কোথায় টি কোথায় টা

এ নিয়ে একটা চমৎকার ব্যবহারবিধি পেলাম কয়েকদিন আগে এক প্রচলিত প্রবাদে। সেকথায় পরে আসছি, কিন্তু এ পর্যন্ত কোথাও আমি এগুলোর ব্যবহারবিধি দেখিনি। আমারটি ও তোমারটা বা আমারটা ও তোমারটি বা আমারটা ও তোমারটা বা আমারটি ও তোমারটি, এর মধ্যে কোনো পার্থক্য তো আমাদের কারোরই চোখে পড়ছে না। আবার একবারে নিয়ম করেই শুধু টি অথবা টা ব্যবহার করব এমনটিও আমাদের মধ্যে দেখা যায় না।
দেবেশ রায়ের এই গদ্যাংশটুকু দেখি :

দেয়ার বিয়ের পর এই তেতলাটি যেন হাঁ করে খেতে আসে। দেয়ার বিয়ের পর এ বাড়িতে কিছুই বদলায়নি, কোনো একটি বাল্বও না। নেহার এই সাতাশ বছরের শোয়ার ঘরে সাতাশ বছর ধরেই কম পাওয়ারের ঘোলাটে আলো একটা জ্বালানো থাকে — হঠাৎ উঠে বাইরে যেতে যেন অসুবিধে না-হয়। সাতাশ বছর ধরে তার খাটটা যেখানে, এখনো সেখানে।

তেতলাটা লেখা যেত? কোনো একটা বাল্বও না? আলো একটি জ্বালানো থাকে?
রবীন্দ্রনাথের এই গদ্যাংশটুকু দেখি :

স্বামীকে দেখলুম, তার সঙ্গে ঠিক মেলে না। এমন-কি, তাঁর রঙ দেখলুম আমারই মতো। নিজের রূপের অভাব নিয়ে মনে যে সংকোচ ছিল সেটা কিছু ঘুচল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে একটা দীর্ঘনিশ্বাসও পড়ল। নিজের জন্যে লজ্জায় নাহয় মরেই যেতুম, তবু মনে মনে যে রাজপুত্রটি ছিল তাকে একবার চোখে চোখে দেখতে পেলাম না কেন?

লেখা যেত, সেটি কিছু ঘুচল বটে? বা, যে রাজপুত্রটা ছিল?
শঙ্খ ঘোষ লিখছেন :

আর যখন এর পাশাপাশি মনে পড়ে যে এই পর্বটির মধ্যেই আক্ষরিক অর্থে প্রতিদিন ভোরবেলায় কিছু আধ্যাত্মকথা তিনি শোনাচ্ছিলেন তাঁর শান্তিনিকেতনের সহকর্মীদের কাছে, পর্বে পর্বে ছাপা হচ্ছিল ‘শান্তিনিকেতন’ বইটি, কিংবা ছাপা হলো ‘ধর্ম’ নামেরই আত্মিকতায় ভরা আরেকখানা বই, ‘গীতাঞ্জলী’র বছরে যখন পেয়ে যাই আধ্যাত্মবিভাময় ‘রাজা’ নাটকটিকেও, তখন আমরা ধরে নিই যে তাঁর মনের ইতিহাস যেন পুরোই জানা হয়ে গেল আমাদের, গানে কবিতায় নাটকে প্রবন্ধে মিলিয়ে নিয়ে আমরা যেন পেয়ে গেলাম তাঁর সংসার থেকে দূরে পালানোর একটা ছায়াচ্ছন্ন কালখণ্ড।

লেখা যেত, এই পর্বটার মধ্যেই? কিংবা, সংসার থেকে দূরে পালানোর একটি ছায়াচ্ছন্ন কালখণ্ড?
লিখছেন হাসান আজিজুল হক :

অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু সকাল সকাল উঠে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে পেচ্ছাপ করার জন্য বাইরে আসতেই নজমুল হকচকিয়ে গিয়েছিল। পিছু হঠাটা ঘটেছে প্রায় চোখের আড়ালে। অন্ধকারে বিশালকায় দৈত্যদের চলাফেরার মতো ব্যাপার। উঃ, কি ভয়ানক কাণ্ড এই রকম বার বার মনে হচ্ছিল তার। কিন্তু পিছু হঠাটা যে গায়ের উপরে এসে পড়েছে এটা তার হিসেবে আসেনি। দরজা খুলতেই সে তিনজন পাকিস্তানি সৈন্যের একেবারে মুখোমুখি হয়ে গেল। ফের ঘরে ঢোকার জান্তব টানে সে পিছুতে চেয়েছিল কিন্তু কেমন করে তার চোখ আটকে গেল একটি সৈনিকের কপিশ রঙের চোখের সঙ্গে। খুব ভালো করে তাকে লক্ষ্য করছিল সৈনিকটা, তার সঙ্গের অন্যগুলোও।

কিন্তু পিছু হঠাটি যে গায়ের উপরে এসে পড়েছে, লেখা যায়? বা, একটা সৈনিকের কপিশ রঙের চোখের সঙ্গে? বা, খুব ভালো করে তাকে লক্ষ্য করছিল সৈনিকটি?
কমলকুমার মজুমদার লিখছেন :

পটের মধ্যে সকল সময় সেই আভ্যন্তরীণ স্থানের সাক্ষাৎ ঘটে, এবং তখনই মনে হয় পটটি প্রকৃতির বাস্তবতায় নিবিড়। চৈনিক শিল্পে এবং সেই সূত্রে জাপানের কোনো চিত্রে দেখা যাইবে তাহারা ছবিটা যখন আঁকে তখন ঘেরটাকে একটি বেড়ার মতন মনে করে, কিম্বা বহু জায়গায় দেখা যায় তাহারা ছবিটি যে বাস্তব এ প্রমাণ করিয়াছে।

পরিবর্তন করা যায়, পটটা, ছবিটি, ঘেরটি? আবার দেখুন লেখা কি যায়, তাহারা ছবিটা যে বাস্তব এ প্রমাণ করিয়াছে?
বুদ্ধদেব বসু থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি :

এই কথাটাকেই ঘুরিয়ে বলা যায় যে ক্লাসিক সাহিত্যের পূর্ণ প্রতিভু যোরোপে যেমন হোমার নন, ভার্জিল, ভারতে তেমন বাল্মিকী নন, কালিদাস। রাষ্ট্রে ধর্মে, সমাজে — এতএব রচনারীতিতে — প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলার সম্পূর্ণ স্বীকৃতিকে আমরা বলতে পারি ক্লাসিক মানসের একটি প্রধান লক্ষণ; অতএব ক্লাসিক সাহিত্যের প্রধান একটি লক্ষণ হ’লো — দুর্বোধ্যতার অভাব।

কথাটাকে কথাটি, একটিকে একটা লেখা যায়?

টি ও টা আমরা শব্দের শেষে পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে ব্যবহার করতে পারি। এই হলো এগুলোর চূড়ান্ত ব্যবহারবিধি। শুধু কানটাকে খাড়া রাখতে হবে, কোথায় টি কোথায় টা। ভাষায় এটা ব্যবহারবিধির চেয়েও বড়, এটাকেই বলি গতিবিধি।
আরে প্রবাদটাই তো বাদ পড়ে গেল। সেখানে তুচ্ছার্থে টা ও গৌরবার্থে টি-র প্রয়োগ দেখুন :

আমার ছেলে ছেলেটি, খায় শুধু এতটি,
বেড়ায় যেন গোপালটি।
ওদের ছেলে ছেলেটা, খায় দেখ এতটা
বেড়ায় যেন বাঁদরটা।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

১১ comments

  1. মং হ্লা প্রু পিন্টু - ১৮ নভেম্বর ২০০৯ (১:১৯ পূর্বাহ্ণ)

    প্রবাদের উদাহরণ (আমার ছেলে ছেলেটি, খায় শুধু এতটি, বেড়ায় যেন গোপালটি।
    ওদের ছেলে ছেলেটা, খায় দেখ এতটা(,) বেড়ায় যেন বাঁদরটা।) বৈষম্যপূর্ণ।

    • সুব্রত দাশ - ১৮ নভেম্বর ২০০৯ (১০:১৫ অপরাহ্ণ)

      বৈষম্যটা বোঝানোর জন্যই তো এই প্রবাদ এর উদাহরণ। 🙂
      লেখাটা ভালো লাগলো। চিন্তাশীল। ও না না! লেখাটি ভালো লাগলো।

      • মং হ্লা প্রু পিন্টু - ২০ নভেম্বর ২০০৯ (৪:১৮ অপরাহ্ণ)

        তাই বলে নিজের হলে গৌরবার্থে, অন্যের হলে তুচ্ছার্থে হতে হবে কেন? আমার মতে তা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়।

  2. সালাউদ্দীন খালেদ - ১৮ নভেম্বর ২০০৯ (১০:৩৭ অপরাহ্ণ)

    পড়িলাম

  3. নুর নবী দুলাল - ১৯ নভেম্বর ২০০৯ (২:৩২ পূর্বাহ্ণ)

    পড়লাম……..চিন্তা করলাম……..বুঝলাম…… অবশেষে ভাল লাগল….ধন্যবাদ মাসুদ করিম, আপনাকে।

  4. রায়হান রশিদ - ১৯ নভেম্বর ২০০৯ (৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ)

    একেবারেই ধন্যবাদ দিতে পারছি না মাসুদ করিমকে। এই ‘টি’ এবং ‘টা’ নিয়ে সবসময়ই মহা ঝামেলায় পড়ি। এখন থেকে আরও বেশী করে পড়বো মনে হচ্ছে। গল্পের সেই নাপিতের মতো অবস্থা আর কি! সব দোষ মাসুদ ভাইয়ের।

    • মাসুদ করিম - ১৯ নভেম্বর ২০০৯ (৬:৫৮ অপরাহ্ণ)

      দুটো ক্ষেত্রে শুধুই টা ব্যবহার করতে পারবেন, টি নিয়ে একদম ভাবতে হবে না :
      ১. কখন বাজে বারোটা, সেঅর্থে একটা…দুইটা…তিনটা…চারটা…
      ২. ক্রিয়াপদকে ক্রিয়াপদ বিশেষ্য করতে : হবেটা কী, দিবটা কী, যাবটা কোথায়…

    • রেজাউল করিম সুমন - ২০ নভেম্বর ২০০৯ (১০:৪৫ অপরাহ্ণ)

      টি আর টা নিয়ে ঝামেলায় পড়ি আমিও। এখন থেকে কান খাড়া রাখব। ধন্যবাদ, মাসুদ ভাই।

      মাহমুদুল হকের কালো বরফ উপন্যাসের খানিকটা অংশ পড়া যাক :

      এটা ঠিক যে, আমার এই আঙুল চোষার ব্যাপারটা বাড়ির কারোই তেমন পছন্দের ছিল না, মার কাছে তো নয়ই। অনেক খোঁচা খেয়েছি এর জন্য। ‘এই হাবলুটাকে নিয়ে হয়েছে আমার যতো ঝক্কি –’ এই বলে আমার গাল থেকে আঙুল বের করে দিত মা। ‘আমি তো জানিই, নচ্ছারটা আমাকে জ্বালাবে –’ রেগে গেলে মা বলতো, ‘পেটে থাকতেও দিনরাত হেঁড়েমাথাটা কি কম জ্বালান জ্বালিয়েছে আমাকে!’

      দুটোর কোনোটাই বোধহয় মিথ্যে নয়। খুব সম্ভব আমি কমবেশি হাবাগোছেরই ছিলাম। ঠোঙার একটা নকুলদানা পড়ে গেলেও ধুলেমাটি থেকে তা কুড়িয়ে গালে পুরতাম। পুঁটি নামের যে আলতাপায়ে মেয়েটি রোজ আমাদের পুকুরঘাটে গুচ্ছের পেতল কাঁসার থালাবাসন নিয়ে বসতো, সেও আমার কাছে ছিল এক বিস্ময়ের বস্তু।

      […]

      ধেড়ে মাছ ছিল একটা পুকুরে, রুই কি কাতলা, বয়েসের কোনো গাছপাথর ছিল না মাছটার; কি করে যেন সে ঠিকই টের পেত পুঁটি ঘাটে এসেছে। পুকুরের ঠিক মাঝখানে দু’চারটে ঘাই মেরে, তারপর একডুবে সে সরাসরি ঘাটের কাছে হুপুস করে ভেসে উঠতো।

      নির্দিষ্ট অর্থে টি ও টা তো রয়েছেই, এই উদ্ধৃতিতে আমরা পাচ্ছি আরো দুটি বিকল্প : টো (দুটো) আর টে (চারটে/তিনটে); অবশ্য সংখ্যা নির্দেশের ক্ষেত্রে (অর্থাৎ নির্দিষ্ট অর্থে) টো আর টে-কে দেখা যাবে কয়েকটা মাত্র শব্দে। এসব ক্ষেত্রে টো/টে কি টি/টা-রই পরিবর্তিত রূপ নয়?

      এটি/এটা/এইটা থেকে এইটে এবং সেটি/সেটা/সেইটা থেকে সেইটে — এরকমও তো হয়। চারটে, ঘোলাটে – এই দুই ক্ষেত্রে টে কি একই? চারটে-তে টে ব্যবহৃত হয়েছে নির্দিষ্ট অর্থে — চারটা> চারটে; ঘোলাটে-তে টে ব্যবহৃত হয়েছে ঈষৎ অর্থে — ঘোলা+টিয়া>টে = ঘোলাটে, মানে ঈষৎ ঘোলা। টে-র আরো দু-এক রকম ব্যবহার :

      সাদৃশ্যে — তামাটে, আঁষটে, বকাটে ইত্যাদি।
      পটু অর্থে — ঝগড়া+টে = ঝগড়াটে।

      যাই হোক, পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে না তুলে এবার বরং ‘টাটা’ বলি।

  5. সাদা মন - ২০ নভেম্বর ২০০৯ (১১:১২ অপরাহ্ণ)

    একদম অজানা একটা জিনিষ জানলাম। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ মাসুদ করিম।

  6. maibam sadhon - ২৮ নভেম্বর ২০০৯ (১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ)

    ভালো লেগেছে ।

  7. মুয়িন পার্ভেজ - ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১:৪৩ পূর্বাহ্ণ)

    শব্দ ও অর্থ : শব্দার্থের দর্শন বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে রমাপ্রসাদ দাস ‘আবেগব্যঞ্জক অর্থ’ (‘Emotive Meaning’) সম্বন্ধে লিখেছেন :

    “টি”, “টা”, “উনি”, “ওটা” — ইত্যাদির ব্যবহারেও আবেগব্যঞ্জক অর্থের পার্থক্য ধরা পড়ে, যেমন, ধরা পড়ে

    ওটা গেল [বিদায় হল]
    উনি গেলেন [চলে গেলেন]

    এ দুটি বাক্যে। নিচের ছড়ায় এ পার্থক্য, “আমি — ও”-এর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য খুব প্রকট।

    আমার ছেলে ছেলেটি
    খায় শুধু এইটুকুটি
    ওর ছেলে ছেলেটা
    খায় সে এই এতটা।
    আমার ছেলে ছেলেটি
    নাচে যেন ঠিক ঠাকুরটি।
    ওর ছেলে ছেলেটা
    নাচে যেন ঠিক বাঁদরটা।।

    আর একটা উদাহরণ।

    নন্দ। আজ্ঞে না, নেপালবাবু বললেন…
    তারিণী [কবিরাজ]। রেপাল! সে আবার কেডা?
    নন্দ। জানেন না? চোরবাগানের নেপালচন্দ্র রায় M.B.F.T.S. — মস্ত হোমিওপ্যাথ।
    তারিণী। অঃ, ন্যাপলা, তাই কও। সেডা আবার ডাগদর হল কবে?
    — রাজশেখর বসু

    “নেপালচন্দ্র রায়”, “নেপালবাবু”, “নেপাল”, “ন্যাপলা — এ কথাগুলির পার্থক্য লক্ষণীয়। আবার “কেডা”, “সেডা” অবজ্ঞা ও তুচ্ছতা বোধক।

    (‘বাচ্যার্থ, লক্ষণার্থ ও দ্যোতনা’, প্রথম সংস্করণ, এপ্রিল ১৯৯৫, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ. ১১৩)

    রমাপ্রসাদ কিছু জোড়-শব্দের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন :

    বস্তত সব শব্দকে (বা বাক্যকে) এক দিক থেকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
    (ক) নির্দেশসর্বস্ব, “বর্ণ”হীন
    (খ) অনুকূল-আবেগব্যঞ্জক
    [পছন্দসই আবেগের রঙে রাঙানো]
    (গ) প্রতিকূল-আবেগব্যঞ্জক
    [অপছন্দ আবেগের রঙে রাঙানো]

    (পৃ. ১১৪)


    মাসুদ করিমের উদ্ধৃত ছড়াটির (বা ‘প্রবাদ’টির) রচয়িতা কে জানি না, তবে লোকমুখে যে এর বর্ণিল বিবর্তন ঘটেছে, তা রমাপ্রসাদের এ-লেখা প’ড়ে বেশ বোঝা যাচ্ছে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.