পিন্টারের মহাপ্রয়াণ

হ্যারল্ড পিন্টার (১০ অক্টোবর ১৯৩০ - ২৫ ডিসেম্বর ২০০৮) ইহুদি বংশোদ্ভূত দর্জি পিতার সন্তান হ্যারল্ড পিন্টার ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রাম করে আটাত্তর বছর বয়সে মারা গেলেন। আটাত্তর বছর কম বয়স নয়। তবে তাঁর সমসাময়িক ও বয়োজ্যেষ্ঠ অন্যান্য লেখকদের অনেকেই এখনও লেখালেখিতে সক্রিয়। একসময় পিন্টার বলেছিলেন, 'আমি ২৯টি নাটক লিখেছি এবং মনে করি তা আসলেই যথেষ্ট।' সব মিলিয়ে তাঁর নাটকের সংখ্যা ৩২। [...]

হ্যারল্ড পিন্টার (১০ অক্টোবর ১৯৩০ - ২৫ ডিসেম্বর ২০০৮)

হ্যারল্ড পিন্টার (১০ অক্টোবর ১৯৩০ - ২৫ ডিসেম্বর ২০০৮)

ইহুদি বংশোদ্ভূত দর্জি পিতার সন্তান হ্যারল্ড পিন্টার ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রাম করে আটাত্তর বছর বয়সে মারা গেলেন। আটাত্তর বছর কম বয়স নয়। তবে তাঁর সমসাময়িক ও বয়োজ্যেষ্ঠ অন্যান্য লেখকদের অনেকেই এখনও লেখালেখিতে সক্রিয়। একসময় পিন্টার বলেছিলেন, ‘আমি ২৯টি নাটক লিখেছি এবং মনে করি তা আসলেই যথেষ্ট।’ সব মিলিয়ে তাঁর নাটকের সংখ্যা ৩২। উপন্যাস রয়েছে ১টি, ১৯৯০-এ প্রকাশিত দ্য ডোয়ার্ফ্‌স্ এবং চিত্রনাট্য — ২২টি। যথেষ্টই বটে। কিন্তু তাঁর লেখকসত্তা ছাপিয়ে প্রগতিশীল, মানবদরদী সত্তাটির অস্তিত্ব আরো কিছুদিন থাকলে বিশ্বের মঙ্গল হতো।

২০০৫ সালে নোবেল কমিটি তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণার সময় বলেছিল যে, পিন্টার থিয়েটারের মৌলিক উপাদানগুলো ফিরিয়ে এনেছেন। অসুস্থতার কারণে পিন্টার তাঁর নোবেল বক্তৃতা রেকর্ড করে পাঠিয়েছিলেন, যাতে বুশ ও ব্লেয়ারের ইরাক আক্রমণকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করতে ছাড়েননি। তিনি বলেছিলেন, ‘ইরাক আক্রমণ এক ন্যাক্কারজনক বর্বরতা, এক জঘন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, যাতে আন্তর্জাতিক আইনের ধারণার বিরুদ্ধে এক চরম ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে।’ ‘গণহত্যাকারী আর যুদ্ধাপরাধীর বিশেষণ পাওয়ার জন্য আর কত লোককে হত্যা করবে তোমরা? ১ লাখ?’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে এই ছিল তাঁর প্রশ্ন। বুশকে উদ্ধত যুদ্ধবাজ বলার পাশাপাশি স্বদেশী ব্লেয়ারকে বুশের অনুগত এক ভেড়া বলতেও দ্বিধা করেননি তিনি। ওই নোবেল বক্তৃতায় তিনি আমেরিকাকে পৃথিবীর সকল ডানপন্থী সামরিক একনায়কের সমর্থক অভিধা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধগুলো প্রথাবদ্ধ, বিরামহীন, ভ্রষ্টাচারপূর্ণ ও নির্দয়, তবে খুব কম লোকই এ বিষয়ে কথা বলে।’ যে-ক’জন হাতে-গোনা লোক বলে, তাদের মধ্যে একজনকে আমরা হারালাম।

নাট্যকার বা লেখক হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন অনেক হয়েছে, আরো হবে। তাঁর মৌলিকত্ব হচ্ছে নাটকে ‘নীরবতা’র নাটকীয় ব্যবহার। নীরবতা যে কত বাঙ্ময় হতে পারে তা পিন্টারের নাটকগুলো পড়লে বোঝা যায়। দ্য বার্থডে পার্টি, দ্য কেয়ারটেকার কিংবা কিছুটা অ্যাবসার্ডধর্মী নো ম্যান্’স্ ল্যান্ড-এর (অ্যাবসার্ডধর্মিতা তাঁর অনেক নাটকেই লক্ষণীয়) চরিত্রগুলো যেমন এক একজন একক ব্যক্তি, তেমনি তাদের কেউ কেউ বিশ্বজনীন ব্যক্তিরও প্রতীক। যেমন, দ্য কেয়ারটেকার-এর ডেভিস। ডেভিস বিশ্বের সকল আশ্রয়-অন্বেষী লোকের প্রতিভূ। নাট্যকার ডেভিড হেয়ার (যাঁর নাটক রাজনীতিপ্রধান) পিন্টারের মূল্যায়ন করেছেন এইভাবে : ‘পিন্টার যে তাঁর সময়ের কিছু অসাধারণ নাটক লিখেছেন কেবল তা নয়, প্রচলিত ইংরেজি সাহিত্যের বদ্ধ চিলেকোঠায় কিছু তাজা বাতাসও ঢুকিয়েছেন তিনি। কেননা তিনি যা করেন তাতে রয়েছে গণসম্পৃক্ততা ও রাজনীতি সচেতনতা।’ বিখ্যাত মার্কিন নাট্যকার স্যাম শেপার্ড বা স্বদেশী আর এক বিখ্যাত নাট্যকার টম স্টপার্ড-এর ওপরও রয়েছে তাঁর গভীর প্রভাব। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী যখন বলেন যে তেত্রিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে পিন্টারের সঙ্গে বসবাস তাঁর জন্য এক বিশেষ প্রাপ্তি, তখন মানুষ পিন্টার আর সকল সত্তাকে ছাড়িয়ে যান।

পিন্টারের মৃত্যুকে তাই আমি বলি মহাপ্রয়াণ।

মাইনুল হাসান চৌধুরী

অনুবাদক। সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

৩ comments

  1. রায়হান রশিদ - ১ জানুয়ারি ২০০৯ (৭:৫০ অপরাহ্ণ)

    ক্রিসমাসের ঠিক পরের রাত, বক্সিং ডে’র শুরু। রাত তিনটায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে বেরিয়েছি কোনো দোকান খোলা পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজতে। বড়দিন উপলক্ষে পরিচিত বেশীর ভাগ দোকানই বন্ধ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর টেক্সাকো’র একটি পেট্রোল স্টেশন এবং সংলগ্ন দোকানটি খোলা পেলাম। দোকানের ঠিক বাইরে খবরের কাগজের র‍্যাকে কড়কড়ে নতুন লেট এডিশনের সব দৈনিক পত্রিকা। সবগুলোর প্রথম পাতায় জনৈক পিন্টার-কে নিয়ে কী যেন ছাপা হয়েছে। অনাগ্রহী অন্যমনস্কতায় চোখ না বুলিয়েই ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত ঢুকে পড়লাম দোকানের ভেতরের উষ্ণতায়। যা খুঁজছিলাম তা কিনে নিয়েই দ্রুত বেরিয়ে এসে ফিরতি পথে রওনা দিয়েছি। সুনসান পথঘাট। ড্রাইভ করতে করতে অনেকটাই চলে এসেছি ততক্ষণে, এমন সময় হঠাৎ করেই আমাকে আঘাত করলো চিন্তাগুলো। ‘পিন্টার’, ‘হেডলাইন’, ‘হ্যারল্ড’, ‘গুড বাই’ . . . ! হ্যারল্ড পিন্টার নয়তো? একবার ইচ্ছে হল ফিরে গিয়ে লেট এডিশনের সবগুলো পত্রিকার এক কপি করে কিনে নিয়ে আসি। ইচ্ছেটা মনেই থেকে গেল, আমি ফিরে যাইনি।

    ৯/১১-এর পর বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে, আমাদের মতো সংখ্যালঘুরা ক্রমেই আরো বেশী এলিয়েনেটেড হয়ে উঠছে, যারা বুশ-ব্লেয়ার কিংবা ওসামা কাউকেই সমর্থন করে না, কিন্তু মিডিয়ার কাছে প্রতিনিয়ত চিত্রিত হয় কোনো না কোনো একটি দলের অনুসারী হিসেবে। রং তখন কেবল দুটি, সাদা আর কালো; “you are either with us, or against . . .”। আফগানিস্তান আক্রমণ করা হয়ে গেছে ততদিনে, তালিকায় এর পর ইরাক। প্রতিদিন টিভি খুললেই দেখতাম রিচার্ড পার্ল, এলিস্টেয়ার ক্যাম্পবেল, ইয়ান ব্লেয়ার, টনি ব্লেয়াররা দাপটের সাথে তাদের মিথ্যা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। আলোচনায় মাঝে মাঝে কবি ঔপন্যাসিক নাট্যকারদের কেউ কেউ আমন্ত্রিত হতেন; সে সব দিনগুলোতে আলোচনার ধরণই পালটে যেতো। খুব বোঝা যেতো — রাজনীতি এঁরাও করেন, কিন্তু কারো তাঁবেদারি করেন না। সত্য কথাটা, প্রতিবাদটা মুখের ওপর স্পষ্ট বলে দিয়ে আমন্ত্রিত ক্যাম্পবেল-পার্লদের বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিতেন। তাঁদের কথা শুনে মনোবল বাড়তো। দেশ-জাতির দুর্দিনে জাতির বিবেক হিসেবে লেখক ও সৃজনশীল মানুষরা যে ঠিক কী অবদান রাখতে পারেন, নিজের চোখে দেখে সে উপলদ্ধি আরো দৃঢ় হতো।

    পিন্টারের কিছু লেখার সাথে আমার তখনই প্রথম পরিচয় গার্ডিয়ান পত্রিকার কল্যাণে। সত্যদ্রষ্টা, দেশ-কালের সীমারেখা অতিক্রম করা এমন কিছু মানুষ ছিলেন বলেই তো পৃথিবীটা আজ এতদূর এসেছে (হাজার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও)। তাঁর মতো মানুষরা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য নয়, বরং তাঁদের বিশ্বজনীন চেতনার জন্য। এমন লেখকরা বাকি লেখকদের কলমের শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তাতে বিশ্বাসী হতে শেখান।

    খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্রান্তিলগ্নে পোস্টলেখক হ্যারল্ড পিন্টারকে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। নির্বাচনের পর সারা দেশের সামনে অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে এখন। সামনের দিনগুলোর চ্যালেঞ্জের আলোকে মনে হয় সময় এসেছে আমাদের লেখক এবং সৃজনশীল মানুষদের আরো বেশী সক্রিয় হবার। হৃদয়ে, মননে, চেতনায় ও কলমে। সময়োপযোগী এই লেখাটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, স্যার। (আমি আপনার প্রাক্তন ছাত্রদের একজন)।

    হ্যারল্ড পিন্টারের জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে আরো জানতে তাঁর মূল ওয়েবসাইটটি দেখা যেতে পারে। মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের পটভূমিতে পিন্টারের কিছু কবিতা পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি এখানে:

    (১)

    God Bless America

    Here they go again,
    The Yanks in their armoured parade
    Chanting their ballads of joy
    As they gallop across the big world
    Praising America’s God.

    The gutters are clogged with the dead
    The ones who couldn’t join in
    The others refusing to sing
    The ones who are losing their voice
    The ones who’ve forgotten the tune.

    The riders have whips which cut.
    Your head rolls onto the sand
    Your head is a pool in the dirt
    Your head is a stain in the dust
    Your eyes have gone out and your nose
    Sniffs only the pong of the dead
    And all the dead air is alive
    With the smell of America’s God.
    (January 2003)

    (২)

    Democracy

    There’s no escape.
    The big pricks are out.
    They’ll fuck everything in sight.
    Watch your back.
    (February 2003)

    (৩)

    Weather Forecast

    The day will get off to a cloudy start.
    It will be quite chilly
    But as the day progresses
    The sun will come out
    And the afternoon will be dry and warm.

    In the evening the moon will shine
    And be quite bright.
    There will be, it has to be said,
    A brisk wind
    But it will die out by midnight.
    Nothing further will happen.

    This is the last forecast.
    (March 2003)

  2. ইমতিয়ার - ২ জানুয়ারি ২০০৯ (১০:৩৮ অপরাহ্ণ)

    তাঁর মৌলিকত্ব হচ্ছে নাটকে ‘নীরবতা’র নাটকীয় ব্যবহার। নীরবতা যে কত বাঙ্ময় হতে পারে তা পিন্টারের নাটকগুলো পড়লে বোঝা যায়।

    তাঁর মৃত্যু আমাদের তাঁর এই মৌলিকত্বের মধ্যে প্রবিষ্ট করে গেল আরও গভীরভাবে। লেখকের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বলতে চাই, এ এক মহাপ্রয়াণ।

  3. Pingback: pinter nobel lecture | FrontPageSearch

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.