“পাকিস্তান তো জিম্বাবুয়েরে হারাইয়া দিলো”, আমার এক দূর সম্পর্কের মামা গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন [..]

“পাকিস্তান তো জিম্বাবুয়েরে হারাইয়া দিলো”, আমার এক দূর সম্পর্কের মামা গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন। সেটা ১৯৯৫ কি ৯৬ সালের কথা, তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হচ্ছে পাড়ার ক্রিকেটের মত, প্রায় প্রতিদিনই টিভিতে কোন না কোন দলের ম্যাচ দেখাচ্ছে। মামা পাকিস্তানের সমর্থক জানতাম, কিন্তু জিম্বাবুয়ের মত দুর্বল দলের বিরুদ্ধে খেলার খবরও যে রাখেন আর পাকিস্তান জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে দিলে এতটা খুশি হয়ে উঠেন সেটা জানতাম না। ১৯৯২ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান বিশ্বকাপ জয় করে, কোন কোন অতি উৎসাহী পাকিস্তান সমর্থক নাকি সেদিনের বিজয় উৎসবে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগানও দিয়েছিলেন।
ক্রিকেটে পাকিস্তানকে সমর্থন দিলেই দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব চলে যায় না। তবে খেলার মাঠে অসংখ্য পাকিস্তানী পতাকা দেখলে মনে হতো বাংলাদেশের তরুণ তরুণীদের কি মুক্তিযুদ্ধ বা নিজের দেশ নিয়ে ন্যুনতম অহংকারও নেই? খেলার মাঠে বাংলাদেশের এক তরুণ কোন মানসিকতা থেকে পাকিস্তানী পতাকা উড়ায় বা বাংলাদেশী এক তরুণী কোন মানসিকতা থেকে ‘ম্যারী মি আফ্রিদী’ বলে সেটা বুঝতে পারতাম না। মনে আছে নব্বই দশকের শেষের দিকে, ঢাকায় বাংলাদেশ পাকিস্তান ম্যাচ হচ্ছে, ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে এক স্থানীয় তরুণী হড়বড় করে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের নাম বললেন, কিন্তু কষ্টেসৃষ্টে ‘আকরাম’ ছাড়া দেশী কোন খেলোয়াড়ের নাম বলতে পারলেন না। খুব সম্ভবত ওয়াসিম আকরামের নামের সাথে মিল আছে বলেই আকরাম খানের নাম তাঁর মনে পড়েছিল।
এরপর এলো ১৯৯৯ সালের ৩১ই মে, বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারিয়ে দিলো। চট্টগ্রামের নিউমার্কেট চত্বরে হাজারো জনতা নিমিষে জড়ো হয়ে গেল, ছাত্র, রিকশাওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছা পোষা কেরানী, বেশ্যা, বেশ্যার দালাল সকলেই। সকলেই যে যার মত আনন্দ করছে, এত বিপুল আনন্দ তারা আগে কখনো করেনি, একটিমাত্র জয় যেন তাদের নতুন জীবন এনে দিয়েছে। আগামীকাল সকালে সূর্য আগের মতই উঠবে, নিউমার্কেটে জড়ো হওয়া বেশিরভাগের জন্যই আরেকটি কষ্টকর দিন শুরু হবে। তাতে তো আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না। বিজয় তো আর পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধে নয়, বাংলাদেশে যারা সুযোগ পেলেই পাকিস্তানের পতাকা উড়ায় তাদের বিরুদ্ধে, ‘ম্যারি মি আফ্রিদি’ বলা বড়লোকের নখরা মেয়েদের বিরুদ্ধে।
১৯৯৯ সালের সে দিন বাংলাদেশ দল হিসাবে পাকিস্তানকে হারিয়ে জাতি হিসাবে আরেকটি মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। মাইলস্টোনটি হচ্ছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাকিস্তানের বিজয়ে খুশি হবার দিন শেষ, এখন থেকে বাংলাদেশ জিতল কি হারলো, সেটাই বিবেচনার ব্যাপার হবে।
১৯৯৯ থেকে ২০১১, বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক এগিয়েছে, এগিয়ে যাওয়াটা হয়তো তড়তড় করে হয়নি। বাংলাদেশ কানাডার কাছে হেরে গেছে, টেস্ট দলের অল্প রানে আউট হয়ে যাওয়াটা নিয়ে হাসাহাসি হয়েছে, কিন্তু দুপা সামনে, একপা পেছনে করে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ সবকটি বড় দলের বিপক্ষে একবার করে হলেও জয় পেয়েছে। জিম্বাবুয়েকে হারানো এখন আর কোন খবরই নয়, এমনকি বড় দলের বিপক্ষে জয়ও এমন কিছু আনন্দের উপলক্ষ নয়। এই এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে যে বিরাট অর্জন হয়েছে সেটা হচ্ছে ক্রিকেট কেন্দ্রিক পাকিস্তানী ভূত আমাদের কাঁধ থেকে অনেকাংশেই নেমে গেছে।
এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কতদূর যাবে, জানি না। আশা করি আগের সব অর্জন ছাড়িয়ে যাবে, দেশে গিয়ে মামার সাথে দেখা হলে মামা আবারও ক্রিকেটের গল্প করবেন, তবে সেই গল্প হবে সাকিবদের বিশ্বজয়ের গল্প, আফ্রিদিদের নয়।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

11 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
11
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.