বাংলা ব্লগোস্ফেয়ারের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি ব্লগ ‘আমার ব্লগ’ গত বাইশে মার্চ একটি বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে Bangladesh Telecommunication Regulatory Commission (BTRC) ‘আমার ব্লগ’ কর্তৃপক্ষকে কিছু ব্লগারের একাউন্ট ব্লক করার নির্দেশ দিয়েছে এবং সেসব ব্লগারের নাম, ঠিকানা, আইপি ইত্যাদি জানতে চেয়েছে। ‘আমার ব্লগ’ এই আদেশ অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে।
BTRC কয়েকমাস আগেই গুগল কর্তৃপক্ষকে মহানবীকে কেন্দ্র করে তৈরি অত্যন্ত আপত্তিকর একটি চলচ্চিত্রের ক্লিপ সরিয়ে ফেলতে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল এবং গুগল কর্তৃপক্ষ এই চিঠির কোন জবাব দেয়নি, ফলশ্রুতিতে BTRC বাংলাদেশে ইউটিউব ব্লক করে দেয় এবং এখনো পর্যন্ত (আমি যতদূর জানি) এই ব্লক বলবৎ আছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে আমার ব্লগের ওয়েবসাইটটিও হয়তো অচিরেই ব্লক করা হবে। এটাও ধরে নেওয়া যায় যে মুক্তাঙ্গন সহ অন্যান্য ব্লগেও BTRC-র চিঠি শিগগিরই যাবে।
BTRC ‘আমার ব্লগ’-এর উপর চড়াও হবার পিছনের কারণ আমরা অনেকেই জানি। শাহবাগের আন্দোলনের পরপরই ‘আমার দেশ’ সহ অন্য কয়েকটি পত্রিকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে এই আন্দোলনের পিছনে নাস্তিক ভাবধারার কিছু ব্লগার কলকাঠি নাড়ছে। একজন ব্লগারকে খুনও করে ফেলা হয় এবং মহানবী এবং আল্লাহ সম্পর্কে কুৎসিত কিছু কথাসহ তাঁর ‘ব্যক্তিগত ব্লগটি’ও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দেওয়া হয় (এই ব্লগার খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর এই ব্লগ সম্পর্কে কেউই কিছু জানতো না)। শাহবাগের আন্দোলনের সাথে জড়িত অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ব্লগিং করছেন, এত দিন পর্যন্ত তাঁদের ‘নাস্তিকতাপূর্ণ’ লেখায় কেউ আঘাত না পেলেও দেখা গেলো অতি অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলিম এইসব ব্লগ পড়ে মানসিক ভাবে ‘আহত’ হয়েছেন। সুদূর যুক্তরাজ্য থেকেও কিছু আহত মুসলমান নাস্তিকদের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে যোগ দিতে বাংলাদেশে চলে আসেন। শাহবাগের আন্দোলনকারীরাও আহত মুসলমানদের মন রাখতে প্রতি সভার আগে কোরান তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করলেন, নামাযের সময়ে ‘গান বাজনা’ বন্ধ রাখলেন। সরকারও এই ব্যাপারে পিছিয়ে থাকলো না, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য ব্লগ এবং ফেসবুককে দায়ী করলেন। এই সংসদীয় কমিটিতে সৈয়দা আশিফা আশরাফী নামে বিএনপির একজন মহিলা এম.পি. আছেন, যিনি সংসদে এবং বিভিন্ন টক শোতে আওয়ামী লীগকে অতি অশালীন ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তবে এই মিটিংয়ে তিনি এবং আওয়ামী লীগের নেতারা রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে ফেসবুক এবং ব্লগের কুফল সম্পর্কে একমত পোষণ করেছেন (রামুতে বৌদ্ধপাড়ায় আক্রমণের সময়েও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, জামাত এবং বিএনপির এই জাতীয় অভূতপূর্ব সৌহার্দ্য চোখে পড়েছিল)।
শের শাহ ঘোড়ার ডাক প্রবর্তনের আগে যেমন ঘোড়া ‘ডাকিতে পারিত না’, তেমনিভাবে ফেসবুক এবং ব্লগ পূর্ববর্তী বাংলাদেশেও কি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে কখনোই আঘাত লাগেনি? ১৯৪৬-এ নোয়াখালিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ তবে কি, ’৯২-এর বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে হিন্দুদের উপর যে নির্যাতন চলে তার কারণ? নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তসলিমা নাসরিনের বইও মুসলমানদের নিদারুণ আহত করে, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে বুয়েটের শিক্ষক ড. আলী আসগরও ‘মোহাম্মদ নামের কারণে পশ্চিমে মুসলমানেরা নানা ঝামেলায় পড়েন’ এই জাতীয় একটি উক্তি করে নিজের অজান্তেই বাংলাদেশের মুসলমানদের মনে আঘাত দিয়ে ফেলেন, আঘাতপ্রাপ্ত মুসলমানদের ভয়ে তিনি বেশ কয়েক মাস গৃহবন্দি থাকেন।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মুসলমানেরা ইন্টারনেট-পূর্ববর্তী যুগেও আহত হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন এবং আগামী দিনগুলিতেও নিশ্চিতভাবেই তাঁরা নানা কারণে আহত হবেন। ফেসবুক বা ব্লগ বন্ধ করে তাঁদের আহত হওয়া বন্ধ করা যাবে না। এই অতি সহজ ব্যাপারটি বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের সবাই খুব ভালভাবেই জানেন, তবে ব্লগের সাথে নাস্তিকতার সম্পর্ক যেহেতু স্থাপিত হয়েই গেছে তাই এই দুটি দলই ব্লগের সাথে নিজেদের দূরত্ব স্পষ্ট করতে চাইছেন। আর একটা ফ্যাক্টরও বোধহয় কাজ করছে, সেটা হচ্ছে ব্লগের এবং ফেসবুকের মাধ্যমে তরুণদের ‘বেয়াদবে’ পরিণত হওয়া। শাহবাগ আন্দোলনের এই কয়েক সপ্তাহে ব্লগাররা বিভিন্ন টক শোতে হাজির হয়ে রাজনৈতিক মুরুব্বিদের নানাভাবে নাজেহাল করেছেন। বিএনপির খন্দকার মাহবুব হোসেন, পাকিস্তানী আর দেশী যুদ্ধাপরাধীদের বঙ্গবন্ধুর ক্ষমা করে দেওয়ার মিথ্যা গল্প বলতে গিয়ে অমি রহমান পিয়ালের কাছে ভরা মজলিশে বেইজ্জত হয়েছেন। তিনি হয়তো ভাবতেও পারেননি ব্লগের ছেলেপুলেরা বিভিন্ন দলিলপত্র শেয়ার করে প্রকৃত ইতিহাস জেনে যাবে। এই পর্যায়ে বিএনপির নেতারাই মূলত বেয়াদবির শিকার হলেও আগামীদিনে অন্য কোন ইস্যুতে আওয়ামী লীগের নেতারাও ব্লগারের এই বেয়াদবি থেকে রেহাই পাবেন না। কিছুদিন আগেই টক শোতে কি চমৎকার কথা বলে যেত, বিএনপি নেতা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ডাকছেন, সব দল মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ চালাতে হবে, এইসব কথার ফুলঝুরিতে চমৎকার আলাপ চলতো, এর মাঝে একদল বেয়াদব ছেলেমেয়ে, ফেসবুকে কী-সব লিখে লাখ খানেক লোক জমিয়ে ফেললো, মুখের উপর কথা বলা শুরু করলো — এই পরিস্থিতি আওয়ামী লীগ বিএনপি কারো জন্যই স্বস্তিকর নয়। তাই এত রাজনৈতিক অনৈক্যের মাঝেও বাংলা ব্লগোস্ফেয়ারের গলা চেপে ধরতে দু দলের মাঝেই চমৎকার বোঝাপড়া দেখা যাচ্ছে।
bdnews24-এর মাধ্যমে BTRC জানাচ্ছে যে ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে টেলিযোগাযোগ লাইসেন্সধারী, ইন্টারনেটে ব্যবহারকারী কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার এখতিয়ার তাদের রয়েছে।’ এই ‘প্রয়োজনীয় তথ্যের’ ব্যাপ্তি কতটুকু সেটা অবশ্য ব্যাখ্যা করা হয়নি। তবে এটা মনে হচ্ছে, BTRC ‘প্রয়োজনীয় তথ্য’ পাওয়ার এখতিয়ারের মাধ্যমে দাবী করছে যে ‘চাহিবা মাত্র’ স্বনামে বা বেনামে লেখা যে-কোন পোস্ট মুছে দিতে হবে আর ব্লগারের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার BTRC-কে জানাতে হবে। যেন ব্লগ স্কুলের শ্রেণিকক্ষের ব্ল্যাকবোর্ড, শিক্ষকের ‘তোদের মধ্যে কে কে বোর্ডে এসব লিখেছিস’ বলে হুঙ্কার দিলেই কান ধরে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের পূর্ণ মৌলিক অধিকার সকল নাগরিককেই দেওয়া হয়েছে। সেই সংবিধান মোতাবেক বাংলাদেশে বা প্রবাসে অবস্থানরত সকল বাংলাদেশী নাগরিকেরই ব্লগে বা অন্য কোন মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ এবং মত বিনিময়ের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। সংবিধানে এটাও বলা আছে যে যে-কোন আইনই সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সংবিধানই প্রাধান্য পাবে। BTRC নামের তথাকথিত স্বাধীন এই কমিশনটির হাতে যে-কোন ব্লগ বা ওয়েবসাইট বন্ধের সুইচ থাকলেও সে-সুইচের ব্যবহার দেশের সংবিধান মেনেই করতে হবে, কোন কর্তাব্যক্তির খেয়ালখুশিমতো নয়।
পাকিস্তান স্টাইলে ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষার অজুহাতে মুক্তচিন্তা এবং মুক্ত মত বিনিময়ের অনন্য মাধ্যম বাংলা ব্লগোস্ফেয়ারের উপর বিধিনিষেধ আরোপের প্রচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আশা করি BTRC-র চিঠি পেলে মুক্তাঙ্গনও ‘আমার ব্লগ’-এর মতই দৃঢ় অবস্থান নেবে। ‘আমার ব্লগ’ বন্ধ হলে চালু হবে ‘আমাদের ব্লগ’; যে নামেই হোক, বাংলা ব্লগের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরও এখন থেকে খানিকটা ‘বেয়াদবি’ সহ্য করেই চলতে হবে। এটাও আশা করি যে BTRC ব্লগ, ফেসবুক, ইউটিউবের পিছনে না লেগে যে মহতী উদ্দেশ্যে এই কমিশনটি তৈরি হয়েছে (Facilitate connecting the unconnected through quality telecommunication services at an affordable price by introducing new technologies) সেই উদ্দেশ্য সাধনেই মনোনিবেশ করবে।
পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
