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়বে তাঁর কথা, দাঁত-খিঁচানো মুখে ছড়িয়ে পড়া ব্যথাতুর এক আক্ষেপ : ‘শুয়োরের বাচ্চার দেশ!’
১২ চৈত্র ১৪২২
মুয়িন পারভেজ
জন্ম চট্টগ্রামে। লিখে সময় কাটি, পড়ে জোড়া লাগিয়ে দিই আবার। ভালোবাসি মেঘবৃষ্টিজ্যোৎস্না আর ঝরনাকলম। প্রকাশিত কাব্য : ‘মর্গে ও নিসর্গে’ (ঐতিহ্য, ২০১১)।
You must be logged in to post a comment.