কোভিড১৯ তার নাম। এখন তিন বছর এবং এই কোভিড১৯ যা আমার ভেতরের দীর্ঘতম হতাশা তা আরো কত বছর আমাকে বিকল করে রাখবে আমি জানি না। এই গতকালও ভাবছিলাম, তখন আমি ৪৮ পূর্ণ করেছি, কিন্তু তা না হয়ে যদি ৩৮ পূর্ণ করতাম, হতাশা কি এত প্রবল গ্রাস করত আমাকে, ঘরের ভেতর ৫০এর কাছাকাছি বয়সে আটকে যাওয়াটাই মনে হয় সবচেয়ে বড় হতাশার, আমার আজো মনে হয়, জীবনের হতাশা যখন বিকটভাবে ডানা মেলে, তখন এভাবে ঘরের মধ্যে আটকে যাওয়ার হতাশার সাথে আর কোনো হতাশার কোনো তুলনাই হতে পারে না। ঘরে থাকতে আমার কখনোই তেমন কোনো অসুবিধা ছিল না, আর আমি ঠিক ঘরের বাইরের মানুষও নই, আমি ঘরেরই মানুষ, কাজের ঘর আমার প্রিয় উপলব্ধি সবসময়। কিন্তু সেই আমি এপ্রিল ২০২০ থেকে কেমন ভেতরে অবশ হয়ে যেতে থাকলাম। পড়তে পারি না কিছু, বই নামাই ডেস্কেই পড়ে থাকে, আরো নামাই, পড়েই থাকে, পড়া হয় না, কোনোভাবেই কোনো বইয়ে মনোনিবেশ করতে তো পারি না, ওই উল্টাপাল্টা অমনোযোগেও এক রকমের পড়া আছে আমার, তাও হয় না। বই পড়ার সাথে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, কোভিড১৯ এর ঘরে থাকার বাধ্যতার সপ্তাহ দুই না পেরোতেই। শোনাও বাধাগ্রস্ত। কত কিছু আছে শোনার অথচ কিছুই শোনা হচ্ছে না। গান বাজনা কম্পোজিশন পাঠ সবকিছুর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ। নিজের কান যেন নিজের কাছ থেকেই অনেক দূরে চলে গেছে। আমাকে তার প্রয়োজন নেই যেমন তাকে আমার প্রয়োজন নেই। দেখাও অনুপস্থিত। দেখা যা এখন পৃথিবীর সবকিছু, দেখার কতকিছু, এবং ঘরে বসেই। কিন্তু আমার কিছু দেখা হচ্ছে না। আমি কিছুই দেখতে পারছি না। আর থাকে স্মৃতি। এবং দেখলাম এই তিন বছরে আমি স্মৃতি হারিয়েছি ভয়ঙ্কর ভাবে। কোভিড১৯ এর সময়ে স্মৃতিভ্রষ্টতা, এটাই হতে পারে কোনো অনাগত উপন্যাস লেখকের জন্য আমার জীবনভিত্তিক কোনো বইয়ের শিরোনাম। এভাবে ঘরে বসে বসে, পড়তে না পারা, শুনতে না পারা, দেখতে না পারা, স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়া — কোভিড১৯এর এই জটিল অপারগতার মধ্যে — ঘরে বসে বসে, ঘরে বসে থাকাটাই রপ্ত হয়ে গেছে এখন।
কিছুই না করা হতে পারে জীবনযাপনের একটা ধরন এবং কিছুই করতে না পারা সেক্ষেত্রে জীবনের জড়তা নয়, তার চেয়ে ওই গত তিন বছর তো আমার মনে হয়েছে এই কিছুই করতে না পারার মধ্যে একটা অমলিন নির্জনতা আছে যা আমি ২০২০ এর আগে পেতে পারিনি এবং এখন আর আমি পেয়ে হারাতে পারি না।
আমার যদি অক্ষরজ্ঞান না থাকত, আমার যদি শোনার শক্তি অবরুদ্ধ হয়ে যেত, আমার যদি দেখার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যেত, তারপরও যে আমি থাকতাম তাকেই আজ বেশি বেশি দেখছি। এই যে এমন করে ঘরে বসে বসে এসব উপলব্ধি নিয়ে বেঁচে আছি, এই বেঁচে থাকার ভেতর আমার সমস্ত কোভিডক্লান্তি জড় হয়ে আছে।
আছি প্রবল স্বাতন্ত্রে, ঘরে, যেখানে প্রমাণ দিতে হয় না কিছু, এই জায়গাটি ছাড়া আর কিছু নেই আমার, জেনেছি এই গৃহবাসে, এটাই জীবন মানুষের, শেষের, শুরুর, দূরের, কাছের, সূর্যাস্তের, সূর্যোদয়ের — মানুষের জীবন গাছের নয়, জানি, কিন্তু আবার গাছেরও, শেকড়ের একটা জায়গা চাই তার, সেই তো ঘর, তিন বছর তাই বুঝেছি, বিকলতায়, স্থবিরতায়, অস্থিরতায় — অতল অস্থিমজ্জায়।
অনেক কিছুই আমার আর আগের মতো নেই, নিজের পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সে কোভিড১৯ কাল না হয়ে যদি আরো কয়েক বছর আগে বা পরে কোভিড১৯ কাল আসত আমার জীবনে তাহলে হয়তো সেই অভিজ্ঞতা একই রকম হতো না আমার জীবনে, এই কোভিড১৯ কাল আমাকে যত গভীরে আরো অপরিচিত হতে শিখিয়েছে এই শিক্ষা অন্য কোনো বয়সকালে আমি হয়তো পুরো নিতে পারতাম না। আমার তিন দশকের গ্রন্থাগারমুখর জীবনই আমাকে জানিয়ে রেখেছে সবকিছুর তাড়না থেকে অপরিচিত অন্তরালে উন্মুক্ত থাকার অভয় আছে সেখানে, কোভিড১৯ কালেও ঘরের বাইরে গ্রন্থাগার ছাড়া আমার আর কোনো জায়গা নেই — এই বোধ আমাকে বাঁচতে দিয়েছে সমস্ত নির্মম নাপারার বিষণ্ণতা অবসাদ থেকে।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।