আসলে মনে অনেক কিছুই আসে, মনে মনে অনেক গল্প রেডি করে রাখি যখন সাইকেলটা চালাই। তাতে সময়টা ভাল যায়। নয়তো আটকে যেতে হয় প্রতিবার প্যাডেল দেয়ার সময়। আহ কষ্ট আছে। তাই ভাবি আজ দিন শেষে হলে কী কী করা হবে, কী খাব, আর কী খেলে কত টাকা যাবে। কোনো ক্যাম্প গ্রাউন্ড পাব তো? অথবা পার্ক? তবে টাকা বেঁচে যায়। যদি না পাই? আবার মোটেল? ভাল লাগে ভাবতে যে আরেকটা দিন আরামে থাকা যাবে? আবার চিন্তা, ঝুল বারান্দায় রান্না করতে দিবে তো? আর মুদি দোকানটা কি খুব বেশি দূর? এই গরমে আবার যেতে হয় তাকে। যদি তা না হয় তো আবার মেলা টাকা ঝক্কি! আমার পা চলতে থাকে সমান তালে আর অংক চলে মনে। — পিছে গাড়ি, আরেক টা গাড়ি . . এটা বড় . . সাথে সাথে পাশ দিয়ে দমকা হওয়া দিয়ে একটা ১৮ চাকার গাড়ি চলে যায়। আমার চিন্তার চিতায় ভাটা পড়ে। তখনই মনে পড়ে আমার ডান হাঁটুটাতে একটু ব্যাথা ছিল, ওহ হ্যাঁ ওখানেই তো আবার ব্যাথা। আচ্ছা একটু আস্তে চালাই উজ্জল ভাই, পা টা ব্যাথা করছে; আচ্ছা — সে বলে ওঠে।
আমি আবার চিন্তার চিতায় আগুনটাকে উসকে দেই। সামনের পাহাড়টাতে একটানে উঠতে পারবো তো? এখন থেকেই কি জোরে চালাবো? নাকি শেষ চড়াইটাতে ধীরে উঠে যাব? হিসাব চলে, আমার সাইকেলের ২০ ইঞ্চি চাকাও চলতে থাকে। ওয়ালমার্টের পঁচা চাকাটার জন্য গতি কমে গেছে আর তার থেকে একটা হিসিং সাউন্ড আসে। খারাপের মধ্যে মজাও লাগে, বা কিছু একটা চলছে। শব্দে শব্দে আবার ঢালটা চলে আসে। দূরথেকে আকাশের পেট চেড়া মনে হলেও কাছে এলে মনে হয় – নাহ হয়ে যাবে। একটু কষ্ট হবে উজ্জল ভাই – আমি বলে উঠি। উনি হুঁ করে ওঠে। বলি বাঁয়ের গাড়িটার কথা আগে থেকেই বলেন। ঢালে উঠতে সময় লাগে, গতি কমে যায় তাই সাইকেলের ব্যালান্সটা একটু টালমাটাল করে। গাড়ি কাছে আসলে বলবেন, নেমে যাব। নাহ! এখনও এমনটা করতে হয়নি। চালকরা বরং আমাদের দেখে যতটা পারে বামে চলে যায়। আমরার যতটা পারি ডানে চলে আসি। এইটুকু ভাবতে ভাবতে আরেক টা গাড়ি আসে। আবার দুই জনের কথা হয় একফোটা। আমার পায়ের ব্যাথাটা জানান দেয়ার সাথে সাথে গিয়ারটা একটু লো করে দেই। গতি যায় কমে। ৫ মাইলের কম। কষ্ট হয় হাতে। ভারি বাইক, দুইজন মানুষ। কী করা। সব তো একসাথে পাওয়া যায় না। জীবনটাই মনে হয় এমন না। একটা আসবে তো আরেক টা চলে যাবে। কিছুই করা যাবে না।
উজ্জল ভাই খিদা লাগছে, আমার সুগার লো হয়ে গেছে — আচ্ছা ভাল জায়গা দেখে থামাও তাইলে, আমি বলি ডানে বামে দেখেন আমি জায়গা দেখি। থামতে হয়। টেনডেম দুইজনের মিলিত মেশিন। তাই এগুতে হয় সমঝোতায়। মজাও আছে কাইজাও আছে। মেনে নিতে হয়। রাস্তার পাশে থামিয়ে দেই আমি। একটু ছায়া খুঁজি আর ঘাস থাকলে তো কথাই নাই। পুরা ফাইভ স্টার। সকালের ওটমিলে বাকিটা রাখা থাকে। হাফ ন হাফ দেয়া। ওহ গতকাল রাতে আলসেমিতে চিনি দেয়া হয়নি। সুগারকেন বারটা ফ্রন্ট প্যানিয়ারের থাকলেও বের করে আবার কষ্ট করে কাটার ভয়ে আর খাওয়া হয় না। হালকা নোনতা স্বাদের ওট খেতে খারাপ না। তবে গরমের কারনে একটা ভ্যাপসা ভাব চলে আসে। আরে সব শেষ করতে হবে এখনই না হয় ফেলে দিতে হবে। আবার হিসাব, হাফ ন হাফের দাম ২টাকা আর ওটের প্রায় ১টাকা। ফেলে দিব? না ফেলে যাবে না, ফেললে পেটেই যাক। খারাপ হলে পেটই হবে। হাহা পেটও মনে হয় বুঝে গেছে খারাপ হলেও রক্ষা নাই। যদি তাকে কিছু আর না দেয়া হয়? বেচারা। পেটে যে কিছু যায় তাই তো বেশি। শুরু আগে উজ্জল ভাই বলেছিলেন তার একটু পর পর খাইতে হয়। না হলে উনি থাকতে পারেন না। আমি হেসে ছিলাম। শুরু করেন সব পালটে যাবে। আরে সত্যিই তো, ওনার আর বেশি খিদা লাগে না। আমাদের বেশি থামতেও হয় না। সকাল আর দুপুরের মাঝে একটা সিনেমন বনই মনে হয় , আহ কি খেলাম। খাবার পর পানি খাওয়ার সময় একটু সাবধানে খাই যাতে সব মুখ থেকে পেটে না যায়। চালাতে চালাতে জিব দিয়ে কণা গুলোর স্বাদ নিতেও বেশ লাগে, মনে হয় জাস্ট একটু আগেই পেটপুরে খেলাম। এক টাকার পেটপুরে খাওয়া, যতটা মন ভরা যায় ততই ভাল। আবার থামার আগে ১০-১৫ মাইল আছে। আছে দুচোখ ভরে রাস্তা দেখা। যাকে বলে একে বারে চুলচেরা দেখা। সামনের ছোট এটা পাথর দেখলাম মনে হয়? পাথর তো? নাকি পেরেক নাকি লোহা? না না হিট করা যাবে না। একটু স্লাইড করি। নাইস একটা দুলোনি হয়। আমার ভাল লাগে। অতি খুদ্রাতি খুদ্র সময়। সেটাও আবার হিসাব করি কত অল্প সময় এটা? অনেক অল্প সময়। এতই অল্প সময় যে পরের পাথরের কাছাকাছি চলে আসে আমার বাইক। কি বিশাল একটা মজা! তাই মনে হয় এ্যলবার্ট সাহেব বলেছিলেন — সাইকেল চালাবার সময় সব কিছু চলে আসে। হাহা তার কাছে থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আলোর ফোটন কণিকার মারপ্যাঁচ চলে এসেছিল কিন্তু আমার কাছে আসে আরও কিছু পথ — পাকা রাস্তা। কি বিশাল ফারাক মানুষে মানুষে। তাই মনে হয় আমার সমান্তরাল দুনিয়ায় তার ছবিটা এখনও ওয়ালপেপার হয়ে থাকে। আর আমি থাকি বাস্তবতায় — সাইকেলের উপর।
বেশ কিছু দিন থেকেই আইওয়াতে। নেব্রাসকার পর আইওয়া। ভাল স্টেট তাই শুনছিলাম। তবে ঢুকার পর রাস্তার অবস্থা দেখে মনটাই খাবার। একি? কোনো সোল্ডার নাই? কেন নাই? প্রথম কথা মনে হলো — গরিব? তাই হবে মনে হয়। তা না হলে গত পাঁচ পাঁচটি স্টেট পার করে আসার পর এমন? কীভাবে? প্রথমবার রাস্তায় উঠার পর তো উজ্জল ভাইয়ের সাথে আমার যা তা। আমি বাইক থামায় দিলাম। পারবো না ভাই – ইটস্ ট্যু স্ট্রেসফুল — এভাবে চালাইতে পারবো না। একে তো ট্রাফিক তার উপর সোল্ডার নাই। আমি বায়ে বাইক নামায়া দিলাম। ঝগড়া হলো – আরে ধুরো মিয়া, এই রাস্তায় চালান যায় নাকি! ২ মিনিটের পজ। ঠায় দাড়ায়ে আছি। কী করব? কাকে দোষ দিব? আফটার অল বাঙ্গালি তো দোষ দেয়ার একটা কাঁধ তো দরকার! পাইলাম না। কি আর করা যেতে তো হবেই। আজ সিডর র্যাপিডস এ যেতে হবে। ৫২ মাইলের রাস্তা। খুব কঠিন না। রাস্তায় নামার পর একটাই চিন্তা থাকে কখন শেষ হবে। আজ আবার বাঙ্গালি ফ্যামিলিতে দাওয়াত আছে। যদিও বা দাওয়াতের আগে বলতে হইছে আমাদের কোনো দাবী দাওয়া নাই। আমরা আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে আসব। মনে হয় এটা আমাদের পরিবার গুলোর জন্য ইজি। কে কোন অবস্থায় থাকে কে জানে? কিন্তু আমাদের থেকে ব্যাসিক থাকাটা কি আসলেও সম্ভব? তাও বলা – ভাই আমাদের কিছু লাগবে না। যদি পারেন তো দেখা করেন আর পেট ভরে ডাল ভাত খাইতে চাই। আমার মনে হয় এটা বিশাল কোন চাওয়া না।
দুপুরের আগেই এখানে চলে এলাম। আচ্ছা এতো গরম কেন আজ? গতকাল না দেখলাম মেঘলা দিন? ওহ তার মানে এখানের আবহাওয়া অফিসের অবস্থা আমাদের থেকে খুব বেশি ভাল না? এই তো? তো অনলাইনে দেখলাম ঠান্ডা হবে – তাইলে ১০৭ হলো কেমনে? মাঝ খানে আমার ৪৫ টাকা চলে গেল গরমে চোটে! হুম টু বেলম? কেউ তো নাই।
সন্ধ্যায় বাংলাদেশি ভদ্রলোকের বাসায় দাওয়াত। রেডি হইতে হবে তাড়াতাড়ি। ৬টায় । আরেক ভদ্রলোকের বন্ধুর বন্ধু তিনি। কথা হয়েছিল ক’বার। এর বেশি না। তাই ভদ্রস্থ হবার চেষ্টা করলাম যতটা পারি। বাংলাদেশি মানুষ আফটার অল।
দারুন একটা গাড়িতে করে এলেন। এক্যুরা-এসইউভি সাথে সাদা সার্ট। মার্জিত মানুষ। সিকে এর গগলস টা চোখে লাগে। তাই টাকা আগে বোঝা গেল। কুঁকড়ে গেলাম একটু। ভয় লাগলো কিছুটা। এমনই যদি হবে তবে আমাদের কেন খাবার জন্য বললেন? থাকার কথা একদমই বললেন না যে? যাই হোক। শহর টা দেখা হলো। তার অফিসের পাশ দিয়ে যাবার সময় বুঝলাম অনেক বড় মানুষ তিনি। তার অফিসও অনেক বড়। নামটা না হয় থাক। অনেক কষ্ট করে রোজা রেখে আমাদের নিতে আসছেন তাই বা কম কি।
বাসার কাছে যাবার সময় তিনি ইনফো দিলেন, আইওয়ার এই জায়গা আমেরিকার মধ্যে সব র্যংকিং এ আছে ভাল থাকার জায়গা হিসেবে। আমি ওয়াও বলে উঠলাম। আসলেও সুন্দর। আমার মাথায় এর মধ্যে হিসাব চলে, এখান দিয়ে সাইকেল চালাতে কেমন লাগতো? সাথে বাংলাদেশের পতাকা? উনি কি লজ্জিত হতেন? তার চামড়া অবশ্য সাদাটে হয়েগেছে অনেক দিন রোদে না পুড়ার কারনে। এখানে হাগু করার জায়গাতেও এসি থাকে! বিশাল বাসা। অটোমেটিক সব। দারুন। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। বেশ খাতির। রোজাও আছেন সবাই তার মধ্যেও খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। কম কি। অনেক কথাই হলো খাবার পর – আড্ডা তর্ক হলো। তবে যত যাই বলুক – এত বড় বাসাতে আমাদের একটা রাত গুজে যেতে পারতো। কীই বা হতো? যে লন ছিল তাতেই আমাদের তাবু পড়ে যেত। আহ আমাদের টাকা গুলো বেচে যেত। আহ অনেক দিন পর পেটপুরে খাওয়ার মজাই আলাদা। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।
রাতে বাসায় ফেরার পর সবার সাথে খাবার কথা মনে করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম কখন, মনেই নাই। খালি মনে হলো কাল আবার আগের মত। সাইকেল, রাস্তা আর বিশ্রামের জন্য আকুল আকুতি — একটু (এই) মেঘ, একটু (এই) রৌদ্রছায়া।
সিডর রেপিডস, আইওয়া।
২৭ জুলাই ২০১২
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৫ comments
রায়হান রশিদ - ৫ আগস্ট ২০১২ (৩:৫৩ পূর্বাহ্ণ)
ফেসবুকে শেয়ার করলাম এই মেসেজটি দিয়ে:
সবার প্রতি শেয়ার করার অনুরোধ থাকলো।
ধন্যবাদ।
রায়হান রশিদ - ৬ আগস্ট ২০১২ (৩:০৫ পূর্বাহ্ণ)
গ্লোবাল ভয়েসে রেজওয়ান ইসলাম লিখেছেন মুনতাসির-উজ্জ্বল পথচলা নিয়ে, এখানে।
নীড় সন্ধানী - ৭ আগস্ট ২০১২ (১:২৫ অপরাহ্ণ)
মুনতাসির, অনেকদিন যোগাযোগ হয়নি আপনার সাথে। আমার ফেসবুক এক্সেস সীমিত হওয়াতে আপনাদের অনেক আপডেট জানতে পারিনি। এতদিন পর জেনে ভালো লাগছে আপনাদের এই অভিযানের কথা। আপনাদের দুজনের জন্য অফুরান অফুরান শুভ কামনা। আমি আমার আমেরিকার বন্ধুদের গর্বের সাথে বলেছি আপনাদের কথা। তাদের কারো কারো সাথে দেখা হয়েও যেতে পারে কোথাও।
ভাবতে ভালো লাগছে আমার পরিচিত কেউ বাংলাদেশের পতাকা বুকে নিয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বের অন্য প্রান্তে একটা মহৎ এজেন্ডা নিয়ে। এই লেখাটা বিশেষভাবে টেনেছে। আপনি/আপনারা ভালো থাকুন, নিরাপদ হোক আপনাদের পথ চলা।
Pingback: Bangladesh, USA: 5000 Miles Bicycle Ride For Climate Awareness
Pingback: Bangladesh, USA: 5.000 miglia in bicicletta per informare sul cambiamento climatico | Indipedia – Indipendenti nella rete