তোর জন্মতারিখ জানবার প্রয়োজন পড়েনি কখনো। কিন্তু তুই যেদিন চলে গেলি, অনিচ্ছায়, দুঃস্বপ্নের মতন শাবল আর গাঁইতি দিয়ে খোদাই হয়ে গেল দিনটা। একটা ফোন-কল কী ভয়াবহ হতে পারে আগে বুঝতে পারি নাই।
প্রথম যেদিন তোকে দেখি, তুই একা ছিলি না; দেবেশ আর রিয়াজও ছিল তোর সাথে। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের চারতলার অফিসঘরটার একপাশে বসেছিলি, সপ্রতিভ। আমি, আকতার আর আলভী একসাথে ঢুকলাম কেন্দ্রে। শৈবালদা পরিচয় করিয়ে দিলেন, তোরা কেন্দ্রের নতুন সদস্য। আমরা তিনজন মুহূর্তেই ঈর্ষাপরায়ণ আর শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। শৈবালদা, শ্যামলদার কাছে আমাদের আবদারের নতুন ভাগীদার হয়ে যাবি ভেবে। তারপর আরম্ভ হলো তোদের তিনজনের সাথে আমাদের তিনজনের হাস্যকর প্রতিযোগিতা। আজ এতদিন পর ভাবতে অবাক লাগে, আবার হাসিও পায়। কী ছেলেমানুষই না ছিলাম আমরা! কেন্দ্রে তোদের যে-কোনো কাজ যে-কোনো কথাকে কেমন সতর্কতা আর সন্দেহের চোখে দেখতাম! রিয়াজ আর দেবেশ খানিকটা নিরীহ আর চুপচাপ ছিল। তুই ছিলি ওদের ভিতর নেতা। ফলে তুই ছিলি আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। আস্তে আস্তে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব আর প্রদর্শনীর ভিতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা বন্ধু হতে থাকি।
এর মধ্যে আলভী ঢাকায় আর আকতার চলে যায় ভারতে পড়াশোনার জন্য। তুই আমি ভর্তি হই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তোর বন্ধুরা আমার বন্ধু এবং আমার বন্ধুরা তোর। ফলে কেন্দ্রের আঙিনা পেরিয়ে বন্ধুত্ব দীর্ঘতর হতে থাকে ছায়ার মতো। তোর সদাহাস্য মুখ, মজা করবার সহজাত ক্ষমতা যে-কোনো বিষয়ে; ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তোর বন্ধুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে লাগল।
এর মাঝেই আবিষ্কার করলাম ফটোগ্রাফিতে তোর আগ্রহ আছে। নিয়মিত ছবি তুলছিস। একদিন কেন্দ্রে তোকে বলে বসলাম, আমিও ছবি তোলা শিখতে চাই। তুই আমার দিকে তাকালি, স্বভাবসুলভ হাসলি। তারপর জিজ্ঞেস করলি, আমার ক্যামেরা আছে কি না। জবাবে জানালাম, নাই। তখন তুই বললি, ‘ফটোগ্রাফি শিখতে দুটো জিনিস লাগে : ক্যামেরা আর ফিল্ম। তারপর যা করতে হবে : ক্যামেরায় ফিল্মটা ভরে ফিল্মের প্যাকেটের ভিতর যে-নির্দেশিকা থাকে তা অনুসরণ করে আল্লাহ্র নাম নিয়ে ছুবি তুলতে থাক। দেখবি ফটোগ্রাফি শেখা হয়ে গেছে। প্রথমেই খামোখা বইটই পড়ে মাথা নষ্ট করিস না।’ আমার অন্যান্য শখের মতো ফটোগ্রাফি শেখাও হয় নাই কখনো, কিন্তু তুই আমার একটা খুব বড়ো উপকার করলি। তোর ঐ উপদেশ থেকে একটা জিনিস আমি শিখলাম : হাতে-কলমে কাজ করেও অনেক কিছু শেখা যায়, আগ্রহ আর শেখার সাহসটুকু থাকলে।
এরই মধ্যে চলচ্চিত্র কেন্দ্রে নতুন ভাবনা অঙ্কুরিত হতে লাগল। শুধুমাত্র ছবি দেখে আর ছবি বিষয়ক আলোচনার ভিতর কেন্দ্রের কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ রাখা চলবে না। ছবি বানাতে হবে। শুরু করলেন শৈবালদা, কবিয়াল ফণী বড়ুয়াকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ। আর তা দেখে তুইও খুব আলোড়িত ও অনুপ্রাণিত হলি। আমাদের অবাক করে দিয়ে ঘোষণা করলি তুইও ছবি বানাবি। তোর ছবির বিষয় — শাটল ট্রেন। চট্টগ্রাম শহর থেকে ছাত্রছাত্রীরা যে-বিশেষ ট্রেনে করে প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় ও ফিরে আসে, তার উপর তুই ছবি বানাবি বলে ঠিক করলি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, বাবা-মার কাছ থেকে ধার-দেনা করে আরম্ভ হলো ছবির কাজ। সব রকম ভাবালুতা আর রোমান্টিক চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত শিল্পীর স্বভাবে ধারণ করলি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আয়ুনাশী, সময়নাশী, মেধানাশী, জীবননাশী এক যন্ত্রদানব শাটল ট্রেনকে। কী মহৎ প্রচেষ্টা! রাতদিন জেগে, খেয়ে না-খেয়ে শেষ হলো তোর ছবি। আমরা দেখলাম শাটল ট্রেনে দু’ পা হারানো প্রতিভাবান ছাত্রের দু’ চোখের পানি। দেখলাম প্রতিদিন হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী একহাতে বইখাতা আর অন্যহাতে জীবন নিয়ে যাতায়াত করে এই শাটল ট্রেনে। অতিষ্ঠ গরমে ট্রেনের ভিতর সিদ্ধ হতে হতে গান গেয়ে যাবতীয় হতাশা ও অভিযোগকে বুড়ো আঙুল দেখায় ছাত্রছাত্রীরা।
চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে মুক্তি পেল ‘শাটল ট্রেন’। টানা তিনদিন চলল ছবি। প্রতিটি শো হাউসফুল। অবাক কাণ্ড। এখানে তথ্যচিত্রও মানুষ দেখে পয়সা দিয়ে টিকেট কিনে! ভালোবাসা আর মহৎ প্রচেষ্টায় তাও যে সম্ভব তুই দেখিয়ে দিলি, মাত্র বাইশ কি তেইশ বছর বয়সেই। কিন্তু একটা দুঃখ থেকেই গেল সারা জীবনের জন্য — এত ভাল ছবিটার কোনো মূল্যায়নই করল না সুধী মহল। ‘শাটল ট্রেন’ পেল না তার প্রাপ্য সম্মান। কারণ দেশটা যে আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। একজন কৈশোর-পেরোনো ছেলে যদি সকল বাধা অতিক্রম করে ভালো ছবি বানায় তাহলে প্রতিষ্ঠানের ধ্বজাধারীদের তো মুখ দেখানোর জায়গা থাকে না। তুই হয়তো মনে মনে কষ্ট পেলি, কিন্তু দমবার পাত্র তো তুই নস। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে পূর্ণ মনোযোগে কাজ করতে থাকলি — ছবি দেখা, ছবি দেখানো, পাঠচক্র আয়োজন।
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মাঝে চাকুরি নিয়ে চলে গেলি ঢাকায়। আমরা তখনও শাটল ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী। মাঝে মাঝে ছুটিতে এলে দেখা হতো তোর সাথে। হা-হুতাশ করতি, কাজের চাপে ছবি দেখতে পারছিস না। নিয়মিত আড্ডাটা মিস্ করিস, বন্ধুবান্ধবদের মিস্ করিস। নতুন কোনো ছবি করতে পারছিস না। কিন্তু মাথায় উইপোকার মতো কিলবিল করছে ছবির স্ক্রিপ্ট্। একবার ঢাকা থেকে ছুটিতে এসে চলচ্চিত্র কেন্দ্রে এলি আড্ডা দিতে। এ-কথা সে-কথার পর তোর কাছে জানতে চাইলাম ঢাকায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের হাল-হকিকত। তুই খুব গম্ভীর হয়ে গেলি। তারপর বললি, ‘ঢাকার অধিকাংশ ছেলে যে-পরিমাণ ছবি দেখে আর ওদের এত পড়াশোনা যে খুব হতাশ লাগে।’ একটু পর গলার স্বর নামিয়ে যাতে কেউ শুনতে না পায় এমনভাবে বললি, ‘আচ্ছা, ওরা কি আসলে যতটা বলে ততটা ছবি দেখেছে, না আমারে মফস্বলি মনে করে গুল মারে, আল্লাহ্ই জানে।’ তোর কথা শুনে আমরা দুজনই হাসতে লাগলাম।
একদিন পাকাপাকি নেমে পড়লাম শাটল ট্রেন থেকে। রুটিরুজির ধান্দায় চলে এলাম ঢাকায়। তুই আবার ফিরে গেলি চট্টগ্রামে। আমার সাথে তোর যোগাযোগ শিথিল হয়ে এল কিছুটা। চলচ্চিত্র কেন্দ্রের সাথেও। তুই আবার কেন্দ্রে নিয়মিত হয়ে উঠলি। সংসার জীবনও আরম্ভ হলো কয়েক বছরের মধ্যে। সংসার, চলচ্চিত্র কেন্দ্র আর আটটা-পাঁচটার রুটিরুজি হয়ে উঠল তোর জীবন। এত সবের ভিতরও ছবি বানানোর চিন্তা গিজগিজ করতে থাকল তোর মাথায়। তোর ছবির বিষয়গুলো ছিল অসাধারণ। কয়েক বছর পর হঠাৎ একদিন রাস্তায় তোর সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম নতুন ছবির কথা। তুই জানালি, ব্যান্ডপার্টি নিয়ে ছবি বানাবি। আমি খুব মুগ্ধ হলাম। ব্যান্ডপার্টিগুলো আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় ওদের বাহারি পোশাক, বিশাল বিশাল ড্রাম, স্যাক্সোফোন, বাঁশি দেখে বাজিয়েদের মনে হতো রূপকথার চরিত্র। এখন শুধুমাত্র হিন্দু বিয়েতে দেখা পাওয়া যায় এদের। তাও কী মলিন আর সাদামাটা। তুই কেমন হতাশ গলায় বলেছিলি, পরের মাস থেকে শুটিং আরম্ভ করবি। কিন্তু ছবিটা শেষ পর্যন্ত করতে পারলি না। এর মাঝে তোর ব্যক্তিগত জীবনে নেমে এল ভয়াবহ বিপর্যয়। তোর কন্যা জন্মাবার সময় তার মাকে হারাল। তোর জীবনযুদ্ধের আর একটা ক্ষেত্র তৈরি হলো। তুই সেই যুদ্ধেও প্রমাণ করলি, তুই দমবার পাত্র নস। একইসাথে মা আর বাবার স্নেহ ও যত্নে মেয়েটাকে বড় করে তুললি। অনেকটা ছবি বানানোর মতো করে। কী বিষণ্ণ একাকী সংগ্রামমুখর দিন পার করলি একা একা।
এত সব ঝড়ঝাপটার মাঝেও মাথা থেকে তোর সিনেমার পোকা নামল না। নিজে হয়তো সিনেমা বানাতে পারলি না ঠিকই, কিন্তু শৈবালদার (শ্রীশৈবাল চৌধূরী, পরিচালক, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র) ‘বিস্মৃত অধ্যায়’ ও ‘মেঠো পথের গান’ ছবি দুটির চিত্রগ্রহণের কাজ করলি। এখন একটা কথা বার বার মনে পড়ছে। আমাদের এখানে একটা প্রথা আছে — কেউ সিনেমা বানানোর কথা ভাবলে বা দু-একটা ছোট ছবি বানালে পরবর্তীকালে টিভি-নাটক কিংবা বিজ্ঞাপন বানানোর চেষ্টা করে। তুই কিন্তু ঐ পথে হাঁটলি না। তুই কেবল সিনেমা বানাতেই চাইলি।
মানুষকে ছবি দেখাতে গিয়ে কম হেনস্থা হতে হয়নি তোকে। এই ঝামেলা শুধু যে তোকেই পোহাতে হয়েছে তা নয়, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের প্রায় সমস্ত কর্মীরই তা ভাগ্যলিপি। টিকেট কেটে যে-দর্শক ছবি দেখতে প্রবেশ করেন মিলনায়তনে, তিনি মনে করেন ভালো ছবির সাথে ভালো প্রদর্শন ব্যবস্থায় ছেদহীন যন্ত্রণাহীন একটা ছবি দেখতে পাবেন। আমরাও চাই ছবিটা ক্রটিহীনভাবে প্রদর্শন করতে। আর তার প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে প্রদর্শনীর আগে ছবি সংগ্রহ, টেস্ট প্রোজেকশন, মিলনায়তন ভাড়া করা, আসন বিন্যাস ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় অর্থকড়ির সংস্থান করে নির্দিষ্ট দিনে প্রদর্শনী চলাকালীন অনিচ্ছাকৃত যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিলে। সাথে সাথে দর্শকদের কোনো একটা অংশ থেকে গুঞ্জন ওঠে, অসহিষ্ণু মন্তব্যও ভেসে আসে। আর এরকম সময়ে কেবল ভুক্তভোগীরাই বোঝে, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের বিশেষ্য সর্বনাম কী। উপল, তুই হাসি-হাসি মুখে তাও হজম করে নিতে পারতি।
শুধু হজম করতে পারলাম না আমরা, তোর বন্ধুরা, তোর সহকর্মীরা — এভাবে তোর চলে যাওয়া। একটা ছোট ফোন-কল কেমন মুহূর্তেই বাকি জীবনের জন্য তোকে নিয়ে চলে গেল আমাদের কাছ থেকে। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের অফিসে, জামালখানে, চেরাগিতে, দেব পাহাড়ে, ষোলশহরে তোর অফিসরুমটায় পড়ে থাকল শুধু তোর ব্যান্ডপার্টি আর সাম্পান নিয়ে ছবি বানানোর ভাবনা। তোর মেয়েটার কথা কি একবারও ভাবলি না তুই! যখন মায়ের দরকার তখন মা চলে গেল, যখন তার বাবার দরকার তখন বাবাও…
জন্ম ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭৩। চাকরিজীবী। চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী। পছন্দ করি খেতে, ঘুরতে, আড্ডা দিতে।