বাতাসে যে কথা

প্রথম ছবিটি শুরু হয়েছিল একজন বোতলবন্দি মানুষকে দিয়ে, খালি পারফিউম বোতলের ভেতর বসে আছে মানুষটি[...]

গত ৩১ জুলাই শিল্পী সঞ্জীব দত্তের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। এই জন্মদিন উপলক্ষেই ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত শিল্পীর দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে আমার সেই সময়ের একটি লেখা এখানে তুলে দিচ্ছি। শিল্পী সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনীর প্রস্তুতি চলছে – এবারের প্রদর্শনীটি হবে ঢাকায়, ঢাকা আর্ট সেন্টারে এবং অনুষ্ঠিত হবে এবছরের ২৬ নভেম্বর থেকে ০৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ছবি আঁকার জীবন এক অনন্য জীবন। বর্ণলেপনের শিল্প। ইউরোপীয় পেইন্টার শব্দটি এতই কারিগরি শব্দ এবং এই বৃত্তির বিকাশ ওই মহাদেশে এতই সহজাত সচল বাস্তব যে একে যারা চিত্রশিল্পে উন্নীত করেছিলেন তারা একেকজন আমাদের সানাইয়ের বিসমিল্লাহ খাঁ। বাংলায় পটুয়া বা চিত্রশিল্পী যাই বলি না কেন শুরু থেকেই তা শিল্পকর্ম এবং কারিগরি বিদ্যা হিসেবে এর পুনঃপাঠ আমাদের ইতিহাসের উপনিবেশিক তাৎপর্যে নবজাগরণের এক অনবদ্য ঘটনা। বর্ণলেপন ও অঙ্কন এই দুই বিদ্যার সৃষ্টিশীল চিত্রভাষা আজকের একজন চিত্রশিল্পীর অনন্য আরাধ্য। তাই বলছিলাম ছবি আঁকার জীবন ও বর্ণলেপনের শিল্প এক অনন্য জীবন। আমাদের সুপরিচিত সুহৃদ শিল্পী সঞ্জীব দত্ত পেইন্টারের জীবনযাপন করেন। চিত্রভাষার প্রয়োগে শিল্প সৃষ্টি করেন। কবিতায় জারিত হন। স্নায়ুতে সঙ্গীতকে ডিকোড করেন। ফিল্মে কেঁপে ওঠেন। তার ছবিতে চিত্রকলা কবিতা ও সঙ্গীতের খুব সংহত এক রূপ আমরা দেখেছি, এবার তার সাথে মিশেছে চলচ্চিত্র। অনেক বাদানুবাদের পর এবার তার কাজে এল আধুনিক বাস্তবতা – কিন্তু বিদায় নেয়নি আগের বিমূর্ততাবাদ ছাপবাদ প্রকাশবাদ প্রতীকবাদ আধুনিকতাবাদ। তাই ‘বাতাসে যে কথা’ – এপ্রদর্শনীতে আমরা দেখলাম কিছু বহুত্ববাদী সমবায়ী ক্যানভাস, শিল্পীর সম্ভাবনার পরিণতির শুরু।

২০০৬-এর শেষ দিকে ডিসেম্বর ১৭ থেকে ২১ চট্টগ্রাম অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল সঞ্জীব দত্তের দ্বিতীয় একক শিল্প প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর নাম ‘বাতাসে যে কথা’। চার ফুট বাই চার ফুট মাপের আটটি তেল রঙের ছবি, কয়েকটি স্থাপনা, শিল্পীর নিজের পরিকল্পিত সঙ্গীতের অবিরাম আবহ, স্বয়ংক্রিয় পারফিউম স্প্রের নির্দিষ্ট সময় পরপর ছড়িয়ে দেয়া পারফিউম : ছবি স্থাপনা শব্দ গন্ধ এসব নিয়ে এই শিল্প প্রদর্শনী, সচেতনভাবেই তাই প্রদর্শনীর ক্যাটালগে লেখা ছিল Art Exhibition।

২০০৫-এর এপ্রিলে তার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী শেষ হয়ে যাওয়ার কিছু দিন পর থেকে তার মুখে বারবার আমি আমি নিঃশেষিত পারফিউম বোতলের কথা শুনতে পেতাম, তিনি বলছিলেন আমাদের প্রিয় পারফিউম বোতলের কথা, তার প্রতি আমাদের যত্নের কথা; কিন্তু শেষ হয়ে যাওয়ার পর কী মূল্যহীন এই বোতল, কী অবহেলায় পরিত্যক্ত সে বোতল : নির্যাস নেই তাই নিগৃহীত। তখন থেকেই প্রদর্শনীর নাম খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন শিল্পী, খুব আগ্রহ বোধ করলাম, এভাবে কাজ শুরুরও আগে নাম খুঁজে বেড়ানো খুব ভাল লাগল। কয়েকদিনের মধ্যেই নাম খুঁজে পেলেন তিনি – বাতাসে যে কথা – ঠিক সেদিন থেকেই আগ্রহী হয়ে উঠলাম আমি প্রদর্শনীটির বিষয়ে।

আজ যখন প্রদর্শনীটি শেষ হল তখন একথা ভাবতে খুব ভাল লাগছে এরকম একটি প্রদর্শনীর সাথে আগাগোড়া জড়িত ছিলাম আমি।

এই প্রকল্পের প্রথম ছবিটি শুরু হয়েছিল একজন বোতলবন্দি মানুষকে দিয়ে, খালি পারফিউম বোতলের ভেতর বসে আছে মানুষটি, বোতলের কাঁকের ক্রিস্টালিটির ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার বিষণ্ণ মুখ, এই বিষণ্ণতা আরো অমোঘ হয়ে ওঠে ক্যানভাসের বাম কোণে তুতেনখামেনের মুখের বর্ণাঢ্যতায়। শুধু তাই নয় বেদনার লালে ঢেকে যায় মোগল খিলান, তার সামনে তীরবিদ্ধ কস্তুরীমৃগ, সুগন্ধদানিতে কস্তুরী, মোগল নাগ্রা। ক্যানভাসের ডান দিকে এক জরাজীর্ণ ঘরের আবহ, পড়ে আছে বহু ব্যবহৃত স্যান্ডেল, মদের বোতল। এই ছবিটিকে আমি বলতে চাই একজন শিল্পীর প্রতিকৃতি। একজন বহুত্ববাদী সমবায়ী শিল্পীর প্রতিকৃতি। ‘বাতাসে যে কথা’র শিল্পীর প্রতিকৃতি। বর্ণলেপনে দীপ্তি বর্ণলেপনে ক্ষরণ, জড়জীবন চিত্রের ধরনে মদের বোতল, স্যান্ডেল ও মোগল নাগ্রার স্পষ্ট ও অভিব্যক্ত উপস্থিতি, পিরামিড ও প্রাচীন পাত্রের আভাস : সব মিলিয়ে ক্ষমতা ঐশ্বর্য নিঃস্বতার ভেতর সব যুগে শিল্পীকে বেঁচে থাকতে হয় কোনো এক সুগন্ধদানিতে কস্তুরী হয়ে থাকবে বলে।

দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম এই চারটি ছবি বিজ্ঞাপন মডেল, যাদের শিল্পী পণ্যমানুষ বলছেন, তাদের নিয়ে। দ্বিতীয় ছবিতে মডেলকে দেখা যাচ্ছে ক্যানভাসের ডান দিকে চলচ্চিত্রের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ক্লোজআপে র‌্যাম্পের উচ্ছ্বাসে : তার নীল চুল, সোনালি বক্ষদেশ, সাটিন রোব, উদ্ভাসিত হাসি সবকিছু মিলিয়ে এমনই এক উপস্থিতি তার, এমনই এক অধরা অবস্থান, যেন পৌরাণিক নেফারতিতি, যেন আইফেল টাওয়ার। কিন্তু তার পাশে পড়ে থাকা বোতলবন্দি মানুষটি যেন এক জড়জীবন, তার আশেপাশের মদের বোতল, টাই, পড়ে থাকা শিশি, স্যান্ডেল, কাগজের বাক্সের মতোই সে একজন বর্জ্য, দাঁড়িয়ে আছে নিঃশেষিত পারফিউম বোতলের ভেতর। মডেলের এই অতিমানুষতা আসলে মানুষের পণ্যতা, বোতলবন্দি মানুষটি বর্জ্য এই পণ্যতার। এই ছবির মধ্যে একটি রক্তবাহী নল দেখা যায় যা এমন একটি যোগাযোগ তৈরি করে বর্জ্য ও পণ্যমানুষের মধ্যে যে সেই উষ্ণ রক্তিম স্থিতিস্থাপকতা ছবিটি না দেখলে বুঝবার নয়। তৃতীয় ছবিটিও মডেল বা পণ্যমানুষ নিয়ে। কিন্তু এখানে ভেসে ওঠে মডেলের উদ্দামতা। শিল্পী এখানে মডেলের নাভি, নীল ব্রার স্তনবৃন্তের অঞ্চল দুটো বিকৃত করেন, মুখে মেখে দেন উন্মাদ উল্লাসের সব রঙ। এছবিতে তাজমহলকে মনে হয় বর্জ্য, যেন পড়ে আছে শূন্য পারফিউম বোতলের মতোই, প্রেমহীন এক আবহ, বোতলের ভেতর বন্দি মানুষটি এখন কুঁচকানো কাগজের মানুষ; কিন্তু উজ্জ্বল কমলা রঙে পুরো ক্যানভাস উদ্ভাসিত, নারীদেহের উদ্দামতা বিশাল বিস্তার নিয়ে ডান দিক জুড়ে আছে, এই ছবিতেও আছে আগের ছবির রক্তবাহী নল, এখানেও একইভাবে যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে বর্জ্য আর পণ্যে। চতুর্থ ছবিটিতে মডেলের সাদা ব্রার স্তনবৃন্তের অঞ্চল দুটো বিশাল রক্তময় গহ্বরের মতে করে দেয়া হয়েছে. মোগল খিলান আবার এসেছে, পরিত্যক্ত পারফিউম বোতলের ভেতর সেই কুঁচকানো কাগজের মানুষ, জড়জীবনের মধ্যে পড়ে আছে ব্যাটরি, মদের বোতল, এবার পণ্য ও বর্জ্যের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি হরিণের মাথার প্রোফাইল তার শান্ত চোখ চাইছে এদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে, সোনালি আর তামসিক নীলের এই পরিপ্রেক্ষিত আমাদের বিলাস আর বেদনার গভীরতর বিন্যাসকে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে বিকৃত করে। পঞ্চম ছবিটি, মডেলকে নিয়ে; কিন্তু এখানে আর আগের ছবির পণ্য ও বর্জ্য এই বিন্যাসটি নেই। নেই আর মডেলের স্তনবৃন্ত ও নাভিতে এঁকে দেয়া বেদনার গহ্বর; কিন্তু আছে অনুভবের এক অদ্ভুত কল্পনা, পরাবাস্তব, মডেলের চোখ দুটো ঠোঁট। ফিরে এসেছে শিল্পীর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনীর স্বপ্নে বিভোর ফড়িং, যার বহুদ্যুতিময়, চোখে প্রকৃতি দেখেছিলেন তিনি; কিন্তু এবার সে তীরবিদ্ধ, পড়ে আছে আফ্রোদিতির পায়ের কাছে, আকাশে তীরধনুক হাতে কিউপিডকে দেখা যাচ্ছে, কিউপিড আর ফড়িংয়ের মাঝখানে শূন্যস্থানে ভেসে আছে কুঁচকানো কাগজের মানুষ, এছবিতে নিঃশেষিত পারফিউম বোতলের মতো তীরবিদ্ধ ফড়িং পড়ে আছে প্রেমহীন প্রয়োজনহীন, শুধু তাই নয়, সে আক্রান্ত স্বর্ণাভ পরাবাস্তব মডেল ও আফ্রোদিতির তাতে কিছু আসে যায় না, তারা তাদের লাস্যের চূড়ান্ত রূপে উদ্ভাসিত।

ষষ্ঠ ছবিটি এক চলচ্চিত্র, ছবিতে কামতৃপ্ত পুরুষটির ক্যানভাসে অবস্থান ও তার শরীরের ওপর পড়া রক্তিম বেগুনি আলোর মতো রঙ, ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত সবুজ নারী এবং ক্যানভাসে তার অবস্থান, রহস্যময় সিলিন্ড্রিক্যাল দুই স্প্রে একটি শায়িত একটি ভাসমান, আর রাধা, কী দুঃখী, কী বিষণ্ণ : কিন্তু হোলির উচ্ছ্বাসে, ঠুমরির মতো আবেশে, তীরবিদ্ধ ফড়িং যাকে মনে হয় শুদ্ধতম প্রেমের শহীদ, তার বুকে রাধার হাত, সে হাত ইশ্বরের, সে হাত রাধার পরম প্রেমের, প্রতিবাদেরও, কেন পুরুষ কামগ্রস্ত শুধু, আর প্রেম তীরবিদ্ধ আমাদের প্রেমলীলায়।

সপ্তম ও অষ্টম ছবি দুটি কৃষ্ণায়ন। দুটি ছবির কাহিনী মৃত ফড়িংয়ের অন্ত্যেষ্টি, পিঁপড়া তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নগরকৃষ্ণ, তার মোহনতা শুধুই নারীকে আকর্ষণের প্রণয়রঙ্গ এই ছিনালি ঘোষণা করে প্রেমের পরিপূর্ণ সমাপ্তি, ভেনাস দি মিলো, নারী শরীরের অবয়বে পারফিউম বোতল, সবই প্রণয়রঙ্গের অনুষঙ্গ, পদ্মের শুভ্রতা কোথায় জীবনে, সে হয়ত প্রেমের পবিত্রতার অর্ঘ্য, মৃত শুদ্ধতম ফড়িংয়ের প্রতি, গোলাপ হয়ত শুধুই রক্তক্ষরণ প্রেমাষ্পদের, সেই অমোঘ বর্জ্যে পড়ে থাকা ফড়িংকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়া, অসাধারণ চলচ্চিত্রায়ন। এরপর লেখা থাকবে ‘সমাপ্ত’। আসবে কুশীলব আর পরিচালকের নাম। ‘বাতাসে যে কথা’ তার চিত্রকর্মসমূহ, সঙ্গীত, আলো, গন্ধ, স্থাপনা সব নিয়ে চলচ্চিত্র ধরনের এক শিল্পের শিল্প। এবং সঞ্জীব দত্ত এর সফল পরিচালক।

এটি আমার গুটিকয় ছাপা মাধ্যমে ছাপা লেখার একটি। দৈনিক সংবাদের ‘সংবাদ সাময়িকী’তে বৃহস্পতিবার ২৫ জানুয়ারি ২০০৭ ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল বহুত্ববাদী সমবায়ী ক্যানভাস

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৯ comments

  1. মাসুদ করিম - ১৮ আগস্ট ২০১১ (১২:৪৯ অপরাহ্ণ)

    এই প্রদর্শনীর ছবিগুলো ক্যাটালগ থেকে স্ক্যান করে তোলা আছে আমার টুইটপিক অ্যাকাউন্টে : প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম

  2. মাসুদ করিম - ১৯ নভেম্বর ২০১১ (১২:১০ অপরাহ্ণ)

    শিল্পী সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনীর প্রস্তুতি সম্পন্ন – ঢাকা আর্ট সেন্টার, ঢাকায় ২৬ নভেম্বর ২০১১ সন্ধ্যা সাতটায় উদ্বোধন হবে এই প্রদর্শনীর। উদ্বোধন করবেন শিল্পী মনিরুল ইসলাম। আমন্ত্রণ পত্রটি দেখুন, এখানে

    • মাসুদ করিম - ৯ ডিসেম্বর ২০১১ (১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ)

      সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় এককের রিভিউ, আজ এসেছে দুটি পত্রিকায়, প্রথম আলোতে সিলভিয়া নাজনীন লিখেছেন মেট্রো মহুয়ার আস্বাদ

      চারুশিল্প
      মেট্রো মহুয়ার আস্বাদ

      সিলভিয়া নাজনীন | তারিখ: ০৯-১২-২০১১
      চট্টগ্রাম বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় দ্বিতীয় তীর্থভূমি। পাহাড়ি প্রকৃতি আর লোনা জলের আহ্বানে সাড়া দিয়েই শিল্পীরা সাধনায় মগ্ন হন। হয়তো সে কারণেই চট্টগ্রামের শিল্পীদের কাজে খুঁজে পাওয়া যায় কিছুটা আলাদা বিশেষত্ব। সেই বৈশিষ্ট্যের সাবলীল বাহন হয়ে এসেছে সঞ্জীব দত্তের উজ্জ্বল অর্গানিক ক্যানভাস।
      ‘আমি তুমি সে ইহারা’ শিরোনামে ধানমন্ডির ঢাকা আর্ট সেন্টারে শেষ হয়েছে শিল্পী সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী।
      দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের পারিপার্শ্বিক জীবনের নানাবিধ ঘটনাকে উপজীব্য করে ছবি আঁকছেন সঞ্জীব দত্ত। সমাজ পর্যবেক্ষণের এক নিজস্ব পদ্ধতির প্রয়োগ করেন তিনি। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও আস্বাদ সৃজনের প্রয়োজনে করে চলেছেন বিভিন্ন নিরীক্ষা। শিল্পী একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গকে বহুমাত্রিক রূপে দেখিয়েছেন। একটি সত্যের উপলব্ধির জন্য দীর্ঘ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। বৈরী পরিস্থিতিতে সহিষ্ণু হয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থা আর রাজনীতির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে টিকে থাকে আলাদা এক ধরনের অস্তিত্ব। আর ব্যতিক্রম হলেই সংঘাত হয়; আত্ম-অনুসন্ধিৎসু-আত্মমগ্নতা বা আত্মোপলব্ধি অবচেতনভাবেই মুক্তির পথ খুঁজে বেড়ায়। একটি চিত্রপটে অবজেক্টের বিভাজন মুখ্য করে তোলে কখনো বা; শিল্পকর্মের শিরোনামেও এর তাৎপর্য ব্যাপ্তিময়। ‘কষ্টগুলো নদী হওয়ার আগে’, ‘বাতাসে যে কথা’, ‘ফাঁদ’, ‘চিত্রকল্প’, ‘অচিন পাখি’, ‘নির্দেশ ব্যতীত যন্ত্র কাজ করে না’, ‘সে’, ‘বশীকরণ’ প্রভৃতি শিল্পকর্মকে রঙ-রেখা কৌণিক কম্পোজিশনে নতুন ভাবের সঞ্চার করে। চতুষ্কোণ ক্যানভাসে তার ভাবনাকে সীমায়িত করতে চাননি সঞ্জীব দত্ত তাই ক্যানভাসের আকার-আকৃতি ও কৌণিক বিন্যাস নিয়েও ভেবেছেন নতুন আঙ্গিকে।
      বাংলাদেশের শিল্পচর্চার অন্যতম পুরোধা শিল্পী রশীদ চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রাম চারুচর্চার প্রধান ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ খোলেন। তাঁর শিল্পচিন্তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষস্পন্দন নিরন্তর দৃষ্টিগোচর হয়ে চলেছে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রত্যেক শিল্পীর ওপর অবচেতনেই কোনো না কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তাদের স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ার মতোই। রশীদ চৌধুরী ছিলেন রোমান্টিক আর জীবনমুখী শিল্পী। তিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন, যাতে ঢাকা চারুকলার একাডেমিক প্রভাব চট্টগ্রামে ছায়া না ফেলে। ফোক আর্টের প্রধান রঙ স্টাইলাইজেশন আর কনসেপচুয়াল আইডেন্টিফিকেশনে এক অনবদ্য শিল্পক্রিয়া খুব সহজেই ঢাকা থেকে এই শহরের শিল্পীদের আলাদা বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র করে তোলে। মাধ্যমগত নিরীক্ষার সঙ্গে সমাজ পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গিও নির্মাণের প্রচ্ছন্ন প্রয়াস থাকে এই শিল্পীদের।
      রশীদ চৌধুরীর পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের মাঝেই তার ছায়া রয়েছে। যাঁরা দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করেছেন এবং এখনো করছেন, সেই শিল্পীদের হাত ধরেই সঞ্জীব দত্তের শিল্পচর্চায় পথচলা। তাঁর বেড়ে ওঠার সময়ের মধ্যেই চট্টগ্রাম শহর একটি মেট্রোপলিটন শহর হিসেবে নির্মিত হয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হয়ে থাকে। তাঁরা জীবনের প্রতিটি দৃশ্যকল্প বিভিন্ন স্তরে, নানা ডাইমেনশনে দেখার সুযোগ পান, যা তাঁর মনোভূমিতে কখন প্রভাব ফেলে, তা নিজেই হয়তো জানেন না। শিল্পী সঞ্জীবের শিল্পকর্মেও এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান। তিনি প্রধান চরিত্র হিসেবে ‘ফড়িং’কে বেছে নিয়েছেন এবং এই ক্ষুদ্র পতঙ্গের সমাজে ঘুরে বেড়ানো-ভাসমান তাঁর দৃষ্টিতে শহরকে দেখা এর সবকিছুই রয়েছে এই শিল্পীর চিত্রকর্মে। মেট্রোপলিটন শহরের নির্মিত বড় বড় দালান, দোকানপাট সবকিছুতেই মিররের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত। এসব মিররে নানাভাবে ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে রিফ্লেলকশন দেখা যায়; ফর্মে ডেসটোরশন হয়; এই সম্ভাবনা দেখা যায় তাঁর ক্যানভাসে। শিল্পী সেতার বাজান অনেক দিন ধরে। সুরের মূর্ছনা আর ফ্লেক্সিবিলিটি রয়েছে শিল্পী সঞ্জীবের শিল্পভাবনা আর দৃশ্যপটে। হয়তো সে কারণেই মূর্ত-বিমূর্তের দোলাচলে সঞ্জীব দত্তের চিত্রকর্ম কখনো আমাদের ছুঁয়ে যায় অথবা অধরাই থেকে যায়।

      সঞ্জীব দত্ত: জন্ম ১৯৬১ সালে, চট্টগ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে এমএফএ শেষ করেন। সঞ্জীব তিনটি একক ও বহু যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন এবং নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্স শিল্পী এবং চট্টগ্রামের স্কুল অব ফাইন আর্টসের দায়িত্বে রয়েছেন।

      ইত্তেফাকে মোবাশ্বির আলম মজুমদার লিখেছেন কষ্টগুলো নদী হওয়ার আগে

      কষ্টগুলো নদী হওয়ার আগে
      লেখক: মোবাশ্বির আলম মজুমদার | শুক্র, ৯ ডিসেম্বর ২০১১, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪১৮

      সঞ্জীব দত্তের একক প্রদর্শনী

      ‘যে জীবন ফড়িংয়ের, দোয়েলের’— মানুষী জীবনের নানা বাঁকে চলতে থাকা উত্থান পতন মানুষী অবয়বের নানারূপ বিম্বিত হয়েছে সঞ্জীব দত্তের ক্যানভাসে। সমাজ কাঠামোয় রূপাশ্রিত মানুষী জীবনকে ছুঁয়ে যায় ফড়িং, পাখামেলা উড়ন্ত পাখি মানুষী অবয়বকে শিল্পী রূপ দেন পাখির ডানায়, ফড়িংয়ের অবয়বে। গত ২৬ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর ঢাকা আর্ট সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পী সঞ্জীব দত্তের ‘আমি তুমি, সে ও ইহারা’ শিরোনামের একক প্রদর্শনী। চিত্রতলে মানুষী অবয়বের নানা রূপের সাথে প্রথাগত ক্যানভাসের আকৃতি, ফ্রেমবন্দী চিত্রনির্মাণ তাঁর বিপরীত ভাবনায় আশ্রয় নেয়। কখনো ১৬টি ক্যানভাস মিলে চেয়ার আর সিঁড়ির ধাপ তৈরি করে একটি ক্যানভাসে বন্দী করেন। ‘ম্যাজিক কিউব’ শিরোনামের এ ছবিগুলোতে বাস্তবধর্মী অংকনশৈলীতে সমাজের উঁচু তলার মানুষের জন্যে নিচুতলার মানুষের পদলেহন জ্বী হুজুরী পদ্ধতির কথাকে মনে করিয়ে দেন। জিভ বেরিয়ে থাকা লোলুপ কুকুরের দৃষ্টি মানুষ পায়ে লেহন করছে পোষ্য কুকুর। বিষয়ের দিক থেকে সমাজের উঁচু তলার চরিত্রের মানুষের পায়ে হাত ছুঁয়ে বড় হওয়ার অপচেষ্টার রূপায়ন করেছেন। কোথাও শূন্য একটি চেয়ার, ক্যানভাসের কোন অংশে মানুষের দু’পায়ের কাছে তরলে চূর্ণ কাঁচের বোতলের অবস্থান তৈল মর্দনের সেই প্রবাদ বচনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ প্রদর্শনীটি শিল্পীর তৃতীয় একক প্রদর্শনী। মোট ৩৮টি কাজের মধ্যে শিল্পীর কিছু পেন স্কেচের উপস্থিতি বহুল চর্চায় ঋদ্ধ শিল্পীর রেখার গতি স্ফুরণ অনুভূত হয়। ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজ, শিল্পসত্তা, শিল্পীর প্রকাশভঙ্গি সবই আক্রান্ত হয়েছে বিশ্ব বাজারের ঝকঝকে মোড়কের আবাহনে। তাই মানুষী আকৃতির সুগন্ধির শিশি হয়ে ওঠে তার ছবির বিষয়। তার বিষয় ও রঙের দ্যুতি এক হয়ে ছবিতে এক ধরনের ফ্যান্টাসী তৈরি হয়। অনুপুংখ দৃষ্টিপাতের স্ফুরণ ঘটে ক্যানভাসে। আধা বিমূর্ত ঢংয়ে মানুষী মুখাবয়বের দৃষ্টিনন্দন অভিব্যক্তি দর্শক মনে কিছু প্রশ্ন তৈরি করে। সঞ্জীবের ছবিতে একাধারে দর্শক নিজেকে, তাকে, এবং তাদের সবাইকে খুঁজে পাবেন দৃশ্যমান অবয়ব আশ্রিত শিল্পভাষায়। উজ্জ্বল কমলা রঙের ক্যানভাসের জমিন ভেদ করে উঠে আসে একটি সুগন্ধি ব্রান্ডেড পারফিউমের বোতল। বোতলের গায়ে মানুষ ফড়িংয়ের ডানায় ভর করে ঘ্রান নিতে আসে। পুষ্প অবয়বের কর্তিত অংশবিশেষ সুগন্ধির বোতলের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ‘সে’ শিরোনামের ক্যানভাসগুলোতে শিল্পী ক্রমশ দখল হয়ে যাওয়া নগরের সুউচ্চ অট্টালিকা তার পাশের ডাস্টবিনে খুঁজতে থাকা মানুষের আকৃতি হয়ে ওঠে নগরের যাান্ত্রিক সভ্যতায় যন্ত্রাকৃতির। সুউচ্চ ভবনগুলো আধুনিকতার মোড়কে যেন বহুতল বাক্স। এই শহরের দেয়াল বেয়ে খেলা করে ফড়িং আর প্রজাপতি, কড়কড়ে টাকার নোট, মানুষ সেখানে পিষ্ট হয়েছে দেয়াল, অর্থ, আর রঙিন ফড়িয়ের যাঁতাকলে। লাল সবুজ ক্যানভাসের গায়ে ছুটে বেড়ায় আনন্দের প্রতীক পত্রপল্লব, বস্তাবন্দী বস্তুর গায়ে একটি সবুজাভ পায়ের উপস্থিতি, ছুরি কাঁচির এলোমেলো উপস্থিতি সমাজ ব্যবস্থার কুিসত প্রতীকী উপস্থাপনা নির্দেশ করে। শিল্পী সঞ্জীবের এবারের ক্যানভাসে নগরের সুউচ্চ ভবনের সাথে অবস্থানরত মানুষকে সে হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এই মানুষগুলো কখনো দেয়ালে হেলান দেয়া আয়েশি ভঙ্গিতে কখনো ঝোলা কাঁধে ডাস্টবিনের পাশে উচ্ছিষ্টের খোঁজে ব্যস্ত। সাদা-কালো গতিশীল রেখা পতঙ্গের আকৃতি ধারণ মানুষকে ফড়িংয়ের সাথে তুলনা করেছেন। নারী কিংবা পুরুষ, আকাশ অথবা বৃক্ষের আকৃতি সবই উঠে এসেছে সঞ্জীবের ক্যানভাসে রূপক হিসেবে। চলমান সমাজ সংসারে নিত্য ঘুরপাক খাওয়া মানুষই তাঁর ক্যানভাসের প্রধান বিষয়।

      সঞ্জীব দত্ত: ১৯৬১ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক চারুকলা বিভাগ) বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউটের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এশীয় দ্বিবার্ষিক, জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীসহ ২১টি দলীয় প্রদর্শনীতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তাঁর মোট তিনটি একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে স্বাধীন চারুশিল্পী হিসেবে কাজ করছেন।

  3. মাসুদ করিম - ১৩ জানুয়ারি ২০১২ (১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ)

    আজ কালের কন্ঠের সাময়িকী শিলালিপিতে মইনুদ্দীন খালেদ লিখেছেন সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনী নিয়ে : সঞ্জীবের ফড়িংডানার বালক

    নগর কেবলই আকাশচুম্বী হচ্ছে আর বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে জীবন। দালান যতই মসৃণ, চক্চকে, রঙিন হয়ে উঠছে, ততই প্রকট হয়ে উঠছে তার পাশে শ্রমিকের মলিন রূপ। কোথাও অর্থনীতির মারকুট খেলা চলছে। নগরায়ণ থেমে থাকে না। কে অর্থ জোগান দেয়। জীবনের শিবত্ব কেন ঘুচে যাচ্ছে। মানুষ মানুষকে আর জড়িয়ে ধরছে না। একা হয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে একজন অন্যজনকে দেখছে। মধ্যবিত্তও আর সংবেদী নেই। সেও কেবলই অভ্যাসের দাসত্ব করছে। কোথাও মানুষ বাঁচানোর, সংস্কৃতি বাঁচানোর গভীর কোনো প্রণোদনা নেই। সবই বাণিজ্য। করপোরেটের ছায়ায় ঝিলমিল করছে বুদ্ধিজীবীর সুখ। যত কথা তত অর্থ। কথার কারবারি, শিল্পের নামে দৃষ্টিনন্দন ইমেজ রচনা, একই সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি করে শিল্পপতিকে তোয়াজে নরম করে তা বিক্রি করা; ভণ্ডামি খলখল করে হাসছে। এসব দেখে যেতে হচ্ছে। দালান উন্নত বিশ্বের মতোই, কিন্তু নগর পূতিগন্ধময়। সেই দালানের পাশে গৃহহীন মানুষ_এই বৈপরীত্যের চাবুকি আঘাত সঞ্জীব দত্ত অনুভব করেন। এ রকম অনুভব করা আজ বোধ হয় গেঁয়ো ব্যাপার। কী সরস কণ্ঠে মাইকের জোরে সরবতর করে বৃদ্ধিজীবী ও শিল্পীরা বলছেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলে যাবে। এটাই নিয়ম।’ কিন্তু ফুটপাতে কি মানুষ রাত যাপন করছে না! নগরপ্রান্তে ও রেললাইন ধরে যে ঔপনিবেশিক কাল থেকে চলে আসা মানবেতর বস্তি, তা কি বেড়েই চলছে না? তাহলে জীবনের উন্নতিটা কোথায়? এসব প্রশ্ন ও ভাবনা ঢাকা আর্ট সেন্টারে সমপ্রতি অনুষ্ঠিত সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী ‘আমি তুমি সে ইহারা’র বিশ্লেষণে কারো কারো অহেতুক মনে হতে পারে।
    কিন্তু এই শিল্পীর প্রধান কাজগুলোতে অর্থনীতির বৈষম্য ইমেজের বিপ্রতীপ উপস্থাপনে স্পষ্টতর হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। মানবমন-নিরপেক্ষ কোনো বস্তুর অস্তিত্ব আছে কি না তা নিয়ে দর্শনশাস্ত্রে গভীর বিতর্ক আছে। কিন্তু শিল্প এখনো বস্তু-অভিজ্ঞতানির্ভর। চারপাশের বস্তুপুঞ্জই মনের মধ্যে আন্দোলন আনে। সেই আন্দোলনকে নানা রাগে-রূপে, সুরে-কথায় কাঠে-পাথরে ছেনে ছেনে তবে শিল্প। সঞ্জীব সেই নগরে তাকান। সেখানে স্বপ্নের মতো রঙিন দালান। এই শিল্পী স্বপ্নময়তাকে নিরঙ্কুশ প্রশ্রয় দিয়েছেন। দালান তাই যতটা রঙিন, তার চেয়েও রংময় করে চিত্রিত করেছেন তিনি। হঠাৎ মনে হয় স্বপ্নপুরী। কেননা দালানের পাশে ডাস্টবিনে যে পথবালক আবর্জনা কুড়িয়ে বস্তায় ভরছে, সেও রঙিন এবং সবচেয়ে বড় কথা, সেই বালক যেন পাখিবালক, ফড়িংবালক; কেননা তার কাঁধে ডানা আছে পাখিদের মতো। দালান, পথবালক, আবর্জনা_সবই রঙিন হয়ে গেল শিল্পের প্রয়োজনে। সেই টোকাই বালক যেন এলিয়েন বা আগন্তুকের মতো। নগরের সৌধের পাশে সে বিস্ময়। স্বপ্নপুরীর মতো আবহ সৃষ্টি হওয়ার আরো একটি বড় কারণ বাস্তববাদের কানুন গ্রাহ্য করেননি সঞ্জীব। সৌধায়নে তিনি পরাবাস্তবের অচিন নিয়মটাই অবলম্বন করেছেন। তাই কংক্রিট ও ধাতব ইমারতের পাশের বাঁশের বেড়ার বস্তি সবই স্বপি্নল উপাদানেরই অংশ হয়েছে। মলিনতা ও দারিদ্র্যের জর্জর ভাবটা কোনো অনুষঙ্গে লক্ষ করা যায় না। তবে ফেলনা-কুড়ানো বালকের হাতে যে বস্তাটা তা সিমেন্টের। বস্তার গায়ে ‘সিমেন্ট’ কথাটা ইংরেজিতে লেখা। এই শব্দটা ইমেজের বৈচিত্র্যের পাশে অক্ষর বা টাইপোগ্রাফির মাধ্যমে নগরের রূঢ়তা পরিহাসময় করে রেখেছে। দালানের গায়ে দালানের ছায়া, দালানের গায়ে স্থপতির রৈখিক ডিজাইন_এসবও যোজন করেছেন সঞ্জীব। আর্কিটেকটনিক বাস্তবতাকে তিনি নানাভাবে জাগর রেখেছেন। এসব অনুষঙ্গের সমন্বয়ে ফ্যান্টাসি জমে উঠেছে। হলুদে-ম্যাজেন্টায়-সবুজে আর গোলাপি মিলিয়ে যে কালারস্কিম বা বর্ণজোট দিয়ে ইমেজ অত্যুজ্জ্বল করেছেন সঞ্জীব, তাতে শিল্পীমনের জীবনজগৎ দেখার একটা বিশেষ ভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। এই কসমেটিক বর্ণপ্রলেপের আড়ালে জীবনের নিষ্ঠুর সত্য আছে। এটা সেই বৈষম্যের সত্য, যার মুখোমুখি হলে সংবেদী মন দুঃখভার লাঘব করার জন্য কষ্টের হাসি হাসে কিংবা সার্কাসি পোশাক পরে জীবনের কষ্টের দাগগুলো আড়াল করে রাখে। সঞ্জীবের কাজ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে তিনি রঙিন ও সুররিয়ালিজমের আবহ সৃষ্টি করেছেন সমাজের রূপটাকে বিশেষ তীক্ষ্নতা দেওয়ার জন্য। সমাজ নিয়ে নতুন করে ভাবার জন্য তাঁর এই আয়োজন। তাঁর কাজ প্রথমত দৃষ্টিনন্দন_ চোখকে সুখ দেয়। কিন্তু পরিণামে তা সমাজের সমালোচনা।
    সঞ্জীবের কাজে রৈখিক পরিমার্জনার অনুষঙ্গ আর বর্ণপ্রলেপের অনুষঙ্গ মিলে সংঘর্ষ তৈরি হয়েছে। এই পরিমার্জনা আমেরিকা ও ইউরোপের নিও-এঙ্প্রেশনিস্ট ভাষা থেকে সংগৃহীত। সঞ্জীবের আগে এ দেশের অন্য শিল্পীরাও দৃশ্যমান বাস্তবতা যে বহুস্তরী, তা জানান দেওয়ার জন্য এ ধরনের চিত্রগত নিরীক্ষা করেছেন। সঞ্জীবের শিক্ষকরাও সে ভাষায় ছবি আঁকেন। দ্বিমাত্রিক চিত্রতলে কিভাবে কত বেশি সংঘর্ষের নাটক জমানো যায়, তার প্রয়াস থাকে এ ধারার চিত্রচর্চায়।
    ‘ম্যাজিক কিউব’ নামের যে ছবি সঞ্জীব এঁকেছেন, তাতে রাজনীতিসচেতন মনটার প্রত্যক্ষ প্রকাশ লক্ষ করি। ক্ষমতা, চাটুকারিতা, লোভ-লোলুপতা অনেকগুলো চৌকোণাকৃতি স্পেসে ইমেজজুড়ে উপস্থাপিত করেছেন। মানুষের পা, কুকুর, পা চাটা কুকুর, মদের বোতল, ঘাড় মোটা সপ্রিংয়ের চেয়ার, মুকুট_এসব মিলিয়ে সময়ের ম্যাজিক বা ভেল্কি উন্মোচন করেছেন শিল্পী। তবে দালানের পাশে মানুষের অবস্থিতি নিয়ে তাঁর যে ছবি, তা ‘ম্যাজিক কিউব’-এর চেয়ে ধারালো ও শিল্পগুণমণ্ডিত।
    মানুষ কেন ফড়িংডানা পেল? এ প্রশ্নে যতই কবিতার মতো সুখ থাকুক না কেন, তা আসলে সুখের নয়। তার ফড়িংডানার বড় কারণ তা তার আত্মরক্ষার বর্ম অথবা এই পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব একই সঙ্গে ভঙ্গুর, বিপজ্জনক, ক্ষণস্থায়ী, বিসদৃশ। প্রকৃতির মধ্যে হয়তো ডানাঅলা বালক শোভমান, কিন্তু ইমারতের বন্দি নগরমঞ্চে তা অসম্ভব স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সেই ফড়িংডানার বালক সঞ্জীবের নিজের সৃষ্টি, সে তাঁর স্বরচিত নাটকেরই কুশীলব। এটি একটি চিন্তাগর্ভ শিল্পভাবনা বলে বিবেচনা পেতে পারে। তবে কর্কশ রূঢ়তা নয়, বা রূঢ়তা নির্ভর করেছে কাব্যময়তায়। জীবনানন্দের কবিতাই যেন চিত্ররূপময়তা পেয়েছে। মানবতাহীন সমাজের দিকে তাকিয়েই তো কবির উচ্চারণ :
    ‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে
    তার হয় নাকো দেখা…’

  4. মাসুদ করিম - ১৪ জানুয়ারি ২০১২ (১১:২৮ অপরাহ্ণ)

    ইংরেজি পত্রিকা ইন্ডিপেন্ডেন্টে সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় চিত্রপ্রদর্শনী চলাকালীন সময়ের সাক্ষাৎকার : Reflections of an artist

    DhakaLive shares modern artist Sanjib Datta’s views of society and the artist’s role in it

    Sanjib Datta is one of the Bangladeshi artists who are based in Chittagong, with an MFA from the University of Chittagong, he has continued to live and work in the port city. He tried his hand at teaching at his alma mater for a while but returned to his first love, art, after a short stint. Since 1993, he has worked on his art and is the director of an art school, which also functions as his studio. Bespectacled with a clean shaven head, Datta is a young looking 51 year old, whose third solo exhibition, I You S/he They ended yesterday at the Dhaka Art Centre (DAC), is also an accomplished sitar player. Showcasing his art for the first time in the capital, his mixed media artworks reflect his passion for the fine arts. He shared his ideas and inspirations for the paintings with Nusrat Daud Pritha.

    Who or what encouraged you to become an artist?
    Everyone is an artist in young age as they all have to draw in school, but it was my father’s mama (maternal uncle) who’d studied in Kolkata who influenced me when I was younger. Art was not practised in the mainstream as it is now and he made the sets and sceneries for theatre. I was very young, in class three or four, but both my father and his uncle encouraged me, which planted the seed of inspiration in me. At one point my family expected I should train as a doctor so I did as they wished for a little while but art drew me to it, so I lost two years by giving up all ideas of becoming a doctor, instead I enrolled in the what was then the Chittagong Art Collage and now the Department of Fine Arts at the University of Chittagong in 1980.

    Which medium do you prefer to use the most in your art?
    When I started out nearly 21 years ago, I was a great fan of oil paintings but these days, I find myself leaning more towards acrylic and fabric colours. The problem with oil as a medium is that it takes a lot of time to paint, and our weather is not very suitable for working with oil. But acrylic and fabric paint lets me work at a faster pace and I can finish a painting in a short time.

    What themes do you find dominates your art?
    I tend to use everyday items as subjects in my painting. I feel these objects have the ability to tell the story of our past, the truth. For my debut exhibition at the Chittagong Shilpakala Academy, the paintings I showcased were inspired by Jibanananda Das’s poem ‘Phoring’ or dragon fly. They came to signify life’s trivial things for me. Then for my second exhibition, it was posters of advertisements that triggered the art, because what we often see in many posters is a person being overly exposed to sell a product, but for me the impact of these ads is the opposite. So I focussed on that to reduce the gap in subjectivity, I used things such as perfume bottles and so on. Now for my third exhibition, the dragon flies have returned, but now they signify something slightly different. They are still symbols of trivial things but have merged in some ways with the ‘tokais’, street urchins. I morphed man, dragonfly and alien together, to me that is what they are. I wanted to make people ask of themselves what they think these children living on the streets to be. Are they included in the national consensus? And so on. By summing up the paintings from my exhibitions, I can see how I have merged the mutual interaction of object, spectator, artist, society and state through which a communication or dialogue is created in our minds both structurally and abstractly. I have therefore called the third exhibition, I You S/he They, as an abstract presentation of the inner realities of the objects around us.

    As an artist what is the best piece of advice you have received?
    It is hard to pin point just one piece of advice, but if I had to pick one, or one that is etched in my mind, then it is what the artist Dhali Al Mamun always said, he was my outdoor instructor as an art student. He always reminded us to be silent and neutral observers of society, to emphasise on how we are only a tiny part of a bigger picture. His words still inspire me and keep me focused as an artist. There were others as well, such as Ranjit Das and Chandra Shekhar Dey who also inspired me.

    What is your dream project?
    My dream project could very well be my upcoming project. I don’t want to reveal too much about it, but I have a plan to work with borders next time. I want to portray what happens before and after a partition or separation. I want to portray the art, the art practises, society, people’s mentality and the politics of the two Bengals. It will also show the differences and the sorrows, the idea is still raw and I am not sure how I will go about it but it is what I really want to do and is my next project.
    How does the art scene in Dhaka differ from Chittagong’s? Does it differ at all?
    As for the art itself, I really don’t see that much difference. However, in Dhaka there is a market for art, a demand for art and there are many galleries where you can show case your work. In Chittagong, the demand for works of art is not as developed as it is in Dhaka; here there is certainly a growing demand.

    Tell us a bit about your music?
    I didn’t want to share this part with everyone but the DAC’s trustee Nisar Hossain was adamant I should play the sitar at the inauguration. I learned from my uncle, the same one who encouraged me to paint, who inspired my interest in music, He played the violin and when I was in art college I met many musician including sitar players, and so I picked it up in their company, in fact my first sitar was actually meant for women to play. I continue to practise under my teacher Satyajeet Chokroborti, with whom I have learned for nearly 26 years now. It is a hobby for me, something that I do when I want to relax, but it is also for me, painting but with tunes. Both art and music have the power to take us on a spiritual journey.

    Among the paintings displayed in this exhibition, do you have a favourite artwork?
    There are plenty here I like. If you consider the range from ‘S/he’ you will see that people who are trapped in human bodies wanting to fly but they don’t have wings, where as eagles have wings to fly, and the figures look down, not for food, but to find company in their own shadow.

  5. মাসুদ করিম - ১৪ জানুয়ারি ২০১২ (১১:৩৬ অপরাহ্ণ)

    সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’এ শিল্পী সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় প্রদর্শনী নিয়ে জাহিদ মুস্তাফার রিভিউ : নাগরিক শিল্পীর পতঙ্গ চোখে

    নাগরিক শিল্পীর পতঙ্গ চোখে

    জাহিদ মুস্তাফা

    চেনা জগতের মাঝেই যেন অচেনা এক জগৎ খুঁজে বেড়ায় পতঙ্গ। নগরবাসীর নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, দুঃখ-দারিদ্র্য, আচার-অনাচার, আনন্দ-বেদনা অবলোকন করে তারা। পতঙ্গের চোখ দিয়ে দেখা এসব ঘটনা সমতলে সাজিয়ে তোলেন শিল্পী তাঁর কাগজে-ক্যানভাসে। তিনি সঞ্জীব দত্ত। চট্টগ্রামে জন্ম, শিক্ষাও ওখানে। ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন।

    আশি থেকে নববই। গত শতকের উত্তাল ও ঘটনাবহুল একটি দশক। শিল্পী সঞ্জীব দত্ত এই সময়কালে গড়ে উঠেছেন। একদিকে নিজর শহরের মেট্রোপলিটন রূপ ধারণের নানা পর্যায় তিনি যেমন অবলোকন করেছেন, তেমনি সে-সময়ের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক নানা টানাপড়েন, অপরাধ-অন্তর্ঘাত তিনি দেখেছেন। এসব দেখার উপলব্ধি তাঁর মনে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে – প্রধানত সেগুলোই তাঁর শিল্পী মানস গড়েছে। আর তাঁর চিত্রপটে আমরা দেখি নাগরিক যন্ত্রণা আর নগর ভাগাড়ের সারাৎসার।

    সম্প্রতি ঢাকা আর্ট সেন্টারে শিল্পী সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে গেল। ২৬ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল – ‘আমি তুমি সে ইহারা’। তাঁর প্রথম দুটি একক হয়েছে চট্টগ্রামে – প্রথমটি শিল্পকলা একাডেমী ও দ্বিতীয়টি আলিয়স ফ্রঁসেজে। প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলো সম্পর্কে শিল্পীর ভাষ্য প্রসঙ্গক্রমে তুলে ধরা প্রয়োজন। তিনি নিজ ব্রোশিওরে লিখেছেন – ‘তুচ্ছ জীবনের রূপক হিসেবে ক্ষুদ্র পতঙ্গ ফড়িংকে অবজেক্ট করে আমার প্রথম প্রদর্শনী ছিল। দ্বিতীয় প্রদর্শনীতে সেই রূপক ফড়িংয়ের সঙ্গে অবজেক্ট হিসেবে এলো পণ্যের বিজ্ঞাপনে তার ব্যবহারবিধি ও মোড়কের রকমারিতা। তৃতীয় প্রদর্শনী – ‘আমি তুমি সে ইহারা’তে রূপক ফড়িংকে বহুমাত্রিকতায় যেন অবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারি তার প্রচেষ্টাস্বরূপ এই প্রদর্শনীর সকল ছবির অবজেক্ট নির্বাচিত।’

    ক্ষুদ্র পতঙ্গ ফড়িংকে বহুমাত্রিক রূপে দেখিয়েছেন শিল্পী। সমাজ পর্যবেক্ষণে এটি শিল্পীর নিজস্ব একটি পদ্ধতি। নগরবুকে তিনি যেন ফড়িংয়ের মতো উড়ে বসে, সেটির চোখ দিয়ে অবলোকন করছেন নানা দৃশ্য। বৈরী সময় ও পরিস্থিতির ভেতর নিজেকে মানিয়ে নিয়ে রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে আপস করে টিকে থাকা অস্তিত্ব নিয়ে মানুষ মাটি কামড়ে বেঁচে থাকে। তখন অনুসন্ধিৎসু মন অবচেতনভাবেই সন্ধান করে মুক্তির পথ। শিল্পীর মুক্তি তাঁর সৃজনকর্মে। সঞ্জীব দত্ত এভাবেই নিজের মনোচেতনার মুক্তি খুঁজেছেন।

    তাঁর চিত্রকর্মের শিরোনাম গভীর ভাবনার উদ্রেক করে দর্শক মনে। যেমন – ‘কষ্টগুলো নদী হওয়ার আগে’, ‘বাতাসে যে কথা’, ‘ফাঁদ’, ‘চিত্রকল্প’, ‘অচিন পাখি’, ‘নির্দেশ ব্যতীত যন্ত্র করে না কাজ’, ‘বশীকরণ’, ‘সে’। এসব কাজের ভেতর রং ও রেখার প্রয়োগ এবং কৌণিক গঠন নতুন নতুন ভাবনাকে উস্কে দেয়। ক্যানভাসের পরিধির মধ্যে শিল্পী যখন সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি – তখন তিনি সেই সীমানা অতিক্রম করারও প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন – ‘ফাঁদ’ নামক চিত্রকর্মটির মূল চিত্রপটে এক নারীর শরীর ভঙ্গিমার সঙ্গে অবয়বযুক্ত হয়েছে আলাদা ছোট ক্যানভাস। ফলে চতুষ্কোণ ক্যানভাস এখানে আরো দুটি কোণ পেয়ে গেল।

    চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে কথা বলা দরকার শিল্প সঞ্জীব সাহার বরাত ধরেই। সমুদ্র আর পাহাড়বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম শিল্প-সংস্কৃতিচর্চায় বাংলাদেশে ঢাকার পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে। ঢাকার শিল্প-আন্দোলনের পশ্চাদভাগে ছিল কলকাতা আর্ট স্কুলের অ্যাকাডেমিক ধারাবাহিকতা। কিন্তু চট্টগ্রামে শিল্পচর্চার আধুনিকতা এসেছে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর হাত ধরে। তিনি যদিও জয়নুল আবেদিন প্রবর্তিত ঢাকা চারুকলার ছাত্র, তথাপি তাঁর মানস গঠনে তাঁর ইউরোপে উচ্চশিক্ষাগ্রহণ এবং দেশের লোকশিল্পের প্রতি প্রগাঢ় টান সক্রিয় থাকায় চট্টগ্রামে তিনি শুরু করেছিলেন নতুন চিন্তা-চৈতন্যের শিল্পচর্চা ও শিক্ষাদান। রশিদ চৌধুরীর সেই শিল্পভাবনা ও চৈতন্যের ধারক হয়েছেন তাঁরই কতক প্রিয় ছাত্র – যাঁরা বর্তমানে চট্টগ্রামের চারুকলা অঙ্গনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে আছেন। সঞ্জীব দত্তের শিল্পের অধ্যবসায় তাঁদের হাত ধরেই। রশিদ চৌধুরী ও তাঁর ছাত্রদের কাজে লোকশিল্পীদের পছন্দনীয় রং, স্টাইল ও কনসেপচুয়াল স্বাতন্ত্র্য ঢাকার শিল্পীদের কাজ থেকে তাঁদের কাজকে আলাদা করে।

    চট্টগ্রামের নগরায়ণ দেখেছেন শিল্পী সঞ্জীব। তাঁর চোখের সামনেই একে একে গড়ে উঠেছে স্কাই স্ক্র্যাপার, বড় বড় ভবন, শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট।

    শিল্পী পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ হিসেবে জীবনের প্রতিটি দৃশ্যকল্প নানা স্তরে, নানা ডাইমেনশনে দেখেছেন। তা হয়তো নিজের অবচেতনে ছায়া ফেলেছে – সেই প্রভাব এসেছে সঞ্জীবের চিত্রকর্মে। ক্ষুদ্র পতঙ্গ ফড়িংয়ের ভাসমান দৃষ্টিতে নগরকে দেখা, নগরের নানাবিধ ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ে শিল্পীর কৌতূহল ও কৌতুক যেন উঠে এসেছে একেকটি চিত্রতলে।

    নগরের ময়লা-আবর্জনা ঘেঁটে নানা বস্ত্ত আহরণকারী বা টোকাই নিয়ে শিল্পী রফিকুন নবী অসংখ্য কার্টুন এবং ছবি এঁকেছেন। সঞ্জীবের চিত্রকর্মেও আমরা এরকম টোকাই দেখি; কিন্তু সে তার ফড়িংয়ের রূপে চিত্রপটে এসেছে এবং তার অবয়ব, শরীর যেন স্টিলের তৈরি – অনেকটা রোবটের মতো। ‘সে’ নামে নামকরণ হয়েছে এগুলোর। ‘চিত্রকল্প’ শিরোনামে তাঁর একটি কাজ দেখলাম – এটিতে রৌদ্রবিদ্ধ দু’জন নর-নারী উপবেশনরত, তাদের মাথার উপরে বস্তার মতো একটা ঘেরাটোপ, আর তার গায়ে অসংখ্য পতঙ্গের ওড়াউড়ি। মনে পড়ে সেই শ্লোক – ‘পিপিলিকার পাখা হয় মরিবার তরে।’ এ-কাজটি যেন ভুমিকম্প, অগ্নিকান্ড কিংবা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নগরের ধ্বংসবারতা নিয়ে এসেছে।

    মহানগরীর বিশাল ভবন, মার্কেট, দোকানপাট এসবে আয়নার অনেক ব্যবহার করেছেন শিল্পী। এগুলোর বিম্ব-প্রতিবিম্ব এমনকি তার ভঙ্গুরতাও ফর্মে এসেছে। তবে এসবের চেয়ে শিল্পীর ‘মানুষ ও ফড়িং’ এবং ‘কষ্টগুলো নদী হবার আগে’ শীর্ষক চিত্রকর্মগুলো ব্যতিক্রমী ও অনুভূতিপ্রবণ। প্রথম কাজটিতে বর্ণ-প্রয়োগে হলুদ-সবুজাভ পটভূমে একটি ফড়িংমানব যেন ফুলবাগান কিংবা নিসর্গের মধ্যে নিজের আরাধ্যকে খুঁজছে। দ্বিতীয় কাজটি যেন নিশ্চল স্থাণু কঠিন পাথরের বুক চিরে কান্নার আবেগকে তুলে ধরে অতলস্পর্শী কষ্টকে প্রকাশ করেছে। কাজ দুটি সঞ্জীব দত্তের অন্যরকম উন্মোচন।

  6. মাসুদ করিম - ২৮ নভেম্বর ২০১৪ (৯:৫৩ অপরাহ্ণ)

  7. মাসুদ করিম - ১২ আগস্ট ২০১৭ (৬:২৪ অপরাহ্ণ)

    A call for simplicity in life
    Mixed media exhibition of Sanjib Datta

    Sanjib Datta, 51, shaven headed and wearing rectangular spectacles, has displayed his mixed media works at a solo exhibition at the Dhaka Art Centre. He combines surrealism with symbolism to drive home his message. Like most artists in Bangladesh, Datta holds up the mirror to the bitter realities of the current socio-economic and political scenario. His paintings have a soul-pitch, like many Chittagong-based artists, such as Laila Nazlee Mansur, Nilofar Chaman and Alok Roy.
    Datta’s protagonists are men with wings and pixie-faces. At times they appear like Spiderman going through the rubbish of the city. All around are the overwhelming concrete jungle. The high-rises often bear glass fronts, as if the tall buildings are cages are made of cement and glass. The humans outside are adult Tokai, who rummage the rubbish bins for syringes, which may have been used to administer drugs. The raw manner of drawing attention to the misdeeds is startling, as is often the case with avant-garde artists.
    The figures can be seen as futuristic, or borrowed from science fiction. The creatures on the canvas are like sentinels, who warn mankind to arrest material progress at the cost of cultural values. Industrial and material progresses are not all there is to life, believes Datta, like most artists of the 20th and 21st century. At times the winged creatures are shown to literally attack the Bangladeshi Taka notes, almost like honeybees, geared to collect materials. “People have lost their dreams of living in peace and harmony, in their quest for material progress,” says Datta, who laments the loss of simplicity and harmony in contemporary existence.
    In presenting overt shapes of perfume bottles along with female models, with their outthrust bosoms, he highlights the boldness but emptiness of contemporary, urban living. The male figures reveal an undue exposure of their bodies.
    Datta is a modern artist, out to shock the viewer into realising the hedonism and corruption around — where there is laundering of black money and undue crashes in the stock market. Sure, money and material comforts are essential in life, Datta says, even as he questions, “Should an individual forget his roots and indulge in selfish hedonism?” Unwanted elements are thrown into the rubbish bins, which are later found in the garbage by the cleaning man. The artist delineates this ugliness in graphic details to shake us out of our complacency.

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.