সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো

কলকাতার 'আজকাল' পত্রিকার ২৮ জুন ২০০৯ সংখ্যার 'রবিবাসর' বিভাগে উস্তাদ আলি আকবর খান স্মরণে বিশিষ্ট তবলাবাদক শঙ্কর ঘোষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, যিনি ১৯৬১-১৯৭২ পর্যন্ত খাঁ সাহেবের সঙ্গে নিয়মিত সঙ্গত করেছেন [...]

কলকাতার ‘আজকাল’ পত্রিকার ২৮ জুন ২০০৯ সংখ্যার ‘রবিবাসর’ বিভাগে উস্তাদ আলি আকবর খান স্মরণে বিশিষ্ট তবলাবাদক শঙ্কর ঘোষের শ্রদ্ধাঞ্জলি, যিনি ১৯৬১-১৯৭২ পর্যন্ত খাঁ সাহেবের সঙ্গে নিয়মিত সঙ্গত করেছেন।

রাগ চন্দ্রনন্দন। চন্দ্রকোশ, যোগকোশ, কৌশিকী কানাড়া মিলিয়ে খাঁ সাহেবের তৈরি করা রাগ।

চন্দ্রনন্দন ২য় অংশ

[আজকাল কলকাতা ১৩ আষাঢ় ১৪১৬ রবিবার ২৮ জুন ২০০৯ www.aajkaal.net]

সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো

শঙ্কর ঘোষ

উস্তাদ আলি আকবর খানের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাঁচ দশকের সম্পর্কের অবসান হল। আমাদের প্রথম যোগাযোগ অযাচিতভাবেই। বরানগরে স্বামী সত্যানন্দের আশ্রমে বছরে একবার সারারাতের গানবাজনার বিরাট আসর বসত। নামীদামি শিল্পীরা আসতেন। সেটা ১৯৬১ সাল। উস্তাদ আলি আকবর খানের বাজানোর কথা। উনি তখনই খ্যাতির চূড়ায়। খাঁ সাহেবের সঙ্গে বাজানোর কথা ছিল উস্তাদ কেরামতউল্লা খাঁ সাহেবের। অসুস্থতার কারণে উনি আসতে পারেননি। কেরামত সাহেব আসবে না জেনে আলি আকবর সাহেব কানাই দত্তকে নিয়ে আসতে বললেন। কানাইদা থাকতেন ভবানীপুরে। সেখানে গিয়ে তাঁকে বরানগরে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। ওই আসরেই প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাইবার কথা ছিল। প্রসূনদা আমাকে চিনতেন, খাঁ সাহেবকে আমার কথা বললেন। উনি আমাকে চিনতেন না, তাই কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না অপরিচিত, অখ্যাত তবলাবাদকে নিয়ে বাজাতে। যদিও ওঁর পুত্র আশিষের সঙ্গে তখন আমি নিয়মিত বাজাই। ঘটনাচক্রে আমাদের দেখা হয়নি। শেষমেশ বেশ অসন্তুষ্ট হয়েই রাজি হলেন। ওঁর মতো শিল্পীর সঙ্গে বাজাতে হবে, আমি যে মনে মনে একটুও ঘাবড়াইনি, একথা বললে মিথ্যে বলা হবে। মঞ্চের পিছনে স্বামী সত্যানন্দ বসে। আমি ওঁকে আর খাঁ সাহেবকে প্রণাম করে বাজাতে বসলাম। মনে মনে গুরুকে বললাম, মান রেখো। আমার বয়স তখন বছর ছাব্বিশ। তারুণ্যে টগবগ করছি। নিজেকে প্রমাণ করতেই হবে, মনে এই জেদও ছিল। সেদিন আসরে প্রচুর শ্রোতা। খাঁ সাহেব কী রাগ বাজিয়েছিলেন মনে নেই। অসাধারণ বাজালেন। আমিও প্রচুর প্রশংসা পেলাম। খাঁ সাহেবকে দেখে মনে হল, উনি খুশি। আমি উৎসাহ পেয়ে ওঁকে বললাম অন্যান্য তালেও বাজাতে। উনি ধামার তালে বাজাতে শুরু করলেন। ধামার ধ্রুপদ অঙ্গের তাল। আমি একটু অন্যভাবে বাজাতে লাগলাম। ওখানে অনেক ধ্রুপদীয়া ছিলেন। তাঁরা দারুণ প্রশংসা করলেন। অনুষ্ঠানের চার-পাঁচ দিন পরের ঘটনা। আমি চিৎপুরে রয়্যাল-এর চাঁপের খুব ভক্ত। খেতে গিয়ে প্রসূনদার সঙ্গে দেখা। প্রসূনদা বললেন, আরে তোমাকেই খুঁজছি, ভাল খবর আছে। বিরিয়ানির অর্ডার দাও। আমি অবাক, কী ভাল খবর? বললেন, অবিলম্বে খাঁ সাহেবে সঙ্গে দেখা করো, বিদেশ যেতে হবে ওঁর সঙ্গে। আমি পরদিনই খাঁ সাহেবে সঙ্গে দেখা করি। উনি জানতে চাইলেন, পাসপোর্ট আছে কি না। আমি জানালাম, পাসপোর্ট আছে, তবে ভিসা নেই।

মন্ট্রিল এবং মেজগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ ফ্যাকাল্টি অফ মিউজিকের আমন্ত্রণে সেই আমার প্রথম বিদেশযাত্রা। খুবই সফল হয়েছিল সফর। ডিন ড. রোজেট রেন্‌শ দারুণ উচ্ছ্বসিত হন। ভদ্রমহিলা আমার বাবাকে চিঠি লিখে জানান, তোমার ছেলে দেশের সম্পদ, বিশ্বেরও। সেই শুরু খাঁ সাহেবের সঙ্গে আমার বিদেশ-যাপন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত একটানা ছিলাম তাঁর সঙ্গে।

আমেরিকায় আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিক প্রথমে চলত নানা অস্থায়ী ঠিকানা থেকে। শেষমেশ ডন ম্যাককে নামক এক ভদ্রলোক বাড়ি তৈরির জন্য অর্থ দেন। গড়ে ওঠে কলেজের স্থায়ী ভবন। সান ফ্রান্সিসকোর কাছে সান রাফায়েলে। সেটা ১৯৬৭। খাঁ সাহেবের বাড়ি ছিল কলেজের কাছেই। ওই বছরেই আমার পুত্র বিক্রমের জন্ম। স্ত্রী সংযুক্তা বিক্রমকে নিয়ে চলে যান। সংযুক্তা পাতিয়ালা ঘরানার সুপ্রসিদ্ধ কণ্ঠশিল্পী ওস্তাদ মুনব্বর আলি খানের শিষ্যা। সংযুক্তা যেতেই খাঁ সাহেব ওঁকে কণ্ঠসঙ্গীত বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে দেন। সেই সময় কণ্ঠসঙ্গীত বিভাগে ৩৮ জন ছাত্রছাত্রী। তার ওপর অন্যান্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীদেরও গানের তালিম নিতেই হত। ছোট্ট বিক্রমকে নিয়ে সংযুক্তা সামলাতো সবটা। তার মধ্যে আমিও ছিলাম না। একবার আশিসের সঙ্গে এবং একবার খাঁ সাহেবের সঙ্গে তিন মাসের ট্যুরে বেরিয়ে গিয়েছি।

মন্ট্রিল সফরে আমাদের থাকার জন্য দেওয়া হয়েছিল একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। মস্ত বড় ঘর। দুকোণের একদিকে বিছানা। আরেক একটা সোফা-কাম-বেড, যাওয়ার পরেই উনি আমাকে বললেন খিচুড়ি রাঁধতে। খিচুড়ি খেতে উনি দারুণ ভালবাসতেন। আমার অবস্থা তো কাহিল। কারণ আমি তখন রান্নার র-ও জানি না। এদিকে উনি বড় মুখ করে খেতে চেয়েছেন, কী করে বলি যে আমি রাঁধতে জানি না। জয়গুরু বলে শুরু করলাম। এটুকু তো জানতাম, খিচুড়িতে চাল আর ডাল লাগে। রাঁধতে গিয়ে দেখি কি রকম ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে লাগছে। মনে পড়ল হলুদের কথা। ঘরে হলুদ নেই। নিচেই মস্ত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। খিচুড়ি চাপিয়ে চলে গেলাম হলুদ কিনতে। কিন্তু ও হরি, হলুদের ইংরেজি মনে পড়ছে না। ইন্ডিয়ান স্পাইস, ইয়েলো পাউডার ইত্যাদি বলছি। ওরা হলুদ রঙের অনেক রকম গুঁড়ো মসলা এনে দেখাল। তার মধ্যে শুঁকে একটাকে হলুদ মনে হল। কিনে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখি ঘর কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে। আসলে গ্যাস বন্ধ না করেই চলে গিয়েছিলাম। খিচুড়ি পুড়ে ধাপোড়া। আর ওঁকে খিচুড়ি খাওয়ান হল না। দোকান থেকে খাবার কিনে সে যাত্রা খিদে মেটালাম। তবে পরে আমি ভাল রাঁধতে শিখে যাই। আমার রান্নার গুরু অবশ্য সংযুক্তা নয়, ওস্তাদ আমির খানের পুত্র ইকরাম।

আলি আকবর মিউজিক কলেজের ওখানে দারুণ নামডাক হয়েছিল। খাঁ সাহেব ভি জি যোগ থেকে বাহাদুর খান অনেককেই নিয়ে গিয়েছিলেন তালিম দেয়ার জন্য। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ও গিয়েছেন। আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিকের উদযোগেই প্রথম সারা রাতের অনুষ্ঠান শুরু। তার আগে ও দেশে গানবাজনার সারা রাতের অনুষ্ঠান হত না। তবলা বিভাগে আমি চলে আসার পর ওখানে যোগ দেয় জাকির হুসেন, তারপর আমার ভাগ্নে বুলবুল, মানে স্বপন চৌধুরি। স্বপনই শেষ পর্যন্ত খাঁ সাহেবের সঙ্গে ছিল।

শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে খাঁ সাহেব ভারতীয় গুরু-শিষ্য পরম্পরা অনুসরণ করতেন। নিজে যন্ত্র নিয়ে বসতেন। রাগের রূপ, তার চলন ইত্যাদি প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিতেন। তারপর নিজে বাজিয়ে শিষ্যদের তুলিয়ে দিতেন। আর নিজের বাজনা? উনি ছিলেন ‘আর্টিস্ট অফ আর্টিস্টস’। বাজাতেন আত্মমগ্ন হয়ে। শ্রোতা হিসাবে সামনে কে বা কারা, তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। পত্রপত্রিকায় যে সব সমালোচনা প্রকাশিত হত, কোন দিনই উল্টেও দেখতেন না। বলতেন, ওঁরা ওদের কাজ করেছেন। কোনও পুরষ্কার বা সম্মানেরও প্রত্যাশী ছিলেন না। আদর্শ সঙ্গীতসাধক বলতে যা বোঝায় উনি ছিলেন তাই। জাগতিক কোনও কিছু যেন তাকে স্পর্শ করত না। আর নিজের গুরুর প্রতি ছিল অসম্ভব ভক্তি। অত গুরুভক্তি কারো মধ্যে দেখিনি। বাবা আলাউদ্দিনের কথা উঠলে আর থামতেই চাইতেন না। যখন ওঁর বিশ্বজোড়া নামডাক, তখনও বাবা ওঁর বাজনা শুনবেন, শুনলেই গুটিয়ে যেতেন। এই কারণে এলাহাবাদ রেডিও স্টেশনে কখনও বাজাতেন না। এলাহাবাদ রেডিও মাইহার থেকে শোনা যেত। রেডিওয় বাজালে বাবা শুনবেন, এই ভয়েই বাজাতেন না। অথচ বাবা তাকে কি কঠোর অনুশাসনেই না রেখেছেন! সেসব ঘটনা ওঁর মুখেই শোনা। বাজনায় সামান্য ভুলচুক হলেই বাবার বেত আছড়ে পড়ত গায়ে, পিঠে। মা এজন্য মোটা কাঁথা দিয়ে তৈরি জামা জামার নিচে পরিয়ে দিতেন। প্রশংসা শুনলে ছেলে বিগড়ে যাবে, এই আশঙ্কায় কেউ আলাউদ্দিন খান সাহেবের সামনে ছেলের বাজনার প্রশংসা করলে উনি তাঁকে ব্যঙ্গ করে বলতেন, খুব ভাল বাজাচ্ছে! আমার চেয়েও ভাল বাজাচ্ছে, না!

ওস্তাদ আলি আকবর এবং পণ্ডিত রবিশঙ্কর এই দুই সঙ্গীত মহারথীর সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। দুজনেই মহা প্রতিভাধর। তবে আমার মনে হয়, ওঁরা দুজনে দুজনের কাছ থেকে উপকৃতই হয়েছেন। সেই ছোট থেকে দুজনের এক সঙ্গে বেড়ে ওঠা। সে জন্যই দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। একটু-আধটু ইগোর সমস্যা হয়তো ছিল, তবে তা উল্লেখ করার মতো নয়। পণ্ডিতজির অঙ্কের মাথা ছিল ভাল। তাল-লয়ে ছিলেন দারুণ পোক্ত। অন্যদিকে খাঁ সাহেব রাগরূপ ফুটিয়ে তোলা বা তার অ্যাপ্রিসিয়েশনে ছিলেন অনবদ্য। ওঁদের দুজনের যুগলবন্দী অনুষ্ঠান লোকের কাছে তাই দারুণভাবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। ভাবনা হিসাবেও তা ছিল অভিনব। প্রচণ্ড তালিম, শক্তপোক্ত ও ঋজু ভিতের ওপর দাঁড়িয়েও খাঁ সাহেব নিজের একটা স্টাইল তৈরি করে ফেলেছিলেন। যে স্টাইল তাঁকে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছিল। বিশিষ্টতা দিয়েছিল। আমিও খাঁ সাহেবের সাহচর্যে অনেক কিছু শিখেছি। তবলার মাধ্যমে এস্থেটিক ওয়াল্ডে আমাকে আনা খাঁ সাহেবেরই অবদান। আমার মধ্যে পুরনো ঘরানার বাজনার মেজাজটা পেতেন বলে অত পছন্দ করতেন। আমাদের মধ্যে একটা সুস্থ লড়াইও চলত। যেটা এখনকার গাইয়ে-বাজিয়েদের মধ্যে সেভাবে পাওয়া যায় না। আসলে ধ্রুপদ বিলীন হয়ে যাচ্ছে যে! অত বছর ওঁর সঙ্গে কাটিয়েছি, কিন্তু কোনও দিন কোনও শিল্পীর সমালোচনা ওঁর মুখে শুনিনি। আমাদের বলতেন, কারও সমালোচনা করলে হাত থেকে শক্তি চলে যাবে।

বিদেশে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গাণ্ডা বাঁধা প্রচলন করেন উনি। ওদের নিয়ে প্রতি বছর সরস্বতী পুজোও করতেন। তবে কোনও বিশেষ ধর্মের প্রতি ওঁর দুর্বলতা। ওঁর ঘরে সব রকম দেবদেবী, কোরান, যিশু সবার ছবিই থাকত। আবার বাড়িতে দুর্গাপুজোও করতেন। খেতে এবং খাওয়াতে দারুণ ভালবাসতেন। নিজে রান্না করায় খুব আগ্রহ ছিল। যদিও প্রথমে একদম পারতেন না। আমি ওঁকে রান্নায় তালিম দিতাম। ডালটা খেতে যেমন ভালবাসতেন, তেমন রাঁধতেও ভালোবাসতেন। কখনও ডালটা বাংলাদেশ থেকে যেত, দারুণ স্বাদ। পান করতেও খুব ভালবাসতেন। ভক্ত ছিলেন স্কচ হুইস্কির। গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারতেন কোনটা কী হুইস্কি। সন্ধে বেলা টিভি খুলে আস্তে আস্তে পান করতেন। গল্পগুজব করতেন। তবে কোনও দিন সকালে মদ্যপান করতেন না, অনুষ্ঠানের আগেও খেতেন না। বাজানোর সময় তো খাওয়ার কথাই নেই। অনেকে ওঁর চোখ লাল দেখে ভাবেন বুঝি মদ্যপান করে বাজাচ্ছেন। আদৌ তা নয়। আসলে উনি বাজনার পুরো সময়টাতেই চোখ বন্ধ করে রাখতেন। এই কারণেই চোখটা লাল হয়ে যেত। বাজানোর সময় ছাড়া বিদেশে থাকা কালে ইউরোপীয় পোশাকেই থাকতেন। আর পরতেন টাই। টাই ছাড়া ইউরোপীয় পোশাকে ওঁকে কখনও দেখা যায়নি।

অমন বিশাল মনের মানুষ, অত বড় মাপের শিল্পীর চলে যাওয়া শুধু আমার কাছে নয়, গোটা সঙ্গীতবিশ্বের কাছেই অপূরণীয ক্ষতি। অনেক দিন দূরে ছিলাম কিন্তু আমাদের দুজনের আত্মিক যোগ এতটুকু ছিন্ন হয়নি। বললে বিশ্বাস করবেন না, উনি যেদিন মারা গেলেন, তার আগের দিন রাতে আমি স্বপ্নে ওঁকে দেখেছি। দেখেছি সত্যানন্দ আশ্রমে বাজানোর সেই ঘটনা। সকালে উঠে খবর পেয়ে আমি স্তব্ধবাক!

‘আজকাল’ ২৮ জুন ২০০৯-এর ‘রবিবাসর’ বিভাগে আলি আকবর খানের শিষ্য তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের একটি লেখাও ছাপা হয়েছিল। সেসাথে এখানে আলি আকবর খানের ইউরোপীয় শিষ্য কেন জুকারমানের একটি লেখাও দেয়া হল, লেখাটি ‘আউটলুক ইন্ডিয়া’য় ছাপা হয়েছিল ০৬ জুলাই ২০০৯ সংখ্যায়।

আমার বাবা, আমার ঈশ্বর
তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার
মাথার ওপর থেকে যেন ছাদটা সরে গেল। গুরু ওস্তাদ আলি আকবর খান সাহেবের মতো মহীরুহের ছায়া হারিয়ে অসহায় লাগছে। গুরুজিকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতাম। ১৯৯২ সাল থেকে ওঁর কাছে নিয়মিত যাতায়াত। তবে ওস্তাদ আলি আকবরকে প্রথম যখন দেখি, তখন আমার বয়স বড় জোর সাত-আট বছর। সরোদ নিয়ে একটু-আধটু টুংটাং করছি। মহাজাতি সদনে কী একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ওঁর বাজনা শুনতে। কী রাগ বাজিয়েছেন তার কিছুই বুঝিনি, বোঝার বয়সও হয়নি। কিন্তু অদ্ভুত এক মোহিনী জাদু আমাকে তখনই আচ্ছন্ন করে ফেলে। মনে হয়েছিল, উনি কোনও মানুষ নন, ভগবান। সেই ভগবানের সান্নিধ্য পাব, তাঁর কাছে তালিম পাব, এ ছিল আমার স্বপ্নের অতীত।

সরোদশিক্ষায় আমার প্রথম গুরু ওস্তাদ বাহাদুর খান সাহেব। ওঁর কাছে ১৮ বছর তালিম নিয়েছি। প্রসঙ্গত জানাই, ওস্তাদ বাহাদুর খান ছিলেন ওস্তাদ আলি আকবর খান সাহেবের ছোটকাকা হায়েত আলি খান সাহেবের পুত্র। মানে ওস্তাদ বাহাদুর খান ছিলেন ওস্তাদ আলি আকবর খানের খুড়তুতো ভাই। দুজনেই ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেবের ছাত্র। দুজনেই বিশাল মাপের শিল্পী। ওঁদের বাজনায় অনেক মিলও ছিল। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, হায়েত আলি খান সাহেব সেতার-সরোদ তৈরিতেও সেরা ছিলেন। ওঁর তৈরি সরোদ ওস্তাদ বাহাদুর খান এবং ওস্তাদ আলি আকবর খান বাজাতেন। ১৯৮৯ সালে হঠাৎ প্রয়াত হন ওস্তাদ বাহাদুর খান। বেশ অসহায় হয়ে পড়ি। যদিও ততদিনে আমার সামান্য নামডাক হয়েছে। বিদেশে বাজাতেও যাচ্ছি।

১৯৯২ সালে আমেরিকা সফরে গিয়ে হঠাৎ হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। এর জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব তবলাশিল্পী পণ্ডিত স্বপন চৌধুরির। স্বপনদা তখন নিয়মিত বাজান ওস্তাদ আলি আকবর খান সাহেবের সঙ্গে। আমাকে নিয়ে গেলেন ক্যালিফোর্নিয়ায় খান সাহেবের কাছে। গুরু পূর্ণিমার দিন গাণ্ডা বাঁধলাম। শুরু হল দ্বিতীয় পর্বের শিক্ষা। আমার জীবনের দুর্লভ মুহূর্তগুলো ওই ১৯৯২ সাল থেকে এই ২০০৯ পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের গুরু-শিষ্যে শেষ সাক্ষাৎ গত বছর, ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে, ক্যালিফোর্নিয়ায়।

শিল্পী হিসেবে ওস্তাদ আলি আকবর কেমন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তাবৎ সঙ্গীতশিল্পী ওকে কুর্নিশ জানিয়েছেন। ইহুদি মেনুইন বলেছিলেন, গ্রেটেস্ট মিউজিশিয়ান অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ বিলায়েত খান বা পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্ছ্বসিত ওঁর কথা বলার সময়। গুরুজির ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। একটা কলকাতায় আর একটা মুম্বইতে। কলকাতার অনুষ্ঠান হয়েছিল রবীন্দ্রসদনে। সহায়তা করেছিল রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি ও অনামিকা কলাসঙ্গম। কলকাতায় বাজিয়েছিলেন পণ্ডিত কিষেণ মহারাজ, মুম্বইতে ওস্তাদ জাকির হুসেন। কিষেণ মহারাজজি গুরুজি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘লয় মেঁ হ্যায় আলি, স্বর মেঁ হ্যায় আকবর’। এর চেয়ে ভাল বিশেষণ বোধহয় আর হয় না। সেবার গুরুজি ছোটদের নিয়ে কলকাতায় এক কর্মশালাও করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন পুত্রকে ‘স্বরসম্রাট’ উপাধি দিয়েছিলেন। আমার ধারনা, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান টের পেয়েছিলেন, তাঁর এই পুত্র ক্ষণজন্মা। কোনও ফরিস্তা। তাই অত আগলে আগলে রাখতেন। অনুশাসনের নিগড়ে বাঁধতে চাইতেন। রেডিওতে যখন বাজাতে ঢুকলেন, বাবা গিয়ে পয়সা কম দেওয়ার জন্য বলে আসতেন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই গুরুজি যোধপুর রাজসভার শিল্পী হন। বাবা আলাউদ্দিন সেখানে গিয়েও বলে আসেন, রাজাসাহেব যেন আলি আকবরের বাজনা আট ঘণ্টার কম না শোনেন। আসলে বাবার উদ্দেশ্য ছিল, ছেলের রেওয়াজে যেন ফাঁকি না পড়ে। আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রেওয়াজকে বরাবরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রেওয়াজই শিল্পীকে পথ দেখিয়ে দেয়। গুরুজিদের কাছে দিনে ১৬ ঘণ্টা থেকে ১৮ ঘণ্টা রেওয়াজ কোনও ব্যাপারই ছিল না।

বাবার কঠোর অনুশাসন যুবক আলি আকবরের মনকে বিদ্রোহী করে তুলত। তিনি নিজেই আমাদের সেই কথা বলতেন। বলতেন, রেওয়াজে যেন ফাঁকি না দিই, সেই জন্য মাকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিতে বলতেন। ওভাবে খেয়ে আমার পেট ভরেনি বুঝতে পেরে মা আমার বাজনার ফাঁকে ফাঁকে এসে খাইয়ে দিয়ে যেতেন। ওই জন্যই ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত বাজনা বাজাতাম বটে, খুব ভালবাসতে পারিনি। তারপর আস্তে আস্তে একে ভালবাসতে শুরু করি। তবে আশি পেরিয়েও তাঁকে বলতে শোনা গেছে, কী শিখলাম, এখনও সা-ই খুঁজে পেলাম না! বলতেন, এখন বুঝি বাবা ঠিকই বলতেন! বুঝুন, ওই রকম বিশাল মাপের সঙ্গীতব্যক্তিত্বের কী বিনয়! নিউটনের জ্ঞানসাগরের পাড়ের কয়েকটা নুড়ি কুড়নোর উদাহরণটা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়। প্রকৃত শিল্পীরা বুঝি এমনই হন!

গুরু হিসেবেও আলি আকবর খান সাহেবের কোনও তুলনা নেই। কত কঠিন জিনিস কত সহজ করে বোঝাতেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। রামকৃষ্ণ যেমন কথায় কথায় উপমা দিয়ে বিষয়কে সরল করে দিতেন, গুরুজিও তাই। রাগরূপকে, তার চলনকে অতি সহজ করে কখনও রূপকের সাহায্যে বুঝিয়ে দিতেন। তারপর নিজে বাজিয়ে দেখাতেন। ভারতীয় গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে কঠোরভাবে মেনে চলতেন।

আরেকটা বড় ব্যাপারের উল্লেখ না করলেই নয়। অত বছর আমাকে তালিম দিয়েছেন, কিন্তু বললে বিশ্বাস করবেন না, একটিও পয়সা নেননি। উল্টে আমেরিকা গেলে আমাকেই ধরে নিয়ে গিয়ে কোনও রেস্তোরাঁতে খাওয়াতেন। ১৯৯৮ সালে আমার স্ত্রী ও পুত্র ওখানে গিয়েছিল। উনি ওদেরও ধরে নিয়ে যেতেন খাওয়াতে। আমি ভয়ানক কুণ্ঠিত হতাম। কিন্তু করার কিছু থাকত না। ওর স্নেহের টান এমই ছিল।

আমি যখন খান সাহেবের কাছে শিখতে শুরু করি, তখন মাঝে মাঝে মনে হত, ইস, ওঁকে যদি আরও আগে পেতাম। পরক্ষরণেই ভাবতাম, ১০ বছর আগে হলে যে ব্যাপারটা এখন বুঝতে পারছি, তা হয়ত তখন বুঝতেই পারতাম না! গেলে আমাকে ছাড়তে চাইতে না। আরও থেকে যাওয়ার জন্য বলতেন। আমার উপায় ছিল না। দেশে ফিরতেই হত। সবচেয়ে বিপদে পড়তাম ওঁর সামনে বাজাতে হলে। একবার মনে আছে, ওঁর কলেজের এক অনুষ্ঠানে বাজাতে বললেন। আমি সরাসরি বলে দিলাম, আপনি সামনে থাকলে বাজাতে পারব না। বাজানোর ভয়ে লস-এঞ্জেলেসে এক বন্ধুর বাড়ি পালিয়ে যাই। উনি ওখানেই ফোন করে ধরেন। বলেন, আমাকে লোকজন আসছে শুনতে। আর আমিও অন্য সব কাজ সেরে হাজির থাকব। বুঝুন অবস্থাটা। শেষমেশ বাজাতেই হয়। সকলের তারিফও পাই।

এমনিতে অবশ্য ওঁর সামনে অনেকবারই বাজাতে হয়েছে। যে হলঘরটায় বাজাতাম, উনি তার একেবারে উল্টোদিকের কোণে দূরে একটা চেয়ার নিয়ে বসে থাকতেন। কোনও ভুল হলে পরে বুঝিয়ে দিতেন। একবার বেহাগ ও ঝিঁজিট বাজাই। বেহাগে গা মা গা মা পা-র প্রথমটা কড়ি মা, পরেরটা শুদ্ধ। আমি মীড় দিয়ে বাজিয়েছিলাম। উনি বললেন পর্দায় বাজাতে। বাজিয়ে দেখলাম সত্যিই এটা বেশি ভাল লাগছে। আরও একটা ঘটনার কথাও খুব মনে আছে। একবার রেডিওতে ছায়ানট বাজিয়েছি। বাজনায় কিছু ভুল ছিল। উনি শুনে বললেন, আবার ছায়ানট শেখো। বলে নতুন করে রাগটা শেখাতে লাগলেন। এমনও হয়েছে, একটা রাগ দু-তিনবার এক-এক রঙে শিখিয়েছেন। শেখানোর সময় এবং অনুষ্ঠানে বাজানোর সময় লক্ষ্য করতাম, কী অনায়াস ভঙ্গিতে গুরুজি নোটগুলো লাগাচ্ছেন। অনন্য ভঙ্গিমা। আর টোন? আমি বহু গুণিজনের বাজনা শুনেছি। সবার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে মাথায় রেখেই বলছি, অমনটি আর কারও হাত দিয়ে বেরোয় না। যখন রাগের আলাপ করতেন, আলাপের সমস্ত অঙ্গগুলো বাজনায় পাওয়া যেত। লয়ের কাজ ছিল অসাধারণ। শাস্ত্রীয় শুদ্ধতা বজায় রেখেই সৃষ্টি করতেন সুরের জাদু। এক ধরনের রোমান্টিসিজম। আর বাজানোর সময় নিবিষ্ট হয়ে চোখ বন্ধ করে বাজাতেন। বাজাতে বাজাতে মাঝে মাঝে ঢোঁক গেলার মতো করতেন। অনেকে এটা নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। আমার ধারনা, উনি মনে মনে গাইতেন। সে জন্য গলা শুকিয়ে যেত বলেই অমন করতেন। ওঁর বাজনা গায়কী অঙ্গের কিনা জিজ্ঞেস করলে মজা করে বলতেন, গায়কী অঙ্গ নয় তো কি ভঁইসি অঙ্গ।

চন্দ্রনন্দন, গৌরীমঞ্জরী, মেধাবী, আলমগিরি ইত্যাদি বেশ কিছু রাগ উনি সৃষ্টি করেছিলেন। দু-তিনটে কোশ, যেমন চন্দ্রকোশ, যোগকোশ, কৌশিকী কানাড়া মিশিয়ে তৈরি করেন চন্দ্রনন্দন। গৌরীমঞ্জরীতে গৌরী রাগের সঙ্গে মিলিয়ে ছিলেন পূর্বী ঠাটের অঙ্গকে। এতে শুদ্ধ রে এবং কোমল নি-কে অদ্ভুতভাবে মিলিয়েছেন। মেধাবীতে আছে মলোহা। আসলে এইভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি বটে কিন্তু এগুলোকে উনি এমনভাবে মিলিয়েছেন যে, এগুলো মিলেমিশে একটা আলাদা অপূর্ব রূপ পেয়েছে, না শুনলে বলে বোঝানো যাবে না।

আমি তো ওঁর কাছে শিক্ষা শুরুর অনেক আগে থেকেই ওঁর গুণমুগ্ধ। সরোদ বাজানো শুরু করতে সেই মুগ্ধতা দিনে দিনে বেড়েছে। কলকাতায় উনি বাজাচ্ছেন, আর আমি শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত নেই, এমনটি হয়নি। ওঁর বাজনা শোনার জন্য কলকাতার বাইরেও ছুটে গেছি। ২০০৬ সালে ডোভার লেনে গুরুজি শেষবার বাজিয়েছিলেন। তার আগে বেশ কয়েক মাস উনি সরোদে হাতও ছোঁয়াননি। তার উপর কিডনির সমস্যায় দারুণ অসুস্থ। উনি যখন বাজাতে এসেছেন, তখনও সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস চলছে। ডাক্তাররা ওঁর স্বাস্থ্য নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগে। আমরাও প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায়। এত অসুস্থতা নিয়ে বাজাবেন কী করে! কিন্তু যখন ওঁর কোলে সরোদ দেওয়া হল, এ যেন সেই মন্ত্রশক্তি। চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হয়ে ধরলেন রাগ জয়জয়ন্তী। টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা বাজালেন। কোথাও সুরের একটুকু নড়চড় হল না। সেদিন প্রচুর শ্রোতা এসেছিলেন। তাঁরা মুগ্ধ, উচ্ছ্বসিত। তাঁদের প্রাপ্তির ভাঁড়ার কানায় কানায় পূর্ণ।

অত বছর বিদেশে কাটিয়েছেন কিন্তু চালচলনে এতটুকুও ছাপ ফেলেনি। সেখানে খাঁটি ভারতীয়। খুব হালকা রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি পরতে ভালবাসতেন। ওপরে পরতেন হালকা বর্ডার দেওয়া জ্যাকেট। বিদেশে থাকা বা যাতায়াত করা অন্য শিল্পীরা তাঁদের উপস্থাপনায় যে চটক দেখাতেন, ওস্তাদ আলি আকবর কখনও তার ধার দিয়েও যাননি। একেবারে সাদামাঠা ছিল উপস্থাপনা। অত্যন্ত প্রচারবিমুখ ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, শেষদিন পর্যন্ত প্রচারের আলোতেই থেকেছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে সমস্ত বড় কাগজে প্রথম পাতায় খবরে এসেছেন। ওঁর ব্যাপারস্যাপার দেখে আমার মনে হত, উনি বুঝি কোনও সাধক। সাধনার উচ্চমার্গে বিচরন করছেন। যখন বাজাচ্ছেন কখনো দেখতেন না শ্রোতা-আসনে কে বা কারা রয়েছেন। চোখ বন্ধ করে বাজাতেন। আমরা বাজাতে বাজাতে সামনের দিকে তাকালে উনি মজা করে বলতেন, কী দেখছ? সামনে কোনও সুন্দরী মহিলা আছে কিনা দেখছ বুঝি! নিজের বাজনা প্রসঙ্গে বলতেন, আমি বাজাতে শুরু করি, শুরু করি। তারপর কেউ যেন হাত ধরে আমায় নিয়ে যায়, আমি শ্রোতা হয়ে যাই। আত্মমগ্নতা আর সাধনা কোন পর্যায়ে গেলে এমন কথা একজন বলতে পারেন ভাবুন!

খেতে ও খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। খাবারের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল ডাল আর খিচুড়ি। গুরুজি চমৎকার ডাল রাঁধতে পারতেন। ডালের ওপর ভয়ংকর দুর্বলতা ছিল। আর ছিল গাড়ি চালানোর শখ। এদেশে ওর একটা স্টুডিবেকার গাড়ি ছিল। এক এক সময় মুম্বই থেকে গাড়ি চালিয়ে সটান চলে এসেছেন কলকাতায়। আমেরিকাতে ওঁর ছিল ক্যডিলাক গোল্ড ‘টপ অফ দ্য লাইন’। দারুণ আরামদায়ক একবার সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলেন গাড়ি চালাতে চালাতে। গাড়ির গতি বেড়ে গিয়েছিল। জোরে চালানোর জন্য ঝামেলায় পড়েন। তারপর আর নিজে গাড়ি চালাতেন না। ছেলে আলমই চালাত। অবসর সময়ে আধুনিক গান খুব শুনতেন। বিশেষ করে শুনতেন লতাজি ও আশাজির গান। ১৯৯৫ সালে উনি ‘লেগ্যাসি’ নামে শেষ যে অ্যালবামটি করেন, তাতে আশাজিকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন। অ্যালবামটি গ্র্যামি নমিনেশন পেয়েছিল। শুনেছি আশাজি ওঁর কাছে গাণ্ডাও বেঁধেছিলেন। গুরুজির আর এক মস্ত ব্যাপার ছিল নিয়মানুবর্তিতা। ৬টা বললে ৬টা। ৫টা থেকেই কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিতেন। আমরা পৌনে ৬টায় পৌঁছলেও দেরি হয়েছে বলে বকাবকি করতেন।

ওঁর আর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা না বললে লেখাটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তা হল ওঁর রসবোধ। শেখানোর সময় বা আড্ডার ফাঁকে নানা মজার কথা বলতেন। একবার বিশ্বভারতীতে গিয়েছিলেন আমন্ত্রণে। তৎকালীন উপাচার্য ওঁর ঘরে এসে জানতে চান, খাঁ সাহেব, সব ঠিক আছে তো? খাঁ সাহেব বলেন, ‘হ্যাঁ, সব ঠিকই আছে। তবে বাথরুমের কলের প্রস্টেট প্রবলেম আছে।’ মানে, কল দিয়ে জল ঠিকমতো পড়ছিল না। এখন ক্যাসেট শুনে গান-বাজনা শেখার ব্যাপরটা ওঁর পছন্দের ছিল না। তাই বলতেন, আগে ছিল সেনি ঘরানা, এখন হয়েছে সোনি ঘরানা।

গুরুজির কথা কত বলব। এ শেষ হওয়ার নয়। তাঁকে যে অল্প সময় পেয়েছি, তাতেই আমি ধন্য। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছি। কাজ শেষ হওয়ার মুখে। আর মাস দুয়েক পরেই আমার ওঁর কাছে যাওয়ার কথা ছিল। যাব, আর ওঁর সঙ্গে দেখা হবে না ভাবতেই মনটা বিষন্ন হয়ে যাচ্ছে।

I Become The Rabab
Ken Zuckerman
Dear Baba, it is so hard to realize that you are no longer with us. After 37 years, you have been as much a part of my life as my parents. You have been a second father to me, a guru and the most important teacher and spiritual guide I ever had. With love, respect, devotion and sadness, I am now searching for a way to bid farewell to you and to ease the pain that is in my heart.
But why all this pain? Actually I am happy for you. You have had an incredible and long life, spanning epochs and continents. You have fulfilled your father’s wish to “spread this music as far as the sun and moon shine.” You have given the gift of your music to audiences all over the world. For over 70 years, and in spite of ill health recently, you have continued to inspire thousands of students with your teaching and sense of duty and commitment to passing on this great tradition. You have taught us right up to your last breath. I am so happy and fortunate to have been with you for a significant part of your long journey.
So how is it that with so much to be happy about, I am still so sad? I am sad because I miss you terribly. I miss your patient and devoted teaching. I miss your unique presence and wisdom. I miss your sense of humour. I miss your compassion and love for all your students and family. I even miss your complaining. And perhaps most of all, I miss your incomparable music. I miss that one note, which only you can produce, that wipes away all words and thoughts, and puts me into a state of silent and deep listening, peaceful contemplation and joy.
I am flooded by memories of all the time I spent with you over the years, from the first moment I saw you perform in 1971 to the last incredibly poignant lesson you gave us only hours before you passed away.. Somewhere during that first concert, it was as if a bolt of lightning hit me with the power of your music — so deep, so compelling and so spontaneous. I had to find out where this came from. I made the pilgrimage to your college in California and as soon as I began studying with you, I knew that this was the music I had been searching for my whole life. All questions of what to do, why, how to survive, all faded into the background. All I wanted was to be in your presence, learning this beautiful and rich tradition.
One day, after having studied for several years, you surprised me by greeting me with my name. I was so happy and touched that in spite of the hundreds of students coming and going, you were getting to know me at the same that I was becoming more and more immersed in learning from you. Then there was the time when during a vocal class, you requested each one of us to sing alone. As if that wasn’t terrifying enough, you insisted that we use the microphone and you had the volume turned all the way up. There was no escape, although we all wanted to melt and disappear into the carpet. One by one we all tried and after I sang you said, “Very good, you are better. But you must get better still.” It was a rare compliment, the first and one of the few you ever gave me directly. After cherishing it for a moment, I again dove into what seemed like an ocean of your knowledge, so often with a feeling that I would never get much deeper than the surface.
Years went by and whenever I felt like I made a little progress, I immediately had the sinking feeling that the ocean of your music was getting deeper all the time. Sometimes I despaired that I
would fail, but you always taught us with such patience and inspiration that the pure joy of working in your presence renewed my hope.
In 1985, after seeing the growing interest for your music in Switzerland, you recommended that I open a branch of the Ali Akbar College in Basel. I felt so honoured that you would trust me with this endeavour and at the same time, I was afraid of the challenge. In December, just after the birth of my first daughter, you arrived for the first of what would turn out to be many memorable seminars and European concert tours. But there were some growing pains and I made some mistakes. One evening you were so upset that you spent several hours lambasting me. You constructed this “composition” as musically as one of your performances. The main theme was, “But Ken, how could you do this to me?” After each variation, during which you would elaborate how I had messed things up, you would always come back to the main theme, “But Ken, how could you…” I was devastated and at one point broke down in tears. And then, almost as if you were waiting for that breaking point, you said, “Ken, I’m doing this because I love you and I want you to grow”. I replied that you could have just told me what you wanted earlier. You then said, “It doesn’t matter what I say — you have to know what I want.” I looked at you, first in disbelief, and then I understood that you were inviting me to change my entire view of the world. I slowly realized that you were demanding that I perceive something more subtle than just your words, to hear more of the microtones in-between the notes and to sense the rhythms that are hidden in the shadows of the beats. From then on, everything was different and I felt closer than ever to you and your teaching.
How can I ever thank you for all you have given me? During the last few years you repeatedly requested me to continue your work and keep the Ali Akbar College going. I promise that I will do my best to pass on to others whatever small amount of your vast knowledge I have been able to grasp. I also promise that I will go on exploring the infinite ways that you taught us of expressing ragas on the sarod and I will always try to please the hearts of music lovers everywhere. Baba, even though I will no longer be able to hear what you say, I promise that I will always try to understand and follow what you want.
With love, deep respect and devotion,
Your disciple always,
Ken
Basel

Ken Zuckerman has been a disciple of Ustad Ali Akbar Khan since 1972. He lives in Switzerland where he directs the Ali Akbar College of Music in Basel. He is also a professor at the Music Conservatory of Basel, where he gives courses in North Indian classical music and Western music from the Middle Ages. He performs extensively in Europe, India and the USA.

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

১ comment

  1. রেজাউল করিম সুমন - ১৫ জুলাই ২০০৯ (১:৫৮ অপরাহ্ণ)

    অনবদ্য শোকলেখন। উস্তাদ আলি আকবর খানের জন্য খিচুড়ি রাঁধতে গিয়ে তবলিয়া শঙ্কর ঘোষ কীভাবে নাকাল হয়েছিলেন নিজেই তার বিবরণ দিয়েছেন এ লেখায় :

    … উনি আমাকে বললেন খিচুড়ি রাঁধতে। খিচুড়ি খেতে উনি দারুণ ভালবাসতেন। আমার অবস্থা তো কাহিল। কারণ আমি তখন রান্নার র-ও জানি না। এদিকে উনি বড় মুখ করে খেতে চেয়েছেন, কী করে বলি যে আমি রাঁধতে জানি না। জয়গুরু বলে শুরু করলাম। এটুকু তো জানতাম, খিচুড়িতে চাল আর ডাল লাগে। রাঁধতে গিয়ে দেখি কি রকম ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে লাগছে। মনে পড়ল হলুদের কথা। ঘরে হলুদ নেই। নিচেই মস্ত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। খিচুড়ি চাপিয়ে চলে গেলাম হলুদ কিনতে। কিন্তু ও হরি, হলুদের ইংরেজি মনে পড়ছে না। ইন্ডিয়ান স্পাইস, ইয়েলো পাউডার ইত্যাদি বলছি। ওরা হলুদ রঙের অনেক রকম গুঁড়ো মসলা এনে দেখাল। তার মধ্যে শুঁকে একটাকে হলুদ মনে হল। কিনে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখি ঘর কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে। আসলে গ্যাস বন্ধ না করেই চলে গিয়েছিলাম।

    আলি আকবর খানের গুরুভক্তিও তাঁর উত্তরসাধকদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রইল :

    যখন ওঁর বিশ্বজোড়া নামডাক, তখনও বাবা ওঁর বাজনা শুনবেন, শুনলেই গুটিয়ে যেতেন। এই কারণে এলাহাবাদ রেডিও স্টেশনে কখনও বাজাতেন না। এলাহাবাদ রেডিও মাইহার থেকে শোনা যেত। রেডিওয় বাজালে বাবা শুনবেন, এই ভয়েই বাজাতেন না।

    এই লেখাটি আজকাল থেকে মুক্তাঙ্গন-এ তুলে না দিলে আমাদের অনেকেরই পড়া হতো না। এক্ষেত্রে ‘তুলে দেওয়া’ মানে ‘টাইপ করা’ও। মাসুদ ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম।

    সংগীতপ্রেমী ভাস্কর শর্বরী রায়চৌধুরী আলি আকবর খানের ভাস্কর্য গড়েছিলেন। মূল কাজটা দেখিনি, তার ছবি দেখেছিলাম। হাতের কাছে থাকলে সেই ছবি এখানে তুলে দেওয়া যেত।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.