স্কুল ছুটির দিনগুলোতে কাঁধে বাক্সটা ঝুলিয়ে নিয়ে লোকটা আসতো আমাদের পাড়ায়। তখন ছুটির দিনের সকালটা হয়তো গড়াতে শুরু করেছে কেবল। অদ্ভুত একটা স্বরে বায়োস্কোপ দেখার আমন্ত্রণ। সেই প্রথম বায়োস্কোপ দেখা, সেই প্রথম কালো বাক্সের ভেতর চোখ রেখে দেখা ক্ষুদিরামের ফাঁসি। আহা সেই প্রথম মন কেমন করে ওঠা, ইতিহাসের ভেতর পা রাখা। প্রথমবার তাজমহল, লালকেল্লা, চারমিনার ভ্রমণ শেষে মাথাটা বাক্সের বাইরে খেলার মাঠে স্থির হলেও মনটা তখনো পরিব্রাজক। পরিব্রাজক হতে পারিনি, তবু সেই প্রথম দেখা বায়োস্কোপের বাক্সের ভেতর থেকে লোকটাকে না জানিয়ে চুরি করেছি এই পরিব্রাজক মন। তাই বিশেষত্বহীন সেই বায়োস্কোপ দেখানো লোকটাকে ভুলিনি কখনো।
মুখটা মনে নেই কি আছে — ঝাপসা! মনে আছে শুধু উদাসীন একঘেয়ে গলার সেই ‘আহা দেখো বাহার দেখো’র এক মিনিটের গান। চার আনায় কিনে নেয়া চার কোটি টাকার আনন্দ! আনা আধুলির হিসেব থেকে টাকায় পৌঁছাতে যে সময় লাগে, তার খানিকটা আগেই বন্ধ হয়ে গেছে বায়োস্কোপের বাক্স। লোকটা কোথা থেকে এসে কোথায় ফিরে যেত, জানা হয়নি। তবু লোকটা আর না এলেও জানলায় একজোড়া চোখ ছুটির দিনগুলোতে মরিয়া হয়ে বাক্সটার জন্য অপেক্ষা করে থাকতো।
একটা বাক্সের জন্য প্রতীক্ষার ভেতর ছেলেবেলার দৌড় কি আর থামে? বরং বড়োবেলার দিকে ছুটতে ছুটতে পেছনে ছেড়ে আসে অসংখ্য মুখ, যাদের বেশিরভাগ আর মনেই থাকে না। তবু কেউ কেউ থাকে, ঘুরে ফিরে আসে ছোটবেলার রঙমহল থেকে বড়োবেলার উঠোনে। মাঝে মাঝেই ফিরে আসে আমার দেখা প্রথম ভাস্করের মুখ। বাঁশের মাথায় একটা পাতলা পলিথিনে ঢেকে তার ওপর একটা কাপড়ের পাগড়ি মুড়ে নিয়ে আসতো, সাদা আর গোলাপির নানান শেডের রঙ মাখানো চকলেট ফেরি করতে। মায়ের বদৌলতে পেয়েছিলাম একজোড়া বড় চোখ, বিস্ময়ে সেটা আর চোখ না থেকে গলফ খেলার বল হয়ে যেত! লোকটা সুকুমার রায়ের সেই ফেরিওয়ালার মতোই জানতে চাইতো, ‘তোমার কী চাই?’ তারপর গল্পে গল্পেই কেমন গড়ে দিত ফুল, পাখি, মাছ অথবা বাহারি গয়না। অবাক হবার পালা শেষ হবার আগেই চকোলেটের ভাস্কর্য মুখের ভেতর মিলিয়ে যেত। আর লোকটা তার সামানা গুটিয়ে নিয়ে অন্যপথে ছুট।
কেবল আমরা জনাকয় আরো কিছুক্ষণ চকোলেট না মূর্তি , মূর্তি না চকোলেট করতে করতে দুপুর ডেকে আনতাম। বিস্ময়ে প্রাণ জেগে উঠতো কিনা জানি না, জানি শুধু আজও এদেশের চকোলেটের দোকানের সামনে দাঁড়ালে সেই লোকটা আমার শৈশবকে সঙ্গে করে পাশে এসে দাঁড়ায়। ছাঁচে ফেলা কুকুর, বেড়াল, খরগোশ, পাখি দেখতে দেখতে ভাবি — এ আর এমন কী! ছাঁচে ফেলে দিলেই অমনি সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ে শোকেসের বাক্সে আস্ফালন। বড়ো হবার বুদ্ধিতে বুঝি বিস্ময় সেই গলফের বলের মতো চোখে, যাকে কোনো এক নিপুণ খেলুড়ে গর্তে পুরে দিয়ে হাততালি কুড়োচ্ছে। বিস্ময় সেই সামান্যে অসীমকে পাওয়ার আনন্দে। বিস্ময় সেই কাঠামোর শেকলে আটকে পড়া শিল্পশিক্ষাকে পিঠ দেখিয়ে খেলার ছলে মূর্তি গড়া হাতদুটোয়। বড়ো হতে গিয়ে মনের গা থেকে ছাড়িয়ে নিতে হয়েছে বিস্ময়ের রঙিন জামা, তার পর একটা ফ্রি সাইজের ভেতর মন গলিয়ে নিয়ে ‘এই বেশ ভালো আছি’র সাজ। এই বেশ ভালো থাকার আয়োজনের ভেতর আরো আরো বড়ো হবার রিলে রেইস।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
সুমিমা ইয়াসমিন - ২২ নভেম্বর ২০১৪ (১:৩৩ অপরাহ্ণ)
পরিব্রাজক মনের পর্যটনময় লেখা!