পেশাগত কারণে মাঝে কিছুদিন কয়েকটি উপজেলা শহর ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তাদের মধ্যে একটি উপজেলা শহরে কয়েক বছর স্থায়ীভাবেও ছিলাম। আমাদের এই উপজেলা শহরগুলো নানা মাত্রায় বড়ো শহরগুলো থেকে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে পিছিয়ে। আর পিছিয়ে থাকাটাই হয়তো স্বাভাবিক। তবে আমার মনে হয়েছে একটা ব্যাপারে উপজেলা ভিত্তিক এই ছোট শহরগুলো পুরোপুরি এগিয়ে। আর তা হলো এখানে বড়ো বড়ো খেলার মাঠ এবং খোলা প্রান্তর আছে যা বড়ো শহরগুলোতে প্রায় নাই হয়ে যাচ্ছে। ফলে ছোট শহরগুলোয় শিশু কিশোর যুবকদের বিনোদনে খেলাধুলা এখনও বড়ো একটা স্থান দখল করে আছে। অন্যদিকে বড়ো শহরগুলোয় বিনোদনের ক্ষেত্রে কম্পিউটার বা ইনডোর গেমস-ই ভরসা।
উপজেলা শহরটিতে থাকাকালীন আমিও বিকেলবেলা সময় পেলে স্থানীয় বড়ো মাঠটাতে গিয়ে বসতাম। আমরা দু-চারজন সহকর্মী একসঙ্গে বসে গল্পসল্প করতাম, মাঠে কিশোরদের ছুটোছুটি খেলাধুলা দেখতাম। একসময় খেয়াল করলাম মাঠের আশেপাশে ১০-১২ বছর বয়সের কিছু শিশুও ছড়িয়েছিটিয়ে বসে থাকে। চাতকপাখির মতো তাকিয়ে থাকে মাঠে বড়োদের খেলার দিকে। মাঝেসাঝে বল মাঠের বাইরে এলে বলটা খুঁজে ছোট্ট এক শটে মাঠে ফেরত পাঠানোর আনন্দে শিশু-চোখগুলোতে যে-অপার্থিব আনন্দ নেচে উঠত আমি তা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।
আমার নিয়মিত আসা-যাওয়ার ফলে বিকেলবেলা খেলার মাঠে ওই শিশুদের সাথে এক ধরনের চেনা-পরিচয় হয়ে যেতে থাকে। কেউ সুমন, কেউ ইব্রাহিম, কেউ-বা প্রদীপ। কেউ স্কুলে পড়ে, কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে দোকানে কাজ করছে। আমি কখনও তাদের কাউকে হয়তো জিজ্ঞেস করি, “কী ব্যাপার, তোমরা খেলো না কেন?” ওরা লাজুক হাসে, উত্তর দেয় না। কেউ আবার ঠিক বুঝে উঠতে পারে না প্রশ্নটি আদৌ তাকেই করা হয়েছে কি না। অনেকদিন পর আমার প্রশ্নের উত্তরে ওই শিশুদের একজন বলে ফেলে, “খেলব কেমন করে? আমাদের তো বল নাই!”
প্রতিবছর সরকার সারা দেশে যৎসামান্য ক্রীড়াসামগ্রী প্রেরণ করে। তার মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি খেলার উপকরণ থাকে। জেলা উপজেলা সরকারি বেসরকারি স্কুল-কলেজে এসব ক্রীড়াসামগ্রী সরবরাহ করা হয়, যাতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা, জেলা-উপজেলার শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করার মাধ্যমে তাদের চিত্তের বিকাশ, সুস্বাস্থ্য অর্জন, সামাজিকীকরণ, নেতৃত্বগুণ অর্জন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের সরকারি স্কুলগুলোতে এসব ক্রীড়াসামগ্রী সাধারণত প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বন্দী হয়ে পড়ে থাকে। বছরের বিশেষ দু-চার দিন হয়তো দু-চার ঘণ্টার জন্য ছাত্রছাত্রীরা তা নাড়াচাড়া করার সুযোগ পায়। আর জেলা ও উপজেলার ক্রীড়া অফিস বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে খোঁজ নিলে জানা যায় — “এ বছরের গুলো বিতরণ করা হয়ে গেছে। আপনারা খোঁজ রাখবেন, নতুন চালান এলে প্রথমেই আপনারা পাবেন।”
আমি পরিচিত ওই শিশুদের কথা ভেবে স্থানীয় উপজেলা কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে এ তথ্য পাই। পরে আমরা সহকর্মীরা মিলে ওই শিশুদের ৩০০ টাকা দিয়ে একটা বল উপহার দিই।
কয়েক মাস পেশাগত কারণে বাইরে ছিলাম। ফিরে এসে একদিন বিকেলে মাঠে গিয়ে দেখি প্রদীপ, সুমন, ইব্রাহিম সহ জনা বিশ-পঁচিশেক শিশু মাঠে ফুটবল খেলছে। তারা বলটা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, হল্লা করছে, হাসছে …। আমার তখন বারবার মনে হতে লাগল মাত্র ৩০০ টাকা দামের একটি বল, আর এই একটিমাত্র বল জনা বিশ-পঁচিশেক শিশুর শৈশবকে কেমন রঙিন করে দিয়েছে!
আবু নঈম মাহতাব মোর্শেদ
জন্ম ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭৩। চাকরিজীবী। চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী। পছন্দ করি খেতে, ঘুরতে, আড্ডা দিতে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
ইনসিডেন্টাল ব্লগার - ২৩ আগস্ট ২০০৯ (২:৩৪ অপরাহ্ণ)
লেখকের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। ওয়ার্কগ্রুপের এক সদস্য এই লেখাটির কথা উল্লেখ করার পর খুব মনযোগ দিয়ে আবার পড়লাম। সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত শৈশব নিয়ে বহুদিন এমন কোন মৌলিক লেখা পড়িনি। লেখকের সহজ সরল দেখার চোখটি ভাল লেগেছে। খেলাধুলার সরঞ্জাম বা উম্মুক্ত বাতাসের খোলা মাঠ তো এখন অনেক দূরবর্তী বিষয়। মানুষের এখন বসবাসের জায়গাই নেই। আর যেটুকু খালি জমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখনো তাও একে একে চলে যাচ্ছে অবৈধ দখলদারীদের হাতে, ডেভেলাপারদের দখলে। বন্ধু বান্ধবদের সাহচর্য, খোলা মাঠে দৌড়োতে দৌড়োতে ক্লান্ত হয়ে একসময় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ার জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে প্লে-স্টেশন, নিনটেনডো ডিএস, উইই, ভিডিও গেমস। তাও অবস্থাপন্নদের সন্তানদেরই কেবল সে সবে একসেস আছে!
মনে পড়ে, একটা সময় ছিল যখন শহরে এবং শহরতলীর পাড়ায় পাড়ায় ছিল অসংখ্য ক্লাব, খেলার মাঠ তো ছিলই। পাড়ার কিশোর যুবকরা সে সব ক্লাব চালাতো, আর বড়োরা বুড়োরা তাদের দেখেশুনে রাখতো। বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের টুর্নামেন্ট আর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো ক্লাবগুলোর আয়োজনে। নানা ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হোতো। এ নিয়ে এক ধরণের প্রতিযোগিতাও ছিল পাড়ার ক্লাবগুলোর মধ্যে। এত অনুষ্ঠান এত আয়োজন সেগুলোর অর্থায়ন নিয়ে কখনো কোন সমস্যা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। পাড়ার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী আর চাকুরীজীবিরা আমাদের ছোটদের দেখেশুনে রাখতো, পরামর্শ দিতো, উৎসাহ দিতো। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনে অর্থের সংকট হয়নি কোনদিন। আমরা ছোটোরাও মহা উৎসাহে বাড়ি বাড়ি যেতাম চাঁদা সংগ্রহ করতে। সামর্থ্য থাকলে কেউ ফিরিয়ে দিতো না। বরং কারও বাড়ী গেলে এটা সেটা খাইয়েও দিতো। ভালমন্দের খোঁজখবরও নিতো। আমরা চাঁদা তুলতাম, কিন্তু কেউ আমাদের চাঁদাবাজ বলতো না। অভিধানে তখনো “চাঁদাবাজী” শব্দটা সন্নিবেশিত হয়নি সম্ভবত, অন্তত ধিক্কার অর্থে!
অবহেলিত শৈশব নিয়ে মুক্তাঙ্গনে লেখক মনজুরাউলের পোস্টটাও ভাল লাগলো।