দৃশ্যশিল্পের জগৎ যুগ যুগ ধরে বদলেছে, এ বদল ক্রমিক এবং ভবিষ্যৎ অনুগামী। ভাব, বিষয়বৈচিত্র্য, উপকরণ, উপস্থাপন ও প্রযুক্তির নানা যোজন-বিয়োজন এই পরিবর্তনের গতিকে কেবল ত্বরান্বিত করেছে তা নয়, এতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা, নতুন পরিভাষা। শিল্পের এই নতুন পরিভাষায় ভাবের বিনিময় ঘটছে শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে।
বছর আটেক আগে কুইন্সল্যান্ডে চমৎকার একটি মডার্ন আর্টের প্রদর্শনী দেখার সুযোগ হয়েছিলো। চিরকালীন শিল্পধারার সাথে সমসাময়িক আর আধুনিক ভাবনা ও উপস্থাপন রীতির ব্যবহার মুগ্ধ করেছিলো। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে শিল্পের নানা ক্ষেত্রে — এসব পড়ে বা শুনে থাকলেও চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। ফলে ভালো লাগার সাথে কৌতূহলও মিশে ছিলো।
সে এক্সিবিশন দেখতে গিয়ে দেখেছি বাবা-মায়েরা ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে নিয়ে এক্সিবিশন দেখতে এসেছেন। বাচ্চারা সব কিছুতে আগ্রহ পাচ্ছে তা নয়, কিন্তু যেটা ঘিরে তাদের আগ্রহ হচ্ছে সেখানেই সেটার সাথে যুক্ত হবার সুযোগ তৈরি করে রাখা হয়েছে। এতে করে শিল্পের সাথে পরিচয় এবং সংযোগ স্থাপন সহজ হয়েছে। শিল্পের বহুমাত্রিক ব্যবহার এই আগ্রহের অন্যতম কারণও বটে।
আমাদের মতো দেশে সাধারণ মানুষের শিল্পবোধ তৈরির প্রক্রিয়াকে এখন বহুদূর পথ পাড়ি দিতে হবে। এতে সাধারণ মানুষের দোষ বিশেষ নেই, কারণ এই শিল্পরুচি তৈরির প্রক্রিয়াটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কখনো আলো পায়নি। অথচ বাইরের নানা দেশে আর্ট ও ক্রাফট শিশুশিক্ষার প্রধানতম বাহন। ফলে পরিপূর্ণ বয়েসে পৌঁছে এরা প্রায় সকলেই শিল্পজগতের নানা কিছুর সাথে জুড়ে থাকাকে জীবন যাপনের অংশ হিসেবে দেখতে শেখে। এর ফলে শিল্পের বাজার যেমন তৈরি হয়েছে তেমনি শিল্পরসিক মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। এতে করে শিল্পকেন্দ্রিক নানা রকম পরীক্ষামূলক কাজ এখানে অনেক সহজে হচ্ছে।
অতি সম্প্রতি ‘ভ্যান গগ অ্যালাইভ ‘ নামে চমৎকার একটি ডিজিটাল প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে এসব ভাবনাও ঘুরেফিরে এসেছে। তিন হাজারের বেশি ছবির ব্যবহার ঘটিয়ে এই প্রদর্শনী কেবল চমৎকৃত করেছে তা নয়, বরং এটি যেন ভ্যান গগের জীবন ও সমকালে এই সময়ের দর্শকের পদচারণার এক অভূতপূর্ব আয়োজন। প্রদর্শনীতে ঢোকার মুখেই ভ্যান গগের হলুদ শয়নকক্ষ আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত, মূল প্রদর্শনীতে ঢুকতে হলে পেরিয়ে যেতে হবে দিগন্তবিস্তৃত সূর্যমুখীর খেত। প্রায় সত্তর ফুট মাপের বড় বড় পর্দায় ভেসে উঠছে ভ্যান গগের আঁকা বিখ্যাত সব শিল্পকর্ম। পায়ের নীচ থেকে মাথার উপরে, শরীর ছাপিয়ে মনের উপরে ছাপ ফেলে ছবি ভেসে উঠছে পর্দায়। ভ্যান গগের শিল্পসৃষ্টি ও জীবন অবিচ্ছেদ্য হলেও এই শিল্পীর জীবন তাঁর সৃষ্টির চেয়ে চমকপ্রদ। বহু দর্শক প্রথমে তাঁর জীবনে আকৃষ্ট হয়ে পরে শিল্পেও আগ্রহী হয়েছে। এই ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনের ভেতর দর্শক কেবল ছবি দেখছে তা নয়, বরং একটা সময় যাপন করছে, যেটি ভ্যান গগের সময়কে দর্শকের মনের মধ্যে তৈরি করে দিচ্ছে। শব্দ, সঙ্গীত আর আলোর বহুমাত্রিক ব্যবহারে এই উপস্থানে দর্শকের সামনে খুলে যাচ্ছে শিল্পীর মনোভূমি। দর্শক কখনো আইরিস ফুটতে দেখছে, কখনো যাপন করছে ক্যাফের ধারে ঘননীল আর বেগুনি আকাশের রাত্রি। নানা রকমের হলুদ ভ্যান গগের ভীষণ প্রিয় রঙ। তিনি বিশ্বাস করতেন হলুদ রং সম্ভাবনা, সুখ এবং উজ্জ্বল আগামীর প্রতীক। তাঁর হলুদ রঙের থাকার ঘর পল গগাঁর সাথে ভাগ করে নেবার আনন্দে এঁকেছিলেন অনেকগুলো সূর্যমুখীর ছবি। সেই সব ছবি যখন দর্শকের শরীর ছুঁয়ে মনে পৌঁছে যাচ্ছে তখন পর্দায় ভেসে উঠছে তাঁরই লেখার টুকরো — “The sunflower is mine in a way.”
জাপানি চিত্রকলা দ্বারা প্রভাবিত তাঁর কাজের মধ্যে চেরি-ব্লসমের ছবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুরের মূর্ছনা যেন অন্য একটা জগতের দুয়ার খুলে দিচ্ছে দর্শকের সামনে। ছবিগুলো কেবল স্থিরচিত্র নয়, এরা নড়েচড়ে আভাস দিচ্ছে গতিময়তার, চেরি ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ছে হাওয়ায়, আইরিস উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, পাখি উড়ে যাচ্ছে গমখেত ছুঁয়ে, ক্লান্ত সূর্যমুখী বিবর্ণ হয়ে ঢলে পড়ছে নতুন এই উপস্থাপনে।হলুদাভ নক্ষত্রের রাত্রি, হলুদ বাড়ি, কর্মরত মানুষ, লাল আঙুরের খেত, ঝলমলে ল্যান্ডস্কেপ, জাপানি চিত্রকলা প্রভাবিত ছবি, অজস্র রেখাচিত্রের ভেতর খুলে যাচ্ছে তাঁর ডায়েরির পাতা কিংবা চিঠির খাম। কোনো পর্দায় ভেসে উঠছে তাঁর মনের ছবি শব্দের রঙে — “I would rather die of passion than of boredom.”
তাঁর অসামান্য সব পোর্ট্রেট যখন পর্দা ছাপিয়ে দর্শকের মনের মধ্যে ফুটে উঠছে তখন বহুকাল পেরিয়ে ভেসে উঠছে তাঁর একান্ত ভাবনা — “I can’t live without love.”
সাঁইত্রিশ বছরের জীবনে নানা দুর্বিপাকে মানসিক রোগগ্রস্ত ভ্যান গগ কেবল ভালোবাসা ভিক্ষা করেছেন। জীবদ্দশায় যা মেলেনি তা-ই তিনি অজস্র পেলেন যখন তিনি নেই। স্বশিক্ষিত এই শিল্পী দশ বছরের শিল্পীজীবনে এঁকেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছবি। চোখধাঁধানো রং, এবড়োখেবড়ো ব্রাশস্ট্রোকে শিল্পের ভেতর দিয়ে মানুষের জন্যে ভালোবাসা ছড়িয়ে লিখেছেন — “I Put my heart and soul into my work and have lost my mind in the process.”
হলুদ গমখেতের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখি, একটা গুলির শব্দে শেষের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন ভ্যান গগ। পর্দায় ভেসে উঠছে তাঁর ম্লান মুখচ্ছবি। দর্শক বহুবর্ণিল শিল্পের জগৎ থেকে বিষাদের বাস্তবতায় পা রাখতে রাখতে বিষণ্ন হয়ে উঠছে। ভ্যান গগের আঁকা ছবি, তাঁর বেদনাক্লিষ্ট জীবনের সাথে এ যেন নতুন করে পরিচয়। বিস্ময় আর বিষণ্নতায় মাখামাখি হয়ে যে পথে বেড়িয়ে এসেছি সে পথে মাথার উপর নক্ষত্রের রাত আর টুনিবাতির সজ্জা মিলিয়ে দিয়ে স্টারি নাইটের আবহ তৈরি করা।
‘ভ্যান গগ অ্যালাইভ‘ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে লাইট, মিউজিক, সাউন্ডের অসাধারণ সমন্বয়ে তিরিশ মিনিটে ভ্যান গগের জীবন ও সময়কে যাপনের এক চমৎকার শিল্পিত আয়োজন। শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ প্রায় সবাই এই তিরিশ মিনিটে একটা অন্য জীবনের অভিজ্ঞতাকে যাপন করেছেন। শিল্পজগৎ বেশ অনেকদিন ধরে সীমারেখা মুছে দিয়ে অসীমের সাথে মিলতে শুরু করেছে। চিত্রকলা, ভাস্কর্য বা ছাপচিত্রের নির্ধারিত কাঠামোর বাইরে বেরিয়ে এসেছে সে আরো আগেই। সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ শিল্পের অংশ হিসেবে নতুন নয়। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার শিল্পের সাথে জুড়ে গিয়ে শিল্পবোদ্ধা, শিল্পরসিক এবং সাধারণের মধ্যে নবীন আগ্রহের সূত্রপাত ঘটিয়ে নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দিচ্ছে।
You must be logged in to post a comment.