বাতাসে যে কথা

প্রথম ছবিটি শুরু হয়েছিল একজন বোতলবন্দি মানুষকে দিয়ে, খালি পারফিউম বোতলের ভেতর বসে আছে মানুষটি[...]

গত ৩১ জুলাই শিল্পী সঞ্জীব দত্তের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। এই জন্মদিন উপলক্ষেই ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত শিল্পীর দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে আমার সেই সময়ের একটি লেখা এখানে তুলে দিচ্ছি। শিল্পী সঞ্জীব দত্তের তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনীর প্রস্তুতি চলছে – এবারের প্রদর্শনীটি হবে ঢাকায়, ঢাকা আর্ট সেন্টারে এবং অনুষ্ঠিত হবে এবছরের ২৬ নভেম্বর থেকে ০৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ছবি আঁকার জীবন এক অনন্য জীবন। বর্ণলেপনের শিল্প। ইউরোপীয় পেইন্টার শব্দটি এতই কারিগরি শব্দ এবং এই বৃত্তির বিকাশ ওই মহাদেশে এতই সহজাত সচল বাস্তব যে একে যারা চিত্রশিল্পে উন্নীত করেছিলেন তারা একেকজন আমাদের সানাইয়ের বিসমিল্লাহ খাঁ। বাংলায় পটুয়া বা চিত্রশিল্পী যাই বলি না কেন শুরু থেকেই তা শিল্পকর্ম এবং কারিগরি বিদ্যা হিসেবে এর পুনঃপাঠ আমাদের ইতিহাসের উপনিবেশিক তাৎপর্যে নবজাগরণের এক অনবদ্য ঘটনা। বর্ণলেপন ও অঙ্কন এই দুই বিদ্যার সৃষ্টিশীল চিত্রভাষা আজকের একজন চিত্রশিল্পীর অনন্য আরাধ্য। তাই বলছিলাম ছবি আঁকার জীবন ও বর্ণলেপনের শিল্প এক অনন্য জীবন। আমাদের সুপরিচিত সুহৃদ শিল্পী সঞ্জীব দত্ত পেইন্টারের জীবনযাপন করেন। চিত্রভাষার প্রয়োগে শিল্প সৃষ্টি করেন। কবিতায় জারিত হন। স্নায়ুতে সঙ্গীতকে ডিকোড করেন। ফিল্মে কেঁপে ওঠেন। তার ছবিতে চিত্রকলা কবিতা ও সঙ্গীতের খুব সংহত এক রূপ আমরা দেখেছি, এবার তার সাথে মিশেছে চলচ্চিত্র। অনেক বাদানুবাদের পর এবার তার কাজে এল আধুনিক বাস্তবতা – কিন্তু বিদায় নেয়নি আগের বিমূর্ততাবাদ ছাপবাদ প্রকাশবাদ প্রতীকবাদ আধুনিকতাবাদ। তাই ‘বাতাসে যে কথা’ – এপ্রদর্শনীতে আমরা দেখলাম কিছু বহুত্ববাদী সমবায়ী ক্যানভাস, শিল্পীর সম্ভাবনার পরিণতির শুরু।

২০০৬-এর শেষ দিকে ডিসেম্বর ১৭ থেকে ২১ চট্টগ্রাম অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল সঞ্জীব দত্তের দ্বিতীয় একক শিল্প প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর নাম ‘বাতাসে যে কথা’। চার ফুট বাই চার ফুট মাপের আটটি তেল রঙের ছবি, কয়েকটি স্থাপনা, শিল্পীর নিজের পরিকল্পিত সঙ্গীতের অবিরাম আবহ, স্বয়ংক্রিয় পারফিউম স্প্রের নির্দিষ্ট সময় পরপর ছড়িয়ে দেয়া পারফিউম : ছবি স্থাপনা শব্দ গন্ধ এসব নিয়ে এই শিল্প প্রদর্শনী, সচেতনভাবেই তাই প্রদর্শনীর ক্যাটালগে লেখা ছিল Art Exhibition।

২০০৫-এর এপ্রিলে তার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী শেষ হয়ে যাওয়ার কিছু দিন পর থেকে তার মুখে বারবার আমি আমি নিঃশেষিত পারফিউম বোতলের কথা শুনতে পেতাম, তিনি বলছিলেন আমাদের প্রিয় পারফিউম বোতলের কথা, তার প্রতি আমাদের যত্নের কথা; কিন্তু শেষ হয়ে যাওয়ার পর কী মূল্যহীন এই বোতল, কী অবহেলায় পরিত্যক্ত সে বোতল : নির্যাস নেই তাই নিগৃহীত। তখন থেকেই প্রদর্শনীর নাম খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন শিল্পী, খুব আগ্রহ বোধ করলাম, এভাবে কাজ শুরুরও আগে নাম খুঁজে বেড়ানো খুব ভাল লাগল। কয়েকদিনের মধ্যেই নাম খুঁজে পেলেন তিনি – বাতাসে যে কথা – ঠিক সেদিন থেকেই আগ্রহী হয়ে উঠলাম আমি প্রদর্শনীটির বিষয়ে।

আজ যখন প্রদর্শনীটি শেষ হল তখন একথা ভাবতে খুব ভাল লাগছে এরকম একটি প্রদর্শনীর সাথে আগাগোড়া জড়িত ছিলাম আমি।

এই প্রকল্পের প্রথম ছবিটি শুরু হয়েছিল একজন বোতলবন্দি মানুষকে দিয়ে, খালি পারফিউম বোতলের ভেতর বসে আছে মানুষটি, বোতলের কাঁকের ক্রিস্টালিটির ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার বিষণ্ণ মুখ, এই বিষণ্ণতা আরো অমোঘ হয়ে ওঠে ক্যানভাসের বাম কোণে তুতেনখামেনের মুখের বর্ণাঢ্যতায়। শুধু তাই নয় বেদনার লালে ঢেকে যায় মোগল খিলান, তার সামনে তীরবিদ্ধ কস্তুরীমৃগ, সুগন্ধদানিতে কস্তুরী, মোগল নাগ্রা। ক্যানভাসের ডান দিকে এক জরাজীর্ণ ঘরের আবহ, পড়ে আছে বহু ব্যবহৃত স্যান্ডেল, মদের বোতল। এই ছবিটিকে আমি বলতে চাই একজন শিল্পীর প্রতিকৃতি। একজন বহুত্ববাদী সমবায়ী শিল্পীর প্রতিকৃতি। ‘বাতাসে যে কথা’র শিল্পীর প্রতিকৃতি। বর্ণলেপনে দীপ্তি বর্ণলেপনে ক্ষরণ, জড়জীবন চিত্রের ধরনে মদের বোতল, স্যান্ডেল ও মোগল নাগ্রার স্পষ্ট ও অভিব্যক্ত উপস্থিতি, পিরামিড ও প্রাচীন পাত্রের আভাস : সব মিলিয়ে ক্ষমতা ঐশ্বর্য নিঃস্বতার ভেতর সব যুগে শিল্পীকে বেঁচে থাকতে হয় কোনো এক সুগন্ধদানিতে কস্তুরী হয়ে থাকবে বলে।

দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম এই চারটি ছবি বিজ্ঞাপন মডেল, যাদের শিল্পী পণ্যমানুষ বলছেন, তাদের নিয়ে। দ্বিতীয় ছবিতে মডেলকে দেখা যাচ্ছে ক্যানভাসের ডান দিকে চলচ্চিত্রের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ক্লোজআপে র‌্যাম্পের উচ্ছ্বাসে : তার নীল চুল, সোনালি বক্ষদেশ, সাটিন রোব, উদ্ভাসিত হাসি সবকিছু মিলিয়ে এমনই এক উপস্থিতি তার, এমনই এক অধরা অবস্থান, যেন পৌরাণিক নেফারতিতি, যেন আইফেল টাওয়ার। কিন্তু তার পাশে পড়ে থাকা বোতলবন্দি মানুষটি যেন এক জড়জীবন, তার আশেপাশের মদের বোতল, টাই, পড়ে থাকা শিশি, স্যান্ডেল, কাগজের বাক্সের মতোই সে একজন বর্জ্য, দাঁড়িয়ে আছে নিঃশেষিত পারফিউম বোতলের ভেতর। মডেলের এই অতিমানুষতা আসলে মানুষের পণ্যতা, বোতলবন্দি মানুষটি বর্জ্য এই পণ্যতার। এই ছবির মধ্যে একটি রক্তবাহী নল দেখা যায় যা এমন একটি যোগাযোগ তৈরি করে বর্জ্য ও পণ্যমানুষের মধ্যে যে সেই উষ্ণ রক্তিম স্থিতিস্থাপকতা ছবিটি না দেখলে বুঝবার নয়। তৃতীয় ছবিটিও মডেল বা পণ্যমানুষ নিয়ে। কিন্তু এখানে ভেসে ওঠে মডেলের উদ্দামতা। শিল্পী এখানে মডেলের নাভি, নীল ব্রার স্তনবৃন্তের অঞ্চল দুটো বিকৃত করেন, মুখে মেখে দেন উন্মাদ উল্লাসের সব রঙ। এছবিতে তাজমহলকে মনে হয় বর্জ্য, যেন পড়ে আছে শূন্য পারফিউম বোতলের মতোই, প্রেমহীন এক আবহ, বোতলের ভেতর বন্দি মানুষটি এখন কুঁচকানো কাগজের মানুষ; কিন্তু উজ্জ্বল কমলা রঙে পুরো ক্যানভাস উদ্ভাসিত, নারীদেহের উদ্দামতা বিশাল বিস্তার নিয়ে ডান দিক জুড়ে আছে, এই ছবিতেও আছে আগের ছবির রক্তবাহী নল, এখানেও একইভাবে যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে বর্জ্য আর পণ্যে। চতুর্থ ছবিটিতে মডেলের সাদা ব্রার স্তনবৃন্তের অঞ্চল দুটো বিশাল রক্তময় গহ্বরের মতে করে দেয়া হয়েছে. মোগল খিলান আবার এসেছে, পরিত্যক্ত পারফিউম বোতলের ভেতর সেই কুঁচকানো কাগজের মানুষ, জড়জীবনের মধ্যে পড়ে আছে ব্যাটরি, মদের বোতল, এবার পণ্য ও বর্জ্যের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি হরিণের মাথার প্রোফাইল তার শান্ত চোখ চাইছে এদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে, সোনালি আর তামসিক নীলের এই পরিপ্রেক্ষিত আমাদের বিলাস আর বেদনার গভীরতর বিন্যাসকে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে বিকৃত করে। পঞ্চম ছবিটি, মডেলকে নিয়ে; কিন্তু এখানে আর আগের ছবির পণ্য ও বর্জ্য এই বিন্যাসটি নেই। নেই আর মডেলের স্তনবৃন্ত ও নাভিতে এঁকে দেয়া বেদনার গহ্বর; কিন্তু আছে অনুভবের এক অদ্ভুত কল্পনা, পরাবাস্তব, মডেলের চোখ দুটো ঠোঁট। ফিরে এসেছে শিল্পীর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনীর স্বপ্নে বিভোর ফড়িং, যার বহুদ্যুতিময়, চোখে প্রকৃতি দেখেছিলেন তিনি; কিন্তু এবার সে তীরবিদ্ধ, পড়ে আছে আফ্রোদিতির পায়ের কাছে, আকাশে তীরধনুক হাতে কিউপিডকে দেখা যাচ্ছে, কিউপিড আর ফড়িংয়ের মাঝখানে শূন্যস্থানে ভেসে আছে কুঁচকানো কাগজের মানুষ, এছবিতে নিঃশেষিত পারফিউম বোতলের মতো তীরবিদ্ধ ফড়িং পড়ে আছে প্রেমহীন প্রয়োজনহীন, শুধু তাই নয়, সে আক্রান্ত স্বর্ণাভ পরাবাস্তব মডেল ও আফ্রোদিতির তাতে কিছু আসে যায় না, তারা তাদের লাস্যের চূড়ান্ত রূপে উদ্ভাসিত।

ষষ্ঠ ছবিটি এক চলচ্চিত্র, ছবিতে কামতৃপ্ত পুরুষটির ক্যানভাসে অবস্থান ও তার শরীরের ওপর পড়া রক্তিম বেগুনি আলোর মতো রঙ, ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত সবুজ নারী এবং ক্যানভাসে তার অবস্থান, রহস্যময় সিলিন্ড্রিক্যাল দুই স্প্রে একটি শায়িত একটি ভাসমান, আর রাধা, কী দুঃখী, কী বিষণ্ণ : কিন্তু হোলির উচ্ছ্বাসে, ঠুমরির মতো আবেশে, তীরবিদ্ধ ফড়িং যাকে মনে হয় শুদ্ধতম প্রেমের শহীদ, তার বুকে রাধার হাত, সে হাত ইশ্বরের, সে হাত রাধার পরম প্রেমের, প্রতিবাদেরও, কেন পুরুষ কামগ্রস্ত শুধু, আর প্রেম তীরবিদ্ধ আমাদের প্রেমলীলায়।

সপ্তম ও অষ্টম ছবি দুটি কৃষ্ণায়ন। দুটি ছবির কাহিনী মৃত ফড়িংয়ের অন্ত্যেষ্টি, পিঁপড়া তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নগরকৃষ্ণ, তার মোহনতা শুধুই নারীকে আকর্ষণের প্রণয়রঙ্গ এই ছিনালি ঘোষণা করে প্রেমের পরিপূর্ণ সমাপ্তি, ভেনাস দি মিলো, নারী শরীরের অবয়বে পারফিউম বোতল, সবই প্রণয়রঙ্গের অনুষঙ্গ, পদ্মের শুভ্রতা কোথায় জীবনে, সে হয়ত প্রেমের পবিত্রতার অর্ঘ্য, মৃত শুদ্ধতম ফড়িংয়ের প্রতি, গোলাপ হয়ত শুধুই রক্তক্ষরণ প্রেমাষ্পদের, সেই অমোঘ বর্জ্যে পড়ে থাকা ফড়িংকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়া, অসাধারণ চলচ্চিত্রায়ন। এরপর লেখা থাকবে ‘সমাপ্ত’। আসবে কুশীলব আর পরিচালকের নাম। ‘বাতাসে যে কথা’ তার চিত্রকর্মসমূহ, সঙ্গীত, আলো, গন্ধ, স্থাপনা সব নিয়ে চলচ্চিত্র ধরনের এক শিল্পের শিল্প। এবং সঞ্জীব দত্ত এর সফল পরিচালক।

এটি আমার গুটিকয় ছাপা মাধ্যমে ছাপা লেখার একটি। দৈনিক সংবাদের ‘সংবাদ সাময়িকী’তে বৃহস্পতিবার ২৫ জানুয়ারি ২০০৭ ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল বহুত্ববাদী সমবায়ী ক্যানভাস

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

9 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
9
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.