বেশ কিছুদিন আগে রেডিওতে একটা খবর শুনেছিলাম, খবরটি হচ্ছে টেক্সাসের একটি শহর, নাম লরেডো, যেখানে আড়াই লাখ লোকের বাস, সেই শহরের শেষ বইয়ের দোকানটি বন্ধ হয়ে গেছে। আড়াই লাখ লোকের একটি মার্কিন শহর, ওয়ালমার্ট আছে দুটো, পেল্লায় শপিং মল আছে দুটো, গোটা পাঁচেক বড় বড় রিটেল স্টোর আছে, কাপড় আর প্রসাধনের দোকান নিশ্চয় গণ্ডায় গণ্ডায় আছে, কিন্তু বইয়ের দোকান একটিও নেই! সেই শহরে নিশ্চয় উকিল, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কলেজ শিক্ষক বাস করেন, এঁদের কারুরই বই কেনার প্রয়োজন নেই? অলস দুপুরে সেই শহরের কোন গৃহিণীর বইয়ের দোকানে গিয়ে একটা দুটো ‘নাটক নভেলের’ বই কিনতে ইচ্ছে করে না? বই কিনতে হলে তাঁদের যেতে হবে দেড়শ মাইল দুরের আরেক শহরে।
বেশ কয়েকবছর আগে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ডালাসের কাছাকাছি আরেকটি শহরে, অর্থের অভাবে শহরের একমাত্র পাবলিক লাইব্রেরীটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক সহৃদয় ব্যক্তি লাখ তিনেক ডলার দান করে লাইব্রেরীটিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে উদ্ধার করেন।
একটি ওয়েবসাইটে মার্কিনীদের বই পড়া বিষয়ে পরিসংখ্যান পাওয়া গেলঃ
মাত্র ৩২ ভাগ মার্কিনী সারাজীবনে একবারের জন্য হলেও বইয়ের দোকানে গিয়েছেন (তার মানে ৬৮ ভাগ কখনোই কোন বইয়ের দোকানে যাননি)।
৪২ ভাগ শিক্ষিত (মানে কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রী আছে) মার্কিনী পড়ার বইয়ের বাইরে একটি বইও পড়েননি।
৮০ ভাগ মার্কিন পরিবার ২০০৫ সালে কোন বই কিনেন নি।
২০০৯ সালে মার্কিনীরা বই কিনেছে ১৪ বিলিয়ন ডলারের, একই সময়ে জুতো কিনেছে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের, মদ খেয়েছে ১২০ বিলিয়ন ডলারের আর ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টে খরচ করেছে ১৪৫ বিলিয়ন ডলার।
যে জাতি বই পড়ে না সে জাতির উন্নতি হয়না, এই জাতীয় একটি কথা আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। তাহলে মার্কিনীদের বই পড়ায় এত অনীহা কেন? জাতীয় উন্নতিতে তাদের কি কোন আগ্রহ নেই? নাকি ইতিমধ্যে উন্নত জাতির এই দশাই হয়। উন্নত হবার আগে কি তবে এরা বই পড়তো, মানে উনবিংশ শতকে? সে আমলে বই এত সুলভ ছিল না, সাধারণ লোকজনকে বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হতো, তাই বই পড়ার এত সময়ও ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, তারপরে বিশ বছর জুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দা, এই সব পেরিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, যখন মার্কিন মধ্যবিত্ত সুস্থির হবার সুযোগ পেলো, তখনকি তারা বই পড়েছে? সেরকম কোন তথ্য কখনো চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ছে না।
ডালাসে একটা বাংলা বইয়ের দোকান ছিল, মুক্তধারা নামে, স্থানীয় একজন বাংলাদেশী, দিনে টেক্সাস ইন্স্রুমেন্টে কাজ করে রাতে বইয়ের দোকান চালাতেন, তিনি সময় না পেলে তাঁর স্ত্রী দোকানে বসতেন। বাংলাদেশী মালিকানাধীন একটি গ্রোসারীর ছোট একটি অংশ ভাড়া নিয়ে তাঁরা এই দোকানটি চালাতেন।
বৃহত্তর ডালাসে প্রায় হাজার দশেক বাঙ্গালী থাকেন (বাংলাদেশী আর ভারতীয় বাঙ্গালী মিলে), ইলিশ মাছের দাম প্রতি পাউন্ড সাত ডলারে উঠলেও তাঁদের ইলিশ মাছ খাওয়ার কমতি থাকে না। মুসলমান বাঙ্গালীরা ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে স্থানীয় মসজিদের জন্য চাঁদা তুলেন। হিন্দি চলচ্চিত্র দেখানোর জন্য দু তিনটা সিনেমা হল আছে, উপমহাদেশের অভিবাসীদের জন্য দুটো রেডিও স্টেশনও আছে। স্থানীয় বাঙ্গালীরা প্রতিজনে বছরে বিশ ডলারের বাংলা বই কিনলেও বাংলা বইয়ের দোকানটি বেশ চলে যেত, কিন্তু চলেনি, বছর তিনেক চলেই দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়। দোকানটি আমার বাড়ি থেকে মাইল বিশেক দূরে ছিল, তাই ঘন ঘন যাওয়া হতো না। বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরও কারো কাছ থেকে পাইনি। বন্ধ হয়ে যাওয়ার মাস খানেক পরে সেই বইয়ের দোকানে গিয়ে ফাঁকা দোকানঘরটি দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সাপ্লাই ডিমান্ডের খেলায় কত ব্যবসাই তো হেরে যায়, কত দোকানই তো বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু বইয়ের দোকানের বন্ধ হয়ে যাওয়া কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
মোহাম্মদ মুনিম
পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২ comments
রায়হান রশিদ - ৪ মার্চ ২০১১ (৩:০২ পূর্বাহ্ণ)
আমেরিকার বাংলাদেশ থেকে ‘বইমেলা’র ধারণা আমদানী করার সময় এসেছে। একটা কাজ করলে কেমন হয়? কোনভাবে কি ‘বই’ (কাগজে ছাপানো বই অর্থে) নামক বস্তুটির শত্রুগুলোকে একে একে চিহ্নিত করা যায়?
অবিশ্রুত - ১৬ মার্চ ২০১১ (৬:০০ অপরাহ্ণ)
মার্কিনীদের যে-বইপঠনচিত্র তুলে ধরলেন, তাতে তাদের সম্পর্কে ধারণার আরও একটু অবনতি ঘটল।
তবে এই চিত্র বোধহয় কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নয়, যুক্তরাজ্যেরও। যুক্তরাজ্যেও বছরখানেক আগে বিখ্যাত বইয়ের দোকান বর্ডার বন্ধ হয়ে গেছে। আরও একটি দোকান বুকস এটসেটরা-ও সম্ভবত বন্ধ হয়ে গেছে, তবে অনলাইনে এখনও বই বিক্রি করে (তার মানে গুদাম খালি হয়নি)।
রায়হান রশিদ ঠিকই লিখেছেন, আমাদের উচিত পর্যায়ক্রমে কাগজের বইয়ের শত্রুদের একে একে চিহ্নিত করা।