ঋতুপর্ণের ‘ফার্স্ট পার্সন’

“আজ যদি আমি নিজেকে বাদ দিয়ে একা মানুষদের অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা শৌখিন তাত্ত্বিক সম্পাদকীয় লিখি, তাহলে আমার আগের এবং আগামী দিনের সব ‘ফার্স্ট পার্সন’ মিথ্যে হয়ে যাবে। আর, বিনে পয়সায় রোববার পান বলে আপনারা মিথ্যে কথা পড়বেন কেন? যে জীবন হয়তোবা আমাকে একাকিত্বের এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিতে পারত, আমাদের সমাজে তার কোনো স্থান নেই।” [. . .]

বাবার উৎসাহে একসময় পড়েছিলাম সাগরময় ঘোষের ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকীয়, নিজেই বেছে নিয়ে পড়তাম ‘সানন্দা’র পাতায় অপর্ণা সেনের সম্পাদকীয়। এর বাইরে সম্পাদকীয় বলতে কেবল সম্পাদিত গ্রন্থের শুরুতে সম্পাদকের কথা। ফলে সম্পাদকীয়র একটা চেনা ছক ছিল, সম্পাদকীয় মানেই বই বা পত্রিকার ধারণকৃত বিষয়বস্তুর সারসংক্ষেপ বা আপাত ধারণা। চেনা ছকের ভেতর হুড়মুড়িয়ে এলো এটা —

মেয়েলি বলে যে প্রান্তিকতার অপমান আমাকে বারবার আক্রমণ করেছে, মোটা বলে তার থেকে কিছু কম করেনি কোনোদিন।

অথবা —

মাদুরের সঙ্গে গালিচা বা কার্পেটের একটা সূক্ষ্ম তফাত আছে। আভিজাত্যের দিক দিয়ে কার্পেটের মূল্য হয়তো অনেকটা, আবার মাদুর যেন তার সহজতার জন্যই পবিত্র। এ যেন শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কার্পেট তা সে যতই দামি হোক না কেন, তার স্থান আমাদের পায়ের নীচে। দেয়ালে কার্পেট টাঙানোর ঔপনিবেনিক কায়দা যদিও এখন নানা ধনী বাড়িতে দেখতে পাই। তার পরিপ্রেক্ষিতে মাদুরের স্থান অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ। মাদুর আক্ষরিক অর্থেই আসন। শোওয়ার কিংবা বসার। না! তাকে পায়ের তলায় রেখে তার ওপর আসবাব রাখার নয়। মাদুর পিছলে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে। … মাদুরের কাছে আমার একটা জিনিসই শিখতে বড় ইচ্ছে হয়। নম্রতা। দেখি, এ জীবনে হয় কি না!

কন্টেন্টের সাথে সম্পর্কশূন্য এ রকমের সম্পাদকীয় এই প্রথম। এবং সম্পাদক তাঁর সৃজনশীল চরিত্রের চাইতে বেশি আলোচনায় এসেছেন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণের জন্যে। ঋতুপর্ণ ঘোষ।  পরিচয় তো ছিলই চিত্রপরিচালক, চিত্রনাট্যকার, ঘোষ অ্যান্ড কোং-এর আড্ডাবাজ ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে। সে পরিচয় দর্শক সারিতে বসে তাঁর সৃজনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে ওঠার সুবাদে। সে পরিচয় অবিশ্রাম হাততালিতে মুখর। আপাত বিচিত্র জীবনযাপনের জন্যে আলোচনার তুঙ্গে অবস্থান করা ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে পরিচয় ছিল অনেকেরই।

Image-2

দরকার ছিল কি তবে এই বাড়তি জানা-শোনার? তাঁরই বা দায় ছিল কোথায় নিজেকে এমন জানান দেবার? ছিল একটা তাগিদ তাঁর নিজের মধ্যে, সে তাগিদ বোধ করি তিনি যে-সব প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন তাঁদের অস্তিত্বের লড়াইকে শাণিয়ে নেবার। ছিল একটা অভিলাষ কিছু মানুষের অনমনীয় কৌতূহলের মুখে কুলুপ এঁটে দেবার। নিজেকে সযত্নে মেলে ধরবার আকাঙ্ক্ষাও ছিল হয়তো আপাত-নিঃসঙ্গ মানুষটির। এই রকমের নানা ইচ্ছের ডানা মেলবার আকাশ ছিল তাঁর রোববার-এর ‘ফার্স্ট পার্সন’। ফলে সেটা নিছক সম্পাদকীয় না হয়ে, হয়ে ঊঠেছিল ঋতুপর্ণের অন্তরমহল, যেখানে ব্যক্তি ঋতুপর্ণ একেবারেই নিরাভরণ। নম্র অথচ দৃঢ় ভঙ্গিতে লিখেছেন নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা, কাজের ভাবনা, অকাজেরও। কখনো নিছক ছেলেমানুষিকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন সেখানে। কোথাও হয়তো তাঁর রূঢ় বাস্তবতাকে হাটের মাঝখানে এনে ভেঙে দিয়ে দেখতে চেয়েছেন মানুষের অন্য মুখ। কখনো-বা সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা বৈশ্বিক বাস্তবতাকে যেভাবে দেখছেন তারই সমসাময়িক আলোচনায় মেতেছেন। ভাগ করে নিতে চেয়েছেন নিজের একান্ত সম্পর্কগুলোকে অন্যদের সাথে। যেভাবে মানুষ তার মনের কথা বলতে বসে নিকটতমের কাছে, যেমন করে খুলে ধরে নিজেকে স্নানের সময় কলের নীচে, যেমন করে মেলে ধরে নিজের সামনে নিজেকে। তেমনি করে উজাড় হয়েছেন ‘ফার্স্ট পার্সনে’র পাতায়।

নিজের চারপাশের ছোটখাটো উপাদানের ভেতর টেনে এনেছেন বিশ্বকে। আবার কখনো সেই চেনা চারপাশকে নিয়েই বসেছেন বিশ্বসভায়। যে অজস্র প্রশ্নবোধকের নীচ দিয়ে রোজ চলাচল করতেন তার দারুণ মর্মস্পর্শী উত্তর লিখেছেন রোববার-এর একা মানুষকে নিয়ে করা সংখ্যাটিতে। মিটিয়ে দিয়েছেন অপ্রীতিকর কৌতূহল। তাঁর একাকিত্বকে ঘিরে যে অজস্র উৎসাহ তার মেদহীন ব্যাখ্যা দিয়েছেন দুর্দান্ত সাহসে অথচ নম্র স্বরে –

আজ যদি আমি নিজেকে বাদ দিয়ে একা মানুষদের অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা শৌখিন তাত্ত্বিক সম্পাদকীয় লিখি, তাহলে আমার আগের এবং আগামী দিনের সব ‘ফার্স্ট পার্সন’ মিথ্যে হয়ে যাবে। আর, বিনে পয়সায় রোববার পান বলে আপনারা মিথ্যে কথা পড়বেন কেন? যে জীবন হয়তোবা আমাকে একাকিত্বের এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিতে পারত, আমাদের সমাজে তার কোনো স্থান নেই। আমার স্বভাবপ্রণোদিত ‘অস্বাভাবিকতা’ নিয়ে আমি বাস করেছি আমার একাকিত্বের বন্দীজীবনে — আর আমার সামনে ছিল সমাজের এক বিরাট কারাগার। যেখানে ঐতিহাসিকভাবে যে কোনো নতুন প্রথাকেই প্রবেশ করতে হয়েছে দণ্ডিত বিদ্রোহীর মতো। অনেক হিংসা ও রক্তপাতের মূল্যে।

সমস্ত ‘ফার্স্ট পার্সন’ জুড়ে ঘুরে-ফিরে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। কখনো নিজের উচ্ছাসকে রাঙিয়ে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ভেতর দিয়ে। কখনো-বা তাঁর এই সমাজ-বিবিক্ত জীবনযাপনকে শুশ্রূষা দিতে আলোয়ানের মতো পরম যত্নে যাঁকে জড়িয়ে উষ্ণতা নিয়েছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। পরম নির্ভরতায় ঋতুপর্ণ  লিখেছেন —

একদিকে আমি পরম ভাগ্যবান, আমার একজন চিরপ্রণয়ী আমাকে কখনো ত্যাগ করে যাননি। আমার রবীন্দ্রনাথ। নিগূঢ়তম অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যেতে যেতেও বইয়ের তাকে হাত রাখলেই বারবার করে পেয়েছি তাঁর প্রণয়ের উত্তাপ।

মা বোধ করি তাঁর আর একটি প্রিয়তম রক্ষাকবচ। নিজের সমস্ত কিছুকে উজাড় করবার একমাত্র আধার। তাই মাকে মনের ভেতর নিয়ে ভ্রমণ করেছেন কখনো জেরুজালেম তো কখনো-বা কান চলচ্চিত্র উৎসব। অন্যমনে মাকে পাশে বসিয়ে ক্রমাগত গল্প করে গিয়েছেন পাতার পর পাতায়। জীবনে এমন অনেক প্রাপ্তি থাকে যার ভেতর দিয়ে নিজের আকাঙ্ক্ষাকে মুক্তি দেয়া চলে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭৭ ধারার পরিমার্জনার পর সমকামিতা আর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। এই পরিবর্তন এবং মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যু সমসাময়িক। এ দুটো ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন নিপুণ শিল্পীর মতো। আর লেখার শেষদিকে এসে নিজেকেও সে ঘটনার সাথে যুক্ত করতে গিয়ে মুক্তি দিয়েছিলেন তার ইচ্ছের পাখিটিকে —

৩৭৭ ধারা নিয়ে মাতামাতি অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে। তাঁরা এখন অন্য জিনিস নিয়ে ব্যস্ত। তাঁদের ক্যামেরায় ধরাই পড়ল না আর একজন পৌঢ়ার ছবি — আমার মা। কিন্তু আমি মনে মনে জানি, অন্তরীক্ষ বলে যদি কোনো নিঃসীম পথ থাকে সেখানে ক্লিষ্ট পায়ে অশক্ত শরীরে দুর্বল হাতে PROUD MOTHER প্ল্যাকার্ড নিয়ে হেঁটে চলেছে আমার মা। আমার সব নিভৃত নিঃসঙ্গ বিজয় মিছিলের সঙ্গী।

Image-1কেবল অভ্যাসে বা ধরে নেয়ায় যে-সব আচারকে আমরা সামাজিক নিয়ম বা নীতিতে পরিণত করি অথবা মানুষের নির্ণায়ক ছকে রূপান্তরিত করি, তার বাইরে যে মানুষগুলোর চলাচল, সহজে তাদের আমরা নিজদের সমাজের বলে আর মনে করি না। সহজেই মতের বিরোধকে টেনে নিয়ে মিলিয়ে দিই মনের বিরোধের সাথে। সামাজিক ছকে ফেলে দিলে যারা ঠিক মাপ-মতো মিলে গেল না তাদের অনায়াসে ব্রাত্য করে দেয়াই সহজ সিদ্ধান্ত। কিন্তু ব্রাত্য করে দিয়েই তো সমাজ ছেড়ে দিচ্ছে না, বরং সেই সব মানুষের জানালায় চোখ রাখছে, দরোজায় আড়ি পাতছে। অসভ্য ঔৎসুক্যে ভেঙে দিচ্ছে অন্যের পরম যত্নে আগলানো গোপনীয়তা। এই রকমের সমাজ ব্যবস্থায় কেবল প্রতিভায় নয় বরং খানিকটা উদ্যত হয়ে বেড়ে-ওঠা মানুষ ঋতুপর্ণকে আড়ালেই ঢেকে রেখেছে এই সব অযাচিত কৌতূহল। ফলে সাধারণ চোখে বিচিত্র মানুষটির বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন কেবল রসালো কল্পনার সহচর হয়েছে। জানতে চাওয়া হয়নি প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি দারুণ মেধাবী এই সত্তাটিকে — সংবেদনশীলতায়। কালো সালু কাপড়ের মলাটে সোনালি জরিতে লেখা ‘ফার্স্ট পার্সন’ ঋতুপর্ণ ঘোষের সমগ্র জীবনের ছায়াছবি। তাঁর ভাষায় —

এই ‘ফার্স্ট পার্সন’-এর পাতাটা আমার সত্যি কথা লেখার পাতা, আমার জীবনধারণের সমস্ত সত্যি বিশ্বাসকে মেলে ধরার পাতা।

এই ‘ফার্স্ট পার্সন’-এর পাতায় কখনো তিনি বীরের বেশে হাজির হচ্ছেন, কখনো বিপ্লবী, কখনো কনফেশান দিতে আসা সাধারণ একজন। কখনো-বা এই পাতাটাই হয়ে উঠেছে তাঁর ময়দান, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি, দাবি-দাওয়া চাহিদায় মুখর প্রথম পুরুষ ঋতুপর্ণ। নিয়ম রক্ষার সামাজিক সংসদে ব্রাত্যজনের একমাত্র স্বর।

Image-3

সমাজ তাঁকে তাঁর সমস্ত প্রতিভা, সব সৃজনশীলতা, যাবতীয় সৃষ্টিশীল কাজের জন্যে অসাধারণের মাপকাঠিতে মাপতে পারেনি। কিন্তু তাঁর এই সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে তিনি কেবল ব্যক্তিগত সাজপোশাক আর জীবনযাপনের জন্যেই মুখরোচক হয়ে থাকতেন যদি না তাঁর এই যেমন-ইচ্ছে-লেখার ফার্স্ট পার্সন-এর পাতাটায় নিজের সমস্তটাকে ছড়িয়ে নিয়ে না বসতেন :

আমি সাধারণ মানুষ। আমার মধ্যে এখনো কিছু সাদা কালো আছে — সেটা থাক। সেটা হারাতে চাই না আমি। সব কিছু অত ধূসর জটিল করে ফেলার প্রয়োজন নেই আমার।

পড়ে শেষ করে বার বার ফিরে ফিরে এসেছি দাগ দিয়ে রাখা লাইন, প্যারা, শব্দ, তথ্য, তত্ত্ব, উপাখ্যানের অতুল সম্ভার ঋতুপর্ণের ‘ফার্স্ট পার্সন’-এ। সম্পাদকীয়কে পাশে বসিয়ে নিজের জীবনের যে বর্ণাঢ্য ছবি একটু একটু করে ফুটিয়ে তুলেছেন কাগজে, সে জীবন স্নিগ্ধ আভিজাত্যে মোড়া, সাধ্য কি সাধারণের সে জীবনের গায়ে আঁকিবুকি কাটে!

. . .

‘ফার্স্ট পার্সন’ (১ ও ২), ঋতুপর্ণ ঘোষ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, দু’খণ্ড একত্রে ৬০০.০০

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

2 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
2
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.