কী বেদনায় ব্যথিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেন এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমস্ত ব্যবসায়িক নথিপত্র কেন তিনি পুড়ে ফেলেছিলেন, এর আগে এরকম আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দ্বারকানাথের পত্নী দিগম্বরী দেবী – তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুর দ্বারা আয়োজিত সামাজিক বিবিধ ভোজসভায় মদ্যমাংসের প্রাচুর্য ও ঠাকুরের নিজের মদ্যমাংস গ্রহণের প্রতিক্রিয়ায় দ্বারকানাথের সাথে সাক্ষাৎসম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন – এরপর থেকে দ্বারকানাথ বৈঠকখানা বাড়িতেই থাকতেন এবং নিজ বাড়ির পরিবর্তে বেলগাছিয়ায় এক বাগানবাড়ি প্রতিষ্ঠা করে ভোজসভা নৃত্যগীত ইত্যাদির আয়োজন করতেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ধর্মচর্চায় লিপ্ত হয়ে বিষয়কর্ম থেকে দূরেই সরে গিয়েছিলেন, ঠাকুর পরিবারের যাবতীয় আর্থিক প্রতিপত্তির উৎস দ্বারকানাথ কী এমন করেছিলেন যে ঠাকুর পরিবার তাকে এভাবে ভুলতে চেয়েছে, এই যে ১৮৪২এ তিনি প্রথম বিলাতযাত্রা করেছিলেন এবং মহারাণি ভিক্টোরিয়ার অভ্যর্থনা ফ্রান্সের সম্রাট লুই ফিলিপের অভ্যর্থনা এডিনবরা মিউনিসিপ্যালটির মহানাগরিক উপাধি প্রাপ্তি এসবের পরে দেশে ফিরে এসে আবার ১৮৪৫এ বিলাত ফিরে গেলেন, কেন – দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রীবিয়োগ হয়েছিল ১৮৩৯এ, স্ত্রীর মতো সন্তানেরাও তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল – এসব বিষণ্ণ প্রশ্নের উত্তর আর কখনো পাওয়া সম্ভব নয় – অতলে হারিয়ে গেছেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। সেউত্তরের হয়ত আমাদের আর প্রয়োজনও নেই, ঠাকুর পরিবারের এসব একান্ত পারিবারিক ব্যাপারগুলো জেনে আমাদের কী কাজ।
কিন্তু দ্বারকানাথ ঠাকুরের যে বিরাট কীর্তি – প্রথম ভারতীয় ব্রিটিশ যৌথ মালিকানায় কারটেগোর (Carr-Tagore) কোম্পানির প্রতিষ্ঠা, সেকোম্পানির যাবতীয় নথিপত্র কেন পুড়ে ফিলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কীসে তার লেগেছিল, দ্বারকানাথ ঠাকুরের আয়ের বিরাট অংশ এসেছিল অহিফেন রপ্তানি ও অহিফেন পরিবহনের মাধ্যমে, চীনে যেত অহিফেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আনুকূল্যে, যেত চীনের সাধারণ মানুষকে অহিফেন বিষে জর্জরিত করে দিয়ে চীনকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় করে দিতে, সেপ্রমাণ লোপাট করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উচিত হয়নি, একেবারেই উচিত হয়নি – ইতিহাসের এমন এক সূত্র ধ্বংস করে দেয়া উচিত হয়নি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
বিশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ও ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের অহিফেন ব্যবসা নিয়ে এক জার্মান লেখার ইংরেজি অনুবাদ থেকে লেখেন ‘চীনে মরণের ব্যবসায়’, লেখাটি জৈষ্ঠ ১২৮৮ (১৮৮২ সালে) ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয়েছিল।
ভারতবর্ষীয় রাজস্বের অধিকাংশ এই অহিফেন বাণিজ্য হইতে উৎপন্ন হয়। কিন্তু অহিফেনের ন্যায় ক্ষতিবৃদ্ধিশীল বাণিজ্যের উপর ভারতবর্ষের রাজস্ব অত অধিক পরিমাণে নির্ভর করাকে সকলেই ভয়ের কারণ বলিয়া মনে করিতেছেন। ১৮৭১/৭২ খৃস্টাব্দে এই বাণিজ্য হইতে সাড়ে সাত কোটি পাউন্ডেরও অধিক রাজস্ব আদায় হইয়াছিল। কিন্তু কয়েক বৎসরের মধ্যে তাহা ৬ কোটি ৩ লক্ষ পাউন্ডে নামিয়া আসে। এরূপ রাজস্বের উপর নির্ভর করা অত্যন্ত আশঙ্কার কারণ। ভারতবর্ষীয় অহিফেন নিকৃষ্ট হইয়া আসিতেছে, সুতরাং তাহার দাম কমিবার কথা। তাহা ভিন্ন চীনে ক্রমশই অহিফেন চাষ বাড়িতেছে। চীনে স্থানে স্থানে অহিফেন-সেবন-নিবারক সভা বসিয়াছে। ক্যান্টনবাসী আমীর-ওমরাহগণ প্রায় সহস্র প্রসিদ্ধ পল্লীতে প্রতি গৃহস্থকে বলিয়া পাঠাইয়াছেন যে, ‘তোমরা সাবধান থাকিয়ো যাহাতে বাড়ির ছেলেপিলেরা অহিফেন অভ্যাস না করিতে পায়।’ যাহারা অহিফেন সেবন করে তাহাদের সমাজ হইতে বহিষ্কৃত করিবেন বলিয়া ভয় দেখাইয়াছেন। তিনটি বড়ো বড়ো নগরের অধিবাসী বড়োলোকেরা সমস্ত অহিফেনের দোকান বন্ধ করাইতে পারিয়াছেন। এইরূপে চীনে অহিফেনের চাষ এত বাড়িতে পারে, ও অহিফেন সেবন এত কমিতে পারে যে, সহসা ভারতবর্ষীয় রাজস্বের বিশেষ হানি হইবার সম্ভাবনা। অতএব ওই বাণিজ্যের উপর রাজস্বের জন্য অত নির্ভর না করিয়া অন্য উপায় দেখা উচিত। এতদ্ভিন্ন অহিফেন চাষে ভারতবর্ষের স্পষ্ট অপকার দেখা যাইতেছে। অহিফেন চাষ করিতে বিশেষ উর্বরা জমির আবশ্যক। সমস্ত ভারতবর্ষে দেড় কোটি একর (Acre) উর্বরতম জমি অহিফেনের জন্য নিযুক্ত আছে। পূর্বে সে-সকল জমিতে শস্য ও ইক্ষু চাষ হইত। এক বাংলা দেশে আধ কোটি একরেরও অধিক জমি অহিফেন চাষের জন্য নিযুক্ত। ১৮৭৭/৭৮-এর দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক কোটি লোক মরে। আধ কোটি একক উর্বর ভূমিতে এক কোটি লোকের খাদ্য জোগাইতে পারে। ১৮৭১ খৃস্টাব্দে ডাক্তার উইল্সন পার্লিয়ামেন্টে কহিয়াছেন যে, মালোয়াতে অহিফেনের চাষে অন্যান্য চাষের এত ক্ষতি হইয়াছিল যে, নিকটবর্তী রাজপুতানা দেশে ১২ লক্ষ লোক না খাইয়া মরে। রাজপুতানায় ১২ লক্ষ লোক মরিল তাহাতে তেমন ক্ষতি বিবেচনা করি না, সে তো ক্ষণস্থায়ী ক্ষতি। এই অহিফেনে রাজপুতানার চিরস্থায়ী সর্বনাশের সূত্রপাত হইয়াছে। সমস্ত রাজপুতানা আজ অহিফেন খাইয়া আত্মহত্যা করিতে বসিয়াছে। অত বড়ো বীর জাতি আজ অকর্মণ্য, অলস, নির্জীব, নিরুদ্যম হইয়া ঝিমাইতেছে। আধুনিক রাজপুতানা নিদ্রার রাজ্য ও প্রাচীন রাজপুতানা স্বপ্নের রাজ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অত বড়ো জাতি অসার হইয়া যাইতেছে। কী দুঃখ! আসামে যেরূপে অহিফেন প্রবেশ করিয়াছে, তাহাতে আসামের অতিশয় হানি হইতেছে। বাণিজ্য-তত্ত্বাবধায়ক ব্রুস্ সাহেব বলেন, ‘অহিফেন সেবন রূপ ভীষণ মড়ক আসামের সুন্দর রাজ্য জনশূন্য ও বন্য জন্তুর বাসভূমি করিয়া তুলিয়াছে এবং আসামীদের মতো অমন ভালো একটি জাতিকে ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধম, দাসবৎ এবং নীতিভ্রষ্ট করিয়া তুলিয়াছে।’ অহিফেন বাণিজ্য আমাদের ভারতবর্ষের তো এই-সকল উপকার করিয়াছে!
১৮৭১/৭২এ অহিফেনের ব্যবসা অনেক কমে গিয়েছিল সেই সময়েই রাজস্ব আয় সাড়ে সাত কোটি পাউন্ডের বেশি আর ১৮৩০-১৮৪২এ যখন অহিফেনের রমরমা বাণিজ্য তখন দ্বারকানাথ এই ব্যবসায় জড়িত হন ১৮৩৪এ কারটেগোর কোম্পানি গঠিত হওয়ার পর থেকে – তার ব্যবসায়িক নথিপত্রে এই ব্যবসার হদিস ছিল – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসমস্ত কাগজপত্র ধ্বংস করে দেন, কিন্তু কেন করলেন, ঠাকুর পরিবারকে অপমান অপবাদের হাত থেকে বাঁচাতে – আবারো বলব উচিত হয়নি – অহিফেন ঠাকুরের নথিপত্র ধ্বংস করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উচিত হয়নি। ওই নথিপত্র থাকলে ব্রিটিশভারতের সাথে চীনের ন্যাক্কারজনক অহিফেন পর্বের ইতিহাস আরো স্পষ্ট হত – সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঐতিহাসিক নথিপত্র ধ্বংস করেছিলেন।
‘রামমোহন রায়’কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম বক্তৃতা চব্বিশ বছর বয়সে, এরপর বিভিন্ন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ‘রামমোহন রায়’কে নিয়ে আরো বক্তৃতা করেছেন – আমি এরকম তিন/চারটি বক্তৃতা পড়েছি – এই বক্তৃতাগুলোর কোথাও একবারের জন্যও দ্বারকানাথ ঠাকুরের উল্লেখ নেই, অথচ ইতিহাস বলে রামমোহন রায়ের সমাজসংস্কারমূলক কাজের সবচেয়ে বড় পৃষ্টপোষক ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। দেখে শুনে তো মনে হচ্ছে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ও সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথ দ্বারকানাথ ঠাকুরকে মুছে ফেলেছিলেন। অহিফেন ঠাকুরকে রবীন্দ্রনাথ পারিবারিক কলঙ্কের ইতিহাসই ভেবেছিলেন, তার ব্যবসায়িক কীর্তির সবকিছু নিশ্চয় কলঙ্কের ছিল না, তিনি ব্যাঙ্ক বীমা জাহাজ কয়লা এসবের ব্যবসাও করতেন – অহিফেন ঠাকুরকে মুছতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরো দ্বারকানাথ ঠাকুরকেই পুড়ে ফেলেছিলেন।