এই ‘কামাল ভাই’ আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কেউ নন, তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল [..]

এই ‘কামাল ভাই’ আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কেউ নন, তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আ হ ম মোস্তফা কামাল। তাঁর জীবনী ইন্টারনেটে খুঁজে পেলাম না, তবে আবছা মনে পড়ছে ক্রীড়া সংগঠক হিসাবে তাঁর নাম আগে শুনেছি। নিজের মহল্লায় তিনি নিশ্চয় বিভিন্ন ক্লাবের দায়িত্বে ছিলেন, নানা টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছেন। সেটা খারাপ কিছু নয়, একজন সাকিব বা তামিম তো পাড়া থেকেই উঠে আসে। কিন্তু যে দেশ বিশ্ব পর্যায়ের ক্রিকেট খেলে, সেই দেশের সর্বোচ্চ ক্রিকেট সংস্থার প্রধান হয়েও তিনি আটকে আছেন পাড়ার ‘কামাল ভাই’ সংস্কৃতিতে। কিছুদিন আগে ফেসবুকে তাঁর আর সাকিব আল হাসানের একটা ছবি দেখলাম। সাকিব মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে তাঁর সামনে মাটিতে বসে আছে, মোস্তফা কামালের মুখ অতি গম্ভীর। সম্ভবত সাকিব কোথাও বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে। জিম্বাবুয়েকে অর্ডিনারী বলে বা বিসিবির কোন পাতি কর্মকর্তার ড্রেসিং রুমে অযথা মাতব্বরির প্রতিবাদ করে। পাকিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক ইমরান খান একবার এক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে ঘাড় ধরে ড্রেসিং রুম থেকে বের করে দিয়েছিলেন, কোন খেলোয়াড় খেলবে না খেলবে তাতে ইমরানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল। সাকিব অধিনায়ক থাকাকালে এসব কিছুই পায়নি, যদিও ড্রেসিং রুমের রাজা তারই হবার কথা, কাকে নিলে দলের সবচেয়ে উপকার হবে সেটা সেই সবচেয়ে ভাল বোঝে, অন্য দলকে অর্ডিনারী বলে মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা নেয়া, সেটাও বিশ্ব ক্রিকেটে পুরনো কৌশল। কামাল ভাইয়ের এসব কিছুই জানা নেই, জানার প্রয়োজনও নেই। তিনি সবকিছু সহ্য করতে পারেন, কিন্তু বেয়াদবি না। পাড়ার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসাবে বিস্তর বেয়াদব খেলোয়াড়কে তিনি চড় থাপ্পড় দিয়ে মানুষ করেছেন। মাফ না চেয়ে সাকিব তামিমের রেহাই নেই। ফিটনেস টিটনেস কিচ্ছু না, লর্ডসে সেঞ্চুরি করা তামিমের ঘাড় ত্যাড়ামি তাঁর অসহ্য, চাচা আকরাম খান বলে কি তামিম দুনিয়া কিনে নিয়েছে? তামিম খেলার মাঠে তাঁকে চার আঙ্গুল দেখিয়েছে বটে, তবে তিনি দেখেছেন এক আঙ্গুল। এই আঙ্গুল দেখানোর শাস্তি তিনি এখনো দিতে পারেননি, পাকিস্তানে গিয়ে তামিমের একটা কিছু হয়ে গেলে মোস্তফা কামাল সম্ভবত খুব অসুখী হবেন না।
‘সবকিছু ঠিকঠাক’ থাকলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর হচ্ছে। সফর মানে হচ্ছে লাহোরে নামকাওয়াস্তে দুটো ম্যাচ খেলে আসা। খেলোয়াড়রা বিমানবন্দরের বাস ধরার আগে মায়ের দোয়া নিতে যাবেন, মায়েরা কাঁদো কাঁদো গলায় বলবেন ‘বাবা সাবধানে থাকিস’। বিমান উড়ে গেলে মায়েদের দফায় দফায় নফল নামাজ পড়া শুরু হবে, সেই নামাজ শেষ হবে দুদিনের সফর শেষে ছেলেরা নিরাপদে ফিরে এলে। এত উৎকন্ঠা আর নফল নামাজের ফলাফল কি। পাকিস্তান বড়াই করে বলবে, পাকিস্তান বিদেশী দলের জন্য নিরাপদ। বলে বলে গলা ফাটিয়ে ফেলবে, তাতে অবশ্য কোন দলই পাত্তা দিবে না। অন্যান্য দলের তো আর কামাল ভাই নেই, পাকিস্তান আগের মতই ‘হোম সিরিজ’ খেলবে দুবাই বা শারজাতে। একটা ‘বিরাট’ ব্যাপার হয়তো হবে, বাংলাদেশের মোস্তফা কামাল আইসিসির সহ-সভাপতি হয়ে যাবেন, দেশের জন্য আরেকটি বিরল সম্মান বয়ে আনবেন। ডঃ ইউনুসের নোবেল বিজয়, সমুদ্র বিজয়ের পরে আমাদের আরেকটি বিজয় হবে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাসপোর্টের সম্মান আরেক দফা বেড়ে যাবে, একজন বাংলাদেশী আইসিসির সহ সভাপতি, এতো আর মামুলী ব্যাপার নয়।
বাংলাদেশ পাকিস্তান সফরে না গেলে কি হবে, মোস্তফা কামাল যা ভয় দেখাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে আকাশ ধসে পড়বে, পাকিস্তান বাংলাদেশে আর খেলতে আসবে না, লীগে আর খেলোয়াড় পাঠাবে না, বিপিএল আর জমবে না, গুলশান বনানীর মেয়েরা আর ধাক্কাধাক্কি করে (ম্যারি মি) আফ্রিদির অটোগ্রাফ নিতে পারবে না। বাংলাদেশের ক্রিকেটের যা কিছু অর্জন তা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। এত বড় ক্রীড়া সংগঠক হয়ে সেটা তিনি কিভাবে মেনে নিবেন? দুটোই তো মোটে ম্যাচ, পাকিস্তানীরা তো আল্লাহর কসম খেয়ে বলেছে নিরাপত্তা দিবে। নিরাপত্তা শ্রীলঙ্কা দলেরও ছিল, জঙ্গিদের হামলায় সেই নিরাপত্তা নিমিষেই উবে গেছে, স্রেফ কপালের জোরে শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়েরা জান নিয়ে ফিরে গেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জীবনের দাম আর কত? ঐ তো মঞ্জুরুল হক রানা, সড়ক দুর্ঘটনায় মরল, পাকিস্তানে গিয়ে দুয়েকজন মরলে মোস্তফা কামাল নিজে দায়িত্ব নিবেন, নিজে লাশ গ্রামের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবেন, একজন আব্দুর রাজ্জাক আর নাজমুল হোসেনের এর চেয়ে বড় আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?
বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ, পাকিস্তান সফর, বিপিএলে শরিয়ত সম্মত চিয়ার লিডার, এইসব নিয়ে মোস্তফা কামাল যখন ব্যস্ত, তখন ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের অন্যান্য কামাল ভাইদের দাপটে লীগের খেলাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানী খেলোয়াড় মোহাম্মদ ইউসুফের ছাড়পত্র নিয়ে টানাটানিতে আবাহনী, মোহামেডান একজোট হয়ে খেলাই বন্ধ করে দিয়েছে। একটি দেশের ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব কি দেশের ক্রিকেটের উন্নতি না নানা জাতের ভ্যারাইটি শোর আয়োজন করা সেটা বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের কার্যকলাপ দেখে বোঝার উপায় নেই। আশি বা নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের জাতীয় দল ম্যাচের পর ম্যাচ গো হারা হারলেও স্থানীয় ক্রিকেটে একটা প্রাণ ছিল। স্কুল ক্রিকেট ছিল, বিভিন্ন জেলা শহরে স্থানীয় লীগ ছিল, ছোট দলের খেলাও লোকে দল বেঁধে দেখতে আসতো। এখন জাতীয় লীগের খেলাও পিকনিক পার্টির ক্রিকেটে পরিণত হয়েছে। সাকিব তামিমেরা এশিয়া কাপে ভাল করে আমাদের বুক ফুলিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই পিকনিক পার্টির ক্রিকেট থেকে কিন্তু আগামীর সাকিব তামিম উঠে আসবে না, এক দুজন সাকিব তামিম দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটেও কিছু করা যাবে না। এই ‘কামাল ভাই’ মার্কা নেতৃত্ব বছরের পর বছর বিপিএল জাতীয় ভ্যারাইটি শোই করতে পারবে, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কখনোই next plateau তে নিয়ে যেতে পারবে না।

  • মোহাম্মদ মুনিম

    পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।

    View all posts
সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

14 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
14
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.