তাঁর মৃত্যুর আকস্মিকতায় আমি বেদনাহত হয়েছি। এই গত জানুয়ারিতে মাত্র বিচ্ছিন্ন দুএকটি প্রবন্ধ পড়ে তাঁর লেখার সাথে আমার পরিচয়। যদিও মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর, কিন্তু আমার কাছে, যে আমি মাত্র পড়তে শুরু করেছি তাঁকে, এ এক অকালমৃত্যু।
তাঁর বিখ্যাত স্মৃতিকথা ‘ওপারের ছেলেবেলা ১৯৩১-১৯৪৭’-এর দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : রাজনীতি ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা, আমি এখানে তুলে দিচ্ছি—একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে, যে আমার সবসময়ে মনে হয়েছে ‘পাকিস্তান’ আমাদের ইতিহাসের এক চরম ভুল। সেই ভুল ১৯৭১-এ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজে আজও সক্রিয়।
জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ২৪ অক্টোবর ১৯৩১, বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে। মৃত্যু ৫ অক্টোবর ২০০৯, কলকাতায়। অর্থনীতিতে এম.এ., আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পি.এইচ-ডি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডি.লিট। বহু ইংরেজি ও বাংলা গ্রন্থের রচয়িতা। বাংলা গ্রন্থগুলির মধ্যে মহাকাব্য ও মৌলবাদ, সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভগবদগীতা, ধর্মের ভবিষ্যৎ, গণতন্ত্র ধর্ম ও রাজনীতি, বিকল্প নবজাগরণ, বিকল্প বিশ্বায়ন এবং ওপারের ছেলেবেলা উল্লেখযোগ্য।

রাজনীতি ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা
আগেই বলেছি, আমার ছেলেবেলায় বজ্রযোগিনীতে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে ভৌগোলিক, আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দূরত্ব ছিল। কিন্তু সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্ফোরণ হবার আগে পর্যন্ত আমাদের গ্রামে প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব হয়নি। ধর্মীয় ও ভৌগলিক দূরত্বের অন্তরালে এক ধরনের শ্রেণী বৈষম্য দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে বর্তমান ছিল। ধর্মের দিক থেকে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও তারাই ছিল জমিদার-জোতদার-মহাজন শ্রেণীর বিপুল গরিষ্ঠ অংশ, আর প্রায় সমস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও চাকুরিজীবি ও পেশাজীবি। আর মুসলিমরা ধর্মের নিরিখে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাদের অধিকাংশই ছিল ভূমিহীন কিংবা প্রান্তিক কৃষক, দিনমজুর বা অন্য ধরনের শ্রমজীবি। নানা ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক কারণে মুসলিমরা ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে থাকায় এই শ্রেণী বৈষম্য আবার শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মাত্রা পেয়েছিল। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথে বিপথগামী হবার ফলে বজ্রযোগিনীর এই প্রচ্ছন্ন শ্রেণী বৈষম্যও বিশ শতকের চল্লিশের দশকে প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতার রূপ নিতে আরম্ভ করে।

১৯৪২ এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় থেকে বজ্রযোগিনী গ্রামে হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় বিভাজন রাজনৈতিক রূপ নিতে আরম্ভ করেছিল। তার আগে থেকেই অবশ্য ঢাকা শহরে মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতো। সেসব দাঙ্গার খবর বজ্রযোগিনীতে এসে পৌঁছোত, আর বজ্রযোগিনীর মানুষেরা সে বিষয়ে সতর্ক থাকতো। কারণ এদের অনেকেই নানা কাজে প্রায়ই ঢাকা যেতে হতো। দাঙ্গার খবর পেলে ঢাকাযাত্রী হিন্দুরা ঢাকা রেল স্টেশনে বা বাস স্ট্যান্ড থেকে শহরে হিন্দু পল্লীর ভিতর দিয়ে সাবধানে যাতায়াত করতো, আর মুসলমানেরা মুসলিম পল্লীর ভিতর দিয়ে। কিন্তু ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কখনও ব্যাপক আকার ধারণ করেনি। হিন্দুর মন্দিরে গরুর মাংস ছুঁড়ে মারা, মুসলিম মসজিদে শুয়োরের মাংস ফেলা, মসজিদের সামনে দিয়ে দুর্গাঠাকুরের ভাসানের মিছিল বা মন্দিরের পাশ দিয়ে মহরমের মিছিল, ইত্যাদি ঘটনাকে উপলক্ষ করে ছোটোখাটো দাঙ্গা হতো। কিন্তু বজ্রযোগিনীর হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঢাকা শহরের সেসব দাঙ্গার কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েনি, আর তাদের পারস্পরিক সম্পর্কও প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা বিষাক্ত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ১৯৪২ এর পর থেকে, বিশেষত ১৯৪৬-৪৭ সনে সারা ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে বজ্রযোগিনীর উপরও এসে পড়েছিল।

‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় বজ্রযোগিনীর মুসলিমদের মধ্যে একা রমিজুদ্দিন কিভাবে প্রচণ্ড লড়াই করে ইংরেজ পুলিশকে বাধা দিয়েছিল, আর ফলে গ্রেপ্তার হয়ে ব্রিটিশ কারাগারে নির্মম শারীরিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিল, সেকথা আগেই উল্লেখ করেছি। বিশেষত রমিজুদ্দিন পুলিশের নৌকো টেনে ধরে ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান দিয়ে বজ্রযোগিনীর সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হয়েছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রায় অপরিহার্য আঙ্গিক হিসেবে ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান সম্বন্ধে অবশ্য ভারতের মুসলিম নেতারা অনেক আগে আপত্তি করে এসেছিলেন। কারণ এর মধ্যে তারা সঙ্গত কারণেই হিন্দু ধর্মীয়তার পরিচয় দেখতে পেয়েছিলেন, বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পটভূমিতে। আবার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়ও হিন্দুরা ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান দিতো। প্রকৃতপক্ষে মহম্মদ আলি জিন্নাহ এবং অন্যান্য মুসলিম নেতারা এই ‘বন্দেমাতরম’ প্রসঙ্গ বারবার তুলেও হিন্দু নেতাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাননি। অতএব ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা একম্ত্র ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া সাধারণত ‘বন্দেমাতরম’ বলতে অস্বীকার করতেন। বজ্রযোগিনীতেও একমাত্র ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় রমিজুদ্দিন ছাড়া আর কোনো মুসলমানকে আমি ‘বন্দেমাতরম’ বলতে শুনিনি। আর রমিজুদ্দিনের এই স্লোগান দেওয়া নিয়ে হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক বিভাজন প্রকাশ্যে এসে পড়েছিল।

তাছাড়াও মুসলিম লিগ কর্তৃক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে কেন্দ্র করে সারা ভারতেই রাজনীতির আবরণে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিচ্ছেদ বেড়ে উঠতে শুরু করেছিল, আর বজ্রযোগিনীর হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কও সে বৃহত্তর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দিয়ে প্রভাবিত হতে আরম্ভ করেছিল। মুসলিম গরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠিত না হলে স্বাধীন ভারত কার্যত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হবে, আর সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের সব মানুষ দমন-শোষণ-নির্যাতনের শিকার হবে, এই বিশ্বাস দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের মনে দানা বাঁধতে আরম্ভ করে। আর ধীরে ধীরে বজ্রযোগিনীতেও মৌলবী, মোল্লা, ইমাম প্রভৃতি মুসলিম নেতাদের মাধ্যমে এবং মুসলিম লিগের প্রচারকদের মাধ্যমে অধিকাংশ মুসলিমদের মনে এ ধরনের বিশ্বাস গড়ে উঠতে আরম্ভ করে। আর সে কারণে তারা ক্রমশ বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিতে আস্থাশীল হয়ে ওঠে। পঞ্চাশের মন্বন্তরের দুর্যোগে হিন্দু-মুসলমান বিচ্ছেদ কিছুটা স্তিমিত হয়েছিল। কারণ গরীব হিন্দু আর গরীব মুসলমান সকলেই সমানভাবে ঘোর দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিলেন। বারো বছরের আমি নিজ হাতে বজ্রযোগিনী বাজারের লঙ্গরখানায় একই সারিতে বসা হিন্দু-মুসলমান কঙ্কালদের লাপসি পরিবেশন করেছি। দুর্ভিক্ষের প্রকটতা কাটতে কাটতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে এসেছিল, আর তখনই বজ্রযোগিনীতে আবার হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল।

১৯৫৪ সনের শেষ দিকে কয়েকটা ছোট ছোট ঘটনা থেকে আমি ক্রমবর্ধমান হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিচ্ছেদের কিছু পরিচয় পেলাম। আমার বাবা গ্রাজুয়েট এবং স্কুলের শিক্ষক হিসেবে গ্রামের অনেক মানুষের কাছে কিছুটা মৌখিক সম্মান পেতেন। কম বয়স্ক অথবা নিম্নবর্গের হিন্দুরা বাবাকে রাস্তায় দেখতে পেলে ‘নমস্কার’ জানাতো, আর মুসলমানেরা ‘আদাব’। বাবাও উত্তরে হাত তুলে নমস্কার বা আদাব জানাতেন। একদিন বিকেলে বাবা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বললেন যে আজ তাকে সোভান মিঞা রাস্তায় আদাব না জানিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে। তারপর অন্য কয়েকজন মুসলমান গ্রামবাসীর কাছেও বাবা একই রকম ব্যবহার পেয়ে মনঃক্ষুন্ন হলেন। অবশ্য বাবাকে আদাব জানাবার তাদের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু যারা এতোকাল সেই সম্মান দেখিয়েছে তারা আজ বিরূপ হওয়াতে শুধু যে বাবা কিছুটা বিচলিত হলেন তাই না, আমরা ছোটবড় সবাই বুঝতে পারলাম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাওয়া বজ্রযোগিনীতে কোন দিকে বইতে শুরু করেছে। কিন্তু বাবার কপালে এর চেয়েও অনেক বেশি দুঃখ অপেক্ষা করছিল, অবশ্য অংশত বাবার নিজের দোষেই।

একদিন দুটো গরু আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে ঢুকে গাছপালার কিছু ক্ষতি করে। বাবা দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখেন যে গরু দুটোর পেছনে একটি ১৭/১৮ বছরের ছেলে আছে। অর্থাৎ সে ইচ্ছে করেই যেন আমাদের বাগানে গরু ঢুকিয়ে দিয়েছে। বাবা রেগে গিয়ে গরু রাখাল সবাইকে তাড়িয়ে দিলেন, আর তাড়াতে গিয়ে ছেলেটির পিঠে কঞ্চির দু ঘা বসিয়ে দিলেন। ছেলেটি লুঙ্গি পরা ছিল, এতএব বাবা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে সে মুসলমান, কিন্তু অবশ্যই সেকথা ভেবে তিনি তাকে মারেননি। বাব এমনিতেই খুব রাগী ছিলেন, আর রেগে আমাদেরও খুব মারধোর করতেন, সেসব কাহিনী আগেই বলেছি। তাছাড়া এরকম ক্ষেত্রে গরু আর রাখালকে কিঞ্চিত শাসন করা বজ্রযোগিনীর সাধারণ নিয়ম ছিল। এর আগে কখনও এরকম ঘটনার সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের প্রসঙ্গ জড়িয়ে পড়বার কথা শোনা যায়নি। কিন্তু সেদিন বিকেলে আমার সোনাদাদু আদিনাথ চক্রবর্তী লোক পাঠিয়ে বাবাকে জানালেন যে ধলাগাঁও-রামসিং অঞ্চল থেকে বেশ কিছু নেতৃস্থানীয় মুসলমান এসেছেন তাদের একজন যুবককে বাবা কেন মেরেছেন সে বিষয়ে বিচার চাইতে। ঘটনার গুরুত্ব আমিও বাবার পেছন পেছন সোনাদাদুর, অর্থাৎ আমাদেরই পুরনো বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি সেখানে অন্ততপঞ্চাশ-ষ্ট জন বয়স্ক মুসলিম জড়ো হয়েছেন, আর পুকুরের ধারের রাস্তা দিয়ে আরও অনেক লোক ধলাগাঁও-রামসিঙের দিক থেকে তখনও আসছে। দাদুর বারান্দায় বিচার সভা বসলো। বাবা ঘটনা ব্যাখ্যা করলেন, কিন্তু মুসলিম নেতারা তাতে সন্তুষ্ট হলেন না। বিচার সভার সাম্প্রদায়িক রূপ দেখে, আর সোনাদাদুর পরামর্শে বাবা শেষ পর্যন্ত নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন। যাবার সময় দুয়েকজন মুসলিম যুবক বাবাকে লক্ষ করে বললো যে আবার এরকম ঘটনা ঘটলে বাবাকে তারা শেষ করে ফেলবে। অবশ্য দুয়েকজন বৃদ্ধ মুসলমান তাদের নিরস্ত করবার চেষ্টা করে বললেন, সকলের সামনে যখন ক্ষমা চেয়েছে তখন আর বাড়াবাড়ির দরকার নেই। এক বছর আগেও এরকম সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ঘটনার সাম্প্রদায়িক রূপান্তর এবং পরিণতি কল্পনা করা যেতো না।

সে বছরেই, এবং পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৪৬ সনের প্রথম দিকে আমার নিজেরও কয়েকটা অভিজ্ঞতা হলো, যা তেকে আমার কাছেও বজ্রযোগিনীতে বেড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িকতার রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। আগেই বলেছি, আমাদের বাড়িতে বোসপাড়ার লস্কর বাড়ির ওসমান মিঞা দৈনিক দুধের যোগান দিত। সে দুধ ছিল তার নিজের গরুর, আর এভাবে দুধ বিক্রি করা ছিল তার সকালের পার্টটাইম কাজ। তারপর সে তার নিজের জমি চাষ করত। একদিন সে জমিতে লাঙল দিচ্ছিল, আর আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তোর বাবার নাম কিরে?” হঠাৎ এই প্রশ্নের কারণ বুঝতে পারলাম না। বাবার অবশ্র ঠাকুরমার দেওয়া ডাকনাম ছিল বিরাজ। অনেকে তাকে এই নামেই জানতো। তাতেই ওসমান মিঞার কাজ চলে যাবার কথা। তাছাড়া প্রশ্নটার মধ্যে আমি একটা অস্বাভাবিক গন্ধ পেয়েছিলাম। যাই হোক, আমি বুক টান করে বললাম, “শ্রীযুক্ত বাবু প্রিয়নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।” শৈশব থেকে এভাবেই আমাদের গুরুজনদের নাম, বিশেষভাবে বাবার নাম বলতে শেখানো হয়েছিল। বলা বাহুল্য, এভাবে বাবার নাম বলার মধ্যে ওসমানকে হেয় করবার কোনও অভিসন্ধি আমার ছিল না। কিন্তু ওসমান খুব রেগে গিয়ে বলল, “আবার শ্রীযুক্ত বাবু এইসব কীত্তনের কি দরকার? খালি পিত্তনাথ বঙ্গোপাধ্যায় ( এভাবেই সে বাবার নাম উচ্চারণ করল) কইলে কি তোগ জাইত যাইব?” আমি শুনে একেবারে থ হয়ে গেলাম, আর আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরে এলাম। এভাবে তো বাবার নাম আগে হিন্দু-মুসলমান সকলের কাছে কতোবারই বলেছি, এরকম প্রতিক্রিয়া তো কখনও দেখিনি। আমার মনে হলো, বজ্রযোগিনীর সমাজ জীবনে যে সাম্প্রদায়িকতার হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছিল, তারই কিছুটা স্পর্শ যেন ওসমান মিঞার কথায় ও ব্যবহারে পাওয়া গেল।
আমার আরেকটি অভিজ্ঞতা হল লস্কর বাড়ির গহুরকে নিয়ে। তার বয়স ছিল আমার চেয়ে অন্তত দশ বছর বেশি। সে আর তাদের বাড়ির আরেকটি মুসলমান ছেলে কালীজীবন সোমের বাড়ির দক্ষিণে পানের বোরোজের সামনে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। আমি দর্শক হিসেবে কাছেই দাঁড়িয়েছিলাম। গহুরের সঙ্গে প্যাঁচ খেলে অন্য একটা ঘুড়ি কাটা গেল। পেছনে কোনও জায়গা থেকে সে ঘুড়িটা ওড়ানো হয়েছিল। তাই সেটি কাটা যাবার পরে লাটাইয়ের সঙ্গে থাকা দীর্ঘ সুতোটি আমাদের কাছেই পড়ল। এই সুতোকে বজ্রযোগিনীতে ‘গোড়ের সুতা’ বলা হত। যার ঘুড়ি কাটা গেল সে লাটাই পেঁচিয়ে পুরো সুতোটাই টেনে নেবার আগে কেউ যদি সেটাকে ধরতে পারত, তাহলে ‘গোড়ের সুতার’ যে অংশ সে ছিঁড়ে নিতে পারত তাতে তার স্বীকৃত অধিকার থাকত। ঘুড়ি খেলার দর্শক এবং খেলোয়াড়দের হেলপারদের কাছে এটা ছিল একটা বাড়তি আমোদ। গহুরের ঘুড়িতে কাটা যাওয়া যে ঘুড়িটার ‘গোড়ের সুতা’ আমাদের কাছাকাছি পড়ল, আমি সেটাকে ধরবার জন্য ছুটলাম, কিন্তু ধরতে পারলাম না। সেই দেখে রাজ্জাক বলল, “গোড়ের সুতা নিবি?” আমি বললাম, হাঁ। গহুর ওর লুঙ্গি তুলে দেখাল। আমি একই সঙ্গে ভয়ানক রাগ আর ভয়ের শিকার হলাম। এরকম অভিজ্ঞতা আমার ছোট জীবনে আগে কখনও হয়নি। এ দৃশ্য দেখে আমি একদিকে যেমন সুন্নত করার মানে বুঝলাম, অন্যদিকে তেমনি ‘গোড়ের সুতা’ দেবার নামে ও যেভাবে আমাকে ভীষণ অপমান করল, তাও আমাকে বিমূঢ় করে দিল। কিন্তু আমি মগ্ন চৈতন্যে তখনি অনুভব করলাম যে একথা আমি বাবা কিংবা অন্য কারও কাছে প্রকাশ করলে তুলকালাম কাণ্ড বেধে যাবে, আর সম্ভবত সাম্প্রদায়িক সংঘাতের রূপ নেবে। তাই নিজের অপমান চুপ করে সহ্য করে গেলাম কাউকে কিছু না বলে। আমার মনে কোনও সন্দেহ রইল না যে বজ্রযোগিনীতে সাম্প্রদায়িকতার হাওয়া বইতে শুরু করবার ফলেই রাজ্জাক লুঙ্গি তুলে আমাকে এভাবে অপমান করতে সাহস পেয়েছিল। আগে কখনও এ ধরনের ঘটনা কল্পনা করা যেত না।

১৯৪৬ সনের গোড়ায় একদিন আমার স্কুলের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু দিলখুশ হায়দারের কাছে এক বান্ডিল মুসুলিম লিগের ছাপা হ্যান্ডবিল দেখে আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। এই দিলখুশ আমার চেয়ে তিনচার বছরের বড়ো ছিল। ১৯৪৫ সনের জানুয়ারি মাসে সে বাইরে থেকে এসে আমাদের সঙ্গে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিল। সে সুখবাসপুরের এক মুসলিম পরিবারে অতিথি হিসেবে থাকত, আর সেখান থেকে স্কুলে যাতায়াত করত। জিজ্ঞেস করলে বলত যে আগে সে বারমায় থাকত, সেখানেই পড়াশুনা করেছে। বজ্রযোগিনীতে সে নানা কারণেই একটু বেমানান ছিল। প্রথমত, তার একটা নিজস্ব সাইকেল ছিল, যা গ্রামের আর কোনও ছাত্রের ছিল না। প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র এম.বি. ডাক্তার এবং এল.এম.এফ ডাক্তার সুরেশ দত্তর ছিল। দ্বিতীয়ত, সে খাকির সফরি স্যুট জাতীয় একটা পোষাক পরত, যেটা ছিল বেশ দামী আর বজ্রযোগিনীতে এরকবারেই অভিনব। আর তার হাতে বেশ পয়সাও থাকত। তৃতীয়ত, সে মোটামুটি বাংলা জানলেও ইংরেজি, উর্দু এবং আরবি আরও বেশি জানত। হাই স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র সে-ই ইংরেজিতে খুব ভালো কথা বলতে পারত। আমিও অবশ্য ইংরেজিতে ভালো ছিলাম, আর লেখা পরীক্ষায় এর চেয়ে অনেক বেশি নম্বর পেতাম। শুদ্ধ মৌখিক ইংরেজিও বলতে পারতাম। কিন্তু ওর ইংরেজি উচ্চারণ ও কথা শুনলেই বোঝা যেত যে ইংরেজিতে কথা বলায় ও অনেক বেশি অভ্যস্ত ও প্রশিক্ষিত। চতুর্থত, সে প্রায়ই সাইকেলে চেপে বজ্রযোগিনীর বাইরে অনেক দূর দূরান্তে যাতায়াত করত। তাছাড়া মাঝে মাঝেই নদী পেরিয়ে স্টিমার চেপে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি দূরের শহরে ‘আত্মীয়ের বাড়ি’ অথবা কাজে যাতায়াত করত। এই বয়সের এরকম কিশোর-যুবা বজ্রযোগিনীতে আর কেউ ছিল না।
এই দিলখুশ হায়দারের সঙ্গে ক্রমশ আমার বেশ গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। ও মাঝে মাঝেই স্কুল থেকে ফেরার সময় ওর সাইকেলের পেছনে আমাকে বসিয়ে সুখবাসপুর যাবার পথে ভট্টাচার্য পাড়ার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে যেত। তাছাড়া ওর ভালো ইংরেজি বলা, আধুনিক এবং কিছুটা বিদেশী চরিত্র আমাকে আকৃষ্ট করত। একবার অবশ্য ওকে আমি ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিয়ে প্রাইজ পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি তখনই বুঝেছিলাম যে প্রতিযোগিতার বিচারক বিটি মাস্টারের অজ্ঞতা অথবা পক্ষপাত বশতই ওর আবৃত্তির চেয়ে আমার আবৃত্তি উন্নত বিবেচিত হয়েছিল। কবিতাটি ছিল “দেয়ার ডোয়েন্ট এ মিলার হেইল এন্ড বোলড/বিসাইড দ্য বিভার ডি” ইত্যাদি। দিলখুশ এটি আবৃত্তি করেছিল অনেকটা গদ্য পড়ার ভঙ্গিতে। অনেক পরে আমি জেনেছিলাম যে সেটাই ইংরেজি কবিতা আবৃত্তির সঠিক পদ্ধতি। কিন্তু আমি আবৃত্তি করেছিলাম অনেকটা সুর করে, যেভাবে আমাদের স্কুলে শেখানো হয়েছিল। বিটি মাস্টার ওকে পুরস্কৃত না করে আমাকেই করেছিলেন। কিন্তু আমি পরে সরল মনে দিলখুশকে বলেছিলাম যে আমার মতে আমার চেয়ে ওর আবৃত্তিই ভালো হয়েছিল। তাছাড়া ও ফুটবল, ভলিবল প্রভৃতি খেলাধুলোয় অংশ নিত। ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ত, আর দেশবিদেশের খবরাখবর রাখত। সবসুদ্ধ আমার বন্ধু হায়দার ছিল বজ্রযোগিনীতে বেমানান এক চৌকশ যুবক, যাকে ঠিক কিশোর বলা যেত না।

কিন্তু ১৯৪৬ সনের গোড়ায় একদিন এই দিলখুশের কাছেই আমি অপ্রত্যাশিত এবং আদর্শগত আঘাত পেলাম। দেখরাম সে বড় সড়কে সাইকেল চেপে মিরকাদিমের দিক থেকে আসছে, কিন্তু পেছনের সিট খালি নাই। সেখানে বেশ বড় এক বান্ডিল কাগজ। সেটা কী দেখবার জন্য বন্ধুসুলভ ভাবে আমি বান্ডিলটি তুলে দেখি যে তার মধ্যে ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে লেখা অনেকগুলো হ্যান্ডবিল। দিলখুশের নিষেধ না শুনে একটা তুলে নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলাম যে সেগুলি মুসলিম লীগের প্রচারের হ্যান্ডবিল। তাতে শুধু যে পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন করতে সব মুসলমানকে আহবান জানানো হয়েছে তাই নয়। সরাসরি সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করতেও প্ররোচিত করা হয়েছে। আমি এত শক পেলাম যে প্রথমে আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরল না। তারপর শুধু জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি মুসলিম লিগের প্রচারক?” আমার বন্ধু দিলখুশ উত্তর না দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ রাস্তার ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওর সম্বন্ধে অনেক কিছুই আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। ও আসলে বাঙালি নয়। বারমা থেকে এসেছে বলেও মনে হয় না। ভারতেরই কোনও জায়গা থেকে মুসলিম লীগের প্রচারক হিসেবে ওকে বজ্রযোগিনীতে পাঠানো হয়েছে একটা এলাকার দায়িত্ব দিয়ে। সে কারনেই ওর সাইকেল, দূরে দূরে যাতায়াত, বিজাতীয় পোষাক, ভালো ইংরেজি আর উর্দু এবং চলনসই বাংলা বলা। আর আমার মগ্ন চৈতন্যে অনুভব করলাম, ছোট ছোট অনেক ঘটনার মধ্যে যে সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শ পেতে আরম্ভ করেছিলাম, তার শেকড় বজ্রযোগিনীর সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। বাইরের ভারতের ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক প্রভাব থেকে আমার জন্মভূমি বজ্রযোগিনী আর মুক্ত নয়।

একদিন হঠাৎ খবর রটে গেল যে সুখবাসপুর আর আটপাড়ার মাঝখানে একটা বড় ক্ষেতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা আরম্ভ হয়েছে। অন্য অনেকের সঙ্গে আমিও ছুটে গেলাম ঘটনা দেখতে। দূর থেকে একটা উঁচু ঢিবির উপর আরও কয়েকজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখলাম যে যেখানে দুপক্ষের মারামারি হচ্ছে সেটা একটা লাঙল দেওয়া খালি ধানক্ষেত। বড়ো বড়ো শুকনো মাটির ঢেলা সর্বত্র পড়ে আছে, তখনও বীজ বোনা হয়নি। সেখানে লাঠি, কোদাল,ইট মাটির ঢেলা প্রভৃতি নিয়ে দুদলে মারামারি হচ্ছে। পূব দিকের হিন্দু পল্লী থেকে হিন্দুরা এগিয়েছে, আর পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে মুসলমানেরা। কয়েকজনকে মার খেয়ে অসাড় হয়ে পড়ে যেতে দেখলাম। তারা সবাই হিন্দু। প্রথমে মনে হল তারা মারাই গেছে। কিন্তু একটু পরে তারা উঠে পালিয়ে এল। ঘন্টা দুই এভাবে চলার পর মারামারি শেষ হল। শেষটায় মুসলমানেরা জমির দখলে রইল। আর হিন্দুরা মার খেয়ে পালিয়ে এল। আমিও গুরুতর মানসিক আঘাতে আচ্ছন্ন হয়ে ভয়ে বিস্ময়ে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে এলাম। বজ্রযোগিনীতে এর আগেও জমি নিয়ে হিন্দুতে হিন্দুতে, মুসলমানে মুসলমানে, এবং হিন্দু-মুসলমানে ছোটখাট ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মকদ্দমা লেগেই থাকত। কিন্তু সেসব বিবাদ ছিল জমি নিয়ে, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে আগে কখনও সেগুলিকে দেখা হয়নি। এই প্রথম জমি নিয়ে বিবাদ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা দাঙ্গার রূপ ধারন করল। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ যে জনজীবনের গভীরে প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছে, মে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহের অবকাশ রইল না। আরেকটা উপলব্দিও হিন্দু ‘ভদ্রলোকদের’ মধ্যে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তারা বুঝতে পারলেন যে সত্যি সত্যি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে গেলে তাদের পক্ষে আত্মরক্ষা কোনও ভাবেই সম্ভব হবে না। সুখবাসপুর-আটপাড়ার দাঙ্গা অল্পের উপর দিয়ে গেছে। মামুলি অস্ত্র এবং হাতাহাতির লড়াইয়ে হিন্দুরা অল্পসংখ্যক মুসলমানের কাছে পরাজিত হয়েছে। মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রামসিং, ধলাগাঁও, রামপাল, রঘুরামপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে মুসলমানেরা যদি সংঘবদ্ধভাবে কখনও হিন্দুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়, তবে নিঃসন্দেহে সব হিন্দুর জীবন বিপন্ন হবে। তখন থেকে একথা গ্রামের হিন্দু ‘ভদ্রলোকেরা’ নিজেদের মধ্যে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে আলোচনা করতে লাগলেন।

বলা বাহুল্য, ১৯৪০ সনে মুসলিম লিগের পাকিস্তান প্রস্তাব থেকে আরম্ভ করে ১৯৪২ সনের ক্রিপস প্রস্তাব, মুসলিম জনসাধারনের ইপর মুসলিম লিগের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, ১৯৪৬ সনের মে মাসের ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনেক বিবাদ-বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে মুসলিম লিগ দ্বারা গ্রহণ, অন্তবর্তী সরকারের গঠন নিয়ে দুই দলের মধ্যে তীব্র মতভেদ প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহের সব খবরই সংবাদপত্র, রেডিও এবং লোকমুখে বজ্রযোগিনী পৌঁছেছিল। যে উত্তুঙ্গ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মধ্য দিয়ে দেশ তখন দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে চলেছিল, তার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব বজ্রযোগিনীর সমাজ জীবনেও এসে পড়েছিল। উপরে যেসব সাম্প্রদায়িক বা আধা-সাম্প্রদায়িক ঘটনার উল্লেখ করেছি, সেগুলিও এ কারণেই ঘটেছিল। এভাবে ১৯৪৬ সনে বজ্রযোগিনীতে সাম্প্রদায়িকতা প্রায় প্রকাশ্যে চলে এসেছিল। মণিমেলায় মুসলিম ছাত্রদের যোগ না দিতে এবং কোনও রকম অংশগ্রহণ না করতে মৌলবী সাহেবের নির্দেশ এবং স্কুলের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব নিয়ে যে ঘটনার উল্লেখ করেছি আগের পরিচ্ছেদে, তাও ঘটেছিল এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবেশের মধ্যেই। কিন্তু এতসব ঘটনা সত্ত্বেও বজ্রযোগিনীতে ১৯৪৬ সনের অগাস্ট মাস পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা ছিল অর্ধসুপ্ত। সে বছর ১৬ অগাস্ট মুসলিম লিগ ঘোষিত ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’তে কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গা এবং তারপর নোয়াখালি ও বিহারে ব্যাপক এবং মারাত্মক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর এসে পৌঁছোনর পর বজ্রযোগিনীতর সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া প্রায় বিস্ফোরক স্তরে পৌঁছে গেল।
১৭ অগাস্টের সব খবরের কাগজে কলকাতার দাঙ্গার বিস্তারিত খবর বজ্রযোগিনীতে এসে পৌঁছোল। আমি সকাল দশটায় স্কুলে গিয়ে দেখলাম যে শিক্ষকদের বসবার ঘরে খবরের কাগজ পড়া আর উত্তেজিত আলোচনা চলছে। টিফিন পিরিয়ডে সেসব কাগজ ক্লাসে এনে আমরা ক্লাস টেনের ছাত্ররা পরস্পরকে পড়ে শোনাতে লাগলাম। আমি ইংরেজিতে ভালো বলে আমাকে ইংরেজি অমৃতবাজার পত্রিকা পড়ে শোনাতে বলা হল। সেখানে দাঙ্গাকারীদের স্লোগান, পাল্টা স্লোগান, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, এবং সুরাবর্দি সরকারের নিষ্ক্রিয়তা প্রভৃতি সব কিছু ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ পড়ে শোনাতে শোনাতে আমার মনে একই সঙ্গে এক তীব্র আদর্শগত বিদ্রোহ এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করে আমাকে বিহ্বল করে তুলল। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বিশ্বমানবতা আর কমিউনিস্ট আদর্শে অনুপ্রাণিত আমি কিছুতেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কোনও সুস্থ রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে মেনে নিতে পারলাম না। আর সেই সঙ্গে আমার মনে এ ভয়ও বাসা বাঁধল যে বজ্রযোগিনীতে সাম্প্রদায়িকতাকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, এবং অনিবার্যভাবেই অদূর ভবিষ্যতে বিশেষত ‘ভদ্রলোক’ হিন্দুদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। কয়েকদিনের মধ্যেই নোয়াখালি ও বিহারের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অগণিত মানুষের হত্যা ও ধ্বংসলীলার খবর এসে পৌঁছোল, আর সঙ্গে সঙ্গে বজ্রযোগিনীর হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক প্রায় বিস্ফোরক মাত্রায় পৌঁছে গেল।
আগেই বলেছি যে আমাদের গ্রামের ভৌগলিক গঠন ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের কয়েকটি ঘনবসতি পাড়া আর সংখ্যালঘু হিন্দুদের তুলনাক্রমে ছড়ানো, স্বল্পবসতি এবং সংখ্যায় অনেক বেশি পাড়ায় বিভক্ত। ১৯৪৬ সনের অগাস্ট মাসের শেষ দিকে মুসলিম আর হিন্দু অধ্যুষিত এবং ভৌগলিক তথা সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং আতঙ্ক প্রথমে ব্যাপক গুজবের রূপ নিল। বিশেষ করে দুই অঞ্চলেই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের শঙ্কায় রাতজাগা আরম্ভ হল। সকাল থেকে পথে ঘাটে, দোকানে-বাজারে, স্কুলে হিন্দু-মুসলমানের বহু পুরাতন স্বাভাবিক সম্পর্ক দিনের আলোয় আপাতদৃষ্টিতে বজায় থাকলেও, মানুষের চোখের দৃষ্টিতে, কথার ভঙ্গিতে আর পাস্পরিক ব্যবহারে প্রচ্ছন্ন অবিশ্বাস, সন্দেহ আর ভয় সম্বন্ধে কোনও সন্দেহের অবকাশ রইল না। এদিন সকালে বাজারে বাবার পরিচিত দুতিনজন নেতৃস্থানীয় সজ্জন মুসলমান বাবাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “মাস্টার বাবু, আপনেগো পাড়ায় নাকি পাঞ্জাবের থেইগা অনেক শিখ বড় বড় তরোয়াল লইয়া আইসা গোপনে জড় হইছে, আমাগো আক্রমণ করনের লেইগা? আপনের বাড়িতেও নাকি কয়েকজন লুকাইয়া রইছে?” বাবা উত্তরে হেসে বললেন যে তিনি ।নেক বছর আগে বাড়ি বানাবার সময় কিছু লোহার শিক কিনেছিলেন, আর তার দুয়েক টুকরো এখনও বাড়িতে পড়ে আছে। এছাড়া আর কোনও শিখ তিনি আমাদের বাড়িতে কিংবা পাড়ায় কখনও দেখেননি।

বজ্রযোগিনীর মুসলিম জনগণের কাছে যেমন তরোয়ালধারী পাঞ্জাবের শিখেরা ভীষণ যোদ্ধা বলে পরিচিত ছিল, এবং অতএব ভীতির করণ ছিল, তেমনি আবার হিন্দু মানসে ছিল ‘পেশোয়ারী পাঠান গুন্ডার’ ভয়ঙ্কর দুর্জয় ভাবমূর্তি। পাঞ্জাব থেকে শিখদের আগমন নিয়ে যে গুজব মুসলিম পল্লীগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি হিন্দু অঞ্চলগুলিতে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে রামসিং, ধলাগাঁও, রঘুরামপুর অঞ্চলে অসংখ্য পেশোয়ারী গুন্ডার আমদানি হয়েছে, আর তারা সব হিন্দুদের আক্রমণ করবার অপেক্ষায় সেখানে লুকিয়ে আছে। এসব গুজবের একটা তুলনাক্রমে ভালো দিক এই ছিল যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই মনে করত যে স্থানীয় গ্রামবাসীরা পরষ্পরকে আক্রমণ করতে উদ্যোগী হবে না। কিন্তু তথাপি পাঞ্জাবী শিখ আর পেশোয়ারী পাঠান গুন্ডাদের আগমনের গুজব উভয় শিবিরেই রাতজাগা এবং প্রতিরোধের বাসনা বাড়িয়ে তুলল। বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক বর্জিত দুটি কাল্পনিক পরদেশি আগ্রাসীর ভাবমূর্তি এভাবে নেহাৎ গুজবের মাধ্যমে আমাদের গ্রামে দ্রুত বেড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন জোগাল। এসব গুজবের উৎস কোথায় ছিল আমি জানতাম না। হয়তো দুদিকেই অল্প কিছু কল্পনাপ্রবণ মানুষ নিজেদের বিমূর্ত আতঙ্ককে এভাবেই মূর্ত করে তুলেছিলেন। অথবা এর পেছনে মুসলিম লিগ বা হিন্দু মহাসভার চরদের গোপন ষড়যন্ত্র থাকাও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সম্পূর্ণ মিথ্যা গুজব কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে, তা আমি ১৯৪৬ সনের বজ্রযোগিনীতে প্রত্যক্ষ করেছি।

যাই হোক, কাল্পনিক পোশোয়ারী গুন্ডাদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে একদিন সন্ধের পর আমাদের ভট্টাচার্য পাড়া, আর তার লাগোয়া সোমপাড়া, আর ঘোষপাড়ার যুবক ও কিশোরদের নিয়ে একটা মিটিং ডাকা হল। সোমপাড়ার কলকাতাবাসী প্রভাত সোমের একটা দোতলা পাকা বাড়ি খালি পড়ে ছিল। সে বাড়ির দোতলায় সন্ধে সাতটায় ঢাকা দেওয়া লন্ঠনের সামান্য আলোতে গোপন মিটিং বসল। সবসুদ্ধ আমার মতো দশবারোজন কিশোর আর আর আমাদের চেয়ে কিছু বড় তিনচারজন যুবক। আমাদের বাড়ির দক্ষিণের ভট্টাচার্য বাড়ির বেকার যুবক যোগেশ্বর, আমার যোগাদা, নিজেই নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। কারণ তার শক্তিমাণ আর সাহসী হিসেবে খ্যাতি ছিল। তাছাড়া মুসলিম পাড়াগুলি থেকে পশোয়ারী গুন্ডাদের আক্রমণ শুরু হলে তাদের পথে প্রথমেই পড়বে ভট্টাচার্য পাড়া। অতএব সে পাড়ার যুবকদের হাতে প্রতিরোধের নেতৃত্বই থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা এই ছিল যে যোগাদা বিশেষ লেখাপড়া জানতেন না। বজ্রযোগিনীর বাইরে মুন্সীগঞ্জ বা ঢাকা ছাড়া আর কোথাও যাবারও সুযোগ হয়নি। পেশোয়ার সম্বন্ধে তার প্রায় কোনই জ্ঞানই ছিল না, আর সেখানকার গুন্ডাদের সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল সম্পূর্ণই নিজ কল্পনার উপরে প্রতিষ্ঠিত। তিনি বললেন যে পেশোয়ারী গুন্ডারা খুব বিশালকায় আর মহাশক্তিশালী হয়ে থাকে। তাদের গায়ের রং কয়লার মতো মিশকালো। তাদের হাতে একটা ছোট বেটন বা লাঠি ছাড়া আর কোনও অস্ত্র থাকে না। কিন্তু শুধু সেটা দিয়েই তারা অনেক মানুষ মেরে ফেলে, আর বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। তাদের একেক জনকে ঠেকাতেই আমাদের দিকে অনেক লোকের প্রয়োজন। অতএব যুবক-কিশোর নির্বিশেষে আমরা সবাই যেন প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত হই। এসব কথা ফিসফিস করে বলার সময় যোগাদার গা থেকে ঘাম ঝরছিল, তার হাত পা কাঁপছিল, আর তিনি বার বারে ঢোঁক গিলছিলেন। আর শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ বারে বারে বাইরে যাচ্ছিলেন। পেশোয়ারী গুন্ডার নামেই এই অবস্থা, আর তাদের সামনে দেখলে যোগাদাসহ আমাদের দশবারো জনের যে কি অবস্থা হবে তা ভেবে আমার দম বন্ধ হয়ে এলো, একটু হাসিও পেল। এর চেয়ে হাস্যকর আত্মরক্ষার প্রস্তুতি কি কল্পনা করা যায়? মুসলিম পাড়াগুলিতেও নিশ্চয় পাঞ্জাবী শিখ আক্রমণের প্রতিরোধের প্রস্তুতির জন্য মিটিং হয়েছিল। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে সেগুলি এমন হাস্যকর রূপ নিয়েছিল।
কিন্তু বাইরের ঘটনা প্রবাহের অভিঘাত, গুজব আর আতঙ্ক অল্প কালের মধ্যে বজ্রযোগিনীর দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কাছাকাছি নিয়ে এলো। একদিন রাত্রিবেলা বয়স্ক হিন্দু ‘ভদ্রলোক’দের একটা মিটিং হল সোমপাড়ার সূর্য সোমের দালানে। সেখানে বাবার সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। বোস পাড়ার গিরীন্দ্র বোস, ঘোষ পাড়ার ক্ষিতীশ চ্যাটার্জি, প্রাক্তন বিপ্লবী তরণী সোম সহ বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি সে মিটিং-এ উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার বিষয় ছিল মুসলমানদের তরফ থেকে সম্ভাব্য আক্রমণের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তরণী সোম এক সময় সারা বাংলার বিখ্যাত স্বদেশী বিপ্লবী ছিলেন। বোমা তৈরী, রিভলবার বা বন্দুক চালানো প্রভৃতিতে তিনি যৌবনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি ঘটনাচক্রে সে সময়ে বজ্রযোগিনীতে ছিলেন। কিন্তু মিটিং-এ তিনি কোনও মুখ্য ভূমিকা অবলম্বন করলেন না। চুপচাপ সকলের পেছনে বসে থাকলেন। বোধ হয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে যৌবনে স্বদেশী বিপ্লব করা আর পরিণত বয়সে দাঙ্গা করা এক জিনিস নয়। দরজা-জানালা বন্ধ করে যখন মিটিং শুরু হলো, তখন ক্ষিতীশ চ্যাটার্জিই প্রধান বক্তা হলেন। ইনিও এক সময়ে স্বদেশী বিপ্লবী ছিলেন এবং অনেক স্বদেশী ডাকাতি করেছিলেন। লোকে বলত যে রে তিনি সাধারণ ডাকাতিও করতেন। আমার ছোট ভাই ভাস্কর পরে এর কন্যাকে কলকাতায় বিয়ে করেছিল। যাই হোক, এই ক্ষিতীশ চ্যাটার্জি বললেন যে গিরীন্দ্র বসু ও সূর্য সোমের লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুক আছে। সূর্য সোম তখন দেশে নেই, কিন্তু তার স্ত্রী আছেন, এবং তার কাছেই বন্দুক আছে আর তিনি তা চালাতেও জানেন। আরও দুয়েকটি বন্দুক জোগাড় হয়ে যাবে। মুসলমানদের আক্রমণ আসন্ন দেখলে এ বন্দুকগুলিকে জড়ো করে তারপর আক্রমণের সম্ভাব্য সব রাস্তায় বন্দুক চালাতে জানা একেক জনকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। মেয়ে ও শিশুদের সব বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিতে হবে। আর পুরুষরা সব যে যার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে এগিয়ে যাবে। ক্ষিতীশ চ্যাটার্জি এই বলে সভা শেষ করলেন যে তরণীদা যখন গ্রামে রয়েছেন তখন চিন্তার কোনও কারণ নেই। এতক্ষণে তরণী সোম প্রথম কথা বললেন। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন যে অন্তত দুটো ঘোড়া দরকার। এই শুনে সবাই চুপ করে গেল। কারণ সবাই জানতো যে বজ্রযোগিনীতে কিংবা আশেপাশে কোথাও কোনও ঘোড়া ছিল না। আমার মনে হলো যে বড়োরা বোধ হয় তালে তলে গোপনে কোনও বিরাট প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু সবই যে ছিল ফাঁকা বুলি তা প্রমাণ হতে বেশি সময় লাগল না।

অস্ত্রশস্ত্র বলতে হিন্দু পাড়ার মানুষদের কাছে লাঠি, দা, রামদা বা খাঁড়া, কোদাল, খন্তা প্রভৃতি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কাজেই বুড়োদের সঙ্গে পরামর্শ করে যুবকেরা ঠিক করল যে সুপুরি গাছ কেটে গোপনে তা থেকে বর্শা, তীর আর ধনুক তৈরী করা হবে। বাজারের হালুইকর সন্তোষ সোম চারিদিকে ধানক্ষেত আর গাছপালায় ঘেরা সোমপাড়ার একটা তুলনাক্রমে বিচ্ছিন্ন বাড়িতে থাকতেন। তার ছেলে ধীরেন আমার সঙ্গে পড়ত। ঠিক হলো যে প্রতি রাত্তিরে সেখানে বসে সুপুরি গাছের এসব অস্ত্র বানানো হবে। সেই মতো রাত্তিরের খাওয়া শেষ করে কয়েকজন যুবক সন্তোষ সোমের বাড়িতে জড়ো হয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে সুপুরি গাছের বর্শা আর তীর-ধনুক বানাতে আরম্ভ করল। বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী এবং পরিবারের সুরক্ষার তাগিদে আমিও সে দলে সামিল হলাম। অল্প দিনের মধ্যেই সুপুরি গাছ থেকে তৈরী এসব অস্ত্রের স্তূপ জমে গেল। অথচ সত্যি সত্যি ব্যাপক আক্রমণ নেমে এলে এসব আদিম অস্ত্র কিভাবে আর কোথায় আমরা ব্যবহার করব, সে বিষয়ে আমাদের কারোই কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এসব বানাবার মধ্যে শুধু একধরনের সাহস ও শৌর্যের অনুভূতি ছিল, আর তাতেই আমরা আকৃষ্ট হতাম। কার্যত এগুলিরও কোনও ব্যবহার হয়নি। বোধ হয় হওয়া সম্ভবও ছিল না।

ব্যক্তিগত স্তরেও অনেকেই মানসিক ও শারীরিক ভাবে পেশোয়ারী গুন্ডা আর স্থানীয় মুসলিমদের সম্ভাব্য যুগ্ম আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করল। বেশিরবাগ ক্ষেত্রেই এই প্রস্তুতি অবশ্য ছিল শুধুমাত্র ভয়মিশ্রিত কল্পনায় অধিষ্ঠিত, আর ইচ্ছাপূরণের অসহায় বহিঃপ্রকাশ। নগী পিসীমার বাড়ির উঠোনের দক্ষিণের ঘরে যে হাইস্কুলের যুবক সংস্কৃত শিক্ষক জগদীশ চক্রবর্তী স্ত্রী, বাচ্চা ছেলে আর ছিটগ্রস্ত ছোট ভাইকে নিয়ে বাস করতেন তা ইগেই বলেছি। সে উঠোনেরই উত্তরের ঘরে তখন সাময়িক ভাবে আমার সহপাঠী বন্ধু ভূপেন থাকত। কারণ ওর পরিবারের অন্য সবাই তখন ওর বড় দাদার কাছে রায়পুরে চলে গিয়েছিল। ধলাগাও-রামসিং-রঘুরামপুর অঞ্চল থেকে যখন আক্রমণ আসন্ন মনে হল, তখন একদিন নগী পিসিমার বাড়ি গিয়ে দেখলাম জগদীশ স্যর উঠোনে ডন-বৈঠক করছেন, আর ভূপেন এবং অন্যান্যরা তা দাঁড়িয়ে দেখছে। ব্যায়াম শেষ হলে পণ্ডিত মশাই আমার আর ভূপেনের দিকে ফিরে বললেন, তোরা কোনও চিন্তা করিস না। আক্রমণকারীরা যদি আসে তবে প্রত্যেকটাকে এই ভাবে চিৎ করে মাটিতে ফেলে এইভাবে তাদের বুকের ওপর চেপে বসে এই ভাবে চোখ দুটো তুলে নেব। বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অ্যাকশনটাও দেখালেন। এই দেখে আমি আর ভূপেন অবশ্য বেশি আশ্বস্ত হতে পারলাম না। আর পণ্ডিত মশাইয়ের চোখমুখ দেখে মনে হল না নিজের আশু বীরত্বের কল্পনা থেকে তিনি বিশেষ সাহস পাচ্ছেন।

যেদিন রাত্রে সত্যি একটা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের উপক্রম হল, সেদিন হিন্দু পাড়াগুলোর বাসিন্দাদের সাহস আর সংগঠন ক্ষমতার স্বরূপ ধরা পড়ে গেল। মাঝ রাতে হঠাৎ রামসিং-এর দিক থেকে বহু লোকের ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি উঠল। একটু পরে হিন্দু অঞ্চলগুলির ভিন্ন ভিন্ন বাড়ি থেকে কিছুটা ছড়ানো ভাবে ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি উঠল। তারপর ধলাগাঁও-রামসিং অঞ্চল থেকে সমবেত ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি উঠতে লাগল।হঠাৎ দেখি অন্ধকারের মধ্যে ছুটতে ছুটতে জগদীশ পণ্ডিত মশাই তার স্ত্রী, বাচ্চা আর ভাইকে নিয়ে আমাদের বাড়ির উঠোনে উপস্থিত। হাঁপাতে হাঁপাতে মাকে বললেন, বৌদি, আমি, এদের নিয়ে হেমাঙ্গ ব্যানার্জির বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছি, আপনারাও তাড়াতাড়ি চলে আসুন, আজ কিন্তু বাঁচা কঠিন। তারপর পিল পিল করে নারী-পুরুষ বাচ্চা পূব দিক থেকে ছুটতে ছুটতে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে কেউ জঙ্গলে, কেউ সোমপাড়ার দিকে পালাতে লাগল। দুচারজন আমাদের বাড়িতেই লুকিয়ে রইল। গিরীন্দ্র বসু বা তার বন্দুক, অথবা ক্ষিতীশ চ্যাটার্জি বা তরণী সোমের কোনও চিহ্নই দেখা গেল না। আমার বাবা রামদা আর বর্শা ঠিক জায়গায় আছে কিনা দেখে নিলেন, কিন্তু তার বেশি কোনও উদ্যোগ নিলেন না। সংঘবদ্ধ ভাবে কোনও যুবা বা বয়স্ক লোকেদের উত্তর-পূব কিংবা পূব দিকে আক্রমণ প্রতিরোধে এগিয়ে যেতে দেখা গেল না। তীর ধনুকগুলিও স্তূপাকৃতি হয়ে সন্তোষ সোমের বাড়িতেই পড়ে রইল। পালাতে পালাতেও সবাই ‘বন্দেমাতরম্’ স্লোগান দিচ্ছিল। দুপক্ষের স্লোগান যখন তুঙ্গী, তখন হঠাৎ সোম পাড়ার দিক থেকে একটা বন্দুকের গুলির শব্দ হল। পরে আমরা জেনেছিলাম যে সূর্য সোমের বাড়িতে কিছু মেয়েপুরুষ আশ্রয় নিয়েছিল, কারণ সেখানে বন্দুক ছিল। স্বামীর অবর্তমানে বন্দুকপটু বলে কথিত সোমজায়া বন্দুকে গুলি ভরতে গিয়ে হঠাৎ ট্রিগার টিপে বসলে গুলি বেরিয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে কাউকে জখম না করে খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে সে গুলি অন্নদা সোমের বাড়ির দেয়ালে লাগে। কিন্তু ঘন্টা খানেক এভাবে চলার পরেও কোনও আক্রমণ এলো না। ধীরে ধীরে দুপক্ষেরই স্লোগান কমতে কমতে শেষে মিলিয়ে গেল। শেষ রাত্রিরে শান্তি নেমে এলে বীরপুরুষেরা সব স্ত্রীপুত্র নিয়ে যার যার বাড়ি ফিরে গেল।

পরদিন সকালে পথেঘাটে বাজারে হিন্দু-মুসলমান আবার দেখা হতে তারা পরষ্পরকে দোষারোপ করল। মুসলমানেরা বলল যে হিন্দুরাই গত রাতে আগে ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি দিয়েছিল। তারা আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে মনে করেই মসিলমানেরাও সংঘবদ্ধ হয়ে ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি দিয়েছে। আর হিন্দুরা একই অভিযোগ আনল মুসলমানদের বিরুদ্ধে। পরস্পরকে সামগ্রিক ভাবে সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং শত্রুজ্ঞান করার মানসিকতা যে উভয় সম্প্রদায়ের বহু মানুষের অস্তিত্বের গভীরে প্রবেশ করেছিল, সে বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। এরপর থেকে বেশ কিছুদিন দিনের বেলা বজ্রযোগিনীর সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে প্রায় স্বাভাবিক থাকলেও রাত্রে আবার প্রথম দিনের মতোই দুপক্ষের স্লোগান আর উত্তেজনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকল। ততোদিনে সর্বভারতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি থেকে এ সম্ভাবনাও প্রবল হয়ে উঠেছিল যে দেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তার রাষ্ট্রের উদ্ভব হবে, আর সমস্ত পূর্ববঙ্গ পূর্বপাকিস্তানে রূপান্তরিত হবে। সর্বভারতীয় রাজনীতির এই বৃহত্তর পরিবেশে গ্রামের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিচার করে বজ্রযোগিনীর হিন্দুদের মধ্যে প্রবল অস্তিত্বের সংকট দেখা দিল। আত্মরক্ষায় অপটু, শিক্ষিত এবং নরম ব্যক্তিত্বের হিন্দু ভদ্রলোকেরা দ্রুত এই সিদ্ধান্তে আসতে আরম্ভ করলেন যে তাদের জীবন ও ধনসম্পত্তি এখানে আর নিরাপদ নয়। তাদের মধ্যে অনেকেই পশ্চিম বঙ্গে, বিশেষত কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সেখানকার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে উদ্যোগী হলেন। যাদের সে ধরনের যোগাযোগ ছিল না, তারা শঙ্কায় দিন কাটাতে লাগল।
মুসলিম লিগ পাকিস্তানের দাবি ১৯৪০ সনে তুললেও, এবং সে দাবিতে তারপর অনড় থেকে কংগ্রেসের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৬ সন পর্যন্ত বজ্রযোগিনীর হিন্দুরা দেশ ভাগের সম্ভাবনা এবং তার পরিণতিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। বরঞ্চ তারা তাচ্ছিল্যভরে বলত, “কানে বিড়ি মুখে পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।” কিন্তু ১৯৪৬ এর আগস্ট মাসে কলকাতার দাঙ্গা এবং তারপর বিহার ও নোয়াখালিতে দাঙ্গার পরে যেভাবে বজ্রযোগিনীর সাম্প্রদায়িক পরিবেশ দ্রুত বিষিয়ে উঠেছিল, তাতে কেউই আর সে সম্ভাবনাকে বাতিল করে দিতে পারেনি। কিন্তু অনেক উত্তেজনা সত্ত্বেও গ্রামে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেনি, এবং কোনও জীবনহানি হয়নি। সে অবস্থা পারটিশন পর্যন্ত চলেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা হিন্দুদের একজনকেও কোনও সশস্ত্র আক্রমণ করেনি। কিন্তু তথাপি হিন্দুদের, বিশেষত হিন্দু ভদ্রলোকদের অনিরাপত্তাবোধ দ্রুত বেড়েই চলেছিল। ১৯৪৭ এর ফেব্রুয়ারি মাসে মাউন্টব্যাটেন প্ল্যানের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও দেশ ভাগের ঘোষণার পরে এই উৎকণ্ঠা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওপারে চলে যাবার বাসনা ও উদ্যোগ আরও বেড়ে গেল। একদিন ধলাগাঁওয়ের এক মুসলিম কৃষক আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় বাবাকে বলল, “মাস্টারবাবু, অখন থেইগা আমরা হইলাম রাজা, আপনারা হইলেন পরজা। হেই কথা বুইঝা চললেই আপনেগো মঙ্গল।” এতোকাল ধরে হিন্দু ভদ্রলোকদের দ্বারা ঘৃণিত মুসলিম কৃষকের পক্ষে সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ ধরনের কথা বলা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তুও বাবাও স্বাভাবিক ভাবেই এই ক্ষুদ্র ঘটনায় ভবিষ্যতের অশনি সংকেত দেখতে পেলেন। এরকম অভিজ্ঞতা আরও অনেক হিন্দু ভদ্রলোকেরই হলো।

সারা দেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দেশ ভাগের ঘোষণা এবং ক্ষমতালোভী কংগ্রেস নেতাদের দ্বারা তাড়াতাড়ি সে প্রস্তাব গ্রহণ, আর বজ্রযোগিনীর ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আমাকে ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও বিহ্বল করে তুলেছিল। এ ব্যথা বিহ্বলতা শুধু যে আদর্শগত কারণে হয়েছিল তা নয়, যদিও সেটিই ছিল প্রধান কারণ। আমার কিছু সুহৃদভেদও হয়েছিল। আমি ক্লাস টেনের ভালো ছাত্র ছিলাম বলে ক্লাস এইটের আবদুস সাত্তার নামে একজন রামসিং-এর মুসলিম ছাত্র মসিক পনেরো টাকা বেতনে আমার কাছে আমার বাড়িতে পড়তে আসতে শুরু করেছিল। তারই অনুরোধে আমি রাজি হয়েছিলাম। সেটা যে শুধু আমার জীবনের প্রথম সম্ভাব্য রোজগার ছিল তাই নয়। আমাদের পরিবারের কাছে তখন পনেরো টাকা ছিল অনেক টাকা। একমাস পূর্ণ হলে সে আমাকে পাঁচ টকা দিয়ে বলল যে বাকি দশ টাকা সে পরে দেবে। আমি তার বাকি টাকা না দেবার উদ্দেশ্য সন্দেহ করে সে পাঁচ টাকা ফেরত দিয়ে সব টাকা একসঙ্গে দিতে বললাম। তারপরই প্রতি রাতে ‘আল্লা হো আকবর’ আর ‘বন্দেমাতরম্’ আরম্ভ হলো। তথাপি সে আরও দুতিন দিন আমাদের বাড়িতে পড়তে এলো। একদিন আমাকে দুটাকা দিতে চাইল। আমি আবারও তা ফিরিয়ে দিলাম। তারপর সে আসা বন্ধ করল। আমার যে শুধু পনেরো টাকা লোকসান হলো তাই নয়। সাত্তারের সঙ্গে আমার কিছুটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তাও হারিয়ে গেল। হয়তো সে সত্যিই অভাবগ্রস্ত ছিল, অথবা হয়তো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার শিকার হয়েছিল। আমার প্রতি তার ব্যবহারে শেষ দিন পর্যন্তও আমি কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ করিনি। এমনিভাবে আরও কয়েকজন মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্কের মধ্যে হঠাৎ দূরত্ব তৈরী হলো, কোনও পক্ষের ব্যক্তিগত কারণে নয়, সারা দেশের সঙ্গে বজ্রযোগিনীর সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার উত্তাপের কারণে।

সাম্প্রদায়িকতার কারণে আমার উপর আদর্শগত আঘাত শুধুমাত্র সাধারণ তাত্ত্বিক উৎস কিংবা পারিবারিক উৎকণ্ঠা থেকে আসেনি। বাস্তব ক্ষেত্রেও আমার কিশোর জীবনের চিন্তায়, কাজে এবং ভবিষ্যত পৃথিবীর স্বপ্নে কঠিন আঘাত নেমে এসেছিল। প্রথম আঘাত নেমে এসেছিল আমার নাইট স্কুলের উপর, মূলত হিন্দু মহাসভা ও হিন্দু সমাজপতিদের আক্রমণে. সে সম্বন্ধে আগের পরিচ্ছেদে বিস্তারিত বলেছি। চরম সাম্প্রদাযিক উত্তেজনার সময়েই আমি আমার কিশোর জীবনের আদর্শ রূপায়ন আর স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নাইট স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছিলাম। আর সে স্কুলে বয়স্ক হিন্দু-মুসলমান ছাত্র একসঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে পড়তে আরম্ভ করেছিল। যেহেতু তারা সকলেই কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীভুক্ত ছিল, তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনার বদলে শ্রেণী চেতনা গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু তৎকালীন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিবেশে হিন্দু সমাজপতিদের আঘাতে সে উদ্যোগের বিয়োগান্ত পরিণতি আমার গভীর দুঃখ ও সাময়িক হতাশার কারণ হয়েছিল। দ্বিতীয় আদর্শগত আঘাত এসেছিল আমার তাত্ত্বিক নেতা কমিউনিস্ট পার্টির সুশীল ঘোষের কাছ থেকে। মূলত ধর্মের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাধ্যমে ভারত ভাগের ঘোষণায় অন্তরে ব্যথিত হয়ে একদিন সুশীলদার কাছে গিয়ে মনের ক্ষোভ ব্যক্ত করতে সুশীলদা যা বললেন তাতে আমার দুঃখ আরও বেড়েই গেল। তিনি বললেন য দেশ দুভাগ হলে ভালোই হবে। কারণ ভারতের শাসক শ্রেণী আর দেশের সব মানুষকে একসঙ্গে দমন-শোষণ করতে পাববে না। এ কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হলাম। কারন দেশ ভাগ হবার আগে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কৃষক-শ্রমিক শ্রেণী হিন্দু ও মুসলমান শাসক শ্রেণীর কাছে সমান ভাবেই নিপীড়িত ও শোষিত হতো। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুসলমান কৃষক-শ্রমিকেরা কি আর নূতন রাষ্ট্রের শসিক শ্রেণীর দ্বারা শোষিত হবে না? পরে আমি জেনেছি যে পারটিশন সম্বন্ধে তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য সুশীলদা আমাকে সঠিকবাবে বোঝাতে পারেননি। কিন্তু সে সময়ে সুশীলদার বক্তব্যে আমার ক্ষোভ চেপে রাখতে পারিনি। এই সুশীল ঘোষ, আমার সুশীলদা, পারটিশনের বেশ কয়েকবছর পরে বজ্রযোগিনী ছেড়ে কলকাতা চলে এসেছিলেন। পরে শুনেছি, ১৯৬৪ সনে কমিউনিস্ট পার্টি দুভাগ হবার সময় তিনি সিপিআইতে গিয়েছিলেন, এবং কয়েক বছর পরে অনেক কষ্টের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু বজ্রযোগিনী ছেড়ে আসার পর তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।

আগেই বলেছি যে বজ্রযোগিনীতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে ধর্মের আড়ালে এক ধরনের শ্র্রেণী বৈষম্য ছিল। কিন্তু ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন শ্রেণী সংগ্রামকে অনেকটা দুরূহ করে তুলেছিল। সারা দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবর্তে যদি কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক এবং বৈপ্লবিক রাজনীতি গড়ে উঠত, তবে সাম্প্রদায়িকতার কলুষকে অনেকখানি প্রশমিত করে এক অবিভক্ত সমাজতান্ত্রিক ভারতবর্ষ গড়ে উঠতে পারত। একথা আমি তখনও বিশ্বাস করতাম, এখনও করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নানা ঐতিহাসিক কারণে এবং ভুল স্ট্র্যাটেজি ও ট্যাকটিক অবলম্বনের ফলে তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব অধিকার করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে একাধারে শ্রেণীসংগ্রাম ভিত্তিক এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণমুক্তি আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আমার তাত্ত্বিক নেতা সুশীলদা ছিলেন সমকালে অসফল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিরই এক বিভ্রান্ত প্রতিনিধি। তথাপি তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা আমার আজও অটুট আছে।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

৪ comments

  1. tanb - ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৮:৪৭ পূর্বাহ্ণ)

    khub bhalo laglo pore. dada boitir soft copy paoya jabe?

    dhanya bad

    tanb

  2. মাসুদ করিম - ২৭ জুলাই ২০১১ (১১:২৯ অপরাহ্ণ)

    হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনীর দ্বিতীয় পর্বে দেশভাগ, মন্বন্তর, দাঙ্গার কথা আছে। এই বই পড়ে কথাকার অমর মিত্র পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক ‘সকালবেলা’র রবিবাসরীয় ব্যাক্তিগত বিভাগে লিখছেন

    আত্মজীবনী কখনও কখনও হয়ে ওঠে উপন্যাসের মতো আকর্ষণীয়, যদি সেই আত্মজীবনীতে থাকে এমন এক কালের ছায়া, যে কাল আমাদের দেশ, আমাদের পিতৃপুরুষের জীবনে হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে দুঃখময়, আমাদের জাতির ইতিহাসে ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড ‘ উঁকি দিয়ে দিগন্তে’ আমাদের দেশভাগ, মন্বন্তর, কাপড়ের আকালের কথা বলেছেন। আমি তাঁর উপন্যাস ‘আগুন পাখি’তে পেয়েছিলাম এর নানা অনুষঙ্গ। আত্মজীবনীতে পেলাম অনেকটা। সেই সময় লেখক বড় হয়ে উঠছেন। একটি বালক দেখছে কীভাবে তাদের প্রাচীন গ্রাম আর গ্রামের হিন্দু-মুসলমান শতাব্দীপ্রাচীন বন্ধন ছিঁড়ে পরষ্পরের দিকে উঁচিয়ে ধরছে অস্ত্র। কাপড়ের আকালের কথা শুনেছি মায়ের কাছে ছোটবেলায়; অচিন্ত্যকুমারের গল্পে পড়েছি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে পড়েছি, কিন্তু তা কত ভয়াবহ জেনেছি এই আত্মজীবনীতে। হাসান আজিজুল হক এপারের মানুষ। কাটোয়ার কাছে বর্ধমানের জৌ গ্রামে ছিল তাঁদের পৈতৃক ভিটে। ফলে ওপার নয়, এপারের কথা পড়েছি এই বইয়ে। হ্যাঁ, মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’এও ছিল এপারের কথা। তাঁর পিতৃপুরুষও দেশভাগের পর এপার থেকে ওপারে চলে যান ভয়ে, বহু দিন বহু বছর ধরে গড়া দুই সম্প্রদায়ের ভিতরের নিবিড় সম্পর্ক ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। অবিশ্বাস ঢুকে গিয়েছিল পরষ্পরের ভিতর। মাহমুদুল হকের পিতৃপুরুষ ছিলেন বারাসাতের নিকটবর্তী এক গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর উপন্যাসে আছে ভয়াবহ আতঙ্কে দেশ ছাড়ার এক শ্বাসরোধকারী বিরণ। সেই আতঙ্ক তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় ওপারে বেড়ে ওঠা উপন্যাসের প্রধান চরিত্রটিকে। পার্টিশন নিয়ে ওপারে বহু বছর আগে আবু ইসহাক-এর ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ পড়েছিলাম, কিন্তু সে তো ওপারের কথাই ছিল। এপারের কথা আছে বাংলাভাষার প্রবীণ অধ্যাপক, লেখক আনিসুজ্জামান-এর জীবনী ‘জীবন নিরবধি’র ভিতরে। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন বসিরহাটের বাসিন্দা, যে-শহরের গায়ে লাগানো গ্রামে আমরা ওপার থেকে এসে উঠেছিলাম।

    পূর্বপাকিস্তান আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা বাংলাদেশের লেখক মানসে এমন অভিঘাতের ছায়া ফেলেছিল যে ওপারের গল্পে, উপন্যাসে সব যেন বদলে যেতে থাকে। বাঙালি তার নিজস্ব দেশ পেল, কিন্তু বাঙালি যে দু’ভাগে ভাগ হয়ে আছে সে কথাও মনে পড়তে লাগল বারবার। সেই মনে পড়ার কথাই উঠে এসেছে ওপারের বাঙালি লেখকের লেখায়। তাঁরা একটা যুদ্ধ করেছিলেন, ভয়ানক সেই যুদ্ধ জিততে হয়েছিল তাঁদের, জয় এমনি আসেনি।স্বজন-পরিজনকে হারাতে হয়েছিল। দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষদের হারাতে হয়েছিল। স্বাধীনতা এসেছিল অনেক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। সেইসব কথা যেমন লেখা হয়েছে, হচ্ছে, তেমনই লেখা হয়েছে দেশভাগের বেদনার কথা। বাঙালি জীবনের উতিহাস তো এই। এই ইতিহাসের অর্ধেক আমাদের এপারের মানুষের পুরোটা ওপারের বাঙালির। ‘উঁকি দিয়ে দিগন্তে’র ভিতরে প্রবীণ লেখকের বাল্যকালের কথা। যে বাল্যকাল কেটেছিল এপারের গ্রামে, যে বাল্যকাল আর কৈশোর কেটেছিল কাপড়, কেরোসিনের আকাল দেখতে দেখতে, দাঙ্গার ভিতরে রাত জেগে। এই নিদারুণ সময়ের ইতিহাস নেই যে, তা নয়। মনে পড়ে যাচ্ছে, শৈলেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাঙ্গার ইতিহাসের কথা, কাপড়ের আকাল নিয়ে সোমনাথ লাহিড়ীর ‘কাপড় চাই’ আবার ছাপা হয়েছে, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৬-এর দাঙ্গার কথা লিখেছেন, দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবনের পীড়নের কথা লিখেছেন, গবেষণা করেছেন। এইসব বই গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই, কিন্তু বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ এক লেখক যদি লেখেন তাঁর বাল্য আর কৈশোরের কথা, তার ভিতরে যা দেখবেন তিনি তা গবেষণায় মেলে না, তা সত্য। আর গবেষণায় এই গ্রন্থের উপাদান ব্যবহার হতে পারে অনায়াসে।

    লিন্ক এখানে

  3. মাসুদ করিম - ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ (১১:১৫ পূর্বাহ্ণ)

    দ্বি-জাতি তত্ত্ব না ছি-জাতি তত্ত্ব জানি না, জানি এটা একটা দুরারোগ্য ব্যাধি।

  4. মাসুদ করিম - ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (২:৫৬ অপরাহ্ণ)

    ৬৮ বছর পরে জন্মভিটায়

    সাতচল্লিশে (১৯৪৭) দেশভাগের পরের বছর কোনো এক দুপুরে চট্টগ্রাম ছেড়েছিলেন শ্যামাচরণ দে এবং তার পরিবারের সদস্যরা। এক কাপড়েই তারা পৌঁছান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বৌ বাজারে। পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ছাড়া শ্যামাচরণের দ্বিতীয় ছেলে পরিমল দে’র বয়স তখন একবছর।

    সেই পরিমলের বয়স এখন ৬৯, শিক্ষকতা, রাজনীতি সবকিছু থেকেই নিয়েছেন অবসর, করছেন লেখালেখি। এই প্রৌঢ় বয়সেই জন্মভিটার টানে ৬৮ বছর পর এসেছেন বাংলাদেশ।

    চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ ভূর্ষি ইউনিয়নের কেচিয়া পাড়া গ্রামে গিয়ে খুঁজে নিয়েছেন জন্মভিটাও।বুধবার দুপুরে সেখানে গিয়ে আবেগাপ্লুত হন পরিমল।

    ভাষার মাসেই পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার (আগে জলপাইগুড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিল) জেলা থেকে বাংলাদেশে আসেন পরিমল দে। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের জানিয়েছেন শ্রদ্ধা, গিয়েছেন একুশের বইমেলাতেও।

    পরিমল দে’র ভাষায়, “ভারতে থাকলেও নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি একটা গভীর টান অনুভব করতাম সবসময়। সে কারণে জীবন সায়াহ্নে এসে নিজের ইচ্ছা পূরণ করলাম জন্মভূমিকে প্রণাম জানিয়ে।”

    পরিমল শিক্ষকতা করেছেন আলিপুরদুয়ারের নিমতিঝোরা হাই স্কুলে, প্রধান শিক্ষক হিসেবে কয়েকবছর আগে অবসরে যান। আজীবন মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী এই বাঙালি ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত জলপাইগুড়ি জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

    বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় পরিমল দে বাংলাদেশে তার আসা এবং জন্মভিটায় যেতে পারার অনুভূতির কথা তুলে ধরেন।
    ১৯৪৭ সালে মাত্র এক বছরের শিশু পরিমলের দেশভাগের কথা বোঝার কথা নয়। পরবর্তীতে বাবা-মায়ের ও জ্যাঠাদের কাছে শুনেছেন সেসময়ের কথা।

    “১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হবার পর আমার বাবা-জ্যাঠারা সিদ্ধান্ত নেন পূর্ব পাকিস্তান ছাড়ার। বাবা ও অন্য দুই কাকা ভারত চলে গেলেও এক জ্যাঠা থেকে যান পটিয়ায়। চলে যাবার পর তিনি বা তার পরিবারের কারও সাথে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না।

    “সেসময়ে (১৯৪৭-৪৮) পাকিস্তানের অনেক এলাকায় দাঙ্গা হলেও পটিয়ায় আমাদের গ্রামের বাড়ি দক্ষিণ ভূর্ষি এলাকায় কিছু হয়নি। তারপরও বাবারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশ ত্যাগের। ”

    পরিমল আরও বলেন, “মা’র কাছ থেকে শুনেছি অনেকটা এক কাপড়েই আমরা দেশ ছেড়েছি। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাইবোন। সবাই মিলে কলকাতার বৌবাজারে স্থায়ী হবার পর বাবা রেলে চাকরি পান। চাকরি সূত্রেই আমাদের পরিবার আলিপুরদুয়ারে স্থায়ী হয়।”

    স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করার সময় থেকেই বাংলাদেশে জন্মভিটা দেখার সাধ ছিল বলে জানান তিনি।

    “৬৮ বছর পর বাংলাদেশে এসেছি, অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। পড়ালেখা করার সময় থেকেই বাংলাদেশে জন্মভিটা দেখার সাধ মনের মধ্যে ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব ইচ্ছে হয়েছিল বাংলাদেশে এসে জন্মভিটা দেখার।

    “পরে কাজের চাপে না পারলেও তাড়নাটা সবসময়ই থেকেছে। সেই তাড়না থেকেই ৬৯ বছর বয়সে এসে পটিয়ায় জন্মভিটা খুঁজে নিয়েছি।”

    তিনি বলেন, “দক্ষিণ ভূর্ষি ইউনিয়নের কেচিয়াপাড়া গ্রামে আমাদের সেই বাড়িটি এখনও আছে। দেশে থেকে যাওয়া জ্যাঠা ধনপতি দে বেঁচে নেই। কিন্তু জ্যাঠতুতো দিদি শচী রাণীকে সেখানে গিয়ে পেয়েছি।”

    সত্তরোর্ধ্ব শচী রাণীকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন পরিমল দে।

    “এ আবেগ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। নিজের ভিটের সামনে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে প্রণাম করেছি। মৃত্যুর আগে অন্তত নিজের জন্মভিটে দেখে যেতে পারলাম।”

    ৬৯ বছর বয়সী পরিমলের মা প্রমীলা রাণী দে এখনো বেঁচে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম ছেড়ে যাবার পর আমার মা নীরবে চোখের জল ফেলতেন। রেখে যাওয়া ভিটেমাটি, স্বজনদের স্মৃতিচারণ করতেন।”

    এখনও মা প্রমীলা রাণীর মনে দেশত্যাগ নিয়ে বেদনাবোধ থাকলেও দুঃখ-কষ্ট নিজের মধ্যে রেখেই জীবন কাটাচ্ছেন, বলেন পরিমল।

    নিজের জন্মস্থান খুঁজতে গিয়ে তাকে সহযোগিতা করেছেন সুরজিৎ সরকার নামে তার এক ছাত্র এবং প্রযুক্তি। এছাড়া চট্টগ্রামের এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকও তাকে সহায়তা করেছেন।

    সুরজিৎ সরকারও পরিমল দে’র সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছেন।

    সুরজিৎ বলেন, ‍“স্যার বাংলাদেশে গিয়ে নিজের জন্মস্থান দেখতে চান এমনটা জানানোর পর থেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পটিয়ার দক্ষিণ ভূর্ষি এলাকার বেসরকারি সংস্থা ‘অবলম্বন’র কর্মকর্তা কংকনময় দে’র সাথে যোগাযোগ হয়।”

    বাংলাদেশে এসে কংকনের মাধ্যমেই অনেক খোঁজাখুঁজির পর চট্টগ্রামের পটিয়াতে নিজের জন্মভূমিতে পৌঁছান পরিমল দে। একইসাথে পটিয়ার আলামপুরে মামাবাড়ি এবং ধলঘাট এলাকায় মাসির বাড়িও খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
    জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও দুই সন্তানের জনক পরিমল দে এখন আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন।

    বড়ছেলে শুভ্রনীল দে কাজ করতেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। স্ত্রী পূর্ণিমা দে, অপর সন্তান শঙ্খনীল দে কে নিয়ে থাকেন আলিপুরদুয়ার জেলার নিমতিঝোড়া এলাকার বাড়িতে।

    ১৭ বছর বয়েস থেকেই খদ্দরের পাঞ্জাবি ও ধুতি পড়ছেন পরিমল। বর্তমানে তিনি মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেই সময় কাটাচ্ছেন। গান্ধীজী নিয়ে গবেষণার জন্য ব্যারাকপুর গান্ধী মেমোরিয়াল মিউজিয়াম থেকে পেয়েছেন ‘মহাত্মা গান্ধী স্মারক পুরস্কার’ও।

    ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে লিখেছেন ‘আত্মজীবনীর গান্ধী’ এবং ‘হিমালয় ও গান্ধীজি’ নামে দুটি বই।

    এছাড়া অনুবাদ করেছেন ‘লন্ডন ডায়েরি, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী’ এবং ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার কারাজীবন (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী)’ নামে আরও দুটি বই। কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা প্রতিভাস থেকে এসব বই প্রকাশিত হয়েছে।

    জীবন সায়াহ্নে নিজের জন্মভিটায় আসা পরিমল দে বাংলাদেশ ছাড়ছেন শুক্রবার। চট্টগ্রামের পটিয়ার দক্ষিণ ভূর্ষি ইউনিয়ন ঘুরে নিয়ে যাওয়া ‘অন্যরকম অনুভূতি’ জীবদ্দশায় তাকে আবারও বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামে আসার ইচ্ছে জাগায়।

    তার ভাষায়, “এ টান অন্যরকম, আবারও আসতে চাই নিজের জন্মভিটেতে।”

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.