চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক এবং চলচ্চিত্র কর্মী রফিকুল আনোয়ার রাসেল ২০১৪ সালে ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারার’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তখন থেকেই ছবিটি দেখার একটা আগ্রহ ছিল, সম্প্রতি তিনি এই ছবিটি ইউটিউবে অবমুক্ত করায় দেখার সুযোগ ঘটে। এই চলচ্চিত্রটির গল্প মোটামুটিভাবে এমন, চট্টগ্রামের কিছু তরুণ তরুণী বর্ষাকালে পাহাড়ে বেড়াতে যায়, এক পর্যায়ে এদের একজন পা হড়কে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়। আহত সঙ্গীকে তারা একজন সিএনজি চালকের সহায়তায় স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে আসে এবং কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। সঙ্গীর অপারেশনের খবরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তরুণ তরুণীরা হাসপাতালের বাইরের এক চায়ের দোকানে আসে এবং তাদের সিএনজি চালককে দেখতে পায়। তিনিও আহত তরুণের খবরের জন্য অপেক্ষা করছেন। কথা প্রসঙ্গে একসময়ে প্রৌঢ় সিএনজি চালক জানান যে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক বাহিনীর আক্রমণে তাঁর বৃদ্ধা মা সহ গ্রামের অনেকেই নিহত হন। তিনি প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। সেসময়ে তিনি রোগা দুবলা এবং ভীরু এক কিশোর ছিলেন। তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক অভিযানে অংশ নেওয়ার পথে তাঁর সহযোদ্ধারা পাকবাহিনীর গুলির মুখে পড়ে এবং সকলেই নিহত হন। এই চরম সঙ্কটের সময়ে তিনি সাহসী হয়ে উঠেন এবং মৃত সহযোদ্ধাদের অস্ত্র সংগ্রহ করে দুর্গম পাহাড়ি পথে ক্যাম্পে ফিরে আসেন। সিএনজি চালকের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শেষ হতে না হতেই হাসপাতাল থেকে খবর আসে যে আহত তরুণের জ্ঞান ফিরেছে এবং ফাঁড়া কেটে গেছে, এভাবেই ছবিটি শেষ হয়।
চলচ্চিত্র নির্মাণ একটি দলবদ্ধ প্রক্রিয়া হলেও শেষ বিচারে এটি একটি ব্যক্তিগত শিল্প মাধ্যমই। ছবি নির্মাণে অভিনেতা, কলা কুশলী অনেকের সংশ্লিষ্টতা থাকে, কিনতু তাদের কাজকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করে গল্পটা বলার দায়িত্ব পরিচালকের, সে হিসাবে পরিচালক রফিকুল আনোয়ার রাসেল বেশ চমৎকার একটি শিল্পকর্মই উপহার দিয়েছেন বলতে হবে। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া এবং দুর্ঘটনার দৃশ্যায়ন নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল, পরিচালককে খুব সম্ভবত তাই সে পথে না গিয়ে সংলাপ, ক্লোজ এবং মিড শটের মাধ্যমে দর্শককে বোঝাতে হয়েছে কি ঘটেছে। তিনি এ কাজটি খুব ভালভাবে করেছেন। আহত তরুণের বন্ধুরা এবং পরিবারের সদস্যদের সবাই টেনশনে আছেন, মেয়ে দুটোকে নিজেদের জড়িয়ে ধরে কাঁদতেও দেখা গেল, কিন্তু পুরো ব্যাপারটিতেই একটা somber tone ছিল, কারো অভিনয়ই মাত্রা ছাড়িয়ে যায় নি।
আহত তরুণের অবস্থা খানিকটা ভাল হলে বন্ধুরা মোড়ের চায়ের দোকানে গিয়ে সেই সিএনজি চালককে দেখতে পায় এবং তার সাথে চা খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠে, মারাত্মক আহত বন্ধুর জন্য টেনশন আছে বটে, কিন্তু এই বয়সের ছেলেমেয়েরা যা করে, সিএনজি চালকের নাম এবং বাল্য স্মৃতি শুনে তারা হাসি ঠাট্টা শুরু করে। একটু পরেই মুক্তিযোদ্ধা সিএনজি চালক তার মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী বলা শুরু করবেন, পরিবেশটা আবারও somber হয়ে উঠবে, কিন্তু সেই somber tone এ pivot করতে হলে এই হালকা মুডের বোধহয় প্রয়োজন ছিল।
সিএনজি চালক মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুরু করতে করতে রাত ঘনিয়ে আসে, বৃদ্ধ যোদ্ধারা পরের প্রজন্মকে যুদ্ধের গল্প হাজার বছর ধরেই বলে আসছেন, সব সময়ই যে তাঁরা সেটা রাতের বেলায় করেন তা হয়তো নয়, কিন্তু অল্প আলোতে এক বৃদ্ধ তার কাহিনী বলে যাচ্ছেন, আর তাঁকে ঘিরে কয়েকটা তরুণ মুখ সেই কাহিনী তন্ময় হয়ে শুনছে, এই দৃশ্যের একটা সার্বজনীন সৌন্দর্য আছে। রাতের দৃশ্যায়ন পরিশ্রমসাপেক্ষ হলেও পরিচালক এই সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ষ্টক ফুটেজ এবং সিএনজি চালকের মুখ সুপারইম্পোজ করে অত্যন্ত চমৎকারভাবে মুক্তিযুদ্ধকে এস্টাব্লিশ করা হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যায়ন আরেকটু ভাল হতে পারতো।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের সবারই আবেগ অনুভূতি আছে, চলচ্চিত্রে বা নাটকে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলেই মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকে, এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসাবে যা এসেছে তাতে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং বীরত্ব যথেষ্ট পরিমাণেই আছে, কিন্তু চড়া সুরটি নেই, মুক্তিযোদ্ধা সিএনজি চালক মোটামুটি নিঃস্পৃহ ভাবেই নিজের স্মৃতি বলে গেলেন। সব মিলিয়ে ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও ছন্দ পতন হয়েছে বলে মনে হয়নি।
এই ছবিটি কি মুক্তিযুদ্ধের গল্প? খানিকটা তো বটেই, পাক বাহিনীর নৃশংসতা আর মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের সাহসিকতা আর আত্মত্যাগের প্রসঙ্গ এ ছবিতে এসেছে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে ছবিটি মূলত দুই প্রজন্মের গল্প, আজকের প্রজন্ম পাহাড়ে উঠছে শখ করে, এর আগের প্রজন্ম, মানে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, তারাও পাহাড়ে উঠেছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে, তবে সেটা শখ করে নয়, দেশকে দখলদার পাক বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে। এই প্রজন্মের খামখেয়ালী আচরণে আগের প্রজন্মের কয়েকজনকে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু এই বিরক্তির মাঝেও একটা প্রছন্ন সন্তুষ্টিও বোধ হয় আছে, পাক বাহিনীর আক্রমণে গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিনহ হয়ে যাওয়া, আদ্যিকালের কয়েকটা অস্ত্র নিয়ে একটি আধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধ, মুহূর্তের মধ্যে পাক বাহিনীর এমবুশে লাশ হয়ে যাওয়া, শেষ সম্বল কয়েকটি অস্ত্র বাঁচানোর জন্য দেড়দিন পাহাড় বেয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসা, সব কিছুই করা একটি একটি স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য, যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শখ করে পাহাড়ে বেড়াতে যেতে পারবে।