শিক্ষক হিসেবে নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মো. আনোয়ার হোসেন যোগ দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের সর্বপ্রধান নির্বাহী হিসেবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ২০১২ সালে ভয়াবহ সংকটে পড়েছিল, প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল অতল খাদের কিনারে; তখন ওই ভয়ানক সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই উদ্যোগী হয়েছিল তাকে সেখানে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে। কিন্তু মনোনীত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ঝুঁকি সম্পর্কে নিশ্চয়ই আনোয়ার হোসেনের ধারণা ছিল। তাই অল্প সময়ের মধ্যেই তার উদ্যোগে উপাচার্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, যে-প্রক্রিয়ার সরাসরি বিরোধিতা করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অদ্ভূত ব্যাপার হলো, শিক্ষকরাও অনীহ ছিলেন নির্বাচিত উপাচার্যের ব্যাপারে। কিন্তু রিটের প্রেক্ষিতে রুলনিশি দিয়ে হাইকোর্ট এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হওয়ার পরও ভোট পাওয়ার দিক থেকে তিনি দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন, তারপর নিয়োগ পেয়েছিলেন উপাচার্য হিসেবে। কিন্তু খুব বেশি দিন দায়িত্বে থাকতে পারেননি- আমাদের কথিত শিক্ষিত শিক্ষকরা ১৯৭৩ সালের স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশের অপব্যবহার করে তার বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়েছেন। ২০১৩ সালেই তাকে ফিরে আসতে হয়েছে তার আগের কর্মস্থলে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
গেল ফাল্গুনে মো. আনোয়ার হোসেন ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : অবাঞ্ছিত একজন’ নামে যে-বই লিখেছেন, সে-বইয়ের উপজীব্য এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অর্জিত তার অভিজ্ঞান, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা। এই অর্জনের পরিপ্রেক্ষিত-ভাবনা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক অতীত, পারিবারিক আবহ, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামের বিভিন্ন ঘটনাপঞ্জী, ব্যক্তিগত অনুভূতি ইত্যাদি বিষয়গুলো এলেও বইয়ের নামই বলে দেয়, এ বই আসলে অন্তর্গত রক্তক্ষরণের দলিল, যে-দর্শন তিনি অর্জন করেছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াতে সেই দর্শনের ওপর আঘাত আসায় তার জ্বলে ওঠার দলিল।
২.
আমি জানি না, আর কারও কাছে এরকম মনে হয় কি না- তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার আনোয়ার হোসেনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই যোগদান ও প্রস্থানের প্রসঙ্গ উঠলেই মনে পড়ে স্পেনের পোর্ট সিটি বিলবাওয়ের মিগুয়েল ডি উনামুনোর কথা। ১৯৩৬ সালের শেষ দিনটিতে মৃত্যু ঘটেছে তার। চোখের সামনে আনোয়ার হোসেনের এই আসা-যাওয়ার ঘটনা না ঘটলে হয়তো আমার মনেও হতো না, এতদিন পরেও মিগুয়েল ডি উনামুনো প্রাসঙ্গিক কোনও কোনও পরিস্থিতিতে। মিগুয়েল ডি উনামুনো-ও, আপনারা জানেন, শিক্ষক ছিলেন। তা ছাড়াও ছিলেন প্রাবন্ধিক, কবি, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক। এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে যে তিনি ওই সময় স্পেনের বহুল আলোচিত জেনারেশন আটানব্বইয়ের সদস্য ছিলেন কি না। ১৮৯৮ সালে এ গ্রুপটি স্প্যানিশ-আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় গড়ে উঠেছিল, সৃজনশীল দার্শনিক ও লেখকেরা সমবেত হয়েছিলেন সে গ্রুপটিতে। লেখা ছাড়াও উনামুনো স্পেনের বুদ্ধিবৃত্তিক বৃত্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইউনিভার্সিটি অব সালামানকায় তিনি পর পর দুই পর্বে রেকটরের দায়িত্ব পালন করেন। একবার ১৯০০ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত, আরেকবার ১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত। স্পেনের সামরিক জান্তা মিগুয়েল প্রিমো দি রিভেরা ১৯২৪ সালে রেকটর পদ থেকে অপসারণ করেন মিগুয়েল উনামুনোকে। তারপর থেকে নির্বাসিত ও পলাতক জীবন যাপন করতে হয় তাকে দীর্ঘ কয়েক বছর। সামরিকজান্তা, অভিজাততন্ত্রের প্রতিনিধি ও প্রধানমন্ত্রী রিভেরার কথাই ছিলো এই, রাজনীতিকরা স্পেনকে ধ্বংস করে ফেলেছে। আর স্পেনকে সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করার জন্যে কি রাজনীতিক, কি মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ জনগণ- সব্বাইকে দৌড়ের ওপর রাখার ‘মহান দায়িত্ব’ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন সামরিক জান্তা রিভেরা। ১৯৩০ সালে এই সামরিক জান্তার পতন ঘটে, তখন উনামুনো ফের স্পেনে ফিরে আসেন এবং পুনরায় রেকটরশিপ শুরু করেন।
সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে উনামুনো পুনরায় রেকটর পদে যোগ দিয়ে তার প্রথম ভাষণ শুরু করেছিলেন এভাবে যে, ‘অ্যাজ উই অয়্যার সেইং ইয়েস্টারডে…’। চার শতাব্দী আগে স্পেনের স্বর্ণযুগের কবি ও অ্যাকাডেমিক ফ্রেই লুইস দি লিওনও একইভাবে না কি তার বক্তব্য শুরু করেছিলেন যেন তিনি মাঝখানের দিনগুলোতেও সেখানে ছিলেন। ১৫৫৭ সালে কবি ফ্রেই লুইস দি লিওন ভাইস রেকটর হন সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, কিন্তু ১৫৭১ সালে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। তারপর ১৫৭২ সালে কারাবন্দি হন তিনি, তারপর জেলের মধ্যে জীবন কাটান ১৫৭৬ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি। কারাগার থেকে বেরিয়ে সালামানকো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে ১৮৭৭ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বক্তব্য শুরু করেছিলেন এভাবে, ‘অ্যাজ উই অয়্যার সেইং ইয়েস্টারডে…’ যেন মাঝখানের দিনগুলোতে তিনি জেলে ছিলেন না- শিক্ষার্থীদের পাশেই ছিলেন, মধ্যে ছিলেন।
তো ইতিহাসের তো পুনরাবৃত্তি ঘটে। আনোয়ার হোসেন যেন স্পেনের ওই মহান দুই শিক্ষক ও ভাবুকেরই সহযাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে বিপ্লবে চলে যান তিনি, বন্দিজীবন কাটিয়ে এসে আবারও শুরু করেন একাগ্র একাডেমিক জীবন; শিক্ষকতা করতে করতেই সহযাত্রী হন আগস্ট বিদ্রোহের এবং সেনাপৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ক্ষমতাধর গোয়েন্দা সংস্থার নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর আবারও ফিরে আসেন পঠন ও গবেষণার ভুবনে; প্রতিকুল পরিস্থিতিতে সরকারের আহ্বানে চলে যান একটি সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা, মুক্ত চিন্তা ও গবেষণার উপযোগী একটি স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার দায়িত্ব নিয়ে, কিন্তু আবারও ফিরে আসেন আপন ভুবনে- এবং প্রতিবারই এত নিমগ্নতা নিয়ে একাডেমিক দায়িত্বে সম্পৃক্ত হন যেন আমরা শুনতে পাই সেই ঐতিহাসিক বাক্য : অ্যাজ উই অয়্যার সেইং ইয়েসটারডে…
৩.
বলেছি, ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অস্থিতিশীল দিনগুলোতে মো. আনোয়ার হোসেন অবাঞ্ছিত ছিলেন না। ২০১২ সালের মে মাসে কি বাংলাদেশ সরকার, কি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবদমান দু পক্ষ, সকলের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কাম্য ও বাঞ্ছিত। যে-চরম বিরোধিতাপূর্ণ ও অমীমাংসেয় এক পরিস্থিতিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবদমান পক্ষগুলো পৌঁছেছিল, সে-পরিস্থিতি উৎক্রমণের জন্যে আনোয়ার হোসেনই ছিলেন তাদের অবলম্বন। প্রাজ্ঞ এক সংগঠক হিসেবে তার সুনাম ছাত্র রাজনীতির কাল থেকেই ছিল, যে-সুনাম অব্যাহত রয়েছে শিক্ষক হওয়ার পরেও এবং লেখাই বাহুল্য, কৃতী একজন শিক্ষক হিসেবেও সুপরিচিত তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষক হওয়ার পেছনে, পরে রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ কারাজীবন কাটালেও সেখানকার শিক্ষক হিসেবে ফের যোগ দেয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন আইন, ১৯৭৩। কিন্তু ১৯৭৩-এর সেই স্বায়ত্তশাসন আইনকেই হাতিয়ারে পরিণত করে তাকে অবাঞ্ছিত করে তোলা হয় উপাচার্য হিসেবে। কেন এই পরিণতি তার? আনোয়ার হোসেন নিজে অবশ্য ভেবেছেন, যেমন তার বইতে পাই, ‘…হয়তো এ কারণে যে আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষক ছিলাম না।’ (পৃষ্ঠা ২২)। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই অনুভব করা যায়, ‘সর্ষের ভূত’ বোধকরি অন্যখানে। কারণ, তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে শুধু তখনকার অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্য নয়- আরও একটি রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে বলে মনে হয়। তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নির্বাচন হয়নি। মনোনীত উপাচার্যের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে অনেকের ‘ভালো ধারণা’ থাকলেও অনির্বাচিত হওয়ার কারণে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যতই বছর গড়াচ্ছিল, ততই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছিল। কিন্তু উপাচার্য নির্বাচন করতে গেলে উপাচার্য পদের তিনজনের প্যানেলে যে মো. আনোয়ার হোসেনও যুক্ত হবেন, তাতে কারও সংশয় ছিল না। একজন মুক্তিযোদ্ধা-গবেষক-শিক্ষক হিসেবে তিনি দৃষ্টান্তস্থানীয় হয়ে উঠেছিলেন; বিশেষ করে আগস্ট বিদ্রোহের সময়ের সাহসী ভূমিকার কারণে সামরিকপৃষ্ঠপোষকতাপূর্ণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। তবে তার নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেলভুক্ত হলে আওয়ামী লীগ ঘরানার শিক্ষকরা যে তাদের সংকীর্ণ শিক্ষক রাজনীতির অর্থে লাভবান হবেন না, তা নিয়ে কোনও সংশয় ও সন্দেহ ছিল না। যদিও সাধারণভাবে তাঁকেও ওই ঘরানার একজন শিক্ষক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে সম্পূর্ণভাবে সরকারদলীয় বলয়ে রাখার স্বার্থে মো. আনোয়ার হোসেনকে উপাচার্য নির্বাচনপ্রক্রিয়ার বাইরে রাখা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তাদের হাতে সে-সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। তারা জানতেন, মো. আনোয়ার হোসেন চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন এবং তাই হয়েছে- উপাচার্য হিসেবে যোগ দিয়ে আনোয়ার হোসেন সে-চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মো. আনোয়ার হোসেন তাড়াতাড়িই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি শিক্ষক-ছাত্রদের গবেষণার উপযোগী আবহ তৈরি করতে চেয়েছেন, উদ্যান ও জীববৈচিত্র্যের তত্ত্ব মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ-প্রতিবেশের বিকাশ চেয়েছেন কিংবা প্রাকৃতিক জলাধারগুলোকে দুর্নীতি-অনিয়মমুক্তভাবে সংস্কার করতে চেয়েছেন, এরকম ঘটনাগুলো তো আছেই- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল, যে-মতলববাজ শিক্ষকরা তার হাত দিয়ে মোয়া খাওয়ার কিংবা কল্কে টানার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই উপাচার্য নির্বাচনের আয়োজন করে তিনি গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক শর্তটিও পূরণ করে ফেলেন। মতলববাজ শিক্ষকরা অনুভব করতে পারেন, আনোয়ার হোসেন তাদের জন্যে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। হয়তো তাদের ধারণা ছিল, রাষ্ট্রপতি যে-ভাবে উপাচার্যকে নির্ধারিত সময়ের জন্যে মনোনীত করেছেন, কোনও ‘ঝামেলায়’ না গিয়ে ওই মনোনয়নভিত্তিক নিয়োগপন্থাতেই আনোয়ার হোসেন খুশি থাকবেন এবং অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেছে, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে এভাবে নিয়োগ পেয়ে সরকারি মহলকে খুশি করে নির্বাচিত উপাচার্য না হয়েই তারা বছরের পর বছর আনন্দিত থেকেছেন, তিনিও সেভাবে আনন্দিত থাকার চেষ্টা করবেন এবং মনোনীত থাকার জন্যে তিনি বিভিন্নজনকে তুষ্ঠ করে চলবেন। কার্যত দেখা গেল, নির্ধারিত মেয়াদের জন্যে নিয়োগ পেলেও নতুন উপাচার্য আনোয়ার হোসেন ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া বৈধতার বদলে গণতান্ত্রিক উপায়ে উপাচার্য নির্বাচনের পথে এগিয়ে গেলেন। সিনেটের মাধ্যমে নির্বাচিত তিনজনের প্যানেলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রাথী হিসেবে মাত্র দু মাসের মধ্যেই আনোয়ার হোসেন চার বছরের জন্যে দায়িত্ব নিলেন নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ও মনোনীত একজন উপাচার্যের মেরুদণ্ড সঙ্গতকারণেই ঋজু হয়ে থাকে। কারণ তিনি জানেন, তার বৈধতা এসেছে প্রথমত সরাসরি নির্বাচকদের কাছ থেকে, দ্বিতীয়ত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার কাঠামো থেকেও। তার মনোনয়ন দাঁড়িয়ে আছে নির্বাচকদের তৈরি করা বুনিয়াদের ওপরে- যে-কারণে তার বৈধতা আসলে বিশেষ কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার ফসল নয়, বিশেষ কোনও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। কোনও গোষ্ঠীর ইচ্ছাপূরণের ক্রীড়নক না হয়েই তিনি টিকে থাকতে পারেন। তিনি জানেন, তার জবাবদিহিতা কোনও দল বা সংগঠনের কাছে নয়, প্রশাসনতন্ত্রের কাছে নয়- বরং ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে। সঙ্গতকারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ক্ষমতাকে কুক্ষীগত করে রাখতে অভ্যস্ত আমলা-প্রশাসনকেন্দ্রিক শিক্ষক ও প্রশাসকচক্র, বিভিন্ন ক্ষুদ্র কোটারি স্বার্থপুষ্ট গোষ্ঠী , বিভিন্ন দল বা সংগঠন ও আমলাতন্ত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত উপাচার্যকে দেখে তাই খুশি হতে পারেনি। ষড়যন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছে তারা এবং তাদের চক্রান্ত শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে, একজন নির্বাচিত উপাচার্যকে সরিয়ে দিয়েছেন তারা এবং লেখার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বা নীতিনির্ধারকদের অনেকেও এই চক্রান্তে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভূমিকা রেখেছেন। যে-কারণে ‘উপাচার্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়ে নতুন নির্বাচন সম্পন্ন করার সময় পর্যন্তও আনোয়ার হোসেনকে থাকতে দেয়া হয়নি; শিক্ষার্থীদের ছাত্রসংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠান করার সুযোগ দেয়া হয়নি। জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাজনীতিকে নতুন করে পথ দেখাতে পারতো- কিন্তু নষ্ট শিক্ষক রাজনীতির অতলে তলিয়ে গেছে সে-প্রক্রিয়াও।
৩.
তা হলে বলব কি ‘অবাঞ্ছিত একজন’ কি একজন উপাচার্যের শেষ পর্যন্ত হার মেনে ফিরে আসার দিনলিপি? চক্রান্তের জালে তার নিষ্প্রভ ও হতাশ হয়ে পড়ার কথকতা? না, মোটেও সেরকম নয়। প্রচ- দুঃখবোধ থেকে মো. আনোয়ার হোসেন এ বইয়ের নাম ‘অবাঞ্ছিত একজন’ রেখেছেন, কিন্তু এ আসলে একজন সংশপ্তকের কথা। কিংবা এ-ও বলা যায়, একজন অভিমন্যুর কথা। সংশপ্তক ও অভিমন্যুরা জানে, পরাজয় তাদের নিশ্চিত, চক্রব্যুহে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে তারা, কিন্তু তারপরও আমৃত্যু লড়াই করে চলে কেননা এ-ও তারা জানে ন্যায়ের জন্যেই তারা সংগ্রাম করছে, এ মৃত্যু তাই গৌরবের, মরণের পরও অমরত্ব অর্জনের। আমরা তাই এ বইয়ের অর্ধেকেরও বেশি পৃষ্ঠা জুড়ে দেখি সৃষ্টির মহাযজ্ঞ- মূলত সংগ্রামশীলতা আর সৃজনশীলতাই সে মহাযজ্ঞের মূল পর্ব। ক্ষুদ্র স্বার্থে একদল শিক্ষক একজন উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, দলবাজিতে মত্ত আরও কিছু শিক্ষক তাদের ইন্ধন যুগিয়ে চলেছেন, অপপ্রচার চালানো হচ্ছে- এসবই সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়; সত্য আরও আছে, সেই সত্যের উদ্বোধনই ঘটতে দেখা যায় কিংবদন্তীর যুগীর পুকুর পুনরায় দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে, সাতটি প্রকল্পের শিলালিপি সাক্ষী সে সত্যের উদ্বোধনের। সেই সত্যের উদ্বোধনই ঘটতে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেশ সাপেরও অভয়ারণ্য হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে। বন্যপ্রাণী সুরক্ষার অভয়ারণ্যে গবেষণাঘরে নির্ভয়েই ঘুমান প্রাণীবিদ্যা বিভাগের এমফিল গবেষক সুলতান আহমেদ। দূর গ্রামের হাকিম আলী গায়েনও অনায়াসে নিজের ঠাঁই করে নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে। পদ্মপুকুর হয়ে ওঠে প্রশান্তির আধার, সৃজনশীলতার আধার। একজন কাজলের আখ্যান হয়ে ওঠে প্রতিটি মানুষের প্রত্যাশার আখ্যান। নিয়ত সংগ্রাম চলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। যারা অসহযোগিতা করেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুষ্ট ক্ষত হয়ে উঠেছে, আনোয়ার হোসেন তাদের নাম নিতে পারতেন; কিন্তু তার আত্মকথনের ধারা থেকেই বোঝা যায়, কোনও ব্যক্তির নন, বরং তিনি সমালোচনা বা বিরোধিতা করেছেন ব্যবস্থার ও প্রক্রিয়ার। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে রক্ষা করতে হলে কোন পথে এগুতে হবে, কোন পথে রোধ করতে হবে ১৯৭৩ সালের স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশের অপব্যবহার- এগুলি তার কাছে অনেক-অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখেছেন, শিক্ষকেরাই কার্যকর স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে অনীহ; উপাচার্য নির্বাচন বা মনোনয়ন, বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে শিক্ষকদের নিয়োগ, শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি সংগ্রহ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজের জন্যে অর্থ বরাদ্দ ও অর্থ ছাড়, উচ্চশিক্ষার প্রসারে পদসৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়গুলোর অন্যতম নিয়ামক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে শিক্ষকদের সংযোগে যে-চক্র গড়ে উঠেছে, তা তাই স্বায়ত্তশাসনকে সোনার পাথরবাটি করে তুলেছে। কী তার দৃষ্টিভঙ্গি, কীই-বা তার প্রতিবন্ধকতা তা উপলব্ধি করতে বোধকরি এই সামান্য উদ্ধৃতিটুকুই যথেষ্ট :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সময় জাতিকে পথ দেখিয়েছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কিন্তু পরিতাপের কথা ছাত্র সংসদ বা উপাচার্য নির্বাচন বিষয়ে সকল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উপাচার্য কোন উদ্যোগ নেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা আমলাতন্ত্র তাতে অখুশি হয়নি। এমন বাধ্য উপাচার্যগণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় থাকুন, এমনটাই তারা চেয়েছে। মন্ত্রী এবং সরকার প্রধানকে পরামর্শও দিয়েছে।
এমন অবস্থার পরিবর্তন আমি আনতে চেয়েছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদিও সরকারের শেষ বছরে সময় আমার অনুকূলে ছিল না তারপরও আপন অঙ্গীকার থেকে পিছু হটিনি। … শিক্ষামন্ত্রী এবং তার সচিব এসব পদক্ষেপ ভালো চোখে দেখেননি। বাধা এসেছে ভেতর থেকেও। খোদ শিক্ষকেরা বাধা দিয়েছেন। সেসব প্রবল বাধা অতিক্রম করে সিনেটে উপাচার্য নির্বাচন সম্ভব হয়েছে। (পৃষ্ঠা ১১৪-১১৫)
এমন অবস্থার জালে উপাচার্য নির্বাচন সম্ভব হলেও সিনেট কিংবা জাকসু নির্বাচন সম্ভব হয়নি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষা আন্দোলনে ও শিক্ষাগবেষণার নতুন ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠার যে-সম্ভাবনা ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে, আনোয়ার হোসেনকে বিদায় জানানোর মধ্যে দিয়ে সে-সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করেছেন সেখানকার শিক্ষকরাই।
আমরা সকলেই চেয়েছি, শিক্ষা ও সৃজনশীলতার, গবেষণা ও মননশীলতার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠুক, মুক্ত দর্শনের ও বিজ্ঞানমনস্কতার মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের মানুষদের পথ দেখাক- ‘অবাঞ্ছিত একজন’ আমাদের জানাচ্ছেন সেই চাওয়াকে পাওয়ার ফাটলগুলো কোথায়। পদত্যাগের পর তিনি ফিরে গেছেন তার নিজস্ব গন্তব্যে, আবারও শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে শুরু করেছেন শ্রেণিকক্ষের ভাষ্য, ‘ অ্যাজ উই অয়্যার সেইং ইয়েস্টারডে…’; কিন্তু এমন একটি জীবন্ত বই হাতের কাছে থাকার পরও আমরা কি পারব বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জেগে উঠতে?