...শাহবাগের এই আন্দোলন উৎস থেকে এখনও প্রতিষ্ঠানবিরোধী। এই আন্দোলন সরকারি ভূমিকার বিরোধিতাজাত, বিরোধী দলগুলোর ব্যর্থতারও বিরোধিতাজাত। কি সরকার, কি বিরোধী দল উভয়েই চেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সীমিত করতে, সংকুচিত করতে কিংবা ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে। কিন্তু তারুণ্যের উত্থান তাদের ওই উদ্দেশ্যকে নসাৎ করে দিয়েছে। এই তারুণ্যকে ধারণ করার শক্তি যাদের নেই, তারা এখন নিজেদের ধারণশক্তির ব্যর্থতা ঢাকতে আওয়ামী সরকারের অপশাসনের ভূত দেখিয়ে তরুণদের থমকিয়ে দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে, নিজেদের গতিহীনতাকে যৌক্তিক প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

…নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস
শান্তির ললিতবাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-
যাবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই
দানবের সঙ্গে সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে যারা আজ ঘরে ঘরে

সত্যি কথা বলতে গেলে, শান্তির ললিতবাণী এখন ব্যর্থ পরিহাসই বটে। গত চার মাসেরও বেশি সময় ধরে জামায়াত-শিবির চক্রের অব্যাহত সশস্ত্র সন্ত্রাসের মূল লক্ষ্যবস্তু পুলিশ; আর ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর সেই সশস্ত্র আক্রমণের লক্ষ্য কেবল রাষ্ট্র, সরকার কিংবা পুলিশ নয়- সাধারণ জনগণও। সুপরিকল্পিতভাবে দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় তারা সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে, রেলপথ উপড়ে ফেলছে, আগুন দিচ্ছে যাত্রীবাহী ট্রেন ও বাসে, হামলা চালাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে- মানুষ বাঁচবে না মরবে, তাতে কিছুই আসে যায় না তাদের। তারপরও, স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে যাওয়া জামায়াতে ইসলামীর উন্মুক্ত মুখপাত্র বিএনপির নেতাদের কাছে শাহবাগের তরুণরা যত ‘বখাটে’ই হোক না কেন, শাহবাগের আন্দোলন পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আছে। প্রজন্ম চত্বরে গত এক মাসে আনুমানিক একশ’ জনেরও বেশি জামাত-শিবির চক্রের গুপ্তচর ধরা পড়েছে- কিন্তু তাদের গায়ে সামান্য আঁচড়ও পড়েনি।
জামায়াতে ইসলামী তাদের কথিত ‘গৃহযুদ্ধে’র প্রস্তুতি তো আজ থেকে নিচ্ছে না। ২০১০ সালেই এরকম ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন একটি বিদেশি পত্রিকাতে যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান। কথিত সেই ‘গৃহযুদ্ধের’ জন্যে এখন মরিয়া তারা। গত কয়েকদিন ধরে হত্যা কিংবা মানুষমৃত্যুর যেসব ঘটনা ঘটেছে, যত রক্তপাত ঘটেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন- কিন্তু তাই বলে আমরা আমাদের চোখে এত বড় ঠুলি পরিনি যে তাকে আমরা ‘গণহত্যা’র সঙ্গে গুলিয়ে ফেলব, কিংবা এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে সম্মিলিত জাতীয় সংলাপ, জরুরি অবস্থা কিংবা জাতিসংঘের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠব। বাংলাদেশের পুলিশ অনেক আগে থেকেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দুষ্ট, বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক ও সামরিক সরকারের সময়ে তো বটেই, বিভিন্ন নির্বাচিত সরকারের শাসনামলেও তারা বার বার সমালোচিত হয়েছে তাদের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্যে, পুলিশি হেফাজতে সাধারণ কয়েদির মৃত্যুর জন্যে, বন্দি নিপীড়নের জন্যে, রাজনৈতিক কর্মী দলনের জন্যে, নারী ধর্ষণের জন্যে। কিন্তু তাই বলে, এমনকি সামরিক শাসনামলেও গণতন্ত্রের জন্যে আন্দোলনকারীদেরও প্রয়োজন হয়নি তাদের সশস্ত্র আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা- যা গত কয়েক মাস ধরে জামায়াত-শিবির করে আসছে। ট্রেনে-বাসে কারা চড়েন? সাধারণ মানুষ। জামায়াত-শিবির সেসব যাত্রীবাহী পরিবহনে আগুন দিচ্ছে। তারা রেলপথ উপড়ে ফেলছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলা চালাচ্ছে, মোটেল তৈরি হলে ‘বেলেল্লাপণা’ হওয়ার অলীক কল্পনায় মানুষকে ভবনের ওপর থেকে ফেলে দিয়ে মারছে আর চাঁদের বুকে সাঈদীকে দেখতে পারার গল্প শোনাচ্ছে।
রাজনৈতিক সমীকরণ এখানে অনেক সরল- কেননা এতসব জঘন্য ঘটনাসংঘটনকারী জামায়াত-শিবিরের দায়ভাগকে পাশ কাটিয়ে খালেদা জিয়া এবং তার দল বিএনপি উল্টো আন্দোলনকারীদের দুষছে। বিএনপি এখন জামায়াতে ইসলামীর স্বঘোষিত প্রতিনিধি- তারা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে, শাহবাগের তরুণরা নাকি ট্রাইব্যুনালের ওপর চাপের সৃষ্টি করেছে, বিচারকে প্রভাবিত করছে এবং সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজে নেমেছে!
শাহবাগ আন্দোলন অনেক বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীর মুখোশও খুলে দিচ্ছে। যেসব বুদ্ধিজীবী অতি চালাক, তারা অবশ্য লিখিতভাবে মন্তব্য করছেন না, সমালোচনা করছেন ঘরোয়া আড্ডাতে এবং তাও সেই বিএনপিমার্কা ‘আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, কিন্তু…’ পদ্ধতিতে। ‘আমরাও শাহবাগের আন্দোলনকে সমর্থনকে সমর্থন করি, তবে…’ গোত্রীয় এই কুতার্কিকদের একটি বড় প্রশ্ন ও আপত্তি হলো, তারুণ্যের জাগরণ তো সব সময় সরকারবিরোধী হয়ে থাকে, অথচ সরকারের সঙ্গে তাদের বিন্দুমাত্র সংঘাত হচ্ছে না, সরকার বরং তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে- এ আন্দোলনের ফায়দা তো তা হলে সরকারেরই ঘরে চলে যাবে, এ জাগরণ তো তা হলে রাষ্ট্র ও সরকারের বিশেষ স্বার্থই পূরণ করছে… ইত্যাদি ইত্যাদি সূচ তাদের খুঁচিয়ে বেড়াচ্ছে। ছাত্রজীবনে বিপ্লব করার স্বপ্ন দেখতেন কিন্তু এখন শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী কিংবা টকশোর আলোচক বনে গেছেন এমন অনেকে এখন তাদের ছাত্র জীবনের আন্দোলনের সঙ্গে কিংবা চলমান গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে আর শাহবাগের উত্থানকে মেলাতে পারছেন না বলে আশঙ্কা করছেন, এ আন্দোলনের দাবিদাওয়াগুলির সূত্রে রাষ্ট্র সহিংসতা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। তারা তাই চেষ্টা করছেন শাহবাগের আন্দোলনকে পোষ মানাতে।
অথচ শাহবাগের এই আন্দোলন উৎস থেকে এখনও প্রতিষ্ঠানবিরোধী। এই আন্দোলন সরকারি ভূমিকার বিরোধিতাজাত, বিরোধী দলগুলোর ব্যর্থতারও বিরোধিতাজাত। কি সরকার, কি বিরোধী দল উভয়েই চেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সীমিত করতে, সংকুচিত করতে কিংবা ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে। কিন্তু তারুণ্যের উত্থান তাদের ওই উদ্দেশ্যকে নসাৎ করে দিয়েছে। এই তারুণ্যকে ধারণ করার শক্তি যাদের নেই, তারা এখন নিজেদের ধারণশক্তির ব্যর্থতা ঢাকতে আওয়ামী সরকারের অপশাসনের ভূত দেখিয়ে তরুণদের থমকিয়ে দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে, নিজেদের গতিহীনতাকে যৌক্তিক প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
আন্দোলন এক বিশাল পরিভ্রমণ। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরবে কি না, এই অনিশ্চিতি ও অনির্দিষ্টতা থাকার পরও মা সন্তানকে যুদ্ধে পাঠায় কেননা সেটিই মানবিক, সেটিই প্রাকৃতিক। যাত্রা পথে এই তরুণদের স্বপ্ন হাতছাড়া হতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাদের পথ আমরা আগলে দাঁড়াতে চাই কোন সে ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থে, কোন সে কুসংস্কারে?
শাহবাগ তরুণরা আমাদের রক্তে আবার একাত্তরকে ফিরিয়ে এনেছে, একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছে- এখন এই আকাঙ্ক্ষাকে যদি আমরা ধরে রাখতে না পারি, এগিয়ে নিতে না পারি তার দায় আমরা কেন চাপাতে চাইছি শাহবাগের তরুণদের কাঁধে?

২২ ফাল্গুন ১৪১৯/ ০৬ মার্চ ২০১৩
(চর্যাপদ গণজাগরণ সংখ্যা, ৭ মার্চ ২০১৩-তে প্রকাশিত)

ইমতিয়ার শামীম

আপনারে এই জানা আমার ফুরাবে না...

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.