পুরনো বইপ্রস্থ
বইপ্রস্থ ২৫ আগস্ট ২০০৯
বইপ্রস্থ ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০
একই সময়ে সংগ্রহ করিনি বই দুটি। কিন্তু একই সময়ে পড়েছি। একই সময়ে পড়ে উপকৃত হয়েছি। এই বিজ্ঞাপন বলছে, এদুটো বই একসাথে পড়ুন – পড়লেই বুঝবেন দুটোর পরিপূরকতা কোথায়।
অতীত প্রগতির খেলাঘর
বেহাত বিপ্লব ১৯৭১।।সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত।। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।। প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৭।। মূল্য ৩২০ টাকা।।
এটি এক ভয়ংকর নাটকীয় প্লট, বিপ্লব মুক্তিযুদ্ধ দেশগড়ারসংগ্রাম হল, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫, এইসময়ের জনগণনায়কেরা বিকট রাজনৈতিক জটিলতায় নিজেদের সব অর্জন নিজেরাই শেষ করে দিয়ে চলে গেল। রয়ে গেল কিছু নিয়ত ‘বেহাত’ তাত্ত্বিক। তেমনই একজন সলিমুল্লাহ খান সম্পাদনা করেছেন ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’, আহমদ ছফার ১৯৭৭এ লেখা ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ প্রবন্ধটিকে বইটির প্রধানকর্ম বিবেচনা করে। এবং এই বইটিকে ঘোষণা করা হয়েছে ‘আহমদ ছফা মহাফেজখানা ১’ । সলিমুল্লাহ খানের বই পড়া আমার হয়ে ওঠে না, পত্রিকা মারফত কিছু কলাম ও প্রবন্ধ পড়েই বুঝে নিয়েছি, এপথ মাড়িয়ে আমার কাজ নেই। এবারের এই বই নিতান্ত লেখক হিসেবে ছফার গুরুত্ব বিবেচনায় পড়তে নিয়েছি এবং ছফাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের জটিলতার দিকটি অনুধাবন করেছি। এবং যারই এই জটিলতা বোঝার প্রয়োজন আছে তাকেই আমি অনুরোধ করব এই বইটি পড়ে নিতে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি(এম-এল), আওয়ামী লীগ এই চতুর্ভুজের আভ্যন্তরীন জটিলতা ও রাশিয়া আমেরিকা ভারত চীন এই চতুর্ভুজের আন্তর্জাতিক জটিলতার হিরণ্ময় বাংলাদেশ কেন শেষ পর্যন্ত মুসলমানের বাংলাদেশ হয়ে উঠল? আসলে বাংলাদেশের অতীতের প্রগতির সব প্রাণশক্তি একে একে উধাও হয়ে গিয়েছিল। আভ্যন্তরীন চারধারা একে অপরকে খেয়ে ফেলেছিল, আন্তর্জাতিক চৌকোষ নিজ নিকেতনে ফিরে গিয়েছিল, পড়ে ছিল পাকিস্তানপন্থার মৌলবাদীরা আর আমেরিকা প্রতাপশালী হয়ে উঠছিল তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে – তাতেই শক্তিশালী হয়ে উঠল পাকিস্তান – আর বাংলাদেশ জিয়া এরশাদের হাত ধরে চলে গেল একতরফা ধর্মীয় অন্ধকারে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পাঠ নিতে ‘বেহাত বিপ্লব ১৯৭১’ কাজে লাগবে ঠিকই কিন্তু ‘বেহাত’ তাত্ত্বিকদের কাজে লাগার কোনো সম্ভাবনা আর নেই।
একটি মুরগি
ভারত অন্দরের অবরোধ।। এম. জে. আকবর।। অনুবাদ অশোক হালদার।। আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।। প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ১৯৯২।। মূল্য ৬০ ভারতীয় টাকা।।
অথবা India The Siege Within || M. J. AKBAR || Penguin India || First Edition 1985 || Price INR 350
অসমতার বর্ণপ্রথা ভারতকে স্মরণাতীতকাল থেকে তার সকল ফলিত ও আধ্যাত্মিক অর্জনের বিপরীতে এক সংকীর্ণ ও সংক্ষুব্ধ জনপদে পর্যবসিত করেছে। এই ভারত যখন স্বাধীন হল স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তান রূপে তখন একে বলা হল পাকিস্তানের জন্ম ও ভারতের উজ্জীবন। সেই স্বাধীন ভারত পথ চলতে শুরু করল অন্দরের অবরোধ নিয়ে। সেই অবরোধ দক্ষিণ ভারতের, পাঞ্জাবের, কাশ্মিরের। এম জে আকবর ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় কংগ্রেসের হয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েছিলেন, কয়েক বছর পরে অবশ্য প্রত্যক্ষ রাজনীতি ছেড়েও দিয়েছেন, তারই লেখা এই উল্লেখযোগ্য বইটি ভারতকে বুঝতে আমাদের কমসময়ে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই বই যখন লেখা হয়েছে তখন ভাষার প্রশ্নে দিল্লির সাথে দক্ষিণ ভারতের অনৈক্য, ধর্মের প্রশ্নে পাঞ্জাব ও কাশ্মিরের সাথে অনৈক্য – এসবই ছিল ভারতের আভ্যন্তরীন প্রধান অবরোধ – সেঅবরোধ অনেকাংশে মিটে গেছে দক্ষিণ ভারত ও পাঞ্জাব থেকে, ভাষার প্রশ্নে ইংরেজি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি এই দুই অবরোধ থেকে ভারতকে মুক্ত করেছে, কিন্তু কাশ্মিরের অবরোধ আরো ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এম জে আকবর উত্তরপূর্ব ভারত নিয়ে লেখেন না, তাই এই অবরোধে মণিপুর আসাম মিজোরাম নাগাল্যান্ড ত্রিপুরার কথা আসে নি, আর আদিবাসী সমস্যা থেকে উদ্ভূত মাওবাদী অবরোধ তো এসময়ের ভারতের সবচেয়ে বড় আভ্যন্তরীন অবরোধ, তবে এই বইটি ভারতের আভ্যন্তরীন অবরোধের অস্তিত্ব ও সংকট নিয়ে আমাদের এতদূর নিয়ে যায় যে আমরা আর ভারতকে ‘উজ্জ্বল অপরূপ’ ভেবে বসে না থেকে এপ্রলাপ থেকে মুক্ত হতে পারি সহজে। আমরা এও বুঝতে পারি ভারতে অর্থনীতির একটি ‘মুরগি’ ও সহনশীলতার দুটি ‘ঠ্যাং’ এখনো আছে বলেই স্বাধীন ভারত আজো খণ্ডিত নয়। বাকি ইতিহাস শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারে।