বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার এই বিধ্বস্ত পটভূমিতে এ বারের বিশ্বনাট্য দিবসের বাণী দিয়েছেন ব্রাজিলিয়ান নাট্যকার আগস্তো বোয়াল। লাতিন আমেরিকার কঠিন আবহে বয়সে, ভাবনাবৈচিত্রে ও আপসহীন প্রতিবাদে বিশিষ্ট হয়ে ওঠা ৭৮ বছরের এই তেজি নাট্যকার সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ান তার ‘নিপীড়িতের থিয়েটার’ বা ‘থিয়েটার অফ দ্য অপ্রেসড’-এর তাত্ত্বিক ভাবনা আর নিত্যনবীন পরীক্ষামূলক নাট্য পদ্ধতির শিক্ষণ নিয়ে। ১৯৬১ সালে ‘দক্ষিণ আমেরিকার বিপ্লব’ নাটকটির সূত্রে রাজনৈতিক প্রতিবাদে থিয়েটারে নতুন এক পদ্ধতির দরজা খুলেছেন বোয়াল। মঞ্চ থেকে মঞ্চের বাইরে থিয়েটারকে নিয়ে এসে অনির্দিষ্ট দর্শককে অনির্দিষ্ট অভিনয়স্থলে অনির্দিষ্ট নাটকীয় দ্বন্দ্ব ও প্রশ্নের সামনে নিয়ে আসে বোয়ালের নাট্যপদ্ধতি। মার্কসবাদে বিশ্বাসী এ বারের বিশ্বনাট্য দিবসের বাণীতে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা আর তার পেছনে ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের জনবিরোধী ভূমিকাকে চিহ্নিত করে দৃপ্তকণ্ঠে ডাক দিয়েছেন নাট্যকর্মীদের সমাজটাকে বদলে দেয়ার কাজে থিয়েটারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে।
বিশ্বনাট্য দিবসের বাণী ২০০৯
দৈনন্দিন জীবনে যা আমাদের এত চেনাজানা তাকেই থিয়েটারে অচেনা-অদেখা মনে হয়। থিয়েটার মানে আমাদের যাপিত জীবনের উপর সঞ্চায়িত আলোকসম্পাত।
গত সেপ্টেম্বরেই আমরা একটা গোপন সত্য প্রকাশের নাটকীয়তায় চমকে গিয়েছিলাম। আমরা এতকাল ভেবে আসছি চারিদিকের এত যুদ্ধ সঙ্ঘাত, গণহত্যা, খুন আর অত্যাচার সত্ত্বেও নিজেরা বেশ এক নিরাপদ দুনিয়াতেই বাস করছি, কারণ ওসব ঘটনা ঘটে আমাদের সুখী গৃহকোণের অনেক দূরে আরণ্যক সমাজে। আমরা এতকাল নামী ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়েছি, শেয়ার বাজারে টাকা খাটিয়েছি, বিশ্বস্ত এবং সৎ সঞ্চয় কর্মীদের হাতে টাকা জমা দিয়েছি,—সেই আমাদের হঠাৎ বলা হল, তোমাদের এত সাধে ও কষ্টে জমানো অর্থের আর কোনো অস্তিত্ব নেই এবং হঠাৎই অর্থনীতিবিদরা এই ভয়ঙ্কর উদ্ভট সত্যকে আবিষ্কার করলেন। বোঝা গেল, এর পেছনে যারা, তারা আর বিশ্বাসযোগ্য নয়, সম্মানীয়ও নয়, এটা খুবই খারাপ থিয়েটারের মতো ছিল গোটা ব্যাপারটা। এটা ছিল একটা নোংরা নাট্যকাহিনী যে কাহিনীতে কিছু লোকের ভাগ্য চকমক করে হাসিতে। কিন্তু অধিকাংশ লোকের ভাগ্যেই নেমে আসে অন্ধকার। গেল গেল রব তুলে ধনী দেশগুলোর কিছু রাজনীতিবিদ সভা করলেন, শলা করলেন এবং কিছু জাদুকরী টোটকার সন্ধানও পেলেন। আমরা যারা ওদের কাজ আর সিদ্ধান্তের হতভাগ্য শিকার তাদের ব্যালকনির শেষ পংক্তিতে বসে নীরব দর্শক হয়ে সব দেখতে হল।
বিশ বছর আগে আমি রাসিনের(Racine) ফেদ্রে (Phedre) মঞ্চস্থ করেছিলাম রিও-ডি-জেনিরোতে। মঞ্চ ছিল দরিদ্র। রোদে শুকোতে দেওয়া পশু-চামড়ার ওপর ছিল অভিনয়স্থল—ঝাড় থেকে কেটে আনা বাঁশ দিয়ে ঘেরা চারপাশ। প্রতিটি মঞ্চায়নের আগে আমি অভিনেতাদের বলতাম, এতকাল দিনের পর দিন যে গল্প আমরা মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে ফেঁদেছি, তা কিন্তু এই বাঁশ ডিঙিয়ে অভিনয়স্থলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ। কারণ এই মুহূর্তে আমাদের আর কোনো মিথ্যা বলার অধিকার রইল না। থিয়েটার এ ধরনের গোপন সত্যকেই আঁকড়ে ধরে। ঘটমান বর্তমানের গভীরতা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এখন সমস্ত সমাজে, সমস্ত জাতি-উপজাতিদের মধ্যে, সব রকম লিঙ্গ বৈষম্যের মধ্যে, সামাজিক শ্রেণী আর জাতপাতের কথা উঠলেই আমরা তো প্রায়ই অত্যাচারিত ও অত্যাচারীকে একই পটভূমিতে দেখতে পাই। দেখতে পাই একটা নোংরা নিষ্ঠুর দুনিয়াকে, তাই আমাদের এখন শল্য চিকিৎসার জন্য যেমন অজ্ঞান করার ঔষধ দরকার হয়, তেমন কিছু দরকার একটা বড় শল্য চিকিৎসার জন্য এবং আমি জানি এটা সম্ভব।
আমাদের হাতে এক নতুন দুনিয়া তৈরির ভার, কারণ আমরা তো আমাদের থিয়েটারকে মঞ্চেই তৈরি করি। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই থিয়েটারের স্থান আছে। সেই নাট্য দৃশ্যটি তৈরি হযে এল বলে যখন আপনারা ঘরে ফিরে নিজের নাটক সৃষ্টির কাজ শুরু করবেন, যা এতদিন দেখতে পাননি তাকে অন্বেষণ অবশ্যম্ভাবী। কারণ থিয়েটার শুধুমাত্র একটা ঘটনা নয়, এটা প্রাত্যহিক জীবনযাপনের একটা অঙ্গ। আমরা সবাই অভিনেতা। একজন নাগরিক হওয়া মানে শুধু ঘর বেঁধে সমাজে বাস করা নয়, সমাজটাকে বদলে দেওয়ার চেষ্টাটাও নাগরিকেরই দায়িত্ব।
আগস্তো বোয়াল
(পর্তুগিজে দেয়া বাণী থেকে ইংরেজি অনুবাদ, ইংরেজী থেকে চন্দন সেনের বাংলা অনুবাদ।)
**এটি লেখক হিসেবে লেখা পোস্ট নয়, কম্পোজার হিসেবে কম্পোজ করা পোস্ট। বিভিন্ন সূত্র থেকে নেয়া কয়েকটি লেখার যোগসাজোস।