ধর্মের ক্ষমতার রাজনীতি, জাতিগত রাষ্ট্রনীতির হৃদয়হীন প্রশাসন ও সেনাবাহিনী, পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ-এ পরিণত করেছে। বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম – একে মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া গেলেও মানুষের মনে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে বাঙালিরা হতরিদ্র, পাহাড়িরা বিচ্ছিন্ন ও উপদ্রুত। এখানে প্রশাসন ও সেনাবাহিনী সবকিছুর মালিক। বৌদ্ধ খ্রিস্টান ও মুসলমানেরা এখানে, জনসমাজ বিন্যাসের প্রতিযোগিতার রাজনীতিতে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। লিজ এখানে অর্থনীতি, জঙ্গিত্ব এখানকার ভবিষ্যৎ। এই পার্বত্য আতঙ্ক বাংলাদেশকে দিশাহারা করবে। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সচরাচর করা প্রশ্ন কিছু এখানে তুলে ধরলাম, আশা করি মন্তব্যে আরো অনেক প্রশ্ন উঠে আসবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস কি কলোনিয়াল রাষ্ট্রের ইতিহাস?
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দারা সেটেলারদের কাছে পরাজিত। সেটেলার কোনো বিছিন্ন শক্তি নয়। উপনিবেশের খেয়াল নিয়ে কাজ করে যাওয়া বড় জাতিসত্তার রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী, তার উপনিবেশিক কার্যক্রমের রসদ হিসেবে সেটেলারদের এখানে বসতি গড়তে দিয়েছে, এবং তাদের ক্ষমতায়ন করেছে, যেভাবে উপনিবেশিক শক্তিগুলো নেটিভল্যান্ডে করত। পাহাড়ি-বাঙালি দুই বিচ্ছিন্ন ধারা, একজন আরেক জনের কাছে অপরিচিত – সম্পূর্ণ সম্পর্করহিত : এটাই তো উপনিবেশের আদর্শ পরিবেশ। বড় জাতিসত্তার রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী তার রাষ্ট্রের অন্তর্গত একটি দেশীয় ভূখণ্ড জয় করেছে, তার ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে সম্পূর্ণ করতলগত ‘কালো’তে পরিণত করেছে। কোনো সিভিল সোসাইটির কোনো অবকাশ পার্বত্য চট্টগ্রামে কখনো ছিল না। প্রভু-ভৃত্য সম্পর্কই সেখানে উচ্চকিত। রাজারা ছিলেন ও আছেন এবং রাষ্ট্রও ছিল ও আছে। এই কলোনিয়াল রাষ্ট্রে রাজাদের বিরুদ্ধে কোনো অভ্যুত্থান দেখা যায় না, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বারো বছরের সংগ্রাম আমরা ‘শান্তি চুক্তি’র মধ্য দিয়ে অবসিত হতে দেখেছি। কিন্তু রাজা ও রাষ্ট্রকে খর্ব করে ওই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মুক্তি ও বিকাশের সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাইনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস কলোনিয়াল রাষ্ট্রের ইতিহাস।
স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ইতিহাসের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস কি এক হতে পেরেছিল?
না, পারেনি। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো বড় বাঙালি জাতিসত্তার সাথে কখনো ঐক্যসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। সহজ সমাধান হিসেবে ‘বাঙালি’ হয়ে যাওয়ার আহবান জাতিসত্তা বিষয়ে জ্ঞানহীনতাকেই প্রকট করেছে। রাজারা আছেন, সংসদ সদস্য আছেন, সংরক্ষণের বদৌলতে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সন্তানরা আছেন – কিন্তু কোনো প্রতিনিধি নেই। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি সেটেলার কি বাঙালি-পাহাড়ি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের পক্ষে কথা বলতে সক্ষম?
এই কণ্ঠস্বর আমরা অতীতে শুনতে পাইনি। ভবিষ্যতে পাব সেআশা করি না। দেশের সমাজবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের জন্য এক বড় ক্ষেত্র হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রাম – যেখানে নিবিড় পাঠ আমাদের বাঙালি-পাহাড়ি সম্পর্কের খতিয়ান উপস্থাপন করতে পারত। না হয় যা সাদা চোখে দেখছি, বাঙালি-পাহাড়ি সম্পর্কহীনতা তাকেই চরম ধরে রাজা ও রাষ্ট্রের দাপটই আমাদের দেখে যেতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা কি পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের পক্ষে কথা বলতে সক্ষম?
একমাত্র সম্ভাবনা আছে এখানে, ইতিহাস ইতিহাসের মতো হয়ে ওঠে এখানেই যখন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হাজার বৈরিতা উপেক্ষা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সেপথের সম্ভাবনার কথা ভেবেই ‘বিচ্ছিন্নতা’ নয় ‘অধিকার আদায়’-এর সংগ্রামই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে নেতৃত্ব দিতে পারে এমন কেউ বাঙালির সংবেদনশীল অংশকেও নেতৃত্ব দিতে পারবে, এটা বেশ জোরের সাথেই বলা যায়।
বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান এই পরিচয় ও সংঘাত কি সব সম্ভাবনার দ্বাররুদ্ধ করে দেবে?
এটাতেই সবচেয়ে বেশি ভয়। এখানেই ধর্মের ক্ষমতার রাজনীতির শিকার হব আমরা সবাই। এই ত্রিমুখী বৈরিতা যদি পাহাড়ি-বাঙালি বিরোধের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে, তাহলে এবিষয়ে আর না ভাবাই ভাল। এই ত্রিমুখী বৈরিতা শক্তিশালী হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকে এখনই মৃত ঘোষণা করতে আর কোনো দ্বিধা থাকবার কথা নয়।
সকপ্র : সচরাচর করা প্রশ্ন।
প্রশ্নগুলো বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের জনকণ্ঠে ছাপানো সাম্প্রতিক কলাম থেকে নেয়া।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
নিরাভরণ - ২৭ মার্চ ২০১০ (৩:৩২ পূর্বাহ্ণ)
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। জনকন্ঠের কলামটির লিঙ্ক থাকলেও ভাল হত, পাশাপাশি রেখে দেখা যেত আর কি কি তথ্য বা বিশ্লেষন উঠে আসছে। পাহাড়ী বাঙ্গালি সমস্যা গুলো কেবল রাজনৈতিক নয়। এর মূল উৎস্য বোধকরি বর্ণবাদের সহজাত প্রবৃত্তি। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, জাতিগত ভাবে আমরা যারা বাঙালি আমাদের অন্য ভাষা বা সংস্কৃতির সাথে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার অভিজ্ঞতা অনেক কম। আর পাহাড়িদের সাথে বাঙালিদের পার্থক্য অনেক প্রকট ভাবে চোখে পড়ার মত একটা দিক। ফলে অচেনা অজানা এই মানুষদের সাথে ঠিক কি ভাবে ব্যবহার করা যায় সেটা বুঝে উঠতে পারে না অনেকে। আর স্বভাবজাত দুষ্টুলোক যারা তারা তো সুযোগ পেলেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে লেগে যায়। তাদের অপরাধগুলো সবক্ষেত্রে হয়ত ঠিক পাহাড়িদের জাতিগত পরিচয়ের দ্বারা মটিভেটেড নয় বরং তাদের অপেক্ষেকৃত দুর্বল জাতিগত অবস্থানের ফল। ভিন্ন জাতিসত্ত্বার প্রতি অথবা জাতিসত্ত্বার স্বকিয়তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব না হলে পাহাড়িদের সাথে বাঙালিদের সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান আশা করা কঠিন হবে। তবে স্বল্পমেয়াদে সরকারের উচিত পাহাড়িদের অধিকারকে সমুন্নত করার ব্যবস্থা নেয়া, তাদেরকে প্রয়োজনিয় নিরাপত্তা দেয়া। সরকারকে এক্ষেত্রে পাহাড়িদের প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করতে হবে। আর কেবল মাত্র আন্তরিক হলেই হবে না পাহাড়িদের আস্থা অর্জনের দিকটা দেখতে হবে বেশ গুরুত্ব দিয়ে।
মাসুদ করিম - ৩০ মার্চ ২০১০ (২:০৮ পূর্বাহ্ণ)
লিন্কটা দেয়া হয়েছে। ছাপা কাগজে পড়ে পোস্ট তৈরি করেছিলাম এবং লিন্কটা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সেদিন জনকণ্ঠে ঢোকা যাচ্ছিল না। আবার কখন ওরকম হয় তাই পুরো লেখাটা এখানেও ব্লক করে দেয়া হল।
মাসুদ করিম - ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ (১০:০৪ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২৭ আগস্ট ২০১৫ (৫:০৪ অপরাহ্ণ)