চোত্তাখলায় মুক্তিযুদ্ধ পার্ক

৭০ বছরের দীনবন্ধু বিশ্বাস এসেছেন নাতনির হাত ধরে। তার হাতে ভারতের জাতীয় পতাকা। নাতনির হাতে বাংলাদেশের। ৬৫ বছরের বিধবা যশোদা দাস হাঁটছিলেন দ্রুত গতিতে। ছেলেকে কাঁধে নিয়ে সুশান্ত ভিল প্রায় দৌড়াচ্ছিলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হেলিকপ্টার নামার আগেই পৌঁছাতে চান তারা। অনেকে উঠে গেছেন টিনের চালে। অনেকে গাছের উপর। ৪০ বছর আগেকার বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনা তাদের কাছে এখনও তরতাজা।[...]

লিন্ক তোলা যাচ্ছে না, তাই টাইপ করেই তুলে দিতে হল – ত্রিপুরার বাংলা দৈনিক ডেইলি দেশের কথার খবর : জেগে উঠল ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি – চোত্তাখলায় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যানের শিলান্যাস।

নিজস্ব প্রতিনিধি।। আগরতলা, ১১ নভেম্বর : আবেগ, উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা, স্মৃতি রোমন্থন আর এক বুক প্রত্যাশা নিয়ে বৃহষ্পতিবার বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত চোত্তাখলায় শুরু হল নতুন পথ চলা। হাজার মানুষের বিপুল করতালিতে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যানের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর আগের স্মৃতি বুকে চোত্তাখলা জেগে উঠল নতুন উদ্যমে।

৭০ বছরের দীনবন্ধু বিশ্বাস এসেছেন নাতনির হাত ধরে। তার হাতে ভারতের জাতীয় পতাকা। নাতনির হাতে বাংলাদেশের। ৬৫ বছরের বিধবা যশোদা দাস হাঁটছিলেন দ্রুত গতিতে। ছেলেকে কাঁধে নিয়ে সুশান্ত ভিল প্রায় দৌড়াচ্ছিলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হেলিকপ্টার নামার আগেই পৌঁছাতে চান তারা। অনেকে উঠে গেছেন টিনের চালে। অনেকে গাছের উপর। ৪০ বছর আগেকার বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনা তাদের কাছে এখনও তরতাজা। ৭১এর পর অনেক বছর কেটে গেলেও মানুষ ভোলেননি সেই স্মৃতি। তাই তারা এলেন হাজারে হাজারে। নিজেদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, এসব শুনেই বড় হচ্ছে। এখানেই ছিল গণকবর, এখানেই ছিল ট্রেনিং ক্যাম্প। ঘুরে ঘুরে তাই দেখাচ্ছিলেন আত্মজদের। গনগনে রোদের উত্তাপ মাথায় নিয়ে বসেছেন অনেকে মাঠেই।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব নাসিরুদ্দিন [ইউসুফ] ইউনুস চোত্তাখলায় মাটিতে পা রেখে আবেগে আপ্লুত হলেন। বলছিলেন এই ক্যাম্পটির নেতৃত্বে ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ। ঘন জঙ্গলে ঢাকা এই এলাকায় কয়েকবার এসেছিলাম। আমার কর্মকাণ্ড ছিল মেলাঘরের হাবুল ব্যানার্জীর বাগান আর ঢাকায়।

তার স্মৃতির রোমন্থনে অনেকে পাশে এসে দাঁড়ান। এমন একটি ঐতিহাসিক স্থানকে ত্রিপুরা সরকার সংরক্ষণ করছে দেখে তাদের চোখে জল। বাংলাদেশ থেকে আসা নতুন প্রজন্মের যুবক-যুবতীরাও ত্রিপুরাবাসীর এই হৃদয় নিংড়ানো উদ্দীপনা দেখে রীতিমতো আপ্লুত।

নির্ধারিত সময়ের ঘন্টা দুয়েক আগে থেকেই রাজনগর ব্লকের সীমান্তবর্তী চোত্তাখলা মাঠ দর্শকে পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে নিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার যখন চোত্তাখলার মাটি ছোঁয় সে সময় দুদেশের পতাকা নাড়িয়ে জনগণ তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। দুদেশের মৈত্রী বন্ধনকে আরও জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে বক্তারা যখন বক্তব্য রাখছিলেন সে সময় পড়ছিল মুহুর্মুহু করতালি। অনুষ্ঠান কভার করতে আসা বাংলাদেশের এক সাংবাদিকের মুখ থেকে বেরিয়েই গেল ‘অভাবনীয়। দেশের বাইরে আছে বুঝতেই পারছি না।’

মৈত্রী উদ্যানের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, গতকাল ত্রিপুরায় আসার পর থেকে এখানকার মানুষদের ভালবাসায় আমি অভিভূত। ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষ্য এখানকার আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরাবাসীর যে ভূমিকা তা চিরকাল আমরা মনে রাখব। ত্রিপুরাবাসীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আত্মার। আমরা এক ভাষায় কথা বলি, আমাদের হাসি, কথা, দুঃখ, বেদনা সব এক। আমার দুটি দেশের নাগরিক হতে পারি, কিন্তু এরকর প্রতি অন্যের ভালবাসা, সহযোগিতা আগেও যেমন ছিল এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই উদ্যান তৈরির জন্য তিনি ত্রিপুরাবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এই উদ্যান তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেলে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে এটি একটি প্রিয় জায়গা হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমার আমাদের দুদেশের সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করতে চাই। এজন্যই এবছরের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে এসেছিলেন। সহযোগিতার অনেক দিক এই সফরে উঠে এসেছে। তিনি বলেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা কাজ করে যাব। দুদেশের সহযোগিতার যে নতুন সম্পর্ক হয়েছে তার জন্য উভয় দেশেরই পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ইচ্ছা রয়েছে। তিনি বলেন, পরষ্পরের উপর শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়াকে শান্তি, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধির অঞ্চল হিসাবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। এই কাজে ভারত সরকার ও তার জনগণের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে পূর্ত তথা অর্থমন্ত্রী বাদল চৌধুরী বলেন, আমাদের দুই দেশের প্রধান সমস্য হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ এবং দরিদ্রতা। দুদেশের জনগণই এগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। লড়াই করেই এক পা, এক পা করে এগোচ্ছে। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের নেয়া ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন সেদেশে যারা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জঙ্গিদের বেশির ভাগ ঘাঁটিই ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে, অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এক ভাষায় কথা বলি। রবীন্দ্র-নজরুল আমাদের চেতনা। দুই দেশের নিবিড় সম্পর্ককে বেশিদিন বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাবে না। ফেনি-বিলোনীয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া রেল সংযোগের কথা উল্লেখ করে চৌধুরী বলেন, এসব অঞ্চলের মানুষ চায় আবার রেলের হুইসেলে তাদের ঘুম ভাঙ্গুক। এনিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিস্তৃত কথা হয়েছে।

স্মৃতি রোমন্থন করে বাদল চৌধুরী শুনিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেনি যাওয়ার কথা। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সময় গুলির শব্দে স্কুলের ছাত্ররা মেঝেতে শুয়ে পড়ত। গুলি বন্ধ হলে আবার হত ক্লাস। এভাবেই বিলোনীয়ার ছাত্র-যুবরা বড় হয়েছে। ছোট একটি এলাকা নিয়ে যে সমস্যা তাকে মিটিয়ে ফেলতে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিলোনীয়া চায় সীমান্তে আর যেন গুলি না চলে। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হবে – ডা. দীপু মনির বক্তব্যের উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বিষয়টি মীমাংসা হোক সবাই চায়। এরসঙ্গে এখানকার মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। রয়েছে মনোকষ্টও।

শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী জীতেন্দ্র চৌধুরী বলেন, আজকের এই অনুষ্ঠান ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীকে আরও শক্তিশালী করবে। ৭১এর মুক্তিযুদ্ধে শুধু চোত্তাখলাই নয়, সারা রাজ্যের মানুষই এক মানবিক দায়িত্ব পালন করেছিল। মৈত্রী উদ্যান স্থাপনের এই উদ্যোগে ভাষা, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধিকে আরও শক্তিশালী করার কাজে সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করেন।

অনুষ্ঠানের মাঠ থেকে সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজের দুরন্ত ঢেউ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি নিজের মুভি ক্যামেরায় তুলে নিচ্ছেন ছবি। ভারত-বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উত্তাল তরঙ্গে মিশে এক অনন্য পরিবেশ। দূরে বাইসন সাফারির সুউচ্চ টাওয়ার। এই মৈত্রী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যেমন রক্ষিত হবে তেমনি জলাশয়, বোটিং এর ব্যবস্থা, ট্রেকিং এর জন্য পথচলা, বাগান, নানা গাছের সমাহারে এক মনোরম উদ্যানে পরিণত হবে চোত্তাখলা। জানালেন স্থানীয় বিধায়ক সুধন দাস। এখানে থাকবে ক্যাফেটেরিয়া গেস্ট হাউস ও টেন্টে থাকার ব্যবস্থা। ২০ হেক্টর জায়গায় হবে পার্ক। পাশে ৪৫ হেক্টর জায়গায় গড়ে উঠছে বাইসন সাফারি। কাছেই রয়েছে চারশ বছরের পুরনো মসজিদ। সব মিলিয়ে এক আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রের মর্যাদা পেতে চলেছে চোত্তাখলা। তারই পথচলা শুরু হল বৃহস্পতিবার। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে যা এক মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৪ comments

  1. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১২ নভেম্বর ২০১০ (১১:৪৯ অপরাহ্ণ)

    একাত্তরে আগরতলার ভিন্ন ইতিহাস তৈরি হয়। এত কাছের, এত আপন তা ছিল যে, আমার কেবলই মনে হতো, ঢাকার চেয়ে আগরতলার কত আপন। যেন হাত বাড়ালেই এর মমতা নেয়া যায়। আগরতলার সাথে এ ধরনের আয়োজন অতি চমৎকার এক বিষয়।
    মাসুদ করিমকেও এমন একটা নোট প্রদানের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।

  2. মাঈন উদ্দিন জাহেদ - ১৩ নভেম্বর ২০১০ (১০:৫২ পূর্বাহ্ণ)

    খুউব ভালো লাগছে এমন একটি আন ন্দের সংবাদ দেওয়ার জন্যে। সব্যসাচি লেখক আব্দুল মান্নান সৈয়দের একাত্তর উপ্ন্যাসে একটি ব র্ণ্না পেয়েছিলাম।ভালো লাগ্লো এ আয়োজন দেখে। মাসুদ ক রিম করিম কে ধ ন্যবাদ।

  3. মাসুদ করিম - ১৮ নভেম্বর ২০১০ (১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ)

    Tripura was then the desperate destination of thousands of men, women and children, all of whom fled their homes as genocidal elements of the Pakistan Army and local goons carried out mass rape, large-scale murder and arson. Tripura sheltered over 1.5 million Bangladesh refugees, a number that exceeded its own population. Tripura, therefore, occupies a special place for Bangladesh.

    Bangladeshi refugees entered West Bengal, Meghalaya and Assam in thousands throughout the nine-month-long war. The hapless people who wanted their lives saved and their women and girls protected from the marauders, were all over Tripura in particular, straining the State’s infrastructure and resources. From Belonia to Sabroom to Dharmanagar, it was a sea of distressed humanity. This writer was a witness to it: there was not a single school, college or government or semi-government office which was not filled with refugees.

    The 1971 war for Independence was essentially a national war. Relentless lightning actions of the guerrilla fighters eroded the moral and physical strength of the Pakistani Army. While India played a significant role in supporting the war, the Indian Army directly intervened only after an India-Bangladesh Joint Command was formed in the first week of December 1971 as Pakistan launched an attack on the western front. India lost an estimated 17,000 servicemen.

    The war culminated in a shared war against a common enemy that had disregarded democratic ideals, perpetrated mass murder and indiscriminate violations upon unarmed civilians.

    বিস্তারিত পড়ুন হারুন হাবীবের ‘দি হিন্দু’র কলাম : Testimony to a friendship

  4. মাসুদ করিম - ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭ (১২:০৭ অপরাহ্ণ)

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.