আমাদের এখানে বাংলা ইংরেজি মেশানো একটা কথার খুব চল আছে, সিরিয়াস পড়াশোনা, একদিন আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের গদ্যের রূপ ঠিক করার জন্য সিরিয়াস পড়াশোনায় নেমেছিলাম। সময়টা আমাকে লেখক হতে তাড়িত করছিল এবং ফরাসি ভাষার গদ্য সবেমাত্র টানা এক পৃষ্টা পড়তে পারছি এবং এই ভাষার গদ্য আমাকে গদ্যে জারিত হতে প্রবল অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে, আমি একটা তালিকা বানালাম, আমার বাংলা গদ্যের সিরিয়াস পড়াশোনার তালিকা : কালীপ্রসন্ন সিংহ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু, কমলকুমার মজুমদার। চলল টানা এদের বাংলা গদ্য পড়া আমার বাংলা গদ্য লিখতে শেখার জন্য। বুদ্ধদেব বসু ও কমলকুমার মজুমদার শেষ পর্যন্ত আমার টেবিলে টিকে ছিলেন সময়ের দাগ তরতাজা লাগছিল আমার অনেক কাছের লাগছিল তাদেরকে, সময়টা ছিল তিরান্নবই চুরানব্বই পঁচানব্বই সাল। কিন্তু কোথায় যেন দুজনের একজনকেও আমার সময়ের অভিঘাতে অতিষ্ঠ করা যাচ্ছিল না, তারা ভেঙ্গে যাচ্ছিলেন আমার সময়ের চাপ তাদের উপর তুলে দিলেই তারা নিতে পারছিলেন না আমাকে, আমি নিতে পারছিলাম না তাদেরকে। আরো একটা ব্যাপারও ঘটে গেল — কালীপ্রসন্ন সিংহ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরীকে পড়তে যেএকটা ধারবাহিকতার যেএকটা প্রবাহমানতার ধারায় বাংলাকে অভিষিক্ত দেখেছি বুদ্ধদেব বসু, কমলকুমার মজুমদারে এসে কোথায় যেন একটা বিচ্ছিন্নতার সুর — তাদের দুজনের দুধরনের ফর্মে তাদের চূড়ান্ত সফলতায় কোনো সন্দেহ ছাড়াই বাংলা গদ্যের চলনের নিজস্বতায় কোথায় এক নিবিড় দূরত্বের প্রান্ত স্পর্শ করছিল — যেন আরেকটু সরলেই সেই দূরত্ব বাংলাকেই হারিয়ে বসবে যেকোনো সময়ে। আমি তখন সময়ের অভিঘাতকে দূরে সরিয়ে আরো বেশি উদ্ধার করতে সচেষ্ট কালীপ্রসন্ন সিংহ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরীকে। আমার গদ্যের দশা তখন অবয়বহীন, একবারে দুয়েক বাক্য ফরাসি গদ্য অনুবাদ করে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে গোপনভাবে টিকিয়ে রেখেছি লেখক হওয়ার তাড়না। বিসদৃশ সব ভাবনা বেদনায় তাড়িত কিন্তু গদ্যের পথে পথ হারিয়ে আর সব ছেড়ে তখন শুরু করলাম রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ কবিতার গদ্য অনুলিপি তৈরি করা এবং জন কিটসের দীর্ঘ কবিতার বাংলা গদ্যে অনুলিপি তৈরি করা — চিত্রশিল্পীরা যেমন ওল্ড মাস্টারদের অনুলিপি তৈরি করে হাত পাকান সেই আদর্শে।
কিন্তু গদ্য তো আর হয় না, যেগদ্য চাই সেগদ্য তো আর হয় না। এমন সময় হাতে আসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’। ফেলে রাখি। অন্য একটা পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করি — আমারই উদ্ভাবিত অসাধারণ এক পন্থা। ফটোগ্রাফের গদ্য অনুলিপি করতে শুরু করি। ভাল ফল পাওয়া যায় — খুঁটিনাটি লিখতে পারি — ভাল লাগে। একদিন ‘সেই সময়’ হাতে আসার বয়স তখন ছয়-সাত মাস হয়ে গেছে, ভাবলাম পড়ে দেখি, পড়তে শুরু করেই নড়েচড়ে বসেছি, এই তো গদ্য — আর কোনো সন্দেহ নেই — এবার আমি গদ্যের তাড়নায় লেখক হতে পা বাড়াতে পারি — সময় আর গদ্য কোনোটাই আর বাংলার জন্য বাধা নয় — সুনীলের গদ্য সত্যিই আমাকে বাঁচিয়েছিল।