গানগুলি, দিনগুলি

কিন্তু সব পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ১৯৫৭ সাল। সেই বছরেই পাঁচ-পাঁচটা হিট গানের সুরকার তিনি। বড়দের মুখে এবং রেকর্ডের গোলাকার পরিচয়পত্রে বারবার ভূপেন হাজারিকার নাম দেখতে হয়েছিল। এবং সেই গানগুলোর জনপ্রিয়তায় ১৯৫৭ সাল এক অলৌকিক মায়ায় পরের বহু বছরে প্রসারিত হয়ে গেল।[...]

চলমান কৈশোর ও প্রথম যৌবনে সময়কে চিহ্নিত করে রাখার অভ্যাস থাকে না। যাঁদের থাকে, তাঁরা অন্য ভুবনের বাসিন্দে। কিন্তু কোন মোহময় জাদুতে গানই জীবনের ক্যালেন্ডার হয়ে ওঠে, সে-রহস্য আজও অনাবিষ্কৃত।

ভূপেন হাজারিকা তখন মারফি রেডিওর সঙ্গীত প্রতিযোগিতার বিচারক হন, তাঁর সঙ্গে সেই পঞ্চাশের দশকে-ষাটের দশকে বাংলা গানের তারকা শিল্পীদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব আছে – এই সব সুরেলা তথ্য প্রচারিত ছিল। কিন্তু সব পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ১৯৫৭ সাল। সেই বছরেই পাঁচ-পাঁচটা হিট গানের সুরকার তিনি। বড়দের মুখে এবং রেকর্ডের গোলাকার পরিচয়পত্রে বারবার ভূপেন হাজারিকার নাম দেখতে হয়েছিল। এবং সেই গানগুলোর জনপ্রিয়তায় ১৯৫৭ সাল এক অলৌকিক মায়ায় পরের বহু বছরে প্রসারিত হয়ে গেল।

ততদিনে ভূপেন হাজারিকা আর শুধু আসামের নয়, কলকাতারও হয়ে গেছেন। তাঁর সুরের যে সব গান সেই সময়ে আলোড়ন ফেলেছিল, তা বাংলার শ্রোতারা আজও ভোলেননি। সাধারণ শ্রোতারা একটা গানের ক্ষেত্রে শুধু শিল্পীকেই মনে রাখেন। সহজ অভ্যাসে সেই বিশেষ গানটি গায়ক বা গায়িকার গান হিসেবেই পরিচিতি পায়। কেবলমাত্র বাড়তি কৌতূহলতাড়িত শ্রোতারা মুগ্ধ অন্বেষণে জেনে ফেলেন গীতিকার ও সুরকারের নাম। সুতরাং, শ্যমিল মিত্র ‘চৈতালি চাঁদ যাক যাক ডুবে যাক’ ও ‘সপ্তডিঙা মধুকর’ গাইলে একই সঙ্গে জেনে নিতে হয় গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরকার ভূপেন হাজারিকার নামও। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে যে-দুটি গান গেয়েছিলেন সুরকার ভূপেন হাজারিকা (‘ঘুম ঘুম মেঘ’। ‘আঁকাবাঁকা এ পথের’) একটা অন্যরকম বৈচিত্র সৃষ্টি করেছিল।

রসিক শ্রোতামাত্রেই জানেন গানের জগতে জনপ্রিয়তার উত্তাপ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘হিট’ হওয়ার কোনও নির্দিষ্ট কৌশল নেই। কিন্তু একজন যথার্থ দক্ষ শিল্পীর গায়নভঙ্গিও সেক্ষেত্রে বাড়তি গুরুত্ব পেতে বাধ্য। ১৯৫৬-তে যখন লতা মঙ্গেশকর তাঁর প্রথম বাংলা বেসিক রেকর্ড (‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ । ‘কত নিশি গেছে নিদহারা’ – কথা : পবিত্র মিত্র, সুর : সতীনাথ মুখোপাধ্যায়) একেবারে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন, সেই সময় লতাজিকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য একধরনের অনুচ্চারিত লড়াই শুরু হয়েছিল। অনেক বছর পরে এই প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ হয়েছিল, পরের বছর (অর্থাৎ সেই ১৯৫৭-তে) লতা মঙ্গেশকর যে-দুটি স্মরণীয় গান গেয়েছিলেন, তার সুরকার ছিলেন ভূপেন হাজারিকা (‘রঙিলা বাঁশিতে কে ডাকে’ । ‘মনে রেখো’)।

সার্থক সুরকারদের প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে শিল্পীদের কণ্ঠস্বর ও মেজাজ সম্পর্কে সচেতন হতেই হয়। ভুপেন হাজারিকাও সেই প্রশ্নে কতদূর দক্ষ ছিলেন , তার স্থায়ী ও উজ্জ্বল প্রমাণ হয়ে থাকবে লতাজির গাওয়া গান দুটি। গানের কথা ও সুরের স্রষ্টারা কখনও কখনও ফসলমুখী সুসময়ের কথা বলেন। তা সেই পঞ্চাশের শেষ ও ষাটের শুরুর দিকে সুরকার ভূপেন হাজারিকারও বোধ হয় সেই সুমসময় এসেছিল। ১৯৫৯-এ সুবীর সেন গেয়েছিলেন ‘ওগো শকুন্তলা’ আর ‘ কালো মেঘে ডম্বরু’। দুটো গানই জনপ্রিয় হয়েছিল। একই কথা বলা যায় ছন্দসুন্দর ‘দাঁড় ছপ ছপ’ গানটি সম্পর্কে, শিল্পী ছিলেন শৈলেন মুখোপাধ্যায়।

সুরকার ভূপেনবাবুর পছন্দের গীতিকার ছিলেন তিনজন – পবিত্র মিত্র, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের মধ্যে এইচ এম ভি-র পদস্থ কর্মী পবিত্র মিত্র গানের ভুবনে এতটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে, সেই সময়ের প্রায় সব শিল্পীই তাঁর উপস্থিতি এবং কাব্যময়, রুচিশীল গীতরচনা-কে বিশেষ মূল্য দিতেন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ই সুরকার ভূপেন হাজারিকার জন্য সর্বাধিক সংখ্যক গান লিখেছিলেন। ওঁর মধ্যে সুরকারের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব থাকা ছাড়া অন্য গুণের সমন্বয় ঘটেছিল। দিব্যি হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন, সুরের বন্দিশ ভালই বুঝতেন – এমন তথ্য জানিয়েছেন সুরকার-গীতিকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং ভিন্ন মেজাজের কিছু গান লিখে দিয়েছিলেন (‘এক খানা মেঘ ভেসে এল’ – শিল্পী : রুমা গুহঠাকুরতা। ‘ভাল করে তুমি চেয়ে দেখ’ – শিল্পী : লতা মঙ্গেশকর) এর মধ্যে ভালবেসে সুরকার নিজেও পরে রেকর্ড করেছিলেন সেই ‘এক খানা মেঘ’।

সেই ১৯৫৭-তেই পরিচালক অসিত সেনের ছবি ‘জীবনতৃষ্ণা’ মুক্তি পেয়েছিল। সুচিত্রা সেন-উত্তমকুমারের সিনেমা হওয়া সত্ত্বেও তখন ছবিটা দেখা হয়নি, দেখা ঘটেছিল চার-পাঁচ বছর পরে। কিন্তু গান শুনতে, আলোচনা করতে বারণ করেছে কে! ‘জীবনতৃষ্ণা’র সঙ্গীত-পরিচালক ভূপেন হাজারিকা এবং গীতিকার ছিলেন সুখ্যাত তিনজনই (শ্যামল গুপ্ত, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়) ।

ততদিনে কফি হাউস ও নিত্যদিনে এক-দেড় গন্ডা রাজা-উজির-মন্ত্রী ইত্যাদিকে মেরে ফেলার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। যেমন হয়, বয়সোচিত বীরত্ব। জানা হয়ে গেছে ভারতীয় সিনেমার নায়ক-নায়িকারা স্বভাবজ প্রতিভায় প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। লম্ফঝম্ফ, দৌড় বা গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থাতেও তাঁরা রাগাশ্রয়ী গানও গাইতে পারেন। সেই ‘জীবনতৃষ্ণা’ ছবিতে দেখা গেল নায়ক উত্তমকুমার সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামার সময় গাইছেন – ‘সাগর সঙ্গমে সাঁতার কেটেছি কত’। কণ্ঠস্বর ভূপেন হাজারিকার। উত্তমকুমারের মুখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কেউ – এই বিপ্লব তখন অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু যা সেই রাজা-উজিরদের হত্যাকারীদের মধ্যে আলোড়ন ফেলেছিল, সেটা একটা শব্দ – ‘তথাপি’। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গানটির তৃতীয় লাইনটায় (‘তথাপি মনের মাঝে প্রশান্ত সাগরের উর্মিমালা অশান্ত’) রাখা তথাপি লেখা হবে ১৯৫৭-তেও? কিন্তু মজার কথা হচ্ছে সুরের জন্য সেই গানটিও জনপ্রিয় হয়েছিল।

শুধুই আসামের লোকসঙ্গীত নয়, সুরের বৈচিত্রের পথে হেঁটেছিলেন সুরকার ভূপেন হাজারিকা। গেয়েছেন নানা ধরনের গানও মানুষের জন্য, মানুষের জীবনসংগ্রাম নিয়েও বিস্তর গানে সুর দিয়েছেন এবং গেয়েছেন। বাদ নেই লোকসঙ্গীতের কথায় ও সুরে প্রেমের গানও (‘দাঁতে কাইটোনা ঠোঁট আর’ । ‘এবার দিব দালান কোঠা’)। গেয়েছেন ‘ও মালিক সারাজীবন কাঁদালে যখন’ (গৌরীপ্রসন্ন। সুপর্নকান্তি ঘোষ), ‘একটি কুঁড়ি দুটি পাতা’, হরিপদ কেরানি’র মতন গানও। পল রোবসন-এর বাংলা অনুবাদের গান ‘মোরা যাত্রী একই তরণীর’, পাশেই আছে ‘তোমরা গেইলে কি আসিবেন মোর’।

কিন্তু সব পেরিয়ে স্মৃতিতে বাজবে সেই সব গান যা সুরের মহিমা, শিল্পীর কণ্ঠমাধুর্য ও গায়কীতে নিজস্ব আবেদনে বেজে থাকে। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া – ‘তোমায় কেন লাগছে চেনা’ (পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়) গানে যে প্রেমস্নিগ্ধ প্রশ্ন, তার কি কোনও উত্তর হয়! ভুপেন হাজারিকার সুরও যেন চিরকাল খুঁজে বেড়াবে প্রথম দেখার মুহূর্ত, শিপ্রা নদীর তীরে বা নাগরিক পথের ভিড়ে অথবা স্মৃতিমেদুর রঙিন কল্পনায়!

লিখেছেন : অলক চট্টোপাধ্যায়
ছাপা হয়েছে : আজকাল | কলকাতা | ২৬ কার্তিক | রবিবার | ১৩ নভেম্বর ২০১১

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.